আমি মহাকাশ থেকে এসেছি!

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২১/০৯/২০১৪ - ৪:১৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

[প্রথম মহাকাশচারী ইউরি গাগারিনের জার্নাল থেকে অনূদিত]

টি মাইনাস ১৫ মিনিটের ঘোষণা আসতেই সীল করা দস্তানাজোড়া হাতে গলিয়ে নিলাম, পরে নিলাম হেলমেট।

টি মাইনাস ৫ মিনিট! টি মাইনাস ১ মিনিট, তারপর হূশ করে রকেটের ছুটে চলা!

তার আগে শুনতে পেলাম টাওয়ারগুলো সরিয়ে নেয়ার আওয়াজ, আর রকেটের গায়ে হালকা দুলুনি। এরই মাঝে মৃদু একটা গুঞ্জন শুরু হলো, রকেটের এঞ্জিন প্রধান স্টেজে ঢোকার সাথে সাথে গুঞ্জনের তীব্রতাও বেড়ে গেল। যদিও কানে তালা লেগে যাওয়ার মতো ভয়াবহ কোন গর্জন না, সত্যি বলতে এর চেয়ে আরো অনেক জোরালো শব্দের জন্য আমি প্রস্তুত ছিলাম।

“পয়েলকা!” – শুরু হোক যাত্রা!


যাত্রা শুরুর ক্ষণে - রকেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন গাগারিন, পাশে সোভিয়েত মহাকাশ সংস্থার কর্মকর্তাবৃন্দ, কালো ফেডোরা হ্যাটে মহাকাশযানের প্রধান ডিজাইনার সের্গেই করোলেভ।


বিদায়, পৃথিবী!

আস্তে করে রকেট পৃথিবীর মায়ার বাঁধন ছিঁড়ে উড়ে চললো শুণ্যে – মহাশূণ্যে! উৎক্ষেপণ নির্ঝঞ্ঝাট হলেও একটু পরেই রকেটের গায়ে অনভিপ্রেত ঝাঁকুনি টের পেয়ে ইজেক্ট করার জন্য তৈরি থাকলাম। এদিকে অভিকর্ষের ত্বরণ (‘জি’ ত্বরণ) টানা বেড়েই চললো, তবে সেটা মোটেই বড় কোন সমস্যা না। সচরাচর সাধারণ বিমানেই এমন অভিজ্ঞতা হতে পারে। ত্বরণ বেড়ে হলো ‘৫ জি’, পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করে রিপোর্ট করে যাচ্ছিলাম তখনও। এ অবস্থায় মাইক্রোফোনে কথা বলাটা দুষ্কর হয়ে পড়লো – প্রচন্ড ত্বরণের কারণে গালের মাংসপেশীগুলো প্রতিনিয়ত নিচের দিকে ঝুলে পড়ছিলো। ‘জি ত্বরণ’ বেড়ে চললো ... এভাবে বাড়তে বাড়তে হঠাৎ করেই আবার কমে গেল। আস্তে আস্তে টের পেলাম ভরশূণ্যতা! এমন সময় জি ত্বরণের পুনরাগমণ আমার শরীরটাকে সীটের সাথে যেন গেঁথে ফেলতে চাইলো। নীচে দেখতে পাচ্ছিলাম মেঘ, ল্যান্ডিং সাইট ... কী সুন্দর! কী অপূর্ব সুন্দর!

৯ টা ১২ মিনিটে রকেটের দ্বিতীয় স্টেজ বন্ধ হলো, তার পরপর তৃতীয় স্টেজ। জি ত্বরণ কিছুটা বাড়লো, হঠাৎ প্রবল একটা ঝাঁকুনি টের পেলাম। এর দশ সেকেন্ডের মাথায় আরেকটা ঝাঁকুনি দিয়ে মহাকাশযানকে একা ফেলে আলাদা হয়ে গেল শেষ বুস্টার রকেট।


বাইকোনুর কসমোড্রোম থেকে প্রথম মনুষ্যবাহী রকেট ভস্টক ১ এর উৎক্ষেপণ।

মহাকাশযান ধীরলয়ে পাক খেতে খেতে এগিয়ে চললো – পৃথিবীটা ছুটে চললো বামে উপরের দিকে, আবার ডানে নিচের দিকে ... চোখে পড়লো দিগন্ত, তারার মেলা ... কালিগোলা কালো আকাশ। এ অন্ধকারের পটভূমিতে নক্ষত্রের দল যেন একটু বেশিই স্পষ্টভাবে জ্বলছিলো। পৃথিবীর গায়ে এক ধরণের হালকা নীল আলোর আভা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়ে বেগুনি রঙে, আবার তার থেকে ক্রমশ বেশ পালটে রূপ নিচ্ছিলো কালোয়।

