হুইসপার অব দ্য হার্ট

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৪/০৫/২০১৫ - ৩:০৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জাপানের অ্যানিমেশন বিশ্ববিখ্যাত। তাদের উদ্ভাবিত স্টাইলটি সারা পৃথিবীতে অ্যানিমে নামে পরিচিত। অ্যানিমেগুলো দেখতে হাতে আঁকা ছবির মতই। চরিত্রগুলোর শরীর বাস্তব অনুপাত মেনেই আঁকা হয়, মুখের অভিব্যক্তি কিছু কম থাকে, চোখের আকার বড় এবং চুলের স্টাইল বেশ অদ্ভুত হয়। ডিজনীর মত গতির বিষয়গুলোতে জোর না দিয়ে অ্যানিমে ডিজাইনাররা পুরো ফ্রেমের ডিটেইলে বেশি মনযোগ দেয় এবং ছবির মধ্যে ত্রিমাত্রিক অনুভূতি আনার চেষ্টা করে।

জাপানের বিখ্যাত স্টুডিও ঝিবলিতে ১৯৯৫ সালে ‘হুইসপার অব দ্য হার্ট’ অ্যানিমে ফিল্মটি তৈরি হয়। কিশোরী একটি মেয়ের জীবনের লক্ষ্য খুঁজে পাওয়া এবং সে স্বপ্নের পথে পা বাড়ানোর গল্প এটি। গল্পের প্রধান চরিত্র শিযুকু বইয়ের পোকা। সে খেয়াল করে, লাইব্রেরী থেকে তার আনা সমস্ত বই এর আগে সিজি নামের এক ছেলে পড়তে নিয়েছে। একদিন আজব এক বিড়ালকে অনুসরণ করে সে একটি অ্যানটিক দোকানে এসে পড়ে। দোকানটি অসংখ্য মূর্তি, পুতুল, পুরনোদিনের আসবাব, ছোট জাহাজ, ঘর সাজানোর জিনিসে ভর্তি ছিল। সেখানে ছিল একটি গ্র্যান্ড ফাদার ক্লক। বিড়াল মূর্তি ব্যারন এবং গ্র্যান্ড ফাদার ক্লকের আলাদা আলাদা কাহিনী ছিল। সেখানে শিযুকু অদ্ভুতভাবে সিজির দেখা পায় এবং জানতে পারে ছেলেটি বেহালা বানানো শিখতে চায়। এজন্য সে ইটালীর ক্রেমোনাতে প্রশিক্ষণও নিতে যায়। সিজিকে তার স্বপ্নের জন্য এতটা ব্যগ্র দেখে শিযুকু নিজের জীবনের স্বপ্ন, লেখালেখি নিয়ে সচেতন হয়। সিজি ও শিযুকুর মধ্যে ঘনিষ্ঠতা তৈরি হয়। শিযুকু ব্যারন ও তার নারী সঙ্গী লুইসাকে নিয়ে উপন্যাসের মাধ্যমে লেখালেখিতে তার যাত্রা শুরু করে। সিজি ও শিযুকু গল্পের শেষ অংশে প্রণয়াবদ্ধ হয়।

হুইসপার অব দ্য হার্টের পোস্টার

সুন্দর গল্পের পাশাপাশি ফিল্মটি জাপানের সংস্কৃতি আর জীবনযাত্রাকেও ধারণ করেছে। জাপানের শহুরে মধ্যবিত্তদের বাড়িঘর, পারিবারিক সম্পর্ক, জীবনের ব্যস্ততা গল্পের ভাঁজে ভাঁজে চলে এসেছে। ছোট বাসায় শিযুকুরা ঠাসাঠাসি করে থাকে, বড়বোনের সাথে তাকে এক কামরায় থাকতে হয়। শিযুকুর বাবা মা সারাদিন কর্মব্যস্ত থাকেন বলে তাদের সাথে মানসিক যোগাযোগ কম ছিল। তাই শিযুকু বইয়ের মধ্যে নিজের জগৎ তৈরি করে নেয়। তার স্কুলের সহপাঠীদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক, কারও কারও মধ্যে প্রেমের টানাপোড়েন এবং তা নিয়ে বাকিদের আগ্রহ উৎসাহ সবই গল্পটিতে স্থান পেয়েছে। গল্পের পটভূমি ইন্টারনেট যুগের আগেকার। তাই চিঠিকেই প্রেম নিবেদনের মাধ্যম হিসেবে দেখানো হয়েছে।

