রসগোল্লা -২

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ৩১/০৭/২০১৫ - ৭:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

"আসুন আসুন" বলে শফিককে হাসি মুখে অভ্যর্থনা জানালেন রসগোল্লার বাবা। " মুনা এদিকে এসো তোমার মহাকাব্য চলে এসেছে " বলে শফিকের সাথে করমর্দন করতে করতে শফিক আসার বার্তাটা ভিতর ঘরে পৌঁছালেন। শফিক সোফায় বসে রসগোল্লার জন্য আনা খেলনা দেখিয়ে রসগোল্লাকে আদুরে কন্ঠে কাছে ডাকল। খেলনা বলে কথা রসগোল্লা একবারে চলে এলো। এমন কি কোলেও বসল। বসার পরক্ষনেই সোফার এক পাশে রাখা শফিকের মোবাইল নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। খেয়াল খুশি মত তুলতুলে পিচ্চি পিচ্চি আঙ্গুল দিয়ে আচঁড়ে যাচ্ছে। মোবাইলের রং বেরংয়ের স্লাইডিংয়ে চুপিচুপি হাসছে। পিছন থেকে তার বাবার আওয়াজ " বাবা ধরে না" মাথা তুলে বাবার দিকে একবার তাকিয়ে রাগী সুরে 'ঊঁম " একটা শব্দ করে সে আবার নিজের মত ব্যস্ত। "থাক, থাক ভাইয়া,খেলুক' বলে শফিক রসগোল্লাকে টকিং টম এ্যপটি খোলে দিল। টকিং টম বাথরুমে যাবে ইশারা করছে আর রসগোল্লার পিচ্চি আঙ্গুলের ছোঁয়ায় তার সামনে খাবার টেবিল এসে হাজির। বেচারা টমকে রসগোল্লা বড্ড বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে দেখে শফিক হাসছে। এমন সময় ভেতর থেকে লেবুর শরবত হাতে হাজির তার মা। অভ্যাস বশত সালামের সাথে সম্মান দেখাতে গিয়ে শফিক বসা থেকে রসগোল্লা সমেত দাঁড়িয়ে গেল। আচমকা দাঁড়াতে গিয়ে রসগোল্লাকে ধরলেও মোবাইল পড়ে গেল। সাথে সাথে রসগোল্লার মুচড় শুরু। "এতোক্ষন ঐ যন্ত্রের জন্যই কোলে ছিল" বলে তার মা শরবতের ট্রে টেবিলে রাখতে রাখতে কুশল বিনিময় করে নেন।

"তোমরা কথা বল,আমি বিলগুলো সেট করে দেয়,নয়তো আবার লেট ফি যোগ হয়ে যাবে'বলে রসগোল্লার বাবা পাশের কম্পিঊটার টেবিলে বসে পড়েন। উন্নত দেশ উন্নত সিস্টেম অনলাইনে যাবতীয় বিলের পরিমান আর তারিখ সেট করে দিয়ে কেউ যদি পাঁচ মাস দেশের বাইরে থাকে কোন সমস্যা নাই। সময় মত যেখানে যত সেট করা থাকে তত চলে যাবে। "ভাই অনেক কষ্ট করলেন,আমেরিকায় কেউ কোন বিনিময় ছাড়া কারো জন্য পাঁচ মিনিট ব্যয় করে না,আর আপনি কত কষ্ট না করলেন,বেশি দিন হয়নি এখানে মনে হচ্ছে? জানতে চান রসগোল্লার মা। "ঠিক বলেছেন আপা ওবামার দেশ এখনো আমাকে পুরোপুরি যন্ত্র বানাতে পারেনি ,দুই বছর শেষ হল। আর কষ্ট করলাম কোথায় আপা,আপনার লিখা পড়ে নিজের মায়ের চেহারা মনে পড়ছে বার বার দায়টা সেখানেই" বলে শফিক আপার এগিয়ে দেয়া শরবতের গ্লাস হাতে নেয়। "বাইরে আজ গরম পড়ছে তাই আগে একটু লেবুর শরবত দিলাম ভাই দাদী-নানীর কায়দায়।" বলতে বলতে রসগোল্লার হাত থেকে শফিকের মোবাইল উদ্ধারের চেষ্টা চালান তার মা। " ভালোই হল আপা,ভাল লাগছে" শরবতে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর গিলে শফিক ঘরের চারপাশ দেখছে। ভিন্ন সংস্কৃতির এক দেশে থেকেও নিজের দেশ আর সংস্কৃতিকে ধরে রাখার যথেষ্ট চেষ্টা নজরে আসছে । শোকেসে সাজানো মাটির কাপ-প্লেট, দেয়ালে ঝুলানো মাটির কলস,হাতের তৈরী নকশা,জয়নুল আবেদিনের ছবি,গ্রামীন প্রকৃতির ছবি। ঘরে ঢুকতেই চোখ পড়ে বাংলাদেশের কবি সাহিত্যিকের নানা ধরণের বইয়ে সাজানো শেলফের দিকে। যার চার পাশ কয়েকটি উচু বাক্স দিয়ে ঘেরা ।রসগোল্লার হাতের নাগাল না লাগার জন্য এই সুরক্ষা ঘের বুঝাই যাচ্ছে। তিন জনের ছোট্ট একটি পরিবার ।