সমুদ্রের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় নীল রঙের দেখা পেলামনা, সমুদ্রের সেদিন পরনে ছিলো ধূসর চাদর ... অসমতল, অনেকটা ছবিতে দেখা বালিয়াড়ির মতো।
আমি খাওয়াদাওয়া ঠিকমতোই করতে পারছিলাম। কোন শারীরিক অসংলগ্নতা টের পাইনি। তবে ভরশূণ্যতার অনুভূতিটা আমার কাছে নতুন – মনে হচ্ছিলো যেন স্ট্র্যাপ মোড়ানো অবস্থায় এক অনুভূমিক অবস্থানে ঝুলে আছি। এরই মধ্যে লিখে চলছিলাম রিপোর্ট – কখন যেন হাত থেকে পেন্সিলটা খসে গেল। কিন্তু সেটা নিচে না পড়ে ভেসে কোথায় যেন চলে গেল। লেখার উপায় নেই, তাই জার্নালটা বন্ধ করে পকেটে রেখে দিলাম।

...

পৃথিবীর দিকে নেমে আসার আরম্ভটা ছিলো বেশ ভয়ানক! মাঝে মাঝেই জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম উজ্জ্বল আলোর দ্যুতি, চোখ-মুখ ঢেকে ফেলতে হলো এর থেকে বাঁচার জন্য।

৯ টা ৫৭ মিনিটঃ “সব ঠিকঠাক চলছে, আমি এই মুহূর্তে আমেরিকার উপরে!”


ভস্টক ১ মহাকাশযানের ভিতরে গাগারিন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এই নিরবচ্ছিন্ন ছুটে চলায় ব্যাঘাত ঘটলো। তৃতীয় রিএন্ট্রি কমান্ড ইস্যু হতেই ব্রেকিং রকেটের কাজ শুরু হয়ে গেলো। ‘জি ত্বরণ’ আবার বেড়ে চললো, হঠাৎ কমে আবার ভরশূণ্যতা! ... ব্রেকিং রকেট ঠিক ৪০ সেকেন্ড ধরে চললো, এঞ্জিন বন্ধ হতেই প্রচন্ড একটা ঝাঁকি – আর তার সাথেই মহাকাশযান এর অক্ষের চারপাশে ভীষণ বেগে ঘুরতে শুরু করলো – কমপক্ষে হলেও সেকেন্ডে ৩০ ডিগ্রী বেগে! ব্যালে নাচের ভঙ্গিতে পাক খেতে থাকলাম – মাথা, পা আবার মাথা, আবার পা ... বাইরে এই দেখি আফ্রিকা মহাদেশ, পরক্ষণেই আবার দিগন্ত – আকাশ – সূর্য। বাদবাকি রকেট থেকে মহাকাশযানের আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা এরই মধ্যে, কিন্তু সেটা ঘটার কোন লক্ষণ দেখতে পেলামনা। এদিকে আমার ‘ব্যালে নাচ’ চলতে থাকলো – মনে মনে হিসাব করলাম, এখন যদি আমি সরাসরি নিচের দিকে নামা শুরু করি, তাতেও খুব একটা সমস্যা হবেনা। সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশাল দেশ, আমার হিসাবে অবতরণ হওয়ার কথা দেশের পূর্ব প্রান্তের কোথাও।

এই চরকিপাক অবস্থাকে আমার ‘জরুরি অবস্থা’ বলে মনে হলোনা – বাটন টিপে তাই ‘সব ঠিক আছে’ বার্তা পাঠিয়ে দিলাম। অবশেষে মহাকাশযান অবশিষ্ট রকেট থেকে আলাদা হলো। পাক খাওয়ার বেগ কিছুটা কমে আসলো, তবে ডানে-বাঁয়ে আরেক নতুন ঘূর্ণন শুরু হলো। হঠাৎ জানালায় টকটকে লাল আলোর হলকা দেখতে পেলাম! একটা মড়মড় শব্দ ক্রমেই বেড়ে চললো – হয় মহাকাশযানের কাঠামো ভেঙ্গে পড়ছে, নাহয় প্রচন্ড উত্তাপে এর তাপসহ আস্তরণ প্রসারিত হচ্ছে। মিনিটখানেক চললো এই শব্দ, তাপমাত্রার বেড়ে যাওয়া টের পেলাম, তার সাথে ‘জি-ত্বরণ’ এর বৃদ্ধি।

একটা সময়ে মনে হলো জি-ত্বরণ বেড়ে ‘১০ জি’ তে পৌঁছাল! দুই-তিন সেকেন্ড ধরে যানের ভিতরের ইন্সট্রুমেন্ট প্যানেলের আলো নিবু নিবু হয়ে আসলো, সবকিছুকে যেন গ্রাস করে নিলো ধূসর এক ছায়া!

