একজন জুলি এবং কিছু কঠিন বাস্তবতা...

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৮/০৪/২০১৩ - ৯:৩৩পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজকে আমার একজন জার্মান বান্ধবী জুলি, যে স্থানীয় রাজনীতির অত্যন্ত প্রভাবশালী সদস্য হঠাৎ করেই সাভার ভবনধ্বস সম্পর্কে জানতে চাইল এবং কোন কোন জার্মান কোম্পানি এই কারখানা থেকে পোশাক কিনেছে তার একটা লিস্ট দেখালো। তারা ওই কোম্পানিগুলোর কাছে জানতে চেয়েছে, যে কারখানার মালিক তাদের শ্রমিক এবং ফ্যাক্টরির প্রতি এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন, তাদের কাছ থেকে কেন পোশাক কেনা হয় এবং অনুরোধ করেছে এমন মালিকের কাছ থেকে আর যেন পোশাক না কেনা হয়। তারা সিএন্ডএ, কারস্টাড, ম্যাক্স বায়িং, এস্পিরিট এইসব কোম্পানিকেও একই অনুরোধ করে চিঠি দিয়েছে এবং কিছু কোম্পানি জানিয়েছে তাদের সাথে রানা প্লাজার গার্মেন্টসের কোন সম্পর্ক নেই। আমি বান্ধবীর কথা শুনে রীতিমত আঁতকে উঠলাম। কারন আমি জানি জার্মানির আইন সম্পর্কে, কেও যদি একটা মামলা ঠুকে দেই এই শ্রমিক ঠকানো নিয়ে তাহলেই হইছে, পুরাই লেজে গোবরে হয়ে যাবে ব্যাপারটা এবং আরও বহুদুর গড়াবে এই পোশাক কেনা না কেনার ব্যাপার, একটা স্টেটে কোন নতুন আইন হলে সারা দেশে হতে সময় লাগেনা এখানে।

একজন অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে এবং দেশে এক্সপোর্ট অফিসার হিসেবে কাজ করার সুবাদে আমি জানি জার্মানি এবং ইউরোপিয়ান দেশগুলোতে প্রতি বছর কত বিলিয়ন ইউরোর পোশাক আমরা রপ্তানি করি। তাই আতঙ্কিত হয়ে দীর্ঘ সময় তাকে অনেক কিছু বুঝালাম, সে অনেকটা সময় পরে বলল তারা কখনই এতো কম দামে পোশাক কিনতে চাইনা কারণ তারাও এখন জানতে পারছে এই পোশাক তৈরি করতে কতটা কষ্ট সহ্য করতে হই পোশাককর্মীদের। আমি যখন পোশাকপ্রতি দাম কয়েক সেন্ট বেশি হওয়া উচিৎ বললাম, সেও ব্যাপারটা মেনে নিলো, বলল তারাও ইকনমিস্টের কাছ থেকে জানতে পেরেছে পোশাক প্রতি ২০-৩০ সেন্ট করে বেশি দিলেই নাকি কর্মীদের প্রত্যাশার অনেকটাই পূরণ হবে এবং তারা সবাই এটা দিতে রাজিও আছে। সে আমাকে স্থানীয় টেলিভিশনে এই বিষয়ে কথা বলতে ইচ্ছুক কিনা জানতে চাইল কারণ আমি যেহেতু এই বিষয়ে পড়াশুনা করছি এবং বাংলাদেশ থেকে এসেছি তাই ব্যাপারটা ভাল বলতে পারব এবং তারাও একটা ভাল ধারনা পাবে।

