আমার বন্ধু সজল: পর্বতের নেশায় এক অদম্য প্রাণ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২৫/০৫/২০১৩ - ৩:৪২পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২০০৯ সালের আগস্টের ২ তারিখ। ফেসবুকের ইনবক্সে একটি নতুন মেসেজ আর সাথে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট। “ম্যানিমেল তোরে চেনা চেনা লাগতাছে” আমার তো চক্ষু চড়কগাছ। ১৬ বছর পর ঐ বিদঘুটে নামে আমাকে সম্বোধনের সাহস করবে শুধু একজনই, এই বিকৃত নামের স্রষ্টা আমার স্কুল জীবনের সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্র সজল।

আমার পিতৃপ্রদত্ত নামটিকে একটু বদলিয়ে ঐ আমলের জনপ্রিয় টিভি সিরিজ MANIMAL এ রূপান্তরের জন্য যেটুকু মেধা প্রয়োজন আমার বন্ধু সজলের তাঁর কয়েক গুণ বেশি মেধা ছিল, কিন্তু পুরাটাই অপচয় হতো ওর দুষ্টুমি আর বাঁদরামি চর্চায়। সহপাঠী আর শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের কারও কারও যে বাড়তি একটি আনঅফিসিয়াল নাম ছিল তাঁর অনেকগুলিই সজলের মস্তিস্কপ্রসুত। ভাইস প্রিন্সিপাল বদিউজ্জামান স্যারের কুঁজো হয়ে হাঁটার ভঙ্গি আর সমাজবিজ্ঞানের বজলুর রহমান স্যারের সেই বিখ্যাত উক্তি “কেতলির মত বসে আছিস ক্যান?” অবিকল নকলের দক্ষতা ছিল সজলের।

স্কুল পালানোটা আমি সজলের কাছে শিখেছি। বাং মেরে দেয়াল টপকিয়ে আমরা চলে যেতাম পাশের গার্লস স্কুলে, দুই স্কুলের মাঝখানে তো শুধু ঐ শহীদ মইনুল রোড। বয়ঃসন্ধির সেই মাতাল দিনগুলিতে সবকিছুই যেন ছিল ভাঙ্গাগড়ার, কোনও কিছুর তোয়াক্কা না করার। সজল মগবাজারের বাসা থেকে আদমজী স্কুলে আসতো স্কুলবাসে করে। শুনেছি ও স্কুলবাসেও হইহুল্লোড় করে বেড়াতো সবসময়। আমি কাছের মহল্লার ছেলে, রিক্সায় চেপে স্কুলে যাবার সময় দেখতাম ঐ যাচ্ছে আমাদের সবুজ রঙের স্কুলবাস, বিনে পয়সার হেল্পার/কনডাকটরের দায়িত্বে আছে আমাদের সজল।

বই পড়ার মারাত্মক নেশা ছিল সজলের, ক্লাসে লুকিয়ে লুকিয়ে ওকে সেবার ওয়েস্টার্ন পড়তে দেখেছি আমি। সৃজনশীল একটি কিশোর মন যে এই দুষ্টু বালকটির আছে তা আমরা বন্ধুরা অনুভব করতাম। দুই পিরিয়ডের মাঝে যে মিনিট পাঁচেকের বিরতি থাকত তার পুরোটাই বরাদ্দ থাকত সজলের জন্য, একের পর এক কৌতুক আর হাস্যরসে মাতিয়ে রাখতো পুরো ক্লাস। একদিন শুনি ভর্তি হয়েছে মার্শালআর্ট আর মেডিটেশনের কোর্সে। স্বভাবেও এসে গেল একটু ভারিক্কি ভাব। তারপরও আমাদের ক্লাসে ও ছিল স্পেশাল ওয়ান, খুব সহজেই বাকি ৫০টা ছাত্রের থেকে আলাদা করে চেনা যেতো সজলকে।

১৯৯৩ সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা শেষে আমি ভর্তি হয়ে যাই অন্য কলেজে, সাঙ্গ হয় আদমজী স্কুলে আমার ৫ বছরের শিক্ষাজীবন। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি সজলের সাথে, সামনাসামনি দেখা হয়নি জীবনে আর, পেরিয়ে গেছে দুই দশক! এক যুগ ধরে দেশের বাইরে অবস্থান করে পুরনো অনেক সম্পর্কের সুতো ছিঁড়ে যাচ্ছিল একটি একটি করে।

১৬ বছর পরে হঠাৎ শুরু হয় আমাদের বন্ধুত্বের দ্বিতীয় ইনিংস। সজল তো ততদিনে বনে গেছে সজল খালেদ, বাংলাদেশের সংস্কৃতি জগত আর মিডিয়ার উদীয়মান তরুণ নক্ষত্র! ওর বদৌলতেই ফেসবুকে আস্তে আস্তে গড়ে উঠল আদমজী স্কুলের আমার সাবেক সহপাঠীদের নিয়ে এক গ্রুপ। মধ্যমণি কিন্তু আবারো ঐ একই ব্যাক্তি, আমাগো সজল। চ্যাটে আর ফোনে পুরুনো বন্ধুদের আলাপচারিতায় ঘুরে ফিরে সেই একই কথা “ঐ শুনছস, আমাগো সজইল্লা ফিল্ম ডাইরেক্টর হইছে?”, “আমাগো সজল এভারেস্ট যাওনের প্ল্যান করতাছে”! গর্বে বুকটা ভরে উঠত আমার। আমার জন্মদিনে ফোন করল ও, খুব খুশি হয়েছিলাম সেদিন। কথা বলে বুঝলাম ঘর সংসার তখনো বাঁধেনি, ঘুরে ফিরে প্রসঙ্গ ঐ একই, পাহাড় আর এভারেস্ট। আমার মাউন্টেন ট্র্যাকিং এর নেশার কথা শুনে বলল একদিন আসবে আমার কাছে, একসাথে যাবো আল্পসের শীর্ষে Mont Blanc(4810 meter)। আমি ভিমড়ি খেয়ে বন্ধুকে মনে করিয়ে দিলাম যে আমি পাহাড়ে হাঁটাহাঁটি করি, ক্লাইম্বিং করি না! ও শুধুই হাসে, সেই ছোটবেলার সজলের নিষ্পাপ হাসি।

পরের বছর সজলের মাথায় চাপল সিনেমার নেশা। আমি লাঞ্চ ব্রেকে বাসায় আসি, ফেসবুক চেক করে দেখি আমাগো সজল অতি জরুরি ভিত্তিতে ভগ্নপ্রায় বাড়ি খুঁজছে শুটিঙের প্রয়োজনে। একান্তই যদি না পাওয়া যায় তবে একটা বড় রুম তাকে খুঁজে দিতে হবে যার ছাদে সে ৪ বাই ৪ দৈঘের একটা ফুটো করতে পারবে!বন্ধুর কাণ্ডকারখানা দেখে আমি হাসি আপন মনে। একদিন ফোন করে বললাম “চালাইয়া যা দোস্ত, তবে একটা কথা আগেই বলে দিচ্ছি কাজলের দিনরাত্রি দেখার তর আমার সইছে না তাই ইউটিউবে আপলোড হওয়া মাত্রই আমি দেখে ফেলব, অরিজিনাল ডিভিডি কেনার জন্য অপেক্ষা করতে পারবোনা”। ও আবারো হাসে, এত সুন্দর করে হাসতে পারত আমাগো সজল!

একদিন দেখি রেইনহোল্ড মেসনারের ছবি লাগিয়েছে প্রোফাইল পিক হিসেবে, নিচে লেখা Rheinhold Messner, a true mountaineering hero। মেসেজ দিয়ে বললাম এত মেসনার মেসনার করিস নাঙ্গা পর্বত মুভিটা দেখেছিস? লাগলে জানাবি...জবাব দিলো এখনও দেখেনি। আমি সেই রাতেই বসে গেলাম টরেন্ট খুঁজতে, ডাউনলোড করে দেখি পুরোটাই জার্মান ভাষার ডায়লগ। ভাবলাম মন্দের ভালো, ওতো কিছুদিন জার্মানিতে ছিল একদিন ঠিক কাজে লাগবে। আমার এখানে ঘুরতে আসলে একসাথে বসে দেখা যাবে...হার্ডডিস্কে এখনও আছে সেই মুভি ফাইল।

নেপালে রওনা হবার আগে আবার কথা হল। দেখলাম এবার অনেক আত্মবিশ্বাসী। আমিও সুযোগ বুঝে ঝুলিয়ে দিলাম মূলো, যদি এভারেস্ট জয় করতে পারিস তাহলে তোর সামিট জয়ের ছবিতে নিজে গিয়ে নিয়ে আসবো তোর ওস্তাদ রেইনহোল্ড মেসনারের অটোগ্রাফ। এরপরে তো শুধুই অপেক্ষার পালা, এপ্রিলের ২৯ তারিখে শেষ ফেসবুক পোস্ট দেখলাম। জানতাম ও যেখানে থাকবে সেখান থেকে প্রতিদিন আপডেট দেয়া সম্ভব না। সময় পেলেই ঢুঁ মারতাম ওর ফেসবুকে। তিন সপ্তাহ পর মনটা উশখুশ করতে লাগল, ধারণা করতে পারছিলাম খুব তাড়াতাড়ি আপডেট পেয়ে যাব। টেনশন কমাতে নাঙ্গা পর্বত আর মেসনার ভাইদের নিয়ে একটা পোস্ট লিখে ফেললাম সচলায়তনে। মঙ্গলবার লাঞ্চ ব্রেকে বাসায় এসে ফেসবুক চেক করে মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, ঐ মুহূর্তে আমার খুব জোরে চিৎকার করে সজলকে ডাকতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

আদমজী স্কুলের আরেক সহপাঠী মিনহাজ ইয়াসিরকেও আমরা হারিয়েছি সেই ১৯৯৫ সালে। মিনহাজ আর সজল কলেজেও একসাথে ছিল। উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশের কিছুদিন বাকি থাকতেই ছুটি কাটাতে গিয়ে বঙ্গোপসাগরে ভেসে যায় ও। সন্তান হারানো পিতা কক্সবাজারে প্রতিষ্ঠা করেন ইয়াসির লাইফগার্ড নামের এক বেসরকারি উদ্যোগ যা আজও চালু আছে বলে শুনেছি। মিনহাজকে হারিয়েছি সমুদ্রে আর সজলকে সমুদ্রপৃষ্ট থেকে ৮৬০০ মিটার উপরে।

খুব ভালো করেই জানি আমাদের জীবন থেমে থাকবে না, বন্ধু হারানোর শোক ধীরে ধীরে হালকা হয়ে আসবে সময়ের আবর্তনে। হৃদয়ের সাদাকালো ক্যানভাসে থেকে যাবে সজলের হাসিমুখের ছবি তারপর হয়ত হঠাৎ একদিন আমার ছেলে স্কুল থেকে ফিরে ভূগোলের বইটি নিয়ে এসে বলবে “বাবা, মাউন্ট এভারেস্টটা ঠিক কোথায় একটু দেখিয়ে দাওনা”। এক দীর্ঘশ্বাস চেপে রেখে হাত রাখব ম্যাপে। ঝাপসা হয়ে আসবে আমার দুচোখ।

(পাদটীকা: অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেছে “তুমি সজলকে যেতে বারণ করনি? ওতো আগেরবার মরার হাত থেকে বেঁচে এসেছে”

না, আমি আমার বন্ধুকে যেতে বারণ করিনি। করেও খুব একটা সুবিধা হতো না। বিশ্ববিখ্যাত মার্কিন পর্বতারোহী এডমুন্ড ভিশ্চাসের একটি বই সজল হালে অনুবাদ করেছে। মূল বইয়ের নাম No Shortcuts to the Top. আমার বন্ধু সজল তাঁর প্রথম প্রকাশিত বইয়ের নামটি দিয়েছে খুব ভেবে চিন্তে, ওর হৃদয়ের কথা স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে মাত্র চারটি শব্দে। বইটির নাম “পর্বতের নেশায় অদম্য প্রাণ”।)

...… জিপসি


মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

মন খারাপ মন খারাপ এভাবেই কেন যেতে হবে?

অতিথি লেখক এর ছবি

সজল ছিল আমাদের স্পেশাল ওয়ান, না ফেরার দেশেও গিয়েছে স্পেশাল ভাবে…… সবাইকে বোকা বানিয়ে।
মন খারাপ মন খারাপ

...… জিপসি

মেহবুবা জুবায়ের এর ছবি

শ্রদ্ধা

জোহরা ফেরদৌসী এর ছবি

পাহাড়ের বন্ধুটির স্মৃতিতে তর্পণ। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন সজল।

__________________________________________
জয় হোক মানবতার ।। জয় হোক জাগ্রত জনতার

অতিথি লেখক এর ছবি

আমাদের অনেকের হৃদয়ে ওকে ঘিরে থাকা হাজারো মধুর স্মৃতি বেঁচে থাকবে বহুদিন।

...… জিপসি

নীল আকাশ এর ছবি

শ্রদ্ধা

স্যাম এর ছবি

জিপসি - সেদিনের দুঃসংবাদ শুনেই আপনার লেখার কথা মনে হয়েছিল ... কিছু বলার নেই......

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মন খারাপ

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রিপন মজুমদার এর ছবি

মিনহাজকে হারিয়েছি সমূদ্রে আর সজলকে সমূদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৬০০ মিটার উপরে

আপনি সাবধানে থাকবেন। বিশেষ করে মরু অঞ্চল বা আমাজন জঙ্গলের উপর দিয়ে বিমান ভ্রমণের ক্ষেত্রে।
(টপিক পড়ে শেষ করার কয়েক ঘন্টাপর মনে হলো, আশঙ্কাটি চাপা না রেখে কমেন্টে বলে ফেলা দরকার। তাই বলে ফেললাম)

অতিথি লেখক এর ছবি

আমি মুক্তমনা মানুষ, মৃত্যুভয় আমাকে আতংকিত করেনা।
কথাপ্রসঙ্গে একটি বাড়তি তথ্য আপনাকে জানাচ্ছি, ক্লাস সিক্সে থাকতে আমাদের আরেক কিশোর সহপাঠী বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট জনিত দুর্ঘটনায় জীবন হারায়। খুব ছোট ছিলাম তখন, সবকিছু স্পষ্ট মনে নেই... যতটুকু মনে পড়ে ওর নাম ছিল মনির।

...… জিপসি

সূফী এর ছবি

বুক ভরে শুধু হাহাকার- সূফী

মনের রাজা টারজান এর ছবি

মন খারাপ

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

মন খারাপ

অতিথি লেখক এর ছবি

গুরু গুরু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।