ট্রেনে একদিন কিংবা আশাবাদী হওয়ার গল্প

মাসুদ সজীব এর ছবি
লিখেছেন মাসুদ সজীব (তারিখ: রবি, ১৫/১২/২০১৩ - ৪:৪৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সারাদিন অফিস শেষে টেলিভিশনে চোখ রাখলেই দেখছি সারাদেশে অবরোধ আর হরতালে উৎসব করে গাড়িতে আগুন দেওয়া হচ্ছে, পেট্রোল বোমা মারছে পাপিস্থানি জারজগুলো। নিজের জীবনটাকে খুব বেশি ভালোবাসি বলেই বেঁচে থাকার লোভে ঝুঁকি মাথা নিয়ে এই উৎসবের মাঝে গত দুই মাস বাড়ি যাওয়া হয়নি। তবু গতকাল অসহ্য হয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে ট্রেনে চেপে বসলাম। এ যেনো অনন্তকালের যাত্রা, ট্রেন দশ মিনিট চলে তো ১ ঘন্টা থেমে থাকে। কুমিল্লা দাঁড়িয়ে আছে ট্রেন, হঠাৎ দেখি ট্রেনের ঠিক মাঝখানে ৭-৮জন মানুষ জড় হয়ে কি নিয়ে যেন উচ্চস্বরে কথা বলছে। ট্রেনের বেশিভাগ আসন খালি তাই আমি একটু সামনে এগিয়ে বসলাম আলোচনা শুনতে। টেলিভিশনেতো রাত জেগে একসময় অনেক টকশো দেখা হয়েছে, এইবার না হয় ট্রেনে লাইভ টকশো দেখি। আলোচনা তখন এরশাদ কেন্দ্র করে, এরশাদ কে নিয়ে এখন যা হচ্ছে তা ঠিকি আছে। ওর মতো একজন স্বৈরাচারের আরো কঠিন শাস্তি দরকার। সবাই একমত হয়ে তার কথায় সম্মতি দিলো। আমি তখন ২য় পর্যায়ের আলোচনার জন্যে অপেক্ষা করছি। অল্প সময়ের মাঝেই শুরু হলো দেশ নিয়ে আলোচনা। জামাতি ইসলাম যেমন প্রথমেই বিসমিল্লাহ বলে হাত পায়ের রগ কাটা শুরু করে তেমনি সচেতন দেশপ্রেমিক এইসব বাঙ্গালি শুরুতেই দুই নেত্রীকে গালাগালি করে আলোচনা শুরু করলো। তারপর পুরো জাতির গোষ্ঠি উদ্ধার করে একজন বললো এই দেশে সবাই খারার, পুলিশ, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা সবাই খারাপ। আমি অপেক্ষা করছি এদের চূড়ান্ত লেজটা দেখার।

আমাকে বেশিক্ষন অপেক্ষায় থাকতে হয়নি, ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে তাদের খাঁটি মুসলমান চরিত্র এর পরে উঠে আসলো। কসাই কাদেরকে নিয়ে মানবতা তাদের চূড়ায় উঠলো। কসাই কাদেরকে নিয়ে রনি সাহেবের লেখে পড়ে নাকি চোখের পানি ধরে রাখা কঠিন, তাকে ঠিক মতো নাস্তা দেওয়া হয় নাই। এই কাদের কসাই কাদের নয়, একজন নিরীহ লোককে ফাঁসিতে ঝুলিতে দিলো। এই জ্বালাও পোড়ায়ের জন্যে শেখ হাসিনা দায়ী, আর বাসে ট্রেনে আগুন কি শুধু -জামাত দিচ্ছে? এগুলো আমরা জানি, এগুলো আওয়ামিলীগের কাজ। আওয়ামিলীগ দেশটাকে দুইভাগে ভাগ করে ফেলেছে। মুক্তিযুদ্ধ আর রাজাকার। এটা ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, আওয়ামিলীগ নাস্তিকের সরকার। এতটুকু আলোচনা শোনার পর আর আলোচনা শোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। এরপরের আলোচনা কোনদিকে যাবে সেটা বুঝতে আর বাকী নেই। তাই যথারীতি হতাশ হয়ে আবার পেছনে ফিরে আসলাম। নিজের আসনে বসা মাত্রেই আমার পাশে বসা ভদ্রলোক বললো কি ভাই হতাশ হয়ে আসলেন বোধহয়। আমি বললাম এরা জারজ সন্তান, এরা না বুঝে ইসলাম, না বুঝে ধর্ম। কসাই কাদের যদি রাজাকার নাইবা হয়ে থাকে তাহলে এতগুলো মানুষ কেন চিনে না জানে না একজনের বিপক্ষে সাক্ষী দিলো? যারা নিজ চোখে দেখলো তারাও মিথ্যে বলছে এটা কি বিশ্বাস যোগ্য? শুধু খুনি টা সত্য বলছে আর বাকী সবাই মিথ্যে বলছে? একটা চিঠি লিখেছে আর তাতেই তিনি সাধু হয়ে গেলেন? একজন খুনি লেখলো সে খুন করে নাই তাহলে সে নিষ্পাপ হয়ে গেল? এভাবে প্রতিটি দেশে একজন করে দালাল রনি থাকলে আর কসাই কাদের দের মতো খুনিদেরকে একখান চিঠি লেখতে দিলে তারা সবাই নিজেকে শিশুর মতো নিষ্পাপ দাবি করবে। তাহলে তো মুজাহিদির কথাই ঠিক দেশে কোন যুদ্ধাপরাধী নেই?

আমাদের পেছনের সিটের আরেক ভদ্রলোক আমার কথা শুনে আলোচনায় যোগ দিলো নিজ উৎসাহে। বললো আমাকে বলেন তো যারা এরশাদকে স্বৈরাচার বলে গালি দিচ্ছে যারা তারা কি জিয়াউর রহমানকে এরশাদের সাথে তুলনা করে? জিয়াউর রহমানও তো একজন স্বৈরাচার? যিনি এক সকালবেলা ক্ষমতা দখল করে নিলো। আমি উত্তর দেওয়ার সুযোগ পেলাম না। এবার আমার সামনে সিটে বসা থাকা আরেকজন এই আলোচনায় যোগ দিলো এবং বললো ভাই আমরা বাঙালিরা জাতি হিসাবে কখনো ঐ্ক্যবদ্ধ ছিলাম না, আজও নেই। যারা বলে আওয়ামিলীগ দেশকে দুইভাগে ভাগ করে দিয়েছে তাদের আসলে এই দেশের জন্মলগ্নের ইতিহাস জানা নেই। হিন্দু-মুসলমান ভিত্তিতে এই বর্ষ ভাগ হয়েছে এটা তারা জানে না, জানে না ৭১ এর ইতিহাস। ৭১ এ বেশিভাগ বাঙ্গালি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলো বিষয়টা এমন না, বেশিভাগি ছিলো স্বাধীনতার বিপক্ষে, তাদের বিশ্বাস ছিলো পাকিস্থানিরা ইসলামের ঐক্য রাখার জন্যেই কাজ করছে। তৎকালীন দেশের বেশি ভাগ গ্রাম্য চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে সব প্রভাবশালীই ছিলো পাকিস্থানের পক্ষে। সুতরাং বাঙ্গালি কখনো ঐক্যবদ্ধ ছিলো না, এখনো নেই। এখনো আমাদের দেশে স্পষ্ট দুই ভাগ, একভাগ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রগতিশীলতায় বিশ্বাসী আর আরেকদল অন্ধ ধর্মান্ধ যারা প্রতিক্রিয়াশীলতায় বিশ্বাসী। আমি মুগ্ধ হয়ে লোকটির কথা শুনছিলাম, তিনি একটি কলেজের ইতিহাসের শিক্ষক। আস্তে আস্তে আমাদের দিকে আলোচক বেড়ে গেলো, অনেক তরুনকে দেখলাম, আমার সিটের পাশে ঘিরে থাকা আলোচনার উচ্চকন্ঠসর বাড়তেই থাকলো, এর মাঝে কিছু ২০-২২ বছরের তরুনরা খুবি আক্রমনাত্বক ভাষায় ওইসব ছাগুদের গালাগালি করতে থাকলো। তখন ওইপাশের আলোচকরা দমে গেল। এর কিছুক্ষন পরেই হুইসাল দিয়ে ট্রেন চলা শুরু করলো, আমার মনে হল এটা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষদের জয়, আমরা শুধু রাস্তায় নেমে তাদের মতো গাড়ি ভাঙ্গচুর করছি না বলে সারা দেশে আমাদের সংখ্যাটা দেখা যাচ্ছে না। আমার নিজের ধারনা ছিলো দেশে ছাগুদের সংখ্যা বেশি কিন্তু আসলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ কম না। আমরা শুধু চুপ করে আছি বলেই বুঝা যায় না, আমার আশে পাশে থাকা মানুষগুলোর এই জেগে ওঠা দেখে আমি বুঝলাম আমরা যদি আবারও এমন এক হতে পারি এই যুদ্ধেও আমাদের জয় হবেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জয় হবেই। জয় বাংলা।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

জাতি হিসেবে আমাদের বিভক্তি স্পষ্ট। আমাদের একটা বড় অংশ সুবিধাবাদী, তারা সবসময় শাসকের পক্ষে ছিল, মন থেকে পরাধীনতা মেনে নিয়েছে।

বিভক্তি আরো স্পষ্ট হয়, যখন নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে সরকার বিরোধিতা থাকে তুঙ্গে, যখন শাহদীন মালিক দাবি করেন ওই বিশেষ অঞ্চলগুলোতে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে বর্তমান সরকার একটি আসনেও জিতে আসতে পারবেনা। দেশের এপিঠ-ওপিঠ দুটোই দেখছি অনেকদিন ধরে। এখনো দেশের মানুষের বড় একটা অংশ মুসলমান হবার দোহাই দিয়ে পাকিস্তানের পিঠ চুলকায়ে দিতে চায় এবং মুক্তিযুদ্ধকালীন সংগঠিত সকল অপরাধকে ভুলে যেতে চায়।

চেতনা হৃদয়ে ধারণ করতে হবে এবং চেতনা সাসটেইনএবল হতে হবে-তবেই বিজয় আসবে। তা নাহলে বিভক্তি এবং অজ্ঞানতা আমাদের খাদের কিনারে নিয়ে যাবে যেখানে চেতনা শব্দ উচ্চারণ করাও অপরাধ হিসেবে গন্য হবে।

শব্দ পথিক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আমার নিজের ধারনা ছিলো দেশে ছাগুদের সংখ্যা বেশি কিন্তু আসলে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ কম না। আমরা শুধু চুপ করে আছি বলেই বুঝা যায় না, আমার আশে পাশে থাকা মানুষগুলোর এই জেগে ওঠা দেখে আমি বুঝলাম আমরা যদি আবারও এমন এক হতে পারি এই যুদ্ধেও আমাদের জয় হবেই, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার জয় হবেই। জয় বাংলা।

চলুক

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

নাম দিতে মনে ছিলোনা সত্যদা। লইজ্জা লাগে

ঘটনা টা আমার নিজের বিশ্বাস আর আস্থাকে আরো বহুগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। এর পাশাপাশি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করার মতো ছিলো কিন্তু সেটা উল্লেখ করলে লেখা বেশি লম্বা হয়ে যাবে তাই করিনি। যারা দেশের সবাইকে খারাপ বলে নিজেকে খুব সচেতন আর শুদ্ধ দাবি করছিলো, তারাই টিটি যখন টিকিট চেক করলো দেখা গেল সেই সব আত্নস্বীকৃত ভালো সার্টিফিকেটধারী কারো কাছে টিকেট নেই গড়াগড়ি দিয়া হাসি

মাসুদ সজীব

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আরে, এটা আপনার লেখা? স্বাগতম হাসি

চেনা কথাগুলো দেখতে দেখতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম...
নাম যে নেই খেয়ালই করিনি ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

আয়নামতি এর ছবি

এটা যদি আপনার প্রথম পোস্ট হয় তবে অভিনন্দন গ্রহন করুন। ব্যাপার হচ্ছে প্রথম না হইলে কি অভিনন্দন ফেরত দিতে হবে? না, হবে না। আমার পড়া প্রথম পোস্ট এটা আপনার, কাজেই অভিনন্দন বলবৎ থাকলো।
বলেন আলহামদুলিল্লাহ দেঁতো হাসি সবার পোস্টে আপনার ইয়ারামু সব মন্তব্য দেখি। কাজেই আপনার পোস্টে সেরাম একটা মন্তব্য করা ফরজ ভেবেই আবজাব বকলাম। পোস্টের শেষকথাগুলো ভালো লাগলো। আরো লিখুন, এবং অবশ্যই নাম দিতে ভুলে যাবেন না। নইলে মাইনাষ শয়তানী হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ইয়ারামু অর্থ কি খুব লম্বা কিংবা বড়?

মাসুদ সজীব

আয়নামতি এর ছবি

জ্বী। শব্দটা কোনো ডিকশনারিতে আছে কিনা জানা নাই।
তবে আপনার ইয়ারামুতে রাম রহিম লক্ষণ সবাই থাকলেও আমারটাতে কেবলই রাবণ দেঁতো হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

শব্দটা কোন ডিকশনারিতে নেই, আমি ধারনা করে বলেছি অর্থটা বোধহয় এমন হতে পারে? আপনার জবাবটা জটিল মনে হচ্ছে আমার কাছে, সহজ করে বললে বিষয়টা বুঝতে আমার জন্যে সহজ হতো।

মাসুদ সজীব

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্যে আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-
সেটাই আশাহত হলে চলবে না, সত্য আর সুন্দরের জয় চিরকালি হয়।

মাসুদ সজীব

দীনহিন এর ছবি

বাসে-রেস্তোরায়, চলতি পথে আমারও একইরকম অভিজ্ঞতা হয়, আর হতাশায় ভেঙ্গে পড়ি, ভাবি, এই মানুষগুলোর জন্য পাকিস্তানই ভাল ছিল, হত্যা-বোমা-রক্ত-আগুন আর দাসত্বই এদের উপযুক্ত নিয়তি! এরা একটি স্বাধীন বাংলাদেশ ডিসার্ভ করে না, শুধু শুধু তিরিশ লাখ লোক প্রাণ দিয়েছে! কিন্তু না, আমাদের দেশ পাকিস্তান হবে না, কারণ আমাদের দেশে রয়েছে আপনার লেখার শেষের মানুষগুলোও। হয়ত এদের সবাই এখনো বের হয়ে আসেনি, হয়নি উচ্চকিত, দীর্ঘদিনের সাম্প্রদায়িক চাষাবাদ অনেককেই রেখেছে নির্লিপ্ত; কিন্তু এরা আছে, সময় হলেই জেগে উঠবে। লক্ষ-কোটি অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধাদের এই দেশে ছাগু-জারজে ভরে যেতে পারে না। আমাদের দেশটা পাকিস্তান হবে না। কখনোই না।

বিজয়ের দিনে আশার বানী শোনানোর জন্য কৃতজ্ঞতা!

.............................
তুমি কষে ধর হাল
আমি তুলে বাঁধি পাল

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

দেশকে সবচেয়ে বেশী ভালোবাসে যে মানুষগুলো, তারা সাধারণত: "চোরের মার বড় গলা"র মত উচ্চস্বরে চিৎকার করে না, নীরবে নিজের অবস্থানে থেকে নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী দেশমাতৃকার সেবা করে যায়। উদয়াস্ত অ:নিশেষ পরিশ্রম করে দেশে টাকা পাঠায়, দেশে নিজের কাজ সুষ্ঠুভাবে করে দেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। সুতরাং শুয়োরের জারজ বাচ্চারা যতই ফালাফালি করুক না কেন, যখন ওদের গালে সপাটে চপেটাঘাত করবে সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশপ্রেমিকের দল, তখন "পথকুক্কুরের" দল "সংকোচে সত্রাসে" মিশে যাবে।

লেখায় চলুক মাসুদ ভাই। লিখতে থাকুন।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- প্রোফেসর সাহেব।

মাসুদ সজীব

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।