‘হুইসপার অব দ্য হার্ট’ শহরের কাহিনী। রাস্তা, বাড়ি, সিঁড়ি, আসবাব, দালানকোঠা, সেতু, ট্রেন, রেললাইন সবকিছু আঁকার জন্য প্রতিটি ফ্রেমে অসংখ্য সরলরেখার ব্যবহার দেখা গেছে। এর মাধ্যমেই আকার এবং দূরত্বের মত বিষয়গুলো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শহরের চিত্রায়ণ এত সুন্দরভাবে করা হয়েছে যে অনেক সময় ক্যামেরায় ধারণ করা বলে ভুল হয়। গাছপালার অঙ্কনও বাস্তবের কাছাকাছি। প্রত্যেকটি ফ্রেমই পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আঁকা হয়েছে।

ফিল্মটির দৃশ্যায়ণের একটি চুম্বক অংশ শিযুকুর কল্পনায় ব্যারনের সাথে তার ওড়া। কল্পনার নগরটি ভাসমান মেঘের মত অনেক টুকরায় বিভক্ত; যাতে আছে বাড়িঘর, গাছপালা সব। এক একটি অংশে বাতাসে ভেসে উড়ে যাচ্ছিল তারা। সে রাজ্যে দূরের জিনিস বড় আর কাছের জিনিস ছোট দেখা যায়।

ব্যারন ও শিযুকু

শিল্পীর মন, মনন ও বিকশিত হওয়ার গল্প এটি। কল্পনার জগতে বিচরণশীল শিযুকু বাস্তবে ছিল ভুলোমনা ধরণের। ঘরের কাজের ব্যাপারে তার উদাসীনতাকে বড় বোন শিও আন্তরিকতার অভাব বলে ধরে নিত। শিও বাস্তব জগতে সন্তুষ্ট এবং সফল ছিল। দুইবোনের মধ্যে প্রায়ই তর্কাতর্কি হত। শিল্পী মন আর সাধারণ মনের পার্থক্যই তাদের বিতর্কের মধ্যে স্পষ্ট হত। কাহিনীর এক পর্যায়ে বৃদ্ধ নিশি পান্নার আকরিক দেখিয়ে শিযুকুকে বলেন, চকমকে জিনিসটিকে শক্ত পাথর থেকে বের করে পালিশ করে সুন্দর আকার দিলে তা পান্না হয়ে উঠবে। একজন মানুষকেও দীর্ঘ সময়ের শ্রম আর প্রচেষ্ঠার বিনিময়ে শিল্পী হয়ে উঠতে হয়।

জাপানের সংস্কৃতিতে শিশুদের মানসিক পরিচর্যার বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিযুকু যখন পরীক্ষার সময় পড়াশোনায় বেশ কিছুদিনের বিরতি দিয়ে উপন্যাস লিখতে চায়, তার বাবা মা এতে অনুমতি দেন। আমাদের সংস্কৃতিতে এ ধরণের চর্চা নেই। থাকলে হয়তো আরও অনেক সৃষ্টিশীল মানুষের জন্ম দিতে পারতাম আমরা।

শিযুকু আর সিজি দুজনেই শিল্পী মনের মানুষ। জীবনের স্বপ্ন পূরণের জন্য নিশ্চয়তার পথ ছেড়ে ঝুঁকির পথ বেছে নিয়েছিল তারা। কৈশোরেই শিল্প−সৌন্দর্য্যের পথে পা বাড়ানো এই দুজনের মধ্যে প্রেম হওয়াটা মোটেও অবাক ব্যাপার ছিল না। কিন্তু সূর্যোদয়ের প্রথম রাঙা আলোয় তাদের একে অপরকে প্রেম নিবেদন এবং গ্রহণের ব্যাপারটি অবশ্যই অভাবনীয়।

