কড়ি ও তীরন্দাজ - একটি ও হেনরির গল্পের অনুবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১৯/০২/২০১৪ - ৪:২৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনুবাদ সাহিত্যে হাতেখড়ির জন্য ছোটোগল্পের চেয়ে ভালো কিছু আর হতে পারেনা, তার উপর গল্পটি যদি হয় ও হেনরি'র। এই গল্পটি মূলত অনুবাদ নিয়ে নিরন্তর আগ্রহের ফসল। প্রথম ইংরেজি থেকে বাংলা অনুবাদ হিসেবে ভুল-ভ্রান্তিগুলো সবাই আশা করি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। সবার সমালোচনা ও পরামর্শ একান্তভাবে কাম্য।

পরিশেষে, বন্ধু ফাহিমা আল ফারাবি ও ফরহাদ হোসেইন মাসুমকে ধন্যবাদ। তাদের পরামর্শ অনুবাদটিকে আরো প্রাঞ্জল হতে সাহায্য করেছে।

যারা মূল গল্পটি পড়তে চান, এখানে ঢুঁ মারতে পারেনঃ http://www.ciudadseva.com/sevacity/stories/en/henry/mammon_and_the_archer.htm

কড়ি ও তীরন্দাজ
(Mammon and the Archer)
মূল গল্প - O. Henry
অনুবাদ – রেহানা আক্তার

ফিফথ এভিনিউ এর উপর দাঁড়িয়ে আছে এক বিশাল অট্টালিকা। সেটার লাইব্রেরীর জানালা দিয়ে তাকিয়ে রকওয়াল’স ইউরেকা সাবানের অবসরপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠাতা ও মালিক, বুড়ো অ্যান্থনি রকওয়াল, দাঁত বের করে হাসলেন। তার ডানের বাড়িটার বাসিন্দা, অভিজাত ক্লাবম্যান জী ভন শ্যুলাইট সাফোক-জোন্স, বাড়ির বাইরে দাঁড়ানো মোটর গাড়িটার দিকে আসতে আসতে বরাবরের মতোই অ্যান্থনির বাড়ির সামনের চাতালে দাঁড়িয়ে থাকা ইতালিয়ান রেনেসাঁ যুগের মূর্তিটার দিকে তাকিয়ে নাক কুঁচকালো।

“বেহদ্দ অকর্মার ধাড়ি!”, বলে উঠলেন প্রাক্তন সাবান সম্রাট। “সে এতো চিড়বিড় না করলে এই পুরনো পুডিং এর দলাটা এতদিনে ইডেন মিউজিয়ামে দিয়ে দিতাম। আসছে গরমেই বাড়িটাকে লাল, সাদা, আর নীল রঙ করাবো। দেখবো, এতে তার ডাচ নাক আরেকটু উপরে উঠে কিনা।”

তারপর বেল বাজানোর তোয়াক্কা না করেই অ্যান্থনি রকওয়াল লাইব্রেরীর দরজার কাছে গিয়ে হাঁক ছাড়লেন, “মাইক!” সেই গমগমে আওয়াজ যেটা এককালে ক্যানসাসের তৃণভূমির আকাশে টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়তো।

হাঁক শুনে যে বেয়ারাটা এলো তাকে অ্যান্থনি বললেন, “ছেলেটা বেরিয়ে যাওয়ার আগে দেখা করে যেতে বোলো।”

তরুণ রকওয়ালকে লাইব্রেরিতে ঢুকতে দেখে বুড়ো হাতের কাগজটা একপাশে সরিয়ে রাখলেন। বড়, মসৃণ, লাল মুখটাতে ফুটে উঠলো গাম্ভীর্যমাখানো স্নেহ। এক হাত দিয়ে সাদা চুলের গোছাগুলোকে এলোমেলো করে, আরেক হাত দিয়ে পকেটের চাবির গোছাটাকে নাড়িয়ে বলে উঠলেন, ‘রিচার্ড, সাবানের পেছনে ক্যামন খরচ হয় তোমার?”

রিচার্ড, যে কিনা সদ্য ছয়মাস হলো কলেজ থেকে বাড়িতে এসেছে, প্রশ্নটা শুনে একটু চমকে উঠলো। সে এখনো তার বাবাকে ঠিক বুঝে উঠতে পারেনি। বুড়োর মতিগতি ঠিক যেনো এখনো প্রথমবারের মতো পার্টিতে আসা কোনো বেসামাল তরুণীর মতো।

“একডজন ছয় ডলারের মতো হবে”।

“আর তোমার জামাকাপড়?”

“মোটের উপর ষাট ডলারের মতো হবে মনে হয়”।

ঘোষণার সুরে অ্যান্থনি বললেন, “তুমি একজন ভদ্রলোক, রিচার্ড”। “আমি এমনসব তরুণদের কথা শুনেছি যারা এক ডজন সাবানে চব্বিশ ডলার খরচ করে আর কাপড়চোপড়ের বেলায় তো একশো ছাড়িয়ে যায়। চাইলেই ওদের যে কারো মতো তুমি টাকা ওড়াতে পারতে, কিন্তু তুমি সেটা করোনি। এখনো আমি পুরনো ইউরেকা সাবান ব্যবহার করি – না, কোনো আবেগ থেকে নয়, বরং এটাই বাজারের সবচেয়ে বিশুদ্ধ সাবান বলে। একটা সাবানের জন্য যদি ১০ সেন্টের বেশী খরচ হয়, তাহলে বুঝতে হবে তুমি বাজে গন্ধ আর মোড়কের পেছনে অযথা টাকা নষ্ট করছো। কিন্তু, তোমার বয়েসের একজন অবস্থাপন্ন তরুণ হিসেবে প্রতি সাবানে ৫০ সেন্ট ঠিকই আছে। যাই হোক, বলছিলাম যে তুমি হচ্ছো একজন ভদ্রলোক। লোকে বলে, এক বংশে নাকি তিন পুরুষে একটা ভদ্রলোক জন্মায়। ওদের মাথা! টাকা থাকলেই সাবানের চর্বির মতো মসৃণভাবে ভদ্রলোক তৈরি হবে। যেমন হয়েছো তুমি। আমিও তো প্রায় হয়েই গেছিলাম। আমিও তো আমার প্রতিবেশী দুই ডাচ বুড়োর মতো প্রায় অভদ্র, অসহিষ্ণু, আর বদমেজাজি। এই দুই বুড়োতো রাতে ঘুমাতেই পারেনা, কারণ আমি ওদের বাড়ির মাঝখানে জেঁকে বসেছি”।

তরুণ রকওয়াল কিছুটা বিষণ্ণ স্বরে বললো, “কিছু জিনিস আছে যেটা টাকা দিয়ে পাওয়া যায়না”।

“কী যে বলো!” বিস্মিত অ্যান্থনি বলে উঠলেন। “আমি তো প্রতিবার টাকার উপরই বাজি ধরবো। এনসাইক্লোপিডিয়াতে ‘Y’ পর্যন্ত খুঁজেও তো এমন কিছু পেলামনা যেটা টাকা দিয়ে মেলেনা। সামনের সপ্তায় ওটার পরিশিষ্টটাও খুঁজে দেখবো, দেখি কিছু মেলে কিনা। দেখি, আমাকে এমন কিছুর নাম বলোতো যেটা টাকা দিয়ে কেনা যায়না”।

রিচার্ড একটু অসহিষ্ণু হয়ে জবাব দিলো, “টাকা দিয়ে তো অভিজাত সমাজের অংশ হওয়া যায়না”।

“ওহো, তাই বুঝি?”, গমগম করে উঠলো বুড়োর গলা। “একটু বলোতো কোথায় থাকতো তোমার এই অভিজাত সমাজ যদি প্রথম অ্যাস্টর সস্তা স্টিরেজের ভাড়াটা যোগাতে না পারতো?”

রিচার্ড দীর্ঘশ্বাস ফেললো।

বুড়ো এবার একটু সুর নরম করলেন, “আসলে এটা জানতেই তোমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম। দু-সপ্তা ধরেই খেয়াল করছি কিছু একটা হয়েছে তোমার। বলে ফেলো কী সমস্যা। দরকার হলে চব্বিশ ঘন্টার ভেতরে এগারো মিলিয়ন টাকা যোগাড় করে ফেলতে পারবো, জমিজমাগুলোর কথা তো বাদই দিলাম। আর যদি তোমার পিলের ব্যামো হয় তবে র্যাজম্বলার জাহাজটা বন্দরে তৈরিই আছে, দুদিনের ভেতর তোমাকে বাহামা নিয়ে যাবে”।

‘হুম, ভালোই অনুমান করেছো। প্রায় ধরে ফেলেছো ব্যাপারটা”।

“আহ”, অ্যান্থনি আগ্রহের সুরে জিজ্ঞেস করলেন, “নাম কী মেয়েটার?”

লাইব্রেরীর ভেতর পায়চারি করতে শুরু করলো রিচার্ড। বদমেজাজি বুড়ো বাপের গলায় সহানুভূতি আর বন্ধুত্বের আভাস পেয়ে তার আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছে।

“তাকে প্রস্তাব দিচ্ছোনা কেনো?”, বুড়ো এবার জানতে চাইলেন। “তোমার টাকা আছে, তুমি দেখতে ভালো, আর তাছাড়া তুমি একটা ভদ্র ছেলে। এই হাত দিয়ে তোমাকে ইউরেকা সাবানের ময়লাও ঘাঁটতে হয়নি। তুমি কলেজেও গিয়েছো, যদিও মেয়েটা সেটা পাত্তা দেবেনা”।

রিচার্ড বললো, “আমি তো সুযোগই পাইনি তাকে বলার”।

"তাহলে সুযোগ বানিয়ে নাও। তাকে নিয়ে পার্কে বেড়াতে যাও, স্ট্র রাইডে যাও, নতুবা চার্চ থেকে বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দাও। সুযোগ! হাহ!”
“তুমি সমাজের রীতিনীতি কিচ্ছু জানোনা, বাবা। সে এমন একটা অবস্থার মধ্যে আছে যেখানে তার প্রত্যেকটা ঘণ্টা, মিনিটের কাজ আগে থেকে ঠিক করা। আমার ওকে পেতেই হবে, বাবা, নতুবা এই শহর চিরদিনের জন্য আমার কাছে একটা বদ্ধ জলাভূমি হয়ে যাবে। আর সেটা আমি সইতে পারবোনা”।

“ছোহ! তুমি বলছো যে আমার যত টাকা-পয়সা আছে তা দিয়ে তোমার জন্য ওই মেয়ের কাছ থেকে একটা বা দুটো ঘণ্টা পেতে পারবোনা?”

“আমি খুব বেশী দেরি করে ফেলেছি। পরশু দুপুরেই সে দুই বছরের জন্য ইউরোপ চলে যাচ্ছে। আগামীকাল বিকেলে মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য তার সাথে দেখা হবে। সে এখন লার্চমন্টে তার খালার সাথে আছে, কিন্তু আমি সেখানে যেতে পারবোনা। আগামীকাল বিকেলে সাড়ে আটটার ট্রেনের সময় একটা ক্যাব নিয়ে গ্র্যান্ড সেন্ট্রাল স্টেশানে তার সাথে দেখা করতে পারবো। ওখান থেকে একটানে ব্রডওয়ে দিয়ে চলে যেতে হবে ওয়ালাক্স থিয়েটারে। ওখানকার লবিতে ওর মা আর একটা বক্স পার্টী আমাদের জন্য অপেক্ষা করবে। তুমি কি মনে করো এতসব ঝামেলা মাথায় নিয়ে এই অল্প সময়ের মধ্যে ও আমার কথা আদৌ শুনবে? না! আর থিয়েটারের মধ্যে অথবা পরে তো কোনো আশাই নেই। না বাবা। এই সমস্যার জট তোমার টাকা দিয়ে ছাড়ানো যাবেনা। টাকা দিয়ে আমরা একটা মিনিটও কিনতে পারবোনা। তাই যদি হতো, তবে ধনী লোকেরাই সবচেয়ে বেশীদিন বাঁচতো। জাহাজ ছাড়ার আগে মিস ল্যান্ট্রির সাথে একান্তে আলাপ করার কোনো সুযোগই নেই”।

“ঠিক আছে বাছা”, উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠলেন অ্যান্থনি, “তুমি এখন যাও”। আমি খুশী হয়েছি যে তুমি পিলের অসুখে ভুগছো না। তবে সময়ে অসময়ে বাবা ‘কড়িনাথের’ দরবারে কিছু আগরবাতি ঠ্যাকাতে ভুলোনা। তুমি বলছো যে টাকা দিয়ে সময় কেনা যায়না? হ্যাঁ, এটা অবশ্য আশা করা যায়না যে কড়ি ছাড়লেই কেউ সময়কে একটা বাকশোতে পুরে তোমার দুয়ারে এসে ফেলে যাবে। কিন্তু সময় বাবাজী যখন সোনার খনির মাঝ দিয়ে হেঁটে যেতো, তখন তার পায়ে খুব বাজে কড়া পড়তে দেখেছি”।

সে রাতে এলেন আন্টি তার ভাইয়ের সাথে দেখা করতে এলেন। নম্র, আবেগী, বিষণ্ণ, বুড়িয়ে যাওয়া মহিলাটি সম্পদের ভারে চাপা পড়ে আছেন। তিনি এসে অ্যান্থনির সাথে কপোত-কপোতীদের হৃদয়ের হাহাকার নিয়ে লম্বা আলোচনা ফেঁদে বসলেন।

অ্যান্থনি হাই তুলতে তুলতে বললেন, “সে আমাকে সবকিছুই বলেছে। আমি বলেছি আমার ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট তৈরিই আছে। কিন্তু, তখনি সে বেঁকে বসলো। টাকা দিয়ে নাকি কিছু হবেনা। দশজন লাখপতিও নাকি সমাজের রীতিনীতি একচুল এদিক ওদিক করতে পারবেনা”।

“আহ, অ্যান্থনি”, এলেন আন্টি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, ‘তুমি এতো টাকা টাকা করো কেনো? সত্যিকার ভালোবাসার কাছে টাকা কিছুইনা। আফসোস, সে যদি আর কিছুদিন আগে মেয়েটির সাথে কথা বলতো! সে আমাদের রিচার্ডকে ফেরাতে পারতোনা। কিন্তু, এখন ভয় হচ্ছে যে খুব বেশী দেরি হয়ে গেছে। মেয়েটিকে এখন আর বলার কোন সুযোগ নেই। তোমার সব ধন-সম্পদ দিয়েও তোমার ছেলেকে সুখি করতে পারবেনা”।

পরদিন বিকেল আটটা বাজে এলেন আন্টি ঘুণে খাওয়া একটা বাকশো থেকে পুরনো দিনের খুব সুন্দর একটি সোনার আংটি বের করলেন । “আজ রাতে এটা পরিস বাবা”, অনুনয় করলেন তিনি, “তোর মা এটা তোকে দিতে বলেছিলো যদি তুই তোর পছন্দের মানুষকে খুঁজে পাস। এটা প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য সৌভাগ্য বয়ে আনে”।

তরুণ রকওয়াল খুব সমীহের সাথে আংটিটা নিয়ে তার কড়ে আঙুলে পরার চেষ্টা করলো। কিন্তু প্রথম দুটো কড়ার পরে আর ঢোকানো গেলোনা। অগত্যা ওটা নিয়ে ভেস্টের পকেটে রেখে দিলো সে। তারপর ক্যাবের জন্য ফোন করলো।

স্টেশানে হুল্লোড়রত মানুষের দঙ্গল পেরিয়ে আটটা বত্রিশে মিস ল্যান্ট্রির দেখা পেলো রিচার্ড। দেখা হতেই সে বললো, “মা আর অন্যদের অপেক্ষা করিয়ে রাখা ঠিক হবেনা”। অনুগত রিচার্ড সাথে সাথে কোচোয়ানকে বললো, “ওয়ালাক্স থিয়েটারের দিকে হাঁকাও যত তাড়াতাড়ি পারো”।

চল্লিশ সেকেন্ডের মতো ব্রডওয়েতে ঘুরপাক খেয়ে ওরা এসে পড়লো সাদা তারাখচিত গলিটাতে, যেটা সূর্যাস্তের নরম উপত্যকা থেকে সোজা চলে গেছে সকালের পাথুরে পাহাড়ের দিকে।

৪২ নম্বর রাস্তায় এসে রিচার্ড ক্যাবের গায়ে ধাক্কা দিয়ে কোচোয়ানকে থামতে বললো। নেমে যেতে যেতে ক্ষমা প্রার্থনার সুরে বললো, “আমার আংটিটা পড়ে গেছে। এটা আমার মায়ের। এক মিনিটের বেশী লাগবেনা, আমি দেখেছি এটা কোথায় পড়েছে”।

এক মিনিটের আগেই সে আংটিটা নিয়ে ক্যাবে ফিরে এলো।

কিন্তু সেই এক মিনিটের মধ্যেই একটা গাড়ি সোজা তাদের ক্যাবের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেছে। কোচোয়ান বাঁদিক দিয়ে বেরোতে চাইলো কিন্তু একটা মালটানা ওয়াগন সেদিকটা বন্ধ করে রেখেছে। ডানদিক দিয়েও পারা গেলোনা একটা আসবাবপত্র বোঝাই ভ্যানের জন্য, যেটার কিনা ওখানে দাঁড়িয়ে থাকার কোনো কারণই ছিলোনা। পেছনদিক দিয়ে সরতে গিয়েও হাতের লাগামটা ফেলে দিয়ে সে বিড়বিড় করে গালি দিয়ে উঠলো। ঘোড়া আর গাড়ির একটা বিশ্রী জ্যামের মাঝে ক্যাবটা আটকে গেছে।

মিস ল্যান্ট্রি অধৈর্য হয়ে বললো, “আমরা যাচ্ছিনা কেনো? দেরি হয়ে যাবে তো”।

রিচার্ড দাঁড়িয়ে চারপাশে চোখ বুলালো। চারদিক থেকে বন্যার মতো ওয়াগন, ট্রাক, ক্যাব, ভ্যান, আর কারগুলো এই তেরাস্তার মাথায় এসে গুঁতোগুঁতি করছে। মনে হচ্ছে যেনো ম্যানহাটনের সমস্ত ট্র্যাফিক এই রাস্তায় এসে থেমে গেছে। হাজার হাজার পথচারী রাস্তার দুপাশে দাঁড়িয়ে এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখতে লাগলো।

দাঁড়ানো থেকে আবার বসে পড়লো রিচার্ড। “আমি খুব দুঃখিত। কিন্তু, মনে হচ্ছে আমরা এখানে আটকা পড়েছি। এক ঘন্টার আগে এই জ্যাম ছুটবেনা। এটা সম্পূর্ণ আমার দোষ। যদি আংটিটা না পড়তো...”

“দেখিতো আংটিটা”, বলে উঠলো মিস ল্যান্ট্রি, “এখনতো আর কিছু করারও নেই। তাছাড়া এমনিতেও থিয়েটার আমার ভালো লাগেনা”।

********************

সেদিন রাতের এগারোটা বাজে কেউ একজন অ্যান্থনি রকওয়ালের বাড়ির দরজায় আলতো করে টোকা দিলো।

একটা লাল ড্রেসিং গাউন পরে জলদস্যুদের রোমাঞ্চকর কাহিনী পড়ছিলো তখন বুড়ো। “ভেতরে এসো”, চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
ধীর পায়ে এসে ঢুকলেন এলেন আন্টি। তাকে দেখাচ্ছিলো একটা ধূসর-চুলো দেবদূতের মতো, যে কিনা ভুল করে এই মাটির পৃথিবীতে চলে এসেছে।

“ওরা বাগদান সেরে ফেলেছে, অ্যান্থনি”, নরম সুরে বললেন তিনি, “মেয়েটা আমাদের রিচার্ডকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে। তারা থিয়েটারে যাওয়ার পথে রাস্তায় দু-ঘন্টার জন্য জ্যাম লেগে গিয়েছিলো”।

‘ও হ্যাঁ, অ্যান্থনি ভ্রাতা, আর কখনো টাকার বড়াই কোরোনা। একটুখানি সত্যিকার ভালোবাসার প্রকাশ আর একটি অপার্থিব ভালোবাসার প্রতীক ছোট্ট একটি আংটিই যথেষ্ট ছিল রিচার্ডের জন্য। ওর আংটিটা রাস্তায় পড়ে যায়। ওটা কুড়িয়ে নিয়ে ক্যাবে ফেরার আগেই রাস্তায় লেগে যায় ওই বিশাল হট্টগোল। সেই অবসরে সে মেয়েটাকে তার মনের কথা খুলে বলে। মেয়েটাও রাজি হয়। সত্যিকার ভালোবাসার কাছে টাকা কিছুইনা, অ্যান্থনি”।

“ঠিক আছে’, বলে উঠলেন বুড়ো অ্যান্থনি, “আমি খুশী যে ছোকরা যা চেয়েছিলো তাই পেয়েছে। আমি ওকে বলেছিলাম যে এই ব্যাপারে যা লাগে আমি তাই দেবো যদি...”

“কিন্তু অ্যান্থনি, টাকা দিয়ে কী করতে পারতে তুমি?”

‘দেখো, ভগিনী”, অ্যান্থনি রকওয়াল বললেন, “আমার জলদস্যুটা খুব শোচনীয় অবস্থায় পড়েছে। এইমাত্র তার জাহাজটা ডুবে গেছে, কিন্তু সে টাকার খুব ভালো সমঝদার বলে এটাকে এতো সহজে ডুবতে দেবেনা। আশা করি তুমি আমাকে এই অধ্যায়টা শেষ করতে দেবে”।

********************

গল্পটা এখানেই শেষ হওয়া উচিৎ ছিলো। আমার মনে হয় পাঠকরাও এখানেই সমাপ্তি আশা করছেন কিন্তু সত্যিটা জানতে হলে আপনাদের শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে।

********************

পরেরদিন নীল ফুটিওয়ালা নেকটাই পরা কেলি নামের একলোক অ্যান্থনি রকওয়ালের বাড়িতে প্রবেশ করলো। প্রায় সাথে সাথেই লাইব্রেরিতে ডাক পড়লো তার।

“সাবানের ভালো একটা বিজ্ঞাপন ছিলো এটা”, চেকবইটা নিতে নিতে বললেন অ্যান্থনি, “দেখা যাক – তোমাকে দিয়েছিলাম নগদ পাঁচ হাজার ডলার”।

“আমাকে আরও তিনশো ডলার নিজের পকেট থেকে গুনতে হয়েছে”, বলে উঠলো কেলি। “মালটানা ওয়াগন আর ক্যাবগুলো প্রতিটা পাঁচ ডলারে হয়ে গিয়েছিলো কিন্তু ট্রাক আর দুই ঘোড়াটানা গাড়িগুলোর জন্য দশ করে লেগেছে। কোচোয়ানদের দিয়েছি দশ করে আর কিছু মালবোঝাই গাড়ির জন্য বিশ ডলার, কিন্তু পুলিশগুলো একেবারে মেরে দিয়েছে – দুজনকে দিয়েছি পঞ্চাশ করে আর বাকি দুজনকে বিশ আর পঁচিশ ডলার। কিন্তু, চরম একটা কাজ হয়েছে এটা, তাই না, মিস্টার রকওয়াল? আমি খুশী যে রাস্তায় মঞ্চস্থ হওয়া এই গাড়ির হট্টগোলের দৃশ্যের মধ্যে উইলিয়াম এ. ব্র্যাডি ছিলোনা। সে ব্যাটা তো হিংসায় হার্টফেল করে মরতো। কোনো রিহার্সেল ছাড়াই, ভাবতে পারেন? ছেলেগুলো একদম কাঁটায় কাঁটায় ওখানে পৌঁছে গেছিলো। আর ঘণ্টা দুয়েকের আগে তো গ্রিলির মূর্তির নিচ দিয়ে একটা সাপেরও গলবার জো ছিলোনা”।

“এই নাও কেলি, তেরশো ডলার”, একটা চেক কাটতে কাটতে বললেন অ্যান্থনি। “তোমার একহাজার আর বাড়তি খরচ হওয়া তিনশো ডলার। তোমার নিশ্চয়ই নগদ নারায়ণে কোনো অরুচি নেই?”

“অরুচি!” বিস্মিত শোনালো কেলির কণ্ঠ। “যে ব্যাটা দারিদ্র্য আবিষ্কার করেছে তাকেও আমি সেলাম ঠুকতে পারবো”।

কেলি দরজার কাছে যেতেই অ্যান্থনি আবার তাকে ডাকলেন। “আচ্ছা, এই হট্টগোলের মাঝে কোথাও কি হাতে তীর-ধনুক ধরা একটা পেটমোটা ন্যাংটো ছেলেকে দেখেছো?

“নাতো!”, হতভম্ব দেখালো কেলিকে, “মনে হয় আমি যাওয়ার আগেই পুলিশ সরিয়ে নিয়ে গেছিলো”।

“আমিও ভেবেছিলাম ওই একরত্তি বদমাশটা ওখানে থাকবেনা”, মুখ টিপে হাসলেন অ্যান্থনি। “ঠিক আছে। তুমি এখন যাও”।

---------------


মন্তব্য

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

সচলায়তনে স্বাগতম। অনুবাদে আপনার আগ্রহ দেখে ভালো লাগছে - আশা করি আপনার কাছ থেকে আমরা ভালো ভালো অনুবাদ পাবো।

অনুবাদ বেশ প্রাঞ্জল হয়েছে। তবে আমার কাছে কথোপকথনের অংশগুলোকে আক্ষরিক অনুবাদ মনে হলো, এগুলো একটু ভাবানুবাদ করলে আরো অনেক ঝরঝরে লাগতো। এছাড়া বাকী অংশ চমৎকার লেগেছে।

আরো লিখতে থাকুন।

____________________________

রেহানা আক্তার  এর ছবি

আসলে একটু দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিলাম আক্ষরিক নাকি ভাবানুবাদ করবো। আপনার পরামর্শের জন্য ধন্যবাদ। হাসি

রেহানা আক্তার

অতিথি লেখক এর ছবি

ও হেনরির লেখা ভালো লাগে, খুব বেশি পড়িনি। পাঠ্যের বাইরে কয়েকটা গল্প পড়েছি কেবল। লোকটার টুইস্ট এক কথায় অসাধারণ।

আরও লিখুন, ভালো থাকুন।
শুভেচ্ছা হাসি

[মেঘলা মানুষ]

এক লহমা এর ছবি

ভালো গল্প বেছেছেন। লেখালেখি চলুক। আস্তে আস্তে জড়তা কেটে যাবে, আশা করি।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

একটু জড়তা আছে মনে হলো। লাইব্রেরি না লিখে পাঠাগার লিখতে পারেন। অনুবাদ চলুক

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রেহানা আক্তার এর ছবি

সবাইকে ধন্যবাদ। হাসি

- রেহানা আক্তার

সাফিনাজ আরজু এর ছবি

আরও লিখুন, লিখতে লিখতেই লেখা সাবলীল হয়ে যাবে। হাসি
সচলে স্বাগতম।

__________________________________
----আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে---

রেহানা আক্তার এর ছবি

হাসি

- রেহানা আক্তার

অতিথি লেখক এর ছবি

আরো অনেক অনেক লেখো, রেহানা। এই তো শুরু।

- ফরহাদ হোসেন মাসুম

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।