শেষ যুদ্ধ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০২/২০১৪ - ২:৫৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমার লেখা এক পর্ব "মাসুদ রানা"
মন চাইলে পড়তে পারেন...

গাড়ির জানালার বাইরে একটা বাচ্চা মেয়ে ফুল হাতে দাঁড়ানো। মেয়েটা দেখতে খুব মিষ্টি। হাসলে গালে টোল পড়ে। হাসিমাখা মুখেই সে হাতে ধরা গোলাপের তোড়া রানার সামনে বাড়িয়ে ধরে। মুচকি হেসে রানা ২ টা গোলাপ নেয়। ২০ টাকার নোট টা হাতে ধরিয়ে দিতেই বাচ্চা মেয়েটা দৌড়ে পেছনের গাড়ির দিকে চলে যায়। রানা ফুলগুলো রাখে তার গাড়ির ড্যাসবোর্ডে। সিগনাল ছাড়তেই আর্মি ইন্টেলিজেন্সের জীপটা আগে বাড়ে। মেজর মাসুদ রানা কালো সানগ্লাসটার ভেতর থেকে ড্যাসবোর্ডে রাখা ফুলগুলোর দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে গাড়ি চালাতে থাকে। গাড়ি যাচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের দিকে।

সন্ধ্যার আলো ফিকে হয়ে পড়েছে ছোট রাস্তায় । ছিমছাম ছোট শহুরে রাস্তায় এই সন্ধায় ভিড় নেই তেমন। রানা দাঁড়িয়ে আছে এই রাস্তার পাশে একটা ছোট চায়ের দোকানের সামনে। তার পরনের সাধাসিধা পোশাকে তাকে দেখাচ্ছে মফঃস্বল শহরের ছোটখাটো ব্যাবসায়ীর মত। এ্যাকশান ব্যাটেলিয়ানের সেকেন্ড ইন কমান্ড কর্নেল মাসুদ রানা নিজেই ফিল্ড অপারেশনে মাঝে মাঝে এমন সিভিল ক্যামোফ্লোজে নেমে পড়ে। কাজটা সে করে নিষ্ঠা থেকে, আর এ্যাকশানের উত্তেজনা টা তার বাড়তি পাওয়া। দেশে জংগী হুমকী আর বোমা সন্ত্রাস মাত্রা ছাড়িয়ে বিভীষিকায় পৌছে যাবার পর রানাকে যখন এ্যাকশান ব্যাটেলিয়ানে পোস্টিং করা হয়, রানা হাঁফ ছেড়েছিল। অনেক হয়েছে ইন্টেলিজেন্সের রিসার্চ সেলের কাজ। সে মনে প্রানে একজন যোদ্ধা। কত আর ভালো লাগে চার দেয়ালের ভেতর কাজ করতে। তার আসল স্থান যুদ্ধের ময়দান। আপাতত হোক না সেটা জংগীদের নির্মূল করার যুদ্ধ। রানা কমান্ড পোস্টে বসে অর্ডার করার চেয়ে আর্মস হাতে শত্রুর সামনে দাড়াতে বেশী পছন্দ করে।

আপাতত রানা ছদ্মবেশে রেকী করতে এসেছে সিলেটের এই ছোট্ট আবাসিক এলাকায়। এই রাস্তায় চায়ের দোকান থেকে ৪ টা বাড়ি পরে হাতের ডানের দোতলা বাড়িটায় নাকি গত ৪ মাস ধরে লুকিয়ে আছে মোস্ট ওয়ান্টেড জংগী নেতা । ৭ মাসের কঠিন ইনভেস্টিগেসন শেষে রানা জাল গুটিয়ে এনেছে। খবর পাকা। আজ রেকি করে সব ঠিক থাকলে আগামীকাল ভোরেই ফুল ফ্লেজেড অপারেশনে যাবে।

রানার পাশে কাঠের টুলে পা তুলে লুঙ্গি গুটিয়ে শব্দ করে চা খাচ্ছে এক দোহারা গড়নের যুবক রিকশাওয়ালা। চা খেতে খেতে যুবক আড়চোখে তাকায় বিশেষ সেই বাড়িটার গেটে। এক টুপি পাঞ্জাবী পরা যুবক বড় ২টা সিল্ভারের টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে গেট দিয়ে বের হয়ে উলটো দিকে হেটে যায়। যুবক সন্ত্রস্ত চেহারায় একবার পিছে তাকিয়ে রাস্তাটা দেখে। রিকশাওয়ালা যুবক দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। হাতের চায়ের কাপ বেঞ্চে রেখে যুবক আপন মনেই বলে

- আইজকা আর ক্ষ্যাপ টানুম না। রাইতের ভাত খাওয়ার যোগার হইতাসে।

রিকশাওয়ালার কথাটা রানা কান খাড়া করে শোনে। কথাটা একটা কোডেড ম্যাসেজ। জংগী নেতা আজ আর বাড়ির বাইরে যাবে না, রাতের খাবার আসছে। রিকশাওয়ালার ভুমিকায় মেজর আসাদ ভালোই এক্টিং করছে। টানা ৪ দিন রিকশা চালাচ্ছে বেচারা। আসলে রানা নিজে ফিল্ড অপারেশন কমান্ড করবে জানার পর হাসি মুখেই সে রানাকে এসিস্ট করতে রাজি হয়েছে। ইউনিটের অন্য মেজর আর ক্যাপ্টেনরা অবশ্য আড়ালে বলাবলি করছিল

" কি দরকার কর্নেল স্যারের নিজে অপারেট করার? ফিল্ড ইউনিট তো ইন্টেল কালেক্ট করেছেই। যাস্ট টাইম্লাইন ফিক্স করে ফোর্স প্যানিট্রেট করে "ভালচার" কে ক্যাপচার করলেই তো হয়। শুধু শুধু হায়ার অফিসারদের ইনভল্ব না হলেই তো ভালো। ইদার হি ইজ আ ফ্রিক ওর অ্যান অ্যাটেনশান সিকার।"

আসাদ বলেছিল

-রানা স্যার ইজ যাস্ট সিন্সিয়ার টু হোয়াট হি ডাজ। হি ডাজন্ট ওয়ান্ট টু কিপ এনি চান্স অফ এরর।

টানা ৩২ ঘন্টার ফুলস্কেল অ্যাসল্ট অপারেশন শেষে "ভালচার" এখন রানার হাতে বন্দী। সারাদেশের মিডিয়া পাগলের মত উতসুক হয়েছিল এই অপারেশনটার দিকে। টিভির সামনে বসে মানুষের বিশ্বাস হচ্ছিল না এই ভয়ংকর জংগী নেতাকে গ্রেফতার করার কাজটা আদৌ সম্ভব হবে কিনা। এই লোক ইতিমধ্যেই আত্মঘাতি বোমাহামলার মহড়া দেখিয়েছে। তার অনুসারী আত্মঘাতী সন্ত্রাসী জংগীর প্রকৃত সংখ্যা কেউ জানেনা। তাকে ধরতে গেলে ঠিক কি ধরনের প্রতিরোধ করা হবে তা নিয়েও ছিল নানান জল্পনা কল্পনা। যাকে নিয়ে এত আশংকা, সেই জংগী নেতা এখন পেছনে হাতকড়া পরা, রানার মুখোমুখি হেলিকপ্টারে বসে আছে। জংগী নেতার লাল দাড়ি বাতাসে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। নার্ভ ঠান্ডা রেখে ৩২ ঘন্টা অপারেশন করে একে ধরে রানার এখন কেমন জানি অবসাদ লাগছে। যদিও এটা ঠিক যে একে জুরিডিকশান শেষে পানিশ করার আগ পর্যন্ত তার রেস্পন্সিবিলিটি, তবুও রানা একটু কৌতুক করার লোভ সামলাতে পারলো না।

- কী হুজুর !! আপনার লোকজনের রকেট লাঞ্চার নাই ? হেলিকপ্টার এ্যাটাক করে আপনাকে ছাড়ায়ে নিবেনা ??

সাপের মত হিশহিশে ঠান্ডা গলায় লোকটা বলে

- আপনি আমারে ধরে কাজটা ভালো করেন নাই

- কেন ? আমার অনেক গুনাহ হইসে ?? হা হা হা

- আমার হাত অনেক লম্বা কর্নেল সাহেব। আপনাকে অনেক বড় দাম দিতে হবে আজকের এই কাজের জন্য

- আমি বেশি বেতন পাইনা, দামটা কিস্তি তে দিলে চলবে ??

হেলিকপ্টারের পাইলট হেসে ফেলে। ঘাড় ঘুরিয়ে একরোখা এই কর্নেলকে একবার দেখে। লোকটা আসলেই একটা হিরো। নার্ভ কি পরিমান শার্প। প্রশংসা করার লোভ সামলাতে পারে না পাইলট , বলে

- স্যার ইউ হ্যাভ আ গুড সেন্স অফ হিউমার

- সামনে তাকিয়ে চালান ক্যাপ্টেন রুম্মান, রিকশার সাথে লাগায়ে দিবেন

কপ্টারে বসা এ্যাকশান ব্যাটেলিয়ানের সবাই হেসে উঠে এই কথায়। দীর্ঘ অপারেশনের ক্লান্তি, মোস্ট ওয়ান্টেড মিলিটেন্ট এর অ্যাস্কর্ট হবার টেনশান সব কেটে পরিবেশ হাল্কা হয়ে যায়। শুধু জংগী নেতা ঠান্ডা চোখে তাকিয়ে দেখে রানাকে। কোন ধাতুতে তৈরী এই কর্নেল ? এর কি ভয় ডর নাই ?

আবার হেলিকপ্টা্রে, গন্তব্য মুক্তাগাছা।

রানা উত্তেজনায় বসে বসে হাত কচলাচ্ছে। সময় এক ধীর গতিতে কেন যাচ্ছে ? সকালেই যখন ওয়্যারলেসে ম্যাসেজ পেয়েছে জংগী দলের সবচেয়ে নটোরিয়াস মিলিট্যান্ট সেকেন্ড ইন কমান্ড এর স্ত্রী কে ক্যাপচার করা হয়েছে তখন থেকেই রানার উত্তেজনা তুঙ্গে। "হায়না" কে ধরার কাজটা তাহলে আজকেই ঘটতে যাচ্ছে ? হেলিকপ্টারে উঠেই খবর পেয়েছে "হায়না" কে ট্রেস করা গেছে মুক্তাগাছায়। অপারেশান শুরু করার জন্য রানার ভেতরে রক্ত বল্কে উঠছে ।

২ ঘন্টা পর।

রানা একটা মেহেগনি গাছের আড়াল থেকে একটু উকি মেরে সামনে দেখে। সাম্নের টিনশেড দোচালা ঘরটা শুনশান । যেন কোথাও কেউ নেই। দুই হাতে শক্ত করে চেপে ধরা নাইন এম এম পিস্তল টা খাড়া করে ধরে রানা পেছনে ক্রল করে আগাতে থাকা সোলজারদের ইশারা করে। এ্যাকশান ব্যাটেলিয়ানের পুরো দুটা ইউনিট ফুল অ্যাসল্ট প্রপারেশনে আছে। কিন্তু রানার ভয় পুলিশ ফোর্স কে নিয়ে। পুলিশের যেই ইউনিট এই অপারেশনে ইনভল্ব তারা এই ধরনের অ্যাসল্ট অপারেশন করার জন্য ওয়েল ট্রেইন্ড না। মিলিট্যান্ট "হায়না" খুব ই সাংঘাতিক। রানা কোন চান্স নিতে চায় না। এই জংগী আফগানিস্তানে রিয়েল ব্যাটেল ফিল্ডে তালেবানদের হয়ে যুদ্ধ করে এসেছে। একে অক্ষত অবস্থায় ক্যাপচার করা মুস্কিল হবে।

সোলজারদের একটা ছোট দল একটু সামনে বাড়তেই টিনশেড বাড়ির ভেতর থেকে সাবমেশিন গানের একটা গুলি আসে। রানার বাম পাশে উচু ঢিবির আড়ালে থাকা এক পুলিশ সদস্যের পায়ে লাগে গুলিটা। চকিতে তার পাশে থাকা অন্য পুলিশরা তাকে টেনে পেছনে সরিয়ে নেয়। রানা সিগনাল দেয় ফায়ার ওপেন করার। এক যোগে বেশ কয়েকটা ভারি আর্মসের গুলি ছুটে যায় টিনশেড ঘরটার দিকে। গুলির শব্দে নরক ভেংগে পড়ে। ওদিক থেকেও রিপ্লাই আসে। এক্টাই সাবমেশিঙ্গান থেকে। সোলজারদের ছোট দল্টা ক্রল করে আরো সামনে বাড়তে চাইলে রানা পেছন থেকে থামতে বলে। তার ভয়, "হায়না" গ্রেনেড চার্জ করতে পারে। আশংকাটাকে সত্যি প্রমান করতেই যেন বিকট শব্দে বিষ্ফোরন হয়। না গ্রেনেড না। বোম্ব বার্স্ট হয়েছে। টিনশেডের চাল উড়ে গেছে। দুমড়ে মুচড়ে গেছে পুরো ঘরটাই। তাহলে কি "হায়না" সুইসাইড বোম্ব ফাটালো ? এত কাছে এসেও কি তাকে জীবিত ধরা গেলনা ? রানা সেফটি ভুলে উঠে দৌড় দেয়। ভরসা বলতে মাথায় হেল্মেট আর বুকে বাধা বুলেটপ্রুফ জ্যাকেটটা। ওদিক থেকে ফায়ার হলে রানা পুরো অসহায়। "হায়না"র সাথে আরো কেউ থাকতে পারে, তাঁদের মধ্যে জীবিত কেউ গুলি করতে পারে এই চিন্তা তার মাথায় নেই। তার একটাই চিন্তা। সারা দেশে ত্রাস সৃষ্টিকারী মিলিট্যান্ট "হায়না" কে তার ধরতে হবে।

না । হায়না মরে নি। বোম্ব সে ফাটিয়েছিল ঠিকই, তবে তাতে মরে যাবার ইচ্ছা থাকলেও সে ইচ্ছা পূরণ হয় নি। রানা লাথি মেরে টিনের টুকরা সরিইয়ে দেখে মোটাসোটা রক্তাক্ত হায়না এক হাতে সাবমেশিঙ্গান ধরে আছে। তার শরীরের অনেকখানি বোমায় ঝলসে গেছে। ডান হাত ক্ষত বিক্ষত। চুল , দাড়ি পুড়ে গেছে কোথাও কোথাও। রানা চোখ বন্ধ করে বড় একটা শ্বাস নেয়। যাক। ধরা গেল "হায়নাকেও" এবং জীবিতই ধরা গেল।

টেবিলের উলটা পাশে যিনি বসে আছেন তার বসার ভংগীতে একটা হতাশ ভাব। কিন্তু মানুষটা মোটেই সাদামাটা নন। পোড়খাওয়া রাজনীতিবিদ। মন্ত্রী ছিলেন, সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দলের নীতি নির্ধারকদের একজন। মানুষটাকে দেখে রানা ভাবে, এই লোকগুলার হাতেই ওলট-পালট হয় ১৬ কোটি মানুষের ভাগ্য। রাজনীতির মঞ্চে কত বড় বড় কথাই না বলেন। কিন্তু এখন এই জয়েন্ট ইন্টারোগেশন সেলে তাকে দেখাচ্ছে ভেজা বিড়ালের বাচ্চার মত চুপসে যাওয়া। রানা তার দিকে বিস্কুটের প্লেট এগিয়ে দিয়ে বলে

- স্যার বিস্কুট নেন

- জী না , স্যার । আমার ডায়াবেটিস। ( ভয়ের চোটে প্রাক্তন মন্ত্রী রানাকে স্যার ডাকছে, রানা মুখের সামনে হাত দিয়ে হাসি চাপে।)

- খান, এটা ডায়াবেটিক বিস্কিট

- একটু পানি খাব।

এক সিভিল ড্রেসের সোলজার এসে টেবিলে এক বোতল পানি রেখে যায়। প্রাক্তন মন্ত্রী ঢকঢক করে পানির বোতল অর্ধেক খালি করেন। রানা টেবিলে কলম ঠুকে বলে

- তাহলে আমরা আবার কাজের কথায় আসি। বলেন সাহাবাগের বাসে গান পাউডার ছিটিয়ে মানুষ মেরেছিল কে ? আইডিয়াটা কার ?

টেপ রেকর্ডারের রেকর্ড বাটন চাপ দিয়ে পাশে বসা ক্যাপ্টেন মন্ত্রী সাহেবের মুখের সামনে ধরে। মন্ত্রী সাহেবের ভীত চেহারায় বাড়তি ভীতি যোগ হয়। রানা চোয়াল শক্ত করে, তার মনে একটা চাপা রাগ ফুসতে শুরু করে। আমতা আমতা করে মন্ত্রী আগের আঊরে যাওয়া মিথ্যা কথা গুলাই বলার চেষ্টা করে ভাংগা গলায়

- আমি আসলে কিছু জানিনা স্যার। এই ডিসিশান কোন ফোরাম থেকে নেয়া হয়েছে। আমি ডেস্ট্রাকশানের পলিটিক্সের সংগে নাই... আমি

- শাটাপ !

টেবিলে একটা কিল মেরে রানা মাথাটা মন্ত্রীর আরো কাছে এগিয়ে আনে, টেবিলের মাঝামাঝি। ঠান্ডা শক্ত গলায় রানা চিবিয়ে চিবিয়ে বলে

- আপনার পজিশন রেস্পেক্ট করে আমি সফটলি জিজ্ঞেস করছি। বারবার মিথ্যা বলে আমাকে হার্ড লাইনে যেতে বাধ্য করবেন না। আমার কাছে সব ইনফরমেশন আছে, আপনি আর কে কে এই ইন্সিডেন্টের জন্য রেস্পন্সিবল । আপনি কি ভেবেছেন ? আপ্নারা পোকা মাকড়ের মত মানুষ মারবেন আর কেউ সেটার খবর রাখবে না ? আপনাদের এথিক্স না থাকতে পারে, আমাদের আছে। আপনাদের পেট থেকে টেনে সত্যটা বের করতে আমার ২ মিনিট লাগবে। যাস্ট প্রসেস টা রেস্পেক্টফুল না। ওকে ? নিন শুরু করুন। কে কে ছিল এই প্ল্যানিং এ ??

প্রাক্তন মন্ত্রী তীব্র আতংক নিয়ে রানার দিকে তাকানোর চেষ্টা করে। টেবিলের উপর থেকে ঝুলতে থাকা বাতিটার আলো রানার ওপরে পড়ে নি তাই তিনি তার মুখ দেখতে পান না। কিন্তু পেটানো বলিস্ট অবয়বটা তার মনের ভীতি বাড়াতেই থাকে। মনে মনে রাজনীতিবিদ ভাবেন এই লোকের সামনে তার মিথ্যা বেশিক্ষন টিকবে না। একে হাত করারও কোনো উপায় তিনি দেখছেন না। ভেঙ্গে পড়াটা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার মাত্র।

অফিসার্স মেসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে রানা হাতের চায়ের কাপে আনমনে একটা চুমুক দেয়। মেসের সামনের বাগানে মালি পানি দিচ্ছে । শেষ বিকালের আলোয় দৃশ্যটা রানার চোখে মায়াময় লাগে। হঠাত করেই রানার নিজের দেশটার জন্য একটা তীব্র মায়াবোধ এর অনুভুতিতে মন ছেয়ে যায়। দেশটা গরীব হলেও কত সুন্দর। মানুষগুলো প্রতিনিয়ত কষ্ট করে যাচ্ছে একটু ভালো থাকার আশায় । কত অভাব তবুও মানুষগুলোর কোনো অভিযোগ নেই। খাদ্য ঘাটতি যদিও বা একটু পুষিয়ে এসেছে, কিন্তু শিক্ষা , চিকিতসায় এখনো কত পিছিয়ে। আর এই মানুষ গুলোকে নিয়ে। এদের অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া দেশটাকে নিয়ে রাজনৈতিক দূর্বৃত্তরা যা খুশি তাই করে যাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে দাড়ানোর কেউ নেই। রানা হঠাত অনুভব করে দেশটাকে পুরো বদলে দেয়া তার একার পক্ষে সম্ভব না। কিন্তু ঘুরে দাড়ানোর উদাহরন হিসেবে যুদ্ধটা সে শুরু করতে পারে। একচুলও আপোষ করবে না সে। দেশের বুকে খামচি মেরে কেউ ক্ষত করতে চাইলে আগে রানার মুখোমুখি হতে হবে তাকে । যাই থাকুক কপালে রানা পরিনতি মেনে নিবে। নিজের কাছে করা প্রতিশ্রুতিটা রানাকে একটু শান্তি দেয়। কাপে শেষ চুমুক দিয়ে রানা রুমের ভেতরে ঢোকে।

ল্যাপ্টপে রাখা ইন্টারোগেশন অডিও ফাইল থেকে ডকুমেন্ট রিপোর্ট আকারে রেডি করা হয়েছে। ফাইল খুলে পড়তে শুরু করে। এক দুইটা না পূরো ১৭ টা বিশাল ইন্টারোগেশন। আরো আছে। এক একজনের জবানবন্দী থেকে বের হয়ে আসছে পাহাড় প্রমান দূর্নীতি আর অনাচারের ফিরিস্তি। আরো কত যে আছে। কত জনকে জেরা করতে হবে। কত ঘটনার যে প্রমান পাওয়া যাবে সেই হিসাব কি এক জীবনে করা যাবে ? হতাশাটা ঝেড়ে ফেলে রানা রিপোর্টে চোখ বুলায়।

বেয়ারা এসে রাতের খাবারের জন্য অনুমতি চায় ।

রানার খেতে ইচ্ছে করছে না। বার বার চেষ্টা করেও ব্যাপারটা মেনে নিতে তার কষ্ট হচ্ছে। পোস্টিং এর অর্ডারটা হুট করেই তাকে রিসিভ করতে হয়েছে। তাও এমন একটা পোস্টিং যেটা রানা ডিজার্ভ করে না। বোঝাই যায় পানিশম্যান্ট এটা একধরনের। তাকে গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সে তাকে কাজ করতে হবে এটা সে ভাবেনি কোনো দিন। হ্যাঙ্গারে ঝোলানো কালো ইউনিফর্মটার দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে যায় রানা। এই ইউনিফর্ম তাকে একটা কঠিন মনোবল আর সাহস দিত। এই কালো পোশাকটা গায়ে চড়িয়ে সে এ্যাকিলিসের মত দাপিয়ে ছুটেছে দেশের কালিমা মুছে যেতে। এই কালো পোশাকটা তাকে নিয়ে যায় তার স্বপ্নের কাছাকাছি। দেশটাকে কালো দাগ মুক্ত করার যেই স্বপ্ন নিয়ে সে ফোর্সে জয়েন করেছিল। এই কালো পোশাকটাই তার যুদ্ধ বর্ম। বিদায় দিতে মন চাচ্ছে না একদমই।

বর্ডার সিকিউরিটির বার্ষিক কনভেনশান। পোস্টে জয়েন করে বেশিদিন হয় নি। প্রথম দিকে একটু মন খারাপ থাকলেও রানা গুছিয়ে নিয়েছে। মেনে নিয়েছে এটাই এখন তার যুদ্ধক্ষেত্র। দেশের জন্য কাজ করার এখানেও অনেক কিছুই আছে। আজ সকালে রানা মনে মনে গুছিয়ে নিয়েছিল কনভেনশনে কি বলবে। তার কিছু নিজস্ব প্ল্যানিং ছিল। কনভেনশনের সামনে সেগুলো প্রেজেন্ট করার ইচ্ছা আছে। চীফ হয়ত পছন্দ করতে পারেন কিছু কিছু আইডিয়া। কনভেনশন হলে লোক ভরে যেতে শুরু করেছে। অফিসাররা মোটামুটি সবাই এসে গেছে। রানা ঘড়ি দেখে, সকালের রোদটা চড়তে শুরু করেছে। ফেব্রুয়ারীর ঝকঝকে রোদে কনভেনশন হলের বাইরের মাঠ ধাধিয়ে আছে।

চীফ ডায়াসে ওঠার একটু পরেই হঠাত ডায়াসের পেছন থেকে এক সোলজার একটা সাবমেশিনগান নিয়ে লাফ দিয়ে সামনে আসে। কনভেনশন হলে আর্মস এ্যলাউড না। এমন কি চীফের গার্ড ও আর্মস ক্যারী করতে পারেনা। রানা অবাক হয়ে দেখে সোলজার ট্রিগারে চাপ দিয়েছে চীফের দিকে নল তাক করে। কিন্তু গুলি বের হল না। সম্ভবত ম্যাগজিন ঠিক মত লোড করা ছিলনা। কি হচ্ছে এটা ?? রানা সহ আরো কয়েকজন অফিসার ঝাপিয়ে পড়ে সোলজারকে মাটিতে চেপে ধরলো। তাকে জুতার ফিতা দিয়েই হাত বেধে ফেলা হল। ঠিক তখনই বাইরে থেকে ছুটে এল অটোমেটিক রাইফেলের গুলি । মাথা নীচু করে বাচবার আগেই রানা খেয়াল করল গুলি ছুড়ছে তাদের সাবর্ডিনেট সোলজাররা। ক্যু হয়ে গেল ? কেন ? রানা দিশাহারা হয়ে যায় একটু। পুরো দরবার হল ভরা অফিসাররা, সবাই নিরস্ত্র। বাইরে থেকে সমানে গুলি আসছে আর চিৎকার করে গালাগাল করা হচ্ছে অফিসারদের। দেয়ালের আড়াল দিয়ে দিয়ে রানা ওয়াশরুমের দিকে আগালো । ওদিক দিয়ে যদি বের হয়ার কোন পথ পাওয়া যায়। ওদিক থেকে কোন গুলি আসছে না, এটাই একমাত্র আশার কথা। একবার বাইরে বের হতে পারলে একটা আর্মস ম্যানেজ করা কঠিন হবে না।

প্রায় ৯ টা কল করল রানা বিভিন্ন জনকে। এখানে ক্যু শুরু হয়ে গেছে এই খবর জানিয়ে দেয়া গেছে মোবাইলে যাদেরকে জানানো প্রয়োজন মনে করেছে রানা। করিডোরের শেষ মাথায় একটা ভেন্টিলেটার আছে, কিন্তু সেটা গলে রানার শরীর বের হবে না। বাইরে থেমে থেমে এখনো গুলি চলছে বিভিন্ন দিক থেকে তার আওয়াজ আসছে। চিৎকার , উল্লাস , খিস্তি ও শোনা যাচ্ছে। কখনো কখনো খুব কাছে চলে আসছে শব্দগুলা। গুলি শুরু হবার কিছুক্ষনের ভেতরেই নেগসিয়েশান করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যার্থ হয়েছে। সোলজাররা আজকে অফিসারদের রক্তের নেশায় উম্মাদ হয়ে উঠেছে। রানা অনেক ভেবেও বের করতে পারছে না কেন শুরু হয়েছে এই হত্যাকান্ড। ইতিমধ্যেই চীফ সহ প্রায় ১৫ জনের ওপরে অফিসার প্রাণ হারিয়েছে গুলিতে। শুধু গুলিই হচ্ছে না। রানা যতটুকু বুঝতে পেরেছে কি এক আক্রোশে এক এক জনের বডিতে প্রচুর গুলি করার পর বেয়নেট চার্জ করা হচ্ছে। এমনটা ব্যাটল ফিল্ডেও করা হয়না শত্রুর সঙ্গে। রানা আর কাকে ফোন করা যায় ভাবছে। এতক্ষনে তো রেস্কিউ ফোর্স চলে আসার কথা এক ঘন্টায় কি ক্যান্টমেন্ট থেকে এখানে একটা অপারেশন করা যায় না ? কি হচ্ছে এসব ? বার বার ফোন করাও রিস্কি । সে যে জায়গা টায় খালি হাতে লুকিয়ে আছে তার আশে পাশে বেশ কয়েকবার ঘাতক সোলজাররা খুজে গেছে। বলা যায় না আবারো আসতে পারে। শব্দ কানে গেলে ধরা পড়ে যেতে পারে।গ

ঘন্টাখানেকের বেশি লুকিয়ে অপেক্ষা করে ধৈর্যের বাধ ভেঙ্গে গেছে। তাই, ইউনিফর্ম খুলে হাতে পেচিয়ে ঘুসি মেরে ভেন্টিলেটরটা ভেঙ্গে ফেলেছে রানা। কিন্তু ফুটো টা অনেক ছোট । পালানো যাবে না এদিক দিয়ে। ইশ একটা কিছু হাতের কাছে পেলে আর ভাবতে হত না। এদিক ওদিক তাকিয়ে কিচ্ছু খুজে পায় না রানা। ঘুসি মেরে সিমেন্টের ভেন্টিলেটর ভাঙ্গা যায় , দেয়াল ভাঙ্গা সম্ভব না। একটা শক্ত কিছু খুজে পাবার আশায় পা টিপে টিপে একটু সরে যেতে শুরু করে করিডোরের সামনের দিকে। বুটের নীচে ভাংগা কাচ কিচ কিচ করে ভেঙ্গে গুড়ো হচ্ছে। দাত দিয়ে ঠোট কামড়ে রানা আরো নিঃশব্দে আরেক পা সামনে ফেলার জন্য বাড়াতে গিয়ে জমে যায় !!

একটা সোলজার পেটের কাছে আড়াআড়ি করে চাইনিজ রাইফেল ধরে এসে দাঁড়িয়েছে করিডোরের দরজায়। রানার চোখাচোখি হয় সোলজারটার সঙ্গে। করিডোরে রানাকে দেখে হতবাক হয়ে সোলজার এক মূহুর্ত থমকে যায় তারপরই একসঙ্গে ঘটে অনেকগুলো ঘটনা খুব অল্প সময়ের মধ্যে।

সোলজার চিৎকার করে

- এইখানে এক শালা অ...ফি...সা...আ...আ...র

একই সঙ্গে সে রাইফেলের নল সোজা করে ট্রিগারে আঙ্গুল চাপ দেয়।

রানা শেষ মূহুর্তে রিফেক্স বশত ডান দিকে লাফ দেয়।

মাটিতে পড়ার আগেই তার বুকে আর পেটে ৪ টা গুলি ঢুকে যায়।

তীব্র ব্যাথায় মাটিতে পড়ে রানা চিত হবার চেষ্টা করতে করতে দেখে আরো কয়েক জোড়া বুট পরা সোলজারের পা করিডোরে ঢুকেছে।

আরেক সোলজার তাকে দেখে চোখ বড় করে উল্লাসে চিৎকার করে

- আরে এইটা তো হারামী কর্নেল রানা, মার শালারে ইচ্ছা মতন।

ঠাস ঠাস ঠাস, অটোমেটিক রাইফেলের গুলিগুলা রানার বুকে গলায় আর পেটে ভোঁতা শব্দ নিয়ে ঢুকতে থাকে। রানার চোখ বন্ধ হবার আগে চোখের সামনে একটা বন্দুকের নল এগিয়ে আসে। কালো নলটার পেটে বিশাল কালো একটা গর্ত। হঠাত সেই গর্তের ভেতর আগুন ঝলসে উঠে।

১০ দিন পর।

ফরেনসিক ল্যাবে পকেট থেকে রুমাল বের করে চোখ মুছে ডাক্তার রায়হান। ফরেন্সিক ল্যাবে কাজ করা ডাক্তারদের মন থাকে শক্ত। পেশাগত কারনেই মৃত্যু তাঁদের কাছে প্রতিদিনের মামলা। আর মৃত ব্যাক্তি তাঁদের কাছে ডিউটি। কিন্তু হাতের রিপোর্ট টা খুলে ডাক্তার রায়হানের কেন জানি বুক ভেঙ্গে কান্না পায়। চোখ টা মুছে রায়হান টেম্পারেচার কন্ট্রোল্ড মর্গের দিকে পা বাড়ায়। মর্গের ভেতর হিমশীতল মৃত্যুর গন্ধ। মাঝের সারীর মাঝা মাঝি একটা ট্রে টান দিয়ে বের করে। চাদরে ঢাকা একটা মৃতদেহের পায়ে ট্যাগ লাগানো ০০৯। রায়হান চাদর টা সরায়। মৃতদেহ টা বিকৃত। অজস্র গুলি, বেয়নেটের কাটা কাটি, এমনকি জায়গায় জায়গায় পোড়ানোর ক্ষত। চেহারাই নেই, চেনার উপায় নেই । ক্ষত বিক্ষত মৃত দেহটা একটা একহারা বলিস্ট পুরুষের। রায়হান বুক পকেট থেকে কলম বের করে পায়ে লাগানো ট্যগটায় লেখে

"ডি এন এ স্যাম্পল ০০৯ ম্যাচড ১০০ % । কনফার্মড এজ কর্নেল মাসুদ রানা"

রায়হানের চোখ আবারো ভিজে উঠে। লেখা শেষ করে দাঁড়িয়ে একটা স্যালুট করে অনভ্যস্ত ভঙ্গিতে। তারপর ঠেলে ট্রে টা আবার কুলিং চেম্বারে ঢুকিয়েরেন...

পরিশিষ্ট

দুর্বল চেষ্টায় "মাসুদ রানা"র নাম ব্যবহার করে লেখার জন্য সেবা প্রকাশনী ও মাসুদ রানা'র ফ্যানদের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
আমার ছোটবেলা থেকেই হিরো কাজী আনোয়ার হোসেনের সৃষ্টি করা চরিত্র "মাসুদ রানা" ।
গল্পের নায়ক রানা সব যুদ্ধে জিতে যায়। কখনো মরে না।
নিজের হাতে স্বপ্নের নায়ককে এই লেখায় মেরে ফেললাম।
লেখার সময় আমার চোখ দিয়েই পানি পড়ছিল।
কিন্তু লিখতে হল। আমি না লিখলেও কাউকে না কাউকে লিখতে হতই।

গল্পের মেজর মাসুদ রানা কখনো মরে না। কিন্ত ...
বাস্তবে "কর্নেল গুলজার আহমেদ" কে মারা যেতে হয়।

বাস্তবের নায়কের মৃত্যু কল্পনার নায়কের মৃত্যুর চেয়ে অনেক অনেক কষ্টের।
বাস্তবের নায়কের মৃত্যু এমন না হোক আর কখনো...

কর্নেল গুলজার আহমেদ সহ ৫৬ জন শহীদ সেনা অফিসারদের বলিদানের বিচার হোক।

- মুকুল চৌধুরী
http://mukulchowdhury.blogspot.com/


মন্তব্য

mofiz এর ছবি

শ্রদ্ধা

অতিথি লেখক এর ছবি

একজন গল্পের নায়ক মাসুদ রানা যদি মারা যায় তখন মন খারাপ হয়। কিন্তু রাগে ক্ষোভে ভেতর টা হয়ত পুড়ে যায় না। তবে একজন কর্নেল গুলজার যদি এভাবে প্রাণ হারায় তখন ভিতর টা কষ্টের আগুনে পুড়ে যায়।

গবেষক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।