" তারপর তোমাকে তুমি করেই বলি আমার ছোট ভাইয়ের বয়সী হবে তুমি' বলে রসগোল্লার বাবা কাজ সেরে কথোপথনে যোগ দিল। প্রথম পরিচয়ে যতটুকু বলা যায় ততটুকু নিজের সম্পর্কে বয়ান করে কাঁধের ব্যাগ থেকে ডায়রীকে তার যথা স্থান তথা রসগোল্লার মায়ের কাছে এগিয়ে দিল। তিনি গাল ভর্তি হাসি নিয়ে তা গ্রহন করলেন। কয়েক পৃষ্ঠা দেখে নিয়ে "তোমরা কথা বল আমি নাস্তা নিয়ে আসি' বলে তিনি চলে গেলেন। রসগোল্লাকে তার বাবা রকিং চেয়ারা বসিয়ে দিয়েছে। সে টিভি দেখছে আপন মনে " টেক দি ট্যাক্টর"। তাদের কথার মাঝখানে কলিং বেল বেজে উঠে, কথা থামিয়ে তিনি চেক করে দরজা খুলে দেন এক মাঝ বয়সী শেতাঙ্গ মহিলাকে। মহিলা ভিতরে ঢুকে শফিককে ' হ্যালো বলায় সেও ভদ্রতার সাথে হ্যালো জানায়। অন্যদিকে তাকে দেখে রসগোল্লার পা নাচানাচি ,হাত ছুড়াছুড়ি বেড়ে যায়। সে রকিং চেয়ারে থাকতে চাই না। মনে হচ্ছে রসগোল্লা মহিলাকে চিনতে পেরেছে।

" বুঝলে ভাই ছেলেটা আমার ফাইটার বলতে পারো, জন্মের পর থেকে আজো সে ফাইট করছে। এই যে মহিলাটা তার স্পীচ থেরাপিষ্ট ' নিশ্বাস ছেড়ে বলে রসগোল্লার বাবা। শফিক সম্মতি দিয়ে বলে তা ঠিক ভাইয়া ডায়রীতে ওর সম্পর্কে পড়ে ওকে না দেখে ওর জন্য কষ্ট অনুভব করেছিলাম। এতোটুকু বাচ্চার হার্নিয়ার সার্জারীও হয়েছিল। কেন এমন হয় ডাক্তাররা কিছু বলেছে? এখন কি অবস্থা ওর?জানতে চায় শফিক।

" কারণ বলতে নিদিষ্ট কিছুই বলেনি তারা। বিড়ি সিগারেট,মদের কথা বলেছে। যা আমাদের বাঙ্গালী মেয়েদের সংষ্কৃতির বিপরীত। তাছাড়া হসপিটালে অনেক দেশী প্রিমি বাচ্চা দেখেছি। বডিও তো ইউনিভার্সাল না। কার হবে ,কার হবে না তা বলা যায় না। এটা নিয়ে নাকি গবেষনা চলছে । তীর খুজে পাচ্ছে না । তবে আশার কথা আল্লাহ'র অশেষ রহমতে এখন ভালোর দিকে আছে । চিকিৎসকরা বলছে সে তার বয়সের তুলনায় ৩৩% পিছিয়ে আছে। অর্থাৎ ও সব করবে কিন্তু একটু সময় নিবে। স্বাভাবিক বাচ্চা যা ঝটপট ধরতে,শিখতে পারে সেটা ওর ক্ষেত্রে ধীর গতিতে হবে। সপ্তাহে তিন দিন দুজন থেরাপিষ্ট আসে। ফিজিকাল আর স্পীচ। আধা ঘন্টা করে ওকে সময় দেয়। ছয় মাস পর পর রিপোর্ট দেয়। বয়সের সাথে সাথে তার শারিরীক ,মানসিক উন্নতি গুলো দেখা হয়। আর জন্মের পর থেকে তো শরীরের বিভিন্ন অংশ যেমন ঃ চোখ,কান,এসবের ফলো আপ তো চলছে-অনেকটা এক টানা বলে গেলেন রসগোল্লার বাবা।

" ভাইরে দেশে থাকলে হয়তো মা-বাবা ডাকও কপালে জুটতো না । দেশে কি প্রিমি বাচ্চা্র সঠিক চিকিৎসা আছে" বলতে বলতে আপা টেবিলে নাস্তা সাজিয়ে ডাক দেয়। যতটুকু জানি এখন অনেকে অকোপেশনাল থেরাপি নিয়ে পড়াশুনা করছে। আমার এক বন্ধুর ছোট ভাই পড়ে শুনেছিলাম। তবে ক্ষেত্রটি এখনো তেমন প্রতিষ্ঠিত না । আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে জানি, ভাল কিছু নিশ্বয়ই পাবেন-সাহস দিয়ে সমবেদনার কন্ঠে জানায় শফিক। আমেরিকায় আসার পর শফিক প্রথম প্রিমি শিশুর কথা শুনে তা কাজের ইন্ডিয়ান ম্যানেজারের কাছে। তার জমজ বাচ্চা হয়েছিল সাড়ে সাত মাসে। কাজে এসে কেমন জানি মন মরা থাকতো। একদিন ক্লোজিং শিফটে শফিকের সাথে এভাবেই শেয়ার করে ছিল সে তার হসপিটালে ভর্তি বাচ্চার কথা। দেশে থাকতে কখনো এমন বাচ্চা হওয়ার কথা শুনেনি কারো কাছে। তাই সাড়ে সাত মাসে বাচ্চা হও‍য়ার কথা শুনে প্রথমে বিশ্বাসই করতে চাইনি সে। আমেরিকায় এর হার অনেক বেশি বলা যায়। তাই প্রতি বছর নভেম্বর মাসে এদেশে প্রিমি দিবস পালন করা হয়। তাদের চিকিৎসার জন্য ফান্ড করা হয়।

" তোমরা খাওয়া শুরু কর,আমি বাবুইকে দেখে আসি' বলে আপা ভেতরে রূমে চলে গেলেন। আর রসগোল্লার বাবা শফিকের আজ অফ ডে জেনে "পাত্তি(