জুলির বিশ্বাস, জার্মানদের আশ্বস্ত করতে না পারলে কোন একদিন তারা হয়ত বাংলাদেশি পোশাক কেনা ছেড়েই দিবে কারন এই ভবন ধ্বসে পড়া এবং পোশাক কর্মীদের প্রতি আচরণ তাদেরকে অপরাধী করে তুলেছে যেহেতু তারা বাংলাদেশের তৈরি অনেক পোশাকই পরিধান করে। আর এই কথাটাই আমার কাছে বেশি ভয়ের লাগলো, কারন এই কয়েক মাস জার্মানি থেকে আমি বুঝতে পেরেছি তারা কতটা আবেগপ্রবণ এবং তাদের ইগো কতটা প্রবল। যদি তারা সবাই প্রতিবাদ করা শুরু করে এবং বাংলাদেশি পোশাক কেনা বন্ধ করে দেয় তাইলেই হইছে আমাদের, সাথে সাথে ইইউ এর অন্য দেশগুলোও তাদের সাথে সুর মেলাবে কারণ জার্মানি এতটাই প্রভাবশালী এখন। আমি জুলিকে আর বলতে পারলাম না, এই ২০-৩০ সেন্টের কতটুকু মালিক পাবে, কতটুকু তাদের লবিস্ট পাবে আর কর্মীদের কাছে কতটুকু পৌঁছাবে। আমি তাকে বুঝালাম পোশাক আমদানি বন্ধ করা কোন সমাধান না, আমাদের কিছু মালিক আর ফ্যাক্টরি হয়ত ঠিকমত সবকিছু মেনে চলেনা, কিন্তু অধিকাংশ মালিকই সবকিছু মেনে চলে, এই নিদারুন মিথ্যা কথাটা বলতে হল আমাকে। জানিনা অতি মুনাফালোভী, অশিক্ষিত, চরম কর্মীশোষণকারী কিছু মালিকের জন্য আমাদের পোশাকখাত কত বড় বাধার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে, আমেরিকাতে জিএসপি সুবিধা হারাতে বসেছি আমরা, এখন না ইউরোপিয়ানরাও আমাদের পোশাক কেনা ছেড়ে দেয়।

দেশে ছাত্র থাকাকালীন এবং চাকরিরত অবস্থায় অনেক গার্মেন্টস মালিককে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়েছে। বেশির ভাগকে আমার প্রবলভাবে ঘৃণা করতে ইচ্ছা হয়েছে তাদের কর্মকাণ্ডের জন্য। যদিও আমি জানি এই ইন্ডাস্ট্রি থেকে আমাদের ভ্যালু এডিসন কত কম হয়, তারপরেও জুলিকে সবকিছু বলতে পারি নাই এই ইন্ডাস্ট্রিতে কর্মরত লক্ষ লক্ষ কর্মীর কথা ভেবে। সমস্যা হচ্ছে দামি মডেলের অডি, বিএমডব্লিও বা জাগুয়ারে করে চোখে কালো চশমা পড়ে ঘুরে বেড়ানো আমাদের গার্মেন্টস মালিকেরা বুঝবেন না এইসব ব্যাপারগুলো কত বড় বিপর্যয় ডেকে আনতে যাচ্ছে আমাদের পোশাক খাঁতে, তারা মত্ত আছেন কি করে কর্মীদের ঠকিয়ে, কারখানাগুলোকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে জাগুয়ার বাদ দিয়ে নতুন মডেলের লিঙ্কন ন্যাভিগেটর কেনা যায়। আমি জানিনা আমি, আপনি কতদিন এই জুলিদের মিথ্যা বলে যাব। মিথ্যা বলার ভয়ে সাভার ধ্বসের কথাটা আমি নিজে ওর কাছে তুলি নাই বরং সে নিজেই আমার কাছ থেকে জানতে চেয়েছে, কারণ সামনে তাদের মেয়র ইলেকশন এবং এই ব্যাপারটা সেখানে উঠে এসেছে। সে আমার কাছ থেকে সময় চেয়েছে এই ব্যাপারে আরও ভালভাবে জানার জন্য এবং আমিও তার সাথে আবার দেখা করার কথা বলে বিদায় নিয়েছি। আমি জানি আবার আমাকে অনেক মিথ্যা বলতে হবে এই লাখো শ্রমিকের কথা ভেবে, অনেক মিথ্যা যুক্তি দেখাতে হবে যাতে কোনভাবেই তারা বাংলাদেশি পোশাক কেনা বন্ধ করার কথা না ভাবে, আমদানি বন্ধ করার কথা না ভাবে। হয়ত জুলিরা পোশাক প্রতি ২০-৩০ সেন্ট করে বেশি দেয়া শুরু করবে কোন একদিন, কিন্তু কতটুকু উন্নতি হবে এই ইন্ডাস্ট্রিতে দিনরাত অমানুষিক পরিশ্রম করা এই লাখো শ্রমিকের, তারা কিভাবে আশ্বস্ত হবে আর একটা রানা প্লাজা তাদের উপর ভেঙ্গে পড়বে না? এই প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই, তারপরও আমাকে আপনাকে এই জুলিদের মোকাবেলা করে যেতে হবে প্রতিদিন, পৃথিবীর সবখানে, শুধুমাত্র আমার দেশের কথা ভেবে।

জামান, (এফ কে জেড)
জার্মানি।

(ব্লগে এটাই আমার প্রথম লেখা এবং অনেকটাই এলোমেলো, তাই কিছু ভুল হলে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন আশা করি।)


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

এই মিডিয়ার যুগে আপনি মিথ্যা বলে কতটুকুই বা থামাতে পারবেন???

