এক একদিন প্রতিদিন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ৩১/০৫/২০১৪ - ৬:০০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১।

আসে না আসে না করে শেষ পর্যন্ত বসন্ত এসেই গেল। কাজের পথে অনেক ফুল ফুটতে দেখছি গত কয়েকদিন। নজর কেড়ে নিচ্ছে মূলত ফোরসাইথিয়া আর ড্যাফোডিল। চেরি আর ম্যাগনোলিয়া এই সপ্তাহের শেষ নাগাদ ফুটে যাবে মনে হচ্ছে।

কাল বাড়ি ফিরে নিজের বাগানের দিকে তাকাচ্ছিলাম, আমার ওদের এখনো মাটির সাথে মাখামাখি। কেবলমাত্র ড্যাফোডিল গুলোকেই দেখা যাচ্ছে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াতে। এমনিতেও আমার ওরা একটু দেরিতে ফুটে। তাতে ভালো হল, সবার যখন ফুল ফোটা শেষ আমার তখন আমার প্রাঙ্গণ জুড়ে ফুল ফোটানোর খেলা। তবু এবার যেন একটু বেশী-ই দেরী হচ্ছে।

আজ সকালে বেরিয়েছি, "দ্বিধা কেন-আসিবে কি ফিরিবে কি—আঙিনাতে বাহিরিতে মন কেন গেল ঠেকি " জানতে। যা দেখলাম তাতে কান্না সংবরণ করতে কষ্ট হচ্ছিল!

বনের হরিণেরা আমার টিউলিপ, হায়াসিন্থ গুলোকে মুড়িয়ে খেয়ে গেছে এর মধ্যেই। ওদের এই মৌসুমে মাথা তুলে দাঁড়াবার সম্ভাবনা খুব কম, ফুল ফোটাবার কথা তো বাদ-ই দিলাম।

মনে পড়ল কয়েক বছর আগে এক হেমন্তে যখন বাবা-মা-মেয়েরা মিলে মহা উৎসাহে বাল্ব লাগাচ্ছিলাম, প্রতিবেশীদের একজন এগিয়ে এসে বলেছিলেন, এখানে হরিণের উপদ্রব খুব বেশী, বাগান টিকিয়ে রাখা কঠিন। তার বাগান নির্মূল হতে খুব বেশীদিন লাগেনি। তখন তার কথায় ভ্রুক্ষেপ করিনি।

হায় আজ বুঝলাম, এই আদুরে কাজল টানা চোখের চতুষ্পদীদের দূরে রাখার ব্যবস্থা করতে না পারলে, আমারও সারঙ্গ রোধী গুল্ম অথবা ফণীমনসার বাগানই ভরসা।

২।

হাসপাতাল রাউন্ড শেষে অফিসে ঢুকেছি পেন্ডিং চার্টগুলো শেষ করতে। বসতে না বসতেই আবার কল, সহকর্মীদের একজন। এর সাথে কিছুক্ষণ আগে হাসপাতালেই কথা হোল। ওপাশ থেকে কাঁচুমাচু গলায় সে জানায়,
-দেখ তুমি চলে যাওয়ার পরপরই এই রুগীটি দেখলাম, তোমার সাহায্য দরকার। যদি কিছু মনে না কর। মনে করার কিছুই নেই, রুগী দেখেই রুটিরুজি। আর এখনো হাসপাতালের আশেপাশেই আছি। আশ্বাস দিয়ে বললাম,
-নিশ্চিতে বল।
জানালো, রুগী ২৬ বছরের যুবক, ডান পায়ে অনেকটা অংশে ইনফেকশন নিয়ে ভর্তি হয়েছে দুদিন আগে। বেশ খারাপ ইনফেকশন, ইতিমধ্যে সার্জন একবার অপারেশন করে পচা চামড়া কেটে বাদ দিয়েছেন, এখন এন্টিবায়োটিক চলছে। ভর্তির সময় কিডনির অবস্থা খারাপ ছিল কিন্তু তেমন নয়। গত দুদিনে খুব খারাপ হয়েছে, ওরা কেউ-ই বুঝতে পারছে না কেন। আরেকটা কথা জানালো সে রুগীটি মাদকাসক্ত একজন, ইনজেকশন হেরোইন এ্যাডিক্ত। অফিস থেকেই চার্ট আর ল্যাব রিভিউ করে তাড়াতাড়ি আবার ছুটলাম হাসপাতালে।

