বিদেশে চাকুরী

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ১৭/০৭/২০১৫ - ৯:১২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শ্রমিক হিসাবে বিদেশ যাত্রার চেষ্টা কালে তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারনে মেডিকেল টেষ্টে আনফিট হলে কেউ কেউ পরামর্শের জন্য আসে। আমি চিকিৎসা প্রসঙ্গের বাইরে একথা ওকথা আলাপ করি। অনেকের বেতন বাংলাদেশী টাকায় পনের-বিশ হাজার টাকা মাত্র। বলি, বউ বাচ্চা ফেলে বছরের পর বছর বাইরে পড়ে থাকবেন। এ টাকাতো দেশেও কামানো যায়। সে বলে কেমনে? কি কইরা? আমার কাছে অবশ্য জবাব নাই।
এই ধরেন যে টাকাটা খরচ করে আপনি যাচ্ছেন, তা তুলতেই তো বছর দেড়েক মাগনা খাটুনি দিতে হবে। তাইলে? সে ক্ষীন কন্ঠে বলে, করার কিচ্ছু নাই।
বাচ্চা কাচ্চা বউ ফেলে সুদুর পরবাসে, বছরের পর বছর। খারাপ লাগেনা? বলে, তাদের জন্যইতো যাচ্ছি। তাদের ভবিষ্যৎ আছেনা? একটু ভালভালাই চলতে হবেনা?
কেউ সংসারের অনটন থেকে রেহাই পেতে, কেউ ঋনে ডুবে গেছে দেনা শোধ করবে, কেউ বাচ্চাকে শহরে পড়তে পাঠাবে, কেউ বাপ মায়ের চিকিৎসাটা ভালমত করাবে, কেউ বেকারত্বের তকমা গা থেকে মুছবে- একেক জনের একেক স্বপ্ন।

অনেক সময় প্রবাসীদের স্ত্রীরা ব্যাখ্যাহীন কিছু ব্যাথা বেদনা, অস্হিরতা, জ্বালাপোড়া, বুক ধড়ফড়- ইত্যকার সমস্যা নিয়ে আসে। টেষ্টে কিছু ধরা পড়েনা। জিজ্ঞাস করার আগেই ধারনা করা যায় স্বামী হয়তো বিদেশে থাকেন। পরে যখন জানতে চাই, বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই অনুমানটি মিলে যায়। এমনো আছে বিয়ের দুদিন পর বিদায় দিয়ে এসেছে তারপর আর দেখা হয়নি বহু বছর। একদিকে মেয়েটির সঙ্গীহীনতা, শরীর ও মনের চাহিদাকে অবদমিত করে রাখা, অন্যদিকে বৈরী সামাজিক,পারিবারিক পরিবেশ- এসবকিছুর মনোদৈহিক প্রকাশ এসব উপসর্গগুলি। পরীক্ষানিরীক্ষার কাগজে ট্রাংক ভরে যায়। রোগ ধরা পড়েনা। সমস্যার মুলে আর যাওয়া হয়না।

কর্মক্ষম মানব শক্তির তুলনায় আমাদের কর্মসংস্হানের সুযোগ অনেক কম। বিশেষ করে অদক্ষদের জন্য। বিদেশী চাকুরীর সুযোগ ও বেতনভাতা দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমিকদের মধ্যে বহু যোজন তফাত। সেই বিশেষ দক্ষতা অর্জনের সুযোগ এদেশে অনেক কম । বিদেশ যাবার সময় আমাদের শ্রমিকরা নিজেরাও জানেনা তারা কি কাজ করবে। পাশের দেশ ভারত এদিক দিয়ে অনেক দূরদর্শী ও অগ্রগামী। আমাদের দেশে কারো দুইটা পয়সা হলে জাগতিক বা বৃত্তিমুলক শিক্ষাপ্রতি্ঠানের বদলে বেকার ও পরনির্ভরশীল তৈরীর মজমাখানা কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা শুরু করি। অথচ কল্পনা করুন আপনার প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেউ এমন শিক্ষা বা দক্ষতা পেল যেটা সম্বল করে সে মানব সম্পদে রূপান্তরিত হয়ে গেল, কর্মবাজারে প্রবেশ করলো, সে তার পরিবার পরিজনদের নিয়ে ভালো থাকলো- এটা কি বড় এক মানবিক ও পূন্যের কাজ নয়?

বছর দুয়েক আগে একজন বেকার ছেলের একটা চাকুরীর আবেদন করে ফেসবুকে পোষ্ট দিয়েছিলাম। বেকারত্ব বিষন্নতা নিয়ে আসে । আর সাথে যদি পারিপার্শ্বিক কটাক্ষ যোগ হয়- সব মিলিয়ে তার ভিতরটা কুকড়ে যায়। ছেলেটার তাই হয়েছিল। দরজা জানালা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকতো । ফেসবুকের পোষ্টটির পর আমেরিকা প্রবাসী একজন আমার সাথে ইনবক্সে যোগাযোগ করেন। তার ঢাকাস্হ Mend care এ একটা জব দেন। অনেক কৃতজ্ঞতা তার প্রতি। কাজটা পাবার আগে সে লুকিয়ে থাকতো, বাস রিক্সায় উঠতো না। ভয় পেতো। আমি ধারনা করেছিলাম ওর ফোবিক ডিসঅর্ডার কিনা । কিন্ত চাকুরীটা পাবার পর তার ব্যাক্তিত্বে সে কি পরিবর্তন। কোথায় পালিয়েছে সে ট্রান্সপ্রোর্ট ফোবিয়া। পরে দেখি কাজের স্বার্থেই সারা ঢাকা শহর টো টো করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাকুরী ও স্বনির্ভরতা এমনই মহৌষদ।