ইয়োশিফুমি কন্ডোর একমাত্র পরিচালিত ছবি এটি। ১৯৯৮ সালে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে আকস্মিক মৃত্যু হয় তাঁর। সবাই ভেবেছিল অ্যানিমেশনের জীবন্ত কিংবদন্তী হায়াও মিয়াযাকির যোগ্য উত্তরসূরি হয়ে উঠবেন তিনি। একমাত্র ফিল্মটির মাধ্যমে তিনি ভবিষ্যৎ শিল্পীদের উৎসাহিত করে গিয়েছেন। বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই আরও ভাল ভাল অ্যানিমে উপহার দিতেন আমাদের।

- তুহিন তালুকদার

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

স্পর্শ এর ছবি

আমার খুব প্রিয় একটা অ্যানেমে। জীবনের গভীরতম ব্যাপারগুলো শিশুকিশোরদের উপযোগী করে উপস্থাপন করেছে।
বিশেষ করে নিজেকে গড়ে তোলার জন্য ওদের স্ট্রাগলটা খুব প্রভাবিত করেছে আমাকে।


ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি...

তুহিন তালুকদার এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ। কিশোরবয়সের বিকাশকালের চিন্তাধারাকে খুব সুন্দরভাবে ধরেছে ছবিটি।

এক লহমা এর ছবি

লেখা ভাল লেগেছে। চলচ্চিত্রটি দেখার ইচ্ছে হচ্ছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

তুহিন তালুকদার এর ছবি

সংগ্রহ করে দেখে ফেলুন। পস্তাতে হবে না, নিশ্চয়তা দিচ্ছি হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক দেখতে ইচ্ছে করছে সিনেমাটা এখনই

দেবদ্যুতি

তুহিন তালুকদার এর ছবি

সংগ্রহ করে দেখে ফেলুন হাসি

ফয়সাল এর ছবি

লেখা মিডা হইছে ভাইডি লেখা -গুড়- হয়েছে ।।।।।
আরো কিছু ছাড়েন তাড়াতাড়ি হাসি

তয় লাইনে থাইকেন, দিনকাল খারাপ ব্লগ দিয়ে ইন্টারনেট না চালানিই ভালা গড়াগড়ি দিয়া হাসি

গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু গুরু

তুহিন তালুকদার এর ছবি

@ফয়সাল ভাই, পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
লাইনে থাকার চেষ্টা করব, কারণ বোলোগিং একটা অভিশাপ। শয়তানী হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

দেখিনি, দেখতে হবে ইয়ে, মানে...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

তুহিন তালুকদার এর ছবি

সংগ্রহ করে দেখে ফেলুন হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

জাপানি এনিমেশন দারুন হয়। শিঘ্রই দেখব। লেখার জন্য ধন্যবাদ।

তুহিন তালুকদার এর ছবি

স্বাগতম হাসি

নীড় সন্ধানী এর ছবি

আমার প্রথম দেখা এনিমেশন মুভি গ্রেভ অব ফায়ারফ্লাইজ। অসাধারণ এই মুভিটা দেখার পর জাপানী এনিমেশানের প্রতি ভক্তি এসে গিয়েছিল। এটাও সংগ্রহ করার ইচ্ছে রাখি। রিভিউটা চমৎকার লেগেছে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

তুহিন তালুকদার এর ছবি

আমি নিজেও গ্রেভ অব দ্য ফায়ারফ্লাইজের মাধ্যমে জাপানী অ্যানিমেশন দেখা শুরু করি। তারপর একে একে মিয়াযাকির সবগুলো অ্যানিমে ফিল্ম দেখে ফেলি। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

দুষ্ট বালিকা এর ছবি

বাহ! কেউ স্টুডিও জিব্লি বা জিবুরি (ঘিবিলি -Ghibili ইটালিয়ান শব্দ, কিন্তু যখন স্টুডিও ঘিবিলিকে রেফার করা হচ্ছে তখন এই দুইটা উচ্চরন মাথায় রাখতে হবে, আইদার জিব্লি অর জিবুরি, মিয়াজাকি এইভাবেই বলেন) নিয়ে লিখছে দেখে খুব ভালো লাগলো! সচল ধূসর গোধূলি সেই ডায়নোসর আমলে আমাকে জিব্লি নিয়ে ভুচুং ভাচুং দিয়ে একগাদা নাম ধরায় দিয়েছিলেন।, এরপরে বাধ্যগত ছাত্রের মতো সিনেমা দেখেই হুকড হয়ে যাই!