তরুণ ছেলেটি, ব্যথায় কাতরাচ্ছে রুমে, পাশে নার্স। পরিচয় দিলাম, নির্লিপ্ত মুখ। জানতে চাইলাম কিসের ব্যথা। জানালো কোমরে ব্যথা, যে ঔষধ দেয়া হচ্ছে তাতে ব্যথা কমছে না। আমি বললাম ব্যথা'র ব্যবস্থা হবে, তবে আগে আমার কিছু প্রশ্নের জবাব দিতে হবে। সে খুব একটা আগ্রহী না হলেও ব্যথার শক্ত ঔষধের প্রলোভনে রাজী হোল বোধহয়। জানলাম, ১৬-১৭ বছর থেকে বিভিন্ন অপরাধে স্থানীয় জেলেই কেটেছে বেশির ভাগ সময়। কয়েক সপ্তাহ আগেই আবার ছাড়া পেয়েছে, নিজের শরীর বা স্বাস্থ্য সম্পর্কে পুরোই উদাসীন। পায়ের ইনফেকশন কবে থেকে হয়েছে কোন ধারনা নেই, যখন পচে গ্যাংগ্রীন হয়ে গন্ধ বেরুলো, তখন এসেছে ইমারজেন্সিতে।

-তোমার কিডনির কোন সমস্যার কথা জানতে আগে থেকে?
-না। তবে আমি অনেক বছর ডাক্তারের কাছে যাইনি, কোন রেগুলার চেকআপ করা হয়নি।
-কেন? ইনস্যুরেন্স নেই?
-নেই। আর গত ৮-৯ বছর আমার জেল আর জেলের বাইরে করেই কেটে গেছে।
-কোন কাজ করো?
-ইলেক্ট্রিশিয়ান এর লাইসেন্স আছে। তবে করি না।
-কেন করো না? কিভাবে চলে তোমার?
-ভালো লাগে না। ......
-সিগারেট বা মদ খাও?
-না, ওগুলো সহ্য হয় না।
-তোমার নেশার অভ্যাস কতদিনের?
-১২-১৩ বছর থেকেই কোক(কোকেন), পট(গাঁজা) এসবের অভ্যাস আছে।
-এতো ছোট বয়েসে! কেন শুরু করলে?
-মজা করতে, জাস্ট টু হ্যাভ ফান উইথ ফ্রেন্ডস।
-আর হেরোইন?
-বেশি দিনের নয়, ছয় মাস-একবছরের। সেও দেখতে কেমন লাগে, ফান করতে।
-দেখো তোমার ফান শেষ হয়েছে কিনা জানিনা, কিন্তু আপাতত তোমার কিডনির ফান শেষ। তোমার ডায়ালাইসিস লাগতে পারে। তবে তার আগে আমাকে বেশ কিছু রক্ত পরীক্ষা, স্ক্যান এবং বায়োপসি করতে হবে যেগুলো তোমার জন্য ফান না হলেও চিকিৎসার জন্য খুব দরকারি এবং আমার ডায়াগনস্টিক কিউরিসিটি এর জন্য ফান হলেও হতে পারে।
সে ভাবলেশহীন মুখে শ্রাগ করে বলে,
-তুমি যা বলো, শুধু আমার ব্যথার ঔষধ টা...

ততোধিক ভাবলেশহীন মুখে রুগীর ঘর থেকে বেরিয়ে এসে চার্টে রক্ত পরীক্ষা, আলট্রাসনোগ্রাম, বায়োপসি আর ব্যথার ঔষধের অর্ডার লিখতে লিখতে ভাবছিলাম, ছেঁদো প্রমোদে অপার সম্ভাবনাময় একটি জীবনের কি নিদারুণ অপচয়।

৩।

আমার কোন গান নেই আজ। আছে, ভুলে যাওয়া একটি কবিতার ছেঁড়াখোঁড়া কয়েকটি অসমাপ্ত পঙক্তি। অনেককাল আগে খুব প্রিয় একজনের কাছে শোনা। সে মানুষটি অঙ্ক-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিতে ডুবে থাকত সারাদিন-সারারাত। গল্প-কবিতার বই পড়ত, গান শুনত, কিন্তু সেসবে তার উচ্ছ্বাস ছিল, জানা ছিল না আমাদের কারোই। শুধু কোন কোন অবাক করা মুহূর্তে অদ্ভুত সব প্রশ্ন করে বুঝিয়ে দিত, তার সাহিত্য-কাব্য বোধের গভীরতা।

কয়েক দশক আগে এক অলস নির্জন দুপুরে হঠাত এসে জিজ্ঞেস করেছিল,
-এতো কবিতা পড়িস এই কবিতাটা'র অর্থ বুঝিস?