পরে আরেকজন এসএসসি পাশ শারীরিকভাবে সুঠাম ছেলের একটা কাজের জন্য ফেসবুকে আরেকটা স্ট্যাটাস দেই। তার অবশ্য পরে কিছু হয়নি। সরকারী চাকুরীর জন্য সে জুতার তলি অনেক ক্ষয় করেছে । সর্বশেষ চেষ্টাটা ছিল চট্রগাম বন্দরে। খালাসী টাইপের পোষ্টের জন্য আড়াই লাখ টাকা ঘুষ দিবে কথা পাকাপাকি ছিল। আরেক জন ওভারট্রাম্প করে সেটা নিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে চাকুরীর বয়স শেষ।

আমার এক উদ্যোক্তা চিকিৎসক বড় ভাইকে বলেছিলাম তাঁর কোনাপাড়ার হাসপাতালটিতে তার শিক্ষাগত যোগ্যতানুযায়ী একটা কাজ দেয়া যায় কিনা। উনি তখন হজ্জ্বে ছিলেন। বললেন, হজ্জ শেষে দেশে ফিরে তিনি দেখবেন। আমি ছেলেটিকে তা জানিয়ে দেই। এ সমান্য আশ্বাসেই বকরী ঈদের আগেই তার মুখে ঈদের হাসি ফুটে উঠে। তাকে অবশ্য কাজ দেয়া সম্ভব হয়নি। আমিও লজ্জায় তার মুখোমুখি হইনা। ঐ যে বলছিলাম, কাজ পাওয়া অত সহজ না। অত সহজ হলে মালয়েশিয়ার মাটির নীচে বাঙ্গালীর হাড়গোড় পাওয়া যেতনা। ভাগ্যের সন্ধানে মানুষ ট্রলারে চড়ে বসতোনা।

মানব পাচারের কথা এই সেদিন থেকে শুনছি। কিন্ত এটা মনে হয় চলে আসছে বহু বছর থেকেই। কেন বললাম, ২০০৮ সালে আমার কাছে এক মা এসেছিল ঘন ঘন দাত মুখ খিচে যায় - এ সমস্যা নিয়ে। পরে জানলাম তার ১৭ বছরের ছেলেটি ৮ লাখ টাকা খরচ করে বিদেশ গিয়েছিল কিন্ত বেশ কয়েকমাস পরও তার কোন খবর পাওয়া যাচ্ছেনা। ২০১২র দিকে আবার এসেছিল। তখনো তার সমস্যা কাটেনি, তখনো ছেলের খোজ মিলেনি।

এত কষ্ট করে, যৌবন ও সাংসারিক জীবনকে বিগত করে, প্রবাসী শ্রমিকরা যা পাঠায় তাকে আমরা আদর করে রেমিটেন্স বলি। আমরা যে এসি রুমে বসে নানাবিধ ফুটানী করি, গোলাভরা রিজার্ভের বড়াই করি, এদিক সেদিক টাকাপয়সা টুপাইস করি- এতে এ শ্রমিকদের ঘাম ও শ্রম মিশে আছে। এদেরকেই দুতাবাসে হোক, কিংবা এয়ারপোর্ট বা বিমানেই হোক লেবার নামে অচ্ছুৎ জ্ঞান করা হয়।

কানাডার টরেন্টো ও অন্যান্য স্হানে নাকি ''বেগম পাড়া'' নামক জায়গা আছে। ঐ খানে আমাদের অনেক আমলা, রাজনীতিবিদ ও ব্যাবসায়ীদের বউ বাচ্চারা থাকে। তাদের সন্তানরা পড়ে সেদেশের সবচেয়ে ভাল স্কুলগুলিতে। সাহেবরা এদেশেই চাকুরী, ব্যাবসা ইত্যাদি করে। মাঝে মাঝে বেগমদের সময় দিতে বিদেশ ঘুরে আসে। আর ঘুষ, দূর্ণীতি মুনাফাখোরী ও শ্রমিকের রক্তচোষা অর্থগুলি মালয়েশিয়া, কানাডা, আমেরিকা, ব্রিটেন ইত্যাদি দেশে বিনিয়োগ করে আসে।
যেসব শ্রমিকরা জীবনের সর্বস্ব ত্যাগ করে রেমিটেন্স পাঠায় তাদের সাথে বেগম পাড়ার স্বামীদের কি অদ্ভূত বিপরীতমুখীনতা! গরীবেরা দেশে টাকা পাঠায় আর অবৈধ পয়সায় ধনীরা দেশের বাইরে টাকা পাচার করে।
==============
আমিনুল ইসলাম


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

অনেকের বেতন বাংলাদেশী টাকায় পনের-বিশ হাজার টাকা মাত্র।

আচ্ছা, এই লোকগুলাকে কোনোভাবেই দেশে থাকতে প্রণোদিত করা যায় না কেন?