...

জি-ত্বরণ আবার কমে আসতেই শুনতে পেলাম বাতাসের শিস। ইজেকশানের জন্য অপেক্ষায় থাকলাম। মোটামুটি ৭০০০ মিটার উচ্চতায় মহাকাশযানের হ্যাচ খুলে গেল – আমি বসে বসে ভাবলাম, “ইজেকশান কি হয়ে গেল নাকি?” ... আস্তে করে উপরের দিকে তাকাতেই দুম করে ছুটে গেলাম সেদিকে ... ইজেকশান সফল, ভারসাম্য ঠিক রাখার প্যারাশুট ডিপ্লয় হলো। সীটে আরামে বসে থাকা অবস্থাতেই দেখতে পেলাম নিচে বিশাল এক নদী – ভলগা!

প্যারাশুট ট্রেনিং এর সময় এই দৃশ্য কতই না দেখেছি! ... রেললাইন, নদীর উপরে ব্রিজ, বিরাট তীরভূমি – সবকিছু কতই না পরিচিত! এরই মধ্যে রিজার্ভ প্যারাশুট ডিপ্লয় হলো – কিন্তু ঠিকভাবে খুললোনা, মধ্য আকাশে শুধুই ঝুলে থাকলো।

আর কিছুটা নেমে আসতে দেখতে পেলাম আমার ডানদিকে একটা ফিল্ড ক্যাম্প, আর রাস্তার পাশে লোকজনের আনাগোনা। কাছেই নদী থেকে একটা খাল বের হয়ে এসেছে, তার পাশেই কয়েকজন রাখাল মহিলাকে দেখতে পেলাম। মনে হলো ওই খালের কাছেই অবতরণ করবো – সবাই অবাক চোখে তাকিয়ে আছে আমার উজ্জ্বল কমলা রঙের প্যারাশূটের দিকে। এবার বুঝলাম যে খালপাড়ের এক চষা ক্ষেতে নামতে যাচ্ছি – অবতরণ হলো খুবই আস্তে করে, বুঝতেই পারলামনা যে এরই মধ্যে আমি দাঁড়িয়ে পড়েছি! পেছনের প্যারাশুটটা পরলো আমার মাথার উপর, অন্যটা সামনে। ... সুস্থ স্বাভাবিকভাবেই আবার পৃথিবীর বুকে নেমে আসলাম!


অবতরণের পর ভস্টক ১ মহাকাশযান ক্যাপসুল।

ছোট একটা টিলার মাথায় উঠে আসতেই দেখতে পেলাম এক মহিলা আর ছোট্ট একটা মেয়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছে। ... কিছুটা কাছে চলে আসতেই মহিলা ত্রস্ত ভঙ্গিতে এগুতে লাগলো – আর ছোট্ট মেয়েটা দৌড়ে পালালো! ... আমি ওদের দিকে হাত নেড়ে বললাম, “আমি এই দেশেরই লোক, ভয়ের কিছু নেই! এদিকে এসো।”

অদ্ভুতদর্শন আর জবরজং স্পেসস্যুট পরে হাঁটতে বেশ কষ্ট হলেও আমি এগিয়ে গেলাম মহিলার দিকে। ... বললাম, “আমি একজন সোভিয়েত, আমি মহাকাশ থেকে এসেছি!”

সূত্রঃ

James Harford, “Korolev: how one man masterminded the Soviet drive to beat America to the Moon”, John Wiley & Sons, Inc. 1997.
http://www.space.com/11346-photos-yuri-gagarin-vostok1-human-spaceflight.html
http://www.americaspace.com/?p=33384
http://www.spaceport.blogspot.com


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

সদস্যনাম: ছায়াপথের পথচারী

এক লহমা এর ছবি

ভাল লাগল।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ! চেষ্টা থাকবে মহাকাশ বিষয়ে আরো কিছু লেখার।

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

চলুক লিখে যান।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

চলুক হাততালি পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

ইয়াসির আরাফাত এর ছবি

চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাল হয়েছে

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ! একটা গল্প লেখার চেষ্টা করলাম। এখানে - http://www.sachalayatan.com/guest_writer/53126

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ভাল লাগল আপনার লেখাটি । ধন্যবাদ ।

মহাবিশ্বের পরিব্রাজক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।