"...যার কারনে রেধেছ শিং মাছ , মাসের বড়ি মাংস তেতো শাক
বেন্সন এর প্যাকেট এক জোড়া জোগাড় করার ঝক্কি দেড় মাইল পোহালে
তার পালটে গেছে কবেই তারিখ, ফেরা হবেনা কোনদিন
ফেরার গাড়ি ফিরেছে সন্ধায়, ফাঁকা হয়েছে অপেক্ষার ঘর...
...হয়তো তুমি তেমনি(?) বসে আছ
ঘোমটা তুলে দর্শণা জংশন..."

আমি কি উত্তর দিয়েছিলাম মনে নেই। কবিতাটি খুঁজে বেড়াচ্ছি আজ অনেক বছর। সেই তাকে জিজ্ঞেস করবার উপায় নেই কোন....

তারও পালটে গেছে কবেই তারিখ, ফেরা হবেনা কোনদিন ...।

রীতু


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

এই না হলে লেখা! ৫ তারা অবশ্যই। হা-পিত্যেশ করে বসে রইব পরের লেখার জন্য।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। নিশ্চয় আবার পড়বেন। হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ এক লহমা, নিশ্চয় পড়বেন। হাসি

রীতু

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ লেখা! হিংসা হওয়ার মত গুরু গুরু

ফাহিমা দিলশাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

তাই কি? লেখার আগ্রহ বাড়িয়ে দিলেন। অনেক ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

দারুণ হয়েছে! অসাধারণ লেখা! পড়ে খুবই ভাল লাগল! অনেক ধন্যবাদ!-মোঃ জাকির হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আপনাকে পড়ার জন্য।

রীতু।

অতিথি লেখক এর ছবি

অসাধারণ! পরেরটার জন্য অপেক্ষায় রইলাম।
-এ এস এম আশিকুর রহমান অমিত

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, লিখবো শিঘ্রি। হাসি

রীতু

গান্ধর্বী এর ছবি

চমৎকার লাগছে। আরো লিখবেন আশা করি।
শুভকামনা হাসি

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি মনে হয় অনেক লিখেন। আমি সময়ের অভাবে ঠিক পড়ে উঠতে পারিনি। অনেক ধন্যবাদ।
রীতু

গান্ধর্বী এর ছবি

অনেক লিখি কিনা জানি না, তবে এটুকু জানি বেশিরভাগই ছাইপাঁশ।
ভাল থাকুন হাসি

------------------------------------------

'আমি এখন উদয় এবং অস্তের মাঝামাঝি এক দিগন্তে।
হাতে রুপোলী ডট পেন
বুকে লেবুপাতার বাগান।' (পূর্ণেন্দু পত্রী)

বন্দনা এর ছবি

বাহ, আপনার লেখার হাত বেশ মিষ্টী।

অতিথি লেখক এর ছবি

লেখাও তাহলে মিষ্টি হয় চোখ টিপি । অনেক ভালো লাগলো জেনে।

রীতু

অতিথি লেখক এর ছবি

অ-নেক সুন্দর লেখা।
পড়ে ভালো লাগলো।

ভালো থাকবেন রীতু।
শুভেচ্ছা জানবেন।

---------------------------
কামরুজ্জামান পলাশ

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনিও শুভেচ্ছা জানবেন। ধন্যবাদ।

রীতু

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আপনার লেখা প্রথম পড়লাম মনে হয়। অনেক ভালো লিখেছেন। চলুক

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

সচলায়তনে এই প্রথম লিখলাম, তবে লিখি টুকটাক। আরো পড়বেন আশাকরি।

রীতু

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

"ছেঁদো প্রমোদে অপার সম্ভাবনাময় একটি জীবনের কি নিদারুণ অপচয়।"

ছোট ছোট একটা দুটো বাক্যে কী দারুণ বোধ -

সচলায়তনে স্বাগতম। আপনার লেখার ধার বলে দিচ্ছে আপনার কাছ থেকে চমৎকার সব লেখা পাবো আমরা। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

হাসি অনেক ধন্যবাদ ।

রীতু

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।