আমাদের দেশে কারো দুইটা পয়সা হলে জাগতিক বা বৃত্তিমুলক শিক্ষাপ্রতি্ঠানের বদলে বেকার ও পরনির্ভরশীল তৈরীর মজমাখানা কওমী মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করা শুরু করি।

হ, নিজেদের জন্য দুনিয়াবি আর অন্যের জন্য আখেরাতি। দুইই হল। মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

হাসিব এর ছবি

আচ্ছা, এই লোকগুলাকে কোনোভাবেই দেশে থাকতে প্রণোদিত করা যায় না কেন?

দেশে কাজ নাই আসলে। বাংলাদেশ থেকে যারা ১৫/২০ হাজার টাকায় বাইরে কাজ করতে যায় তারা দেশে ১৫/২০ টাকা পাবে এরকম কাজ পাবে না।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

সেক্ষেত্রে, দেশেই ঘাড় ধরে ট্রেনিং-ট্রুনিং দিয়ে বিদেশে এদের প্রাপ্য বাড়ানো যায়?

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

হ্যাঁ দেশে দক্ষতা বৃদ্ধির ট্রেনিং দিয়ে বিদেশে তাদের প্রাপ্য বাড়ানো যায়। ভারত যেটা দারুন ভাবে করে যাচ্ছে।
=============
''আঁধারের সিধ কেটে বাইরে এসো''

প্রোফেসর হিজিবিজবিজ এর ছবি

আমার পরিচিত এক লোকের কথা বলি। সে তার দেশের জমি বিক্রি করে এবনং ঋণ করে মধ্যপ্রাচ্যে গিয়েছিল। কিছুদিন কাজ করার পরে তাকে ফেরত আস‌তে হয়েছিল অবৈধ ভিসার জন্য। ঋণ শোধ করবার সাধ্য নেই বলে গ্রামে যায়নি। ভাগ্যক্রমে ঢাকায় এক গাড়ীর ওয়ার্কশপে কাজ পেয়ে যায়। সেখানেই আমার সাথে আলাপ, এবং পরে তার ঘটনা জানতে পারি। তার মধ্যে এখনো ইচ্ছে আছে সুযোগ পেলে সে আবার বিদেশে যাবে। জিজ্ঞেস করেছিলাম এখন সে কেন যেতে চায় - সে তো মোটামুটি ভাল বেতনে চাকরী করছে, গ্রামে টাকাও পাঠাচ্ছে । উত্তর দেয় না, খালি হাসে।

____________________________

অতিথি লেখক এর ছবি

আমার এক পরিচিত মানুষ গিয়েছিলেন সিংগাপুরে। দেশে তাঁদের জমিজমার অভাব নেই, বাড়িতে বাঁধা কাজের লোক থাকে সারা বছর। তিনি গিয়েছিলেন অল্প দিনে বেশ টাকাপয়সা কামানোর ইচ্ছা নিয়ে, কোনোরকমে আট মাস সেদেশে থাকার পর তার থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। যাওয়ার পর থেকেই ফোনে কান্নাকাটি চলতো নিয়মিত। যাই হোক, ভদ্রলোককে বাড়ি থেকে উদ্যোগ নিয়ে ফেরত আনা হয়। পরিচিত কাউকেই আর বিদেশ যেতে দেওয়ার ঘোরতর বিরোধী তিনি।

দেবদ্যুতি

হাসিব এর ছবি

এটা সাধারণীকরণ করা যাবে এরকম উদাহরণ নয়। বেশিরভাগ শ্রমিক যারা অল্পবেতনে মধ‍্যপ্রাচ‍্য বা পূর্ব এশিয়াতে যায় তাদের আসলে দেশে কনসিস্টেন্ট আয় নিশ্চিত করবে এরকম কাজ নেই।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ভাল লাগল লেখাটা

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

অতিথি লেখক এর ছবি

রেমিটেন্স সোনাবাবুর গায়ে যেমন করে আদুরে হাত বুলানি হয়, রেমিটেন্স এর স্রষ্টা মাতা বা পিতার প্রতি যুগ যুগ ধরে আমাদের সরকার বেখেয়াল।কোনোরকমভাবে বোঝা দেশ ছাড়া হলেই হয় যেন!

-সরল গরল

মেঘলা মানুষ এর ছবি

এর আরেকটা বড় কারণ হল: একসময় অনেকেই বিদেশে গিয়ে অনেক আয় করে দেশে ফিরেছেন। তাদের সাফল্যের গল্প আশে পাশের ১০টা গ্রামের মানুষকে উৎসাহিত করে। এখন যে সময় অনেক কঠিন, আগের মত না- এটা অনেকক্ষেত্রেই উপলব্ধি করেন না। মন খারাপ

এর পাশাপাশি আছে দাললাদের প্ররোচনা।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।