হুইস্পারার অফ দা হার্ট ভালো লেগেছিলো অনেক, তবে আমার ব্যক্তিগত পছন্দ মাই নেইবার টোটোরো, পনিয়ো, লাপুতা, স্পিরিটেড এওয়ে। আসলে এই সিনেমাগুলো কোনটা কখন দেখতে ইচ্ছা করবে তা নির্ভর করে মুডের উপরে, আর সত্যি কথা বলতে তাহলে সবগুলোর নামই নিতে হবে।

আর মজার ব্যাপার হলো প্রতিটা সিনেমারই বেশ কিছু অন্তনিহিত অর্থ আছে, যেটা কয়েকবার দেখলে খুব ভালো করে বোঝা যায়। আর এই সিনেমাগুলো বেস্ট হলো ছোট একটা বাচ্চার সাথে দেখা, জিব্লির সিনেমা আর একটা বাচ্চা এবং তার নিজস্ব কল্পনার জগৎ, এর চেয়ে মজার কম্বিনেশন মনে হয় দুনিয়াতে নেই!

জাপানে আমার ছোট বোন থাকে, ও সেখানে থাকা অবস্থায় টোকিও গিয়ে জিব্লি যাদুঘরটা দেখে আসার খুব শখ, জানিনা পারবো কিনা!

আর অফিসে মুডসুইং কমাতে ইবে থেকে জিব্লির একগাদা পুতুল আনিয়ে নিয়েছি, মন মেজাজ গরম হলেই ওদের নিয়ে খেলি! খাইছে

মিয়াজাকির করা কিছু টিভি সিরিজ আছে, ডাই হার্ড ফ্যান হলে দেখতে পারেন, লোকটা পাত্থর!

**************************************************
“মসজিদ ভাঙলে আল্লার কিছু যায় আসে না, মন্দির ভাঙলে ভগবানের কিছু যায়-আসে না; যায়-আসে শুধু ধর্মান্ধদের। ওরাই মসজিদ ভাঙে, মন্দির ভাঙে।

মসজিদ তোলা আর ভাঙার নাম রাজনীতি, মন্দির ভাঙা আর তোলার নাম রাজনীতি।

তুহিন তালুকদার এর ছবি

সময় নিয়ে দীর্ঘ মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ। Ghibli বানান দেখে আমি প্রথমে এটাকে ঘিবলি উচ্চারণ করতাম। পরে এক জাপানী বন্ধুর সাথে আলোচনায় আমি আমার ভুল শুধরে নেওয়ার সুযোগ পাই। ঝিবলির অ্যানিমেগুলো কল্পনার অন্য মাত্রায় নিয়ে যায়, যার সাথে আমার আগে পরিচয় ছিল না।

মিয়াযাকির অ্যানিমে সবগুলোই আমার খুব প্রিয়, তবে সবচেয়ে প্রিয় 'প্রিন্সেস মনোনকি'। মহাকাব্যিক বিস্তারে প্রকৃতিপ্রেমের গল্পটি আমার দেখা সেরা ফিল্মগুলোর একটি।

তানিম এহসান এর ছবি

ভাল লাগলো।

তুহিন তালুকদার এর ছবি

ধন্যবাদ।

রাজিব মোস্তাফিজ এর ছবি

খুব ভালো লাগলো রিভিউটা -- মিয়াযাকির The wind rises খুব ভালো লেগেছিল !

----------------------------------------------------------------------------
একশজন খাঁটি মানুষ দিয়ে একটা দেশ পাল্টে দেয়া যায়।তাই কখনো বিখ্যাত হওয়ার চেষ্টা করতে হয় না--চেষ্টা করতে হয় খাঁটি হওয়ার!!

তুহিন তালুকদার এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।