সুবোধ অবোধ

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি জানি যে এদেরকে মিথ্যা বলে ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব না, এরা সবকিছুর খবর রাখে, কিন্তু তারপরও কিছু খারাপ বিষয় যখন ওরা ভালো আর সত্য বলে বিশ্বাস করে আমি আর ভুল ভাঙ্গায় না, কারণ ব্যাপারগুলো একেবারেই আপেক্ষিক, হয়ত কোন একদিন ঠিকই জেনে যাবে!!

Gautam Mutsuddy এর ছবি

বাংলাদেশের গার্মেন্ট ইন্ডাষ্ট্রী নিওনেটাল কেয়ারিং এর পর্যায় পেরিয়ে এসেছে বেশ আগেই। এখন দেশে একটা RMG – খাত সংক্রান্ত সমন্বিত নীতি প্রনয়ণ জরুরী হয়ে পড়েছে। শহরের যত্র তত্র স্থাপিত কারখানাগুলোকে কয়েকটি নির্দিষ্ট এলাকায় (ইপিজেড টাইপের) সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন। এটি সরকারী উদ্দ্যোগে হওয়াটা বাঞ্ছনীয় যেখানে অবকাঠামোগুলো তৈরী করে স্থানান্তরের জন্য তালিকাভুক্ত কারখানাগুলোর কাছে বিক্রি/ভাড়া দেয়া হবে। সরকারী ইনভল্ভমেন্ট এজন্যই জরুরী যাতে সেখানে অবকাঠামো নির্মানগত কোন ভ্যরিয়েশন না থাকে এবং কিছু কমন ফ্যসিলিটির ব্যবস্থা করা যায় (আবাসন, চিকিতসা, শিক্ষা এবং ডে-কেয়ার)। এতে কর্মসংস্থান এবং কমপ্লায়েন্সের গুনগত মান অনেক ভালো হবে। একসাথে এত জমি পাওয়াটা দুরূহ হলেও বাংলাদেশ রেলওয়ের বেদখলকৃত এবং অব্যবহৃত জমিগুলো বিবেচনায় নিলে দেশে চমৎকার একটি শিল্প পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে। নির্বাচন যেহেতু কাছেই, জনমত ও চাপ তৈরী করতে পারলে রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী মেনিফেষ্টোতে RMG- নীতির খসড়া একটি আবশ্যিক বিষয় হতে পারে।

Emran এর ছবি

আমার তো ধারণা ইপিজেডে গার্মেন্টস কারখানা অলরেডি আছে; শহরাঞ্চলের অলি-গলিতে গড়ে ওঠা গার্মেন্টসগুলি মুলতঃ বড় কারখানাগুলির সাব-কনট্র্যাকটর হিসেবে কাজ করে। এগুলিকে কন্সলিডেট করতে হলে এদের মালিকদের বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে; সরকার সেই ক্ষতিপূরণ দিতে রাজি হবে কিনা, সেই ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার মন্তব্যের সাথে আমি একমত, এই চাওয়াগুলো আমাদের অনেক দিনের। কিন্তু আদৌ নীতিনির্ধারকরা এগুলো কখনও করবেন কিনা আমরা কেও জানিনা, আমরা শুধু প্রত্যাশাই করে যায় দিনের পর দিন।

 সাম্পানওয়ালা এর ছবি

যারা ক্রেতা তারা যেখানে এতটা অপরাধবোধে ভোগেন সেখানে আমরা আমজনতা লভ্যাংশ খেয়েও অপরাধ বোধ করিনা। আমরা কি জাতি হিসেবে অবশ হয়ে যাচ্ছি !

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই সাম্পানওয়ালা, আমরা এখনও সবাই অবশ হয়ে যাইনি, সবাই অবশ হলে একেবারেই সাধারণ কিছু পাগল ছেলেমেয়ে নিজেদের জীবন বাজি রেখে হামাগুড়ি দিয়ে অন্ধকার ধ্বংসবশেশ থেকে মানুষ উদ্ধার করার জন্য ঝাপিয়ে পড়ত না। কিছু চেতনা আমাদের মাঝে অবশিষ্ট আছে এখনও!!

অতিথি লেখক এর ছবি

ব্লগে আপনি নতুন লেখলেও লেখা পড়ে তা মনে হয়নি! বেশ গুছিয়ে সুন্দর করে বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। আপনি যেমন দেশের বাইরে বসে জুলি কিংবা অন্য বিদেশিদের বোঝাতে চেষ্টা করছেন তা প্রশংসনীয়। আজ গার্মেন্ট সেক্টরে বিপর্যয় নেমে এলে সবচেয়ে ক্ষতি হবে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কাজ করতে আসা মেয়েটি-ছেলেটি এবং তাদের পরিবারগুলির।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে।
তবে মাঝে মাঝে অনেক কষ্ট হয়ে যায় এদের উত্তর দিতে। যখন কেউ ৬ তলা ভবন ৯ তলা বানানোর কথা বলে এবং অবাক চোখে প্রশ্ন করে ‘ How is that possible, Zaman?‘, এই প্রশ্নের কোন উত্তর খুঁজে পাইনা, তখন অনেক অসহায় লাগে কারণ অনেকগুলো চোখ অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে!!

রাব্বানী এর ছবি

আমাদের আরো সুন্দর করে মিথ্যা বলা শিখতে হবে যাতে লক্ষ লক্ষ গরীব গার্মেন্টস কর্মীর জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে না যায়। আমাদের এমন করে মিথ্যা বলা শিখতে হবে যাতে ৩৫০ কেন ১০৫০ জন (যা লক্ষ লক্ষ এর তুলনায় কিছুই না) কর্মী মারা পড়লেও কেউ (বিশেষ করে দেশের বাইরের) জানতেও না পারে! লাখ লাখ কর্মীর জীবিকার পথ বলে কথা।

অতিথি লেখক এর ছবি

না রাব্বানী ভাই, এই মিথ্যাগুলো বলার চেষ্টা করিনা, আপনি চাইলেও এইগুলো বলতে পারবেননা, কিন্তু কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো পুরোপুরিই অনুমান আর কিছু ডাটার উপর দাড়িয়ে আছে, আমি খালি সবক্ষেত্রে ওদের ওই ভুলগুলো ভাঙ্গাই না। তবে আমি আপনার ক্ষোভের কারণটা বুঝতে পারছি, আমার ক্ষোভও একই জায়গায়, কিন্তু আমি আপনি চাইলেই এই মালিকগুলো ঠিক হবেনা, যতদিন না বাইরের ক্রেতাগুলো ওদেরকে চাপ দেই। এই কমপ্লায়ান্সগুলো যাতে ঠিকমত করে সেইগুলোই এই জুলিদেরকে বুঝানোর চেষ্টা করি, যখন ওরা কাপড় কিনবে এই ব্যাপারগুলো যেন দেখে কিনে। তবে আমি আপনি মালিকগুলোকে হাজারো ঘৃণা করলেও আমদানি বন্ধ করার কথা মনে হয় বলতে পারবোনা কখনোই, আমিও পারিনা।

মরুদ্যান এর ছবি

এই গার্মেন্টস মালিকরা নিজের পাছায় আগুন না লাগা পর্যন্ত কিছু করবে বলে মনে হয়না। আমার মতে এদের একটা ধাক্কা খাওয়ার দরকার আছে, গার্মেন্টস সেকটরে বিপর্যয় আর প্রাণহানি নতুন না, তাও এদের টনক নড়েনাই। আবার অর্ডার পেতে হলে শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই পেতে হবে। এসব মিথ্যা বলে মালিকদের আরো সুযোগ দেয়ার কোন মানে হয়না। এরা ব্ল‌্যাকমেইলারের পর্যায়ে চলে গেছে। রেগে টং

-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চল রে

রফিকুন্ননবী নয়ন এর ছবি

সহমত

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।