রবিবার এবং কফি -৩

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৫/০৫/২০১৪ - ৫:৩১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

পর পর দুটো সপ্তাহ চলে গেলো অথচ তড়িৎ কাগজে আঙুল ছোঁয়ানো হয় নি। এক গেলাস সুরা আর আর ছোট পিঠা নিয়ে বসলাম, খেতে খেতে লিখবো কিন্তু কতটা আত্মনিয়ন্ত্রিত লেখা হবে তা বুঝতে পারছি না।
ভাবছি কি নিয়ে লিখব। নিজের সমালোচনা আমার অনেক প্রিয় একটা বিষয়, অতীত আর বর্তমান যখন মিলিয়ে দেখি তখন বিস্মিত হই, নানা যুক্তি দিয়ে নিজেকে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। নিজের মধ্যে একটা পরিবর্তন খুব চোখে পড়ছে। সেটা হল যা ভাল লাগছে না, তা খুব সৎ ভাবে প্রত্যাখ্যান করতে পারছি।
“না” শব্দটার সাথে আমার পরচিতি ছিলো খুব অল্প, এই শব্দটার ক্ষমতার কথা জানা ছিল না। পরিবারে সবার আদরের হওয়ার কারনে হয়তো না শোনার অথবা বলার অনুশীলন খুব কম ছিল। ঘর থেকে বের হওয়ার সময় জেবে প্রকৃত জীবনের সাথে মুখোমুখি হবার বিদ্যা বলতে তেমন কিছু ছিল না। ধীরে ধীরে আবিষ্কার করতে লাগলাম কতৃ্ত্বাধীন যেকোনো মানুষের সাথে কথা বলতেই গলা শুকিয়ে যায়, অজান্তেই ডান দিকে মাথা কাত করে সবকিছুতে সায় দিয়ে ফেলি। বংশানুগতি সম্পর্কিত বিদ্যা কাজে না লাগিয়েই বিশ্লেষণ করতে থাকি। বাবাকে কখনো গুরুত্বপূর্ণ সিধান্ত নেবার সময় মায়ের পরামর্শ নিতে দেখি নি, তাই মা’র মুখে কখনো না শব্দটা শোনা হয় নি। বোন বাবার মতেই জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিধান্তে একবাক্যে সম্মতি দিয়ে দিলো। ভাইয়ারা না বলতে পারতো খুব সহজে, সেই না বলাতে ছিলো কেমন একটা গর্ববোধ আর আত্মসম্মানের আভাস।
নবম শ্রেণীতে পড়ার সময় মনির নামে এক ভাইয়া বাসায় এসে ইংরেজি পড়াতো, পুরোটা সময় আমার উরুতে হাত দিয়ে বসে থাকতো। আতঙ্ক নিয়ে বসে থাকতাম। অথচ সাহস করে যদি মাকে বলতাম, নতুন শিক্ষক চাই অথবা ওই মনিরকে যদি প্রথমদিনই বলতাম, দয়া করে গায়ে হাত দিবেন না, এটি আমার জন্য সুখকর নয়, সমস্যার সমাধান হয়তো তখনি হতো, কিন্তু কোন এক ঈশ্বর বার বার আটকে দিচ্ছিল, রক্ষা করছিলো পবিত্র পুরুষসমাজ।
বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন প্রথম অর্ধবর্ষ শেষ হয় নি, দুইজন শিক্ষক ডেকে পাঠালেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে থেকে সদ্য যোগ দেয়া সায়েম স্যার আর সিলেটের এম সি কলেজের ফারুক স্যার। একজন মিটমিট করে হাসছেন বাকিজন বেশ গম্ভীর ভঙ্গীতে বলে যাচ্ছিলেন ছোট জামা আর জিন্স পড়ার অপকারিতা, মুরুব্বী হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছিলেন। আমি আর আমার আরেক বন্ধু মাথা নিচু করে শুনছি, প্রচণ্ড ক্ষোভে গা কাঁপছে, কিন্তু মাথা নাড়িয়ে তার কথায় সায় জানিয়ে ভীরুর মতো শিক্ষক কার্যালয় থেকে বের হয়ে আসলাম। টের পেলাম চরিত্রে দৃঢ়তার খুব অভাব। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সাহস করে বলতে পারি নি, দুঃখিত স্যার আপনার টাইট জিন্স শ্রেণীকক্ষে আমাদের মনে কামবাসনা জাগায়, কাল থেকে দয়া করে ঢোলা পাতলুন পরে আসবেন। এরকম হাজারো ঘটনা যার উপসংহার ছিল চোখের দিকে তাকিয়ে সেই মানুষটিকে কখনো বলি নি তার কর্মকাণ্ড সংযত করতে।
দেশের বাইরে আসার পর সমস্যা আরও প্রকট হতে লাগলো, সবাইকে দেখি কি নিঃসঙ্কোচে নিজের চাহিদা, অনুযোগ, অভিযোগ প্রধান কর্মকর্তার কাছে তুলে ধরছে, আর সেখানে আমি সবকিছুতেই রাজী এমন একটা ভঙ্গি করে সবকিছু করে যাচ্ছি। টের পাচ্ছিলাম নিজের স্বর খুব অপরিচিতো, মাকে নিজের মাঝে খুব স্পষ্ট ভাবে দেখতে পাচ্ছি। কী ভয়ঙ্কর! আরেকটা দুর্বল নারীর ভ্রুন জন্মাচ্ছে আমার মধ্যে, যার পরিচর্যা করে যাচ্ছি উপরে ফেলার বদলে। প্রথমদিকের এক ঘটনা, টিম নামে এক অল্প পরিচিত বন্ধু হটাত কামুকভাবে সবার সামনে আমায় স্পর্শ করছিল, আমি স্বভাবতই শক্ত হয়ে বসে আছি, চোখে টলমলে অশ্রু, ভাবছিলাম আহ সতীত্ব মনে হয় আজ চলেই গেলো। সে রাতে খুব কাছের বন্ধু জেস বাসায় যখন পোঁছে দিচ্ছিল, হাউমাউ করে কাঁদছিলাম। কিন্তু জেসকে বোঝানো খুব শক্ত ছিল, টিম এর স্পর্শ যদি আমার কাছে গ্রহণযোগ্যই না হয় তাহলে তাকে ওই মুহূর্তে কিছু কেন বলি নি। কি অদ্ভুত! আমি যে নিজেকে রক্ষার জন্য কখনো কিছু বলতে শিখিনি তা জেস এর কাছে অবিশ্বাস্য ছিল।
এরপর আরেক রাতের ঘটনা, পুল খেলছিলাম সাথে ইতালির বন্ধু মার্ক। খেলতে খেলতে সে এক পর্যায়ে হাত স্পর্শ করলো, আমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি আসলে এটা পছন্দ করছিনা। তৎক্ষণাৎ দুঃখিত বলে হাত সরিয়ে নিলো আর আমি হটাত করে অনুভব করলাম সেই নারীর ভ্রুনটা কত আত্মবিশ্বাসী, কতো সাহসী হয়ে উঠেছে।
প্রতিদিন এই টানাপড়েনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, মস্তিষ্কের একটা অংশ সব মেনে নিতে চায়, সেটা নিজের প্রতি যত অন্যায়ই হোক না কেন। আর বাকি মৌন অংশটা যুদ্ধ করে নিজেকে বদলাতে, জানি না কতটুকু পারবো। তবে মনে হয় বেড়ে ওঠার সময় নিজের মতামত গড়ে ওঠা খুব প্রয়োজন, আর না বলতে পারাটা খুব দরকার, বিশেষত আমাদের সমাজে।

ফিনিক্স
লস আলামস


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

চলুক লেখা ভাল লাগল।
দু'টি অনুরোধ আছে।
(১) ক্যাটেগরিতে আপনার নিকটি উল্লেখ করুন। এতে ভবিষ্যতে আপনার সব লেখাগুলোকে এক জায়গায় পেতে সুবিধা হবে।
(২) জানি, লেখা লিখে সঙ্গে সঙ্গেই জমা দিতে পারলে মনটা ভাল লাগে। তবু বলি, লিখে একটা দিন ফেলে রাখুন। তারপর জমা দেওয়ার আগে আরো দু'একবার পুরোটা ভাল করে পড়ে নিন। টুক-টাক বানান ভুল বা 'টাইপো'-গুলি এতে ঠিক করে নেওয়ার সুবিধা হয়। যখন হাচল হয়ে যাবেন, নিজের লেখা নিজেই যে কোন সময় ঠিক করে নিতে পারবেন তখন সংশোধনের কাজটা অনেক সহজ হয়ে যাবে। তবে দেখবেন, তখনো এই অভ্যাস-টা ভালই কাজে লাগছে! হাসি

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখা পড়ে আপনার আত্ম-এষণ সম্পর্কে শ্রদ্ধাই জাগে । আমিও আপনার মত এক জন, যিনি অন্দর মহলে মা-র স্বর জোরালো হওয়া সত্ত্বেও 'না' বলতে শিখতে অনেক সময় লেগেছে, কিন্তু যেখানেই চুপ করে থেকেছি, নিজেকে রক্ষা না করে, (কারণ আত্মরক্ষা করার চেয়ে ভদ্র হয়ে ভদ্রতা বজায় রাখা মাঝে মাঝে আমাদের মধ্যবিত্ত পরিবারে বেশি শোভন) সেখানেই পরে তীব্র ক্ষোভ আর অনুশোচনাই হয়েছে - নিজেকে বাদ দিয়ে জগতের কোনো উপকার সাধন করা যায় না । আপনাকে অভিবাদন, 'না' এর মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে একটি আস্ত কলাম লেখার জন্য ।

-আনন্দময়ী মজুমদার

হাসিব এর ছবি

বানানে আরো একটু যত্নবান হোন। প্যারার নিচে একটু স্পেস থাকলে পড়তে সুবিধা। তড়িৎ কাগজ মানে কি পরিস্কার হয়নি। কতৃ্ত্বাধীন শব্দটা মনে হয় আপনি কর্তৃত্বপরায়ন বোঝাতে চেয়েছেন।

লেখা ভালো হয়েছে। কিন্তু খুব বেশি জেনেরাল। নতুন আলাপ উঠে আসা দরকার। পরবর্তী পোস্টগুলোতে সেটা পাবো বলে ভরসা রাখছি।

অতিথি লেখক এর ছবি

এই ব্যাপারে আমি একমত। আমি সহজেই কাওকে না করতে পারি না। কিন্তু এই "না" কথাটাই আমাকে সবচেয়ে বেশি শুনতে হয়। উদাহরণ-
আমিঃ দোস্ত, ৫০০ টাকা ধার দিবি?
দোস্তঃ টেকা নাই। পারুম না।
আমিঃ ক্ষিধায় নাড়িভুড়ি শুকাইয়া গেল। বৌ খাইতে দাও।
বৌঃ নিজে বেরে খাও। আমার পায়ে ব্যাথা।
আমিঃ বস, সামনের মঙ্গল বার আমার ছুটি দরকার। বিয়ের দাওয়াত।
বসঃ আগে বলবেন না? অই দিন আমার ছেলের সুন্নতে খাতনা। আপনাকেই অফিস দেখতে হবে।........ইত্যাদি।

সোহেল লেহস

নীড় সন্ধানী এর ছবি

'না' পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট্ট কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ শব্দ। শুধু নারীদের নয় ক্ষেত্র বিশেষে পুরুষদের জন্যও 'না' বলার শক্তি অনেক দুর্ভোগ থেকে রক্ষা করে। আপনি যে সাহস করে যেসব বিষয় লিখছেন, সেটা প্রমাণ করে আপনার ভেতর সেই শক্তিটা সুপ্ত অবস্থায় ছিল বরাবরই। সুতরাং হাত খুলে লিখতে থাকুন।

আপনার প্যারা সমস্যা নিয়ে উপরে বলেছে দুজন। আমার মনে হয় আপনি অন্য জায়গায় লিখে এখানে পেস্ট করছেন। সেই কারণেই সমস্যাটা হচ্ছে। এটা আমি নিজেও করি বলে সমস্যাটা টের পেয়েছি। আপনি লেখাটা এখানে পেস্ট করার পর প্রতি প্যারার নীচে একবার করে এন্টার দিন, দেখবেন স্পেস সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

তিথীডোর এর ছবি

ওই মনিরকে যদি প্রথমদিনই বলতাম, দয়া করে গায়ে হাত দিবেন না

দয়া কেন? যে পুরুষটি শিক্ষকের ভূমিকায় এসে যৌন নিপীড়নমূলক আচরণ করছে, সে তো বাঁ গালে কষে চটকানার দাবিদার।

ফরম্যাটিঙে মনোযোগ দে, বানান খেয়াল করিস।
লেখা চলুক।

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

অতিথি লেখক এর ছবি

“না” শব্দটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা শব্দ। তবে এই শব্দটার ব্যবহার শুধু মাত্র নারীর জীবণেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, সমান গুরুত্বপূর্ণপুরুষের জীবণেও, অর্থাৎ মানুষের জীবণেই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আমার জীবণে এই মুহূর্ত পর্যন্ত “না” বলতে পারার কারণে পরিবার, সমাজসহ বিভিন্ন পর্যায়ে বঞ্চিত হচ্ছি।
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত।

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

লেখা চলুক। আত্ম বিশ্লেষন ভালো লাগছে।আর টুকরো টুকরো ঘটনায় দেখা যাচ্ছে জীবনের প্রতিচ্ছবি।

আপনার লেখার মান এমনিতেই অনেক ভালো, তবু উপরে দেয়া পরামর্শগুলো মেনে চলুন, লেখার মান একলাফে আরো অনেক বেড়ে যাবে।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

চমৎকার লেখা! আমিও ছোটবেলা থেকেই নারীদের মতামতকে উপেক্ষা করার প্রথার সাথে পরিচিত যা আমাকে খুবই বেদনা দেয়| আমি নারীজাতিকে মায়ের জাতির তুলনায় মানুষজাতি ভাবাকে কর্তব্য বলে মনে করি| -মোঃ জাকির হোসেন

নির্ঝর অলয় এর ছবি

বেশ ভালো লাগল। সরল সত্যভাষণ। অনেক প্রথিতযশা সুরাসক্ত লেখককে দেখেছি এ নিয়ে ঢাক ঢাক গুড় গুড় করতে। পরিমিত সুরাপানে যে কোন দোষ নেই, এবং অমিতপায়ী হয়েও যদি কারো ক্ষতি না করা হয়- তাতেও অপরাধ নেই- এটা আমাদের বোঝা উচিত।

আমাদের মেয়েরা এখন জোর গলায় অন্যায়ের প্রতিবাদ করছে। বইমেলায় দেখেছি এক তরুণী অভব্য আচরণকারীকে উচিত শিক্ষা দিয়েছেন। একবার রাত এগারটার মীরপুরের বাসে এক ঘোরতর মাতালের খিস্তির জবাবে বাঘিনীর মত রুখে দাঁড়িয়েছিল এক তরুণী। তারপর ইতরটা নেমে যাবার পর সব পুরুষসিংহ মিলে শুরু করল হেল্পারকে গালি দেয়া! আমি পুরো সময়ই নীরব ছিলাম। অনিবার্য কারণ ছিল। তবে চুপ থাকার জন্য চার বছর পর এখনো অনুশোচনা হয়। গত পরশু মগবাজারে এক অশ্লীল আচরণকারীর বস্ত্রোন্মোচন করে দেয় এক প্রতিবাদী নারী। দুনিয়াটা আমাদের জায়গির নয়, যে নারীকে আমরা যেভাবে খুশি অপমান করব।

চলুক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।