বই পড়াঃ শব্দ এবং ছবি (অরহান পামুকের লেখা থেকে)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০১/১০/২০১৩ - ২:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আপনার পকেটে অথবা ব্যাগে একটা বই থাকা মানে আপনার অধিকারে আরও একটা জগত আছে। আপনার মনে যখন বিষণ্ণতা এসে ভর করবে তখন এই জগতে আপনি ডুবে যেতে পারেন সুখের সন্ধানে। আমার কৈশোরের অসুখী দিন গুলিতে এমন একটা বইয়ের ভাবনাই আমাকে সুখী করে তুলত। মনে পড়ে স্কুলে আমি ক্লাসরুমে হাইয়ের পর হাই তুলতাম। কিন্তু ব্যাগে থাকা একটা বইয়ের চিন্তা আমাকে সান্ত্বনা দিত। পরবর্তীতে জীবনের এই পর্যায়ে এসে অনুরোধের ঢেঁকী গিলতে যেসব বোরিং মিটিঙয়ে অংশ নিতে বাধ্য হই সেখানেও ব্যাগে থাকা একটা বইয়ের চিন্তা আমাকে সুখি করে তোলে।
আমি আনন্দের জন্যে পড়ি। আমি বিদ্বান হবার জন্য বা জ্ঞানের আলোয় আলোকিত হবার জন্য পড়ি না। কিন্তু কেন আমি আনন্দের জন্য পড়ি? একটা তালিকা করা যাকঃ

১। সেই অন্য জগতের টান যার কথা আগেই উল্লেখ করেছি। এটাকে পলায়নপরতা (এস্কেপিজম) হিসেবে দেখা যায়। যদিও জগতটা কাল্পনিক তবু দৈনন্দিন জীবনের দুঃখ, জরা, পঙ্কিলতা থেকে কিছুক্ষণের জন্যে হলেও লুকিয়ে থাকা ভালো।

২। ষোল থেকে ছাব্বিশ বছর বয়স পর্যন্ত আমার পড়ার মূল উদ্দেশ্য ছিল নিজের জন্য কিছু করা, নিজের চেতনাকে উন্নীত করা আর নিজের অন্তরাত্মাকে একটা নির্দিষ্ট আকার দেওয়া। আমি কেমন মানুষ হব ? এই জগতের অর্থ কি ? আমার চিন্তা কত দূর অগ্রসর হতে পারে ? এইসব প্রশ্নের উত্তর আমি খুঁজেছি ওই সময়। আমি ভেবেছি আমার আগ্রহ, আমার স্বপ্ন আর আমার মনের চোখে দেখা দেশের কথা। আমি যাপন করেছি বইয়ে থাকা অন্যের জীবন, অন্যের স্বপ্ন, অন্যের চিন্তা। আমি জানি বইয়ে পড়া এইসব লেখকের স্বপ্ন, চিন্তা, অনুভব আমি কখনও ভুলবনা। এগুলো থেকে যাবে আমার স্মৃতির গভীরতম দূরবর্তী কোন এক স্থানে। যেমন করে একটা শিশু তার প্রথম দেখা গাছ, পাতা, বিড়াল কখনও বিস্মৃত হয়না। ওই সময়টাতে বই পড়ে যে জ্ঞান অর্জন করেছিলাম সেটা নিয়েই আমি বড় হয়ে উঠলাম। ওই বছরগুলোতে বই পড়ার পিছনে নিজের মানসিক একটা গড়ন অর্জন করার যে বালসুলভ আশাবাদ কাজ করত সেটাই মনে হয় বই পড়াটাকে একটা খেলার মত করে তুলেছিল। কিন্তু এখন আর আমি ওইরকম ভাবে পড়িনা। মনে হয় এই কারণেই বই পড়ার সংখ্যা ওই সময়ের তুলনায় অনেক কমে গেছে।

৩। আরেকটা বিষয় আমার পাঠ অভ্যাসকে খুব বেশি আনন্দময় করে তোলে। সেটা হল আত্মসচেতনতা। আমরা যখন পড়ি তখন আমাদের মনের একটা অংশ টেক্সটের ভিতরে পুরোপুরি ডুবে যেতে প্রতিরোধ করে এবং আমাদেরকে অভিনন্দিত করে এরকম একটা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে ব্যাপৃত হবার জন্য। মার্সেল প্রুস্ত এই ব্যাপারটা ভালোভাবে বুঝেছিলেন। প্রুস্ত বলেছিলেন-“ বই পড়ার সময় আমাদের মনের একটা অংশ বাইরে থেকে যায়, যেটা নিবিষ্ট থাকে যে টেবিলে আমরা বসেছি সেটাতে, যে ল্যাম্প টা আলো দিচ্ছে সেটাতে, জানালার বাইরে বাগানে অথবা আরও দূরে কোথাও”। যখন আমরা এইরকম একটা ব্যাপার খেয়াল করি তখন আমারা একই সাথে উপভোগ করি আমাদের একাকীত্ব আর আমাদের কল্পনাশক্তিকে এবং যারা পড়েনা তাদের থেকে উচ্চতর স্থানে নিজেকে বসিয়ে নিজেকে অভিনন্দিত করি। আমি আমার নিজেকে দিয়েই বুঝি একজন বই পড়ুয়া কিভাবে নিজেকে অভিনন্দিত করতে চায়। তবে যারা নিজের পড়ুয়া স্বত্বাকে নিয়ে অহংকার করে আমি তাদের দুচোখে দেখতে পারিনা।

আমি যখন আমি আমার পড়ুয়া জীবন নিয়ে কথা বলি আমাকে বলতেই হবে যে- ১ আর ২ এ যে আনন্দের কথা আমি বলেছি সেটা যদি ফিল্ম, টেলিভিশন অথবা অন্য কোন মাধ্যমে আমি পেতাম তবে মনে হয় আমি খুব কম বইই পড়তাম। হয়ত এটা কোন একদিন সম্ভভ হবে। কিন্তু এটা খুব কঠিন। কারণ শব্দ হল জলের মত অথবা পিঁপড়ার মত। জীবনের ফাঁক ফোঁকর, গর্ত অথবা অদৃশ্য শূন্য স্থানে শব্দের মত আর কোনকিছুই এত দ্রুত এত সর্বগ্রাসী হয়ে ঢুকতে পারেনা। জীবনের এইসব ফাঁকফোকরই জীবন সম্পর্কে পৃথিবী সম্পর্কে আমাদের কৌতূহলী করে তোলে আর ভালো সাহিত্য এই সব ফাঁক ফোঁকর উন্মোচন করে। ভালো সাহিত্য মন্ত্রের মত কাজ করে, এটা ঠিক সাম্প্রতিক খবরের মতই দরকারি। আমি এর উপরে তাই এখনও আস্থাবান।
তবে আমি মনে করি দেখার যে আনন্দ সেটাকে পড়ার আনন্দের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দাড় করানো উচিত হবেনা। এটা আমি বলছি কারণ সাত থেকে বাইশ বছর বয়স পর্যন্ত আমি চিত্রকর হতে চেয়েছিলাম এবং এই সময়টাতে মোহাচ্ছন্নের মত ছবি এঁকে গিয়েছিলাম। আমার কাছে পড়া হল কারোর মনের একটা ফিল্মি ভার্সন তৈরি করা। আমরা হয়ত বই থেকে চোখ তুলে দেয়ালে ঝুলানো একটা ছবির দিকে তাকাতে পারি, দেখতে পারি জানালার বাইরের দৃশ্যাবলী কিংবা তাকাতে পারি আরও দূরে কোথাও, কিন্তু আমাদের মন এইসব গ্রহণ করেনা যতক্ষণ আমরা পড়ি, আমাদের মন তখনও চিত্রায়িত করতে থাকে বইয়ের কল্পনার জগতটাকে। লেখকের কল্পিত জগতকে দেখতে, অন্যভুবনের আনন্দ অনুভব করতে আমাদেরকে অবশ্যই কল্পনার লাগাম ছেড়ে দিতে হবে। বইয়ের কল্পিত জগতে শুধুমাত্র একজন দর্শক নয়, ওই জগতের অংশ করে নিতে বই আমাদেরকে তার স্রষ্টা লেখকের নিমগ্নতায় নিমজ্জিত করে। এই সেই নিমগ্নতা যা আমাদের বই পড়তে, চিরায়াত সাহিত্য পড়তে মুগ্ধকরের কাজ করে।

অরহান পামুকের আদার কালারস বইয়ের On Reading: Words Or Images থেকে অনুবাদকৃত।

>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>>
তাহসিন রেজা


মন্তব্য

হাসান এর ছবি

পামুক আমার পছন্দের লেখক। ভাল্লাগলো খুব। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
অনুবাদের হাত আপনার খারাপ না- একটু গতিহীন মনে হয়েছে যদিও। "আদার কালার্স" থেকে আরো দুয়েকটা লেখা চটজলদি ছেড়ে দিন না! আপনারও হাতমকশো হলো, আমরাও পড়লাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকেও অনেক ধন্যবাদ হাসান। "আদার কালারস" থেকে আরো দুয়েকটা আসতে পারে। হাসি

তাহসিন রেজা

তিথীডোর এর ছবি

ঢেঁকী > ঢেঁকি, একাকীত্ব > একাকিত্ব, স্বত্বা > সত্ত্বা, ফাঁক ফোঁকর > ফাঁকফোকর-- এরকম টাইপো রয়ে গেছে।
ফিল্মি ভার্সন ফিল্ম, টেলিভিশন-- দু'জায়গায় স্পেস পড়েনি।
আর সম্ভবত হুবহু লিখতে গিয়ে মানে মূলের কাছাকাছি রাখার চেষ্টায় আড়ষ্ট মনে হয়েছে লেখার ধরনকে।

তবে সবচেয়ে জরুরি অংশ, মনে হয়েছে আপনি অনুবাদে ভাল করবেন। আরো লিখুন, নিয়মিত। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

আরে তাইতো। অনেক গুলা টাইপো মন খারাপ আসলে অভ্র এখনো ঠিক ভালো ভাবে বুঝে উঠতে পারছিনা।

মূলের কাছাকাছি রাখার চেষ্টায় আড়ষ্ট মনে হয়েছে লেখার ধরনকে

লেখার সময় আমারো তাই মনে হয়েছিল। পরের বার একটু অন্যভাবে চেষ্টা করে দেখব।

তাহসিন রেজা

কল্যাণ এর ছবি

সম্ভভ = সম্ভব ? চিন্তিত

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

অতিথি লেখক এর ছবি

ইয়ে, মানে... মন খারাপ
পরের বার বানানের দিকে অনেক বেশি নজর রাখব।

তাহসিন রেজা

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

পামুকের লেখা অনুবাদ করা দুরূহ কাজ! আপনি সেই কাজে এগিয়ে এসেছেন বলে প্রথমেই অভিনন্দন।

ভাষার উপরে আপনার ভালো দখল আছে বলে মনে হচ্ছে। চালিয়ে যান।

এবার আমার ব্যক্তিগত একটা অনুভূতি। অনুবাদ করার মূলত দুটো ধরণ আছে - প্রায় আক্ষরিক অনুবাদ আর ভাবানুবাদ (যেটা সেবা প্রকাশনীর ভাষায় 'রূপান্তর")। মনে হলো আপনি প্রথম ধরনটা অনুসরণ করেছেন। আমার মনে হয় (বিশেষ করে পামুকের ক্ষেত্রে), দ্বিতীয় ধরণটা বেশী কার্যকরী হবে।

হাসান ভাইয়ের বক্তব্যের সাথে একমত প্রকাশ করে বলি লিকতে থাকেন দু হাত খুলে।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকে অনেক ধন্যবাদ প্রোফেসর হিজিবিজবিজ ।
আপনার সাথে আমি একমত। ভাবানুবাদই সই। মূলের কাছাকাছি থাকার এক্সপেরিমেন্টটা সফল হয়নি। মন খারাপ
পরের বার একটু অন্যভাবে চেষ্টা করে দেখব।

তাহসিন রেজা

অতিথি লেখক এর ছবি

সুন্দর এবং পরিচ্ছন্ন লেখা মনে হয়েছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

তাহসিন রেজা

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

মাসুদ সজীব

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

তাহসিন রেজা

কল্যাণ এর ছবি

মন্তব্য করতে এসে দেখি হাসান, তিথীডোর এবং হিজিবিজবিজ সব বলে ফেলেছে।

_______________
আমার নামের মধ্যে ১৩

অতিথি লেখক এর ছবি

অ্যাঁ হাসি

অনেক ধন্যবাদ প্রিয় কল্যাণদা।

তাহসিন রেজা

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

হাততালি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি

তাহসিন রেজা

আয়নামতি এর ছবি

খুব সামান্য পড়েছি পামুক। আমার দৌড় মাই নেইম ইজ খান থুরি রেড খাইছে ঐ পর্যন্তই।
আপনার লেখা পড়েই বোঝা যাচ্ছে ভালো লিখেন আপনি।
অনুবাদের প্রাথমিক জড়তা কেটে যাবে যতবেশি লিখবেন।
অতএব আরো আসুক অনুবাদ এবং পামুক হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

পামুক পড়ুন দেঁতো হাসি ভালো লাগবে।

আরো দুয়েকটা পামুক আসতে পারে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ আয়নামতি। হাসি

তাহসিন রেজা

অতিথি লেখক এর ছবি

কি লিখবো! আগের মন্তব্যগুলোতেই মোটামুটি আমার কথাও চলে এসেছে। তবুও বলি- আপনার অনুবাদ খারাপ লাগেনি, কিন্তু পাঠকে শেষ পর্যন্ত ধরে রাখার জন্য আরো কিছু চাই। যেমন, প্রফেসর ভাইয়া বলেছেন পামুকের ক্ষেত্রে ভাবানুবাদটাই ভালো।
লিখতে থাকুন এবং ভালো থাকুন সতত।

-এস এম নিয়াজ মাওলা

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ এস এম নিয়াজ মাওলা ।

তাহসিন রেজা

তারেক অণু এর ছবি

অনুবাদ ভাল লাগল। মূল বইটি খুব প্রিয়

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ প্রিয় অনুদা। মূল বই টি আমারো অসম্ভব প্রিয়। হাসি

তাহসিন রেজা

অতিথি লেখক এর ছবি

পামুকের 'Snow' বইটি পড়ছি এখন। আপনার কাছ থেকে পামুকের আরও অনুবাদ আশা করছি হাসি

- সৈয়দ মনজুর মোর্শেদ

অতিথি লেখক এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

তাহসিন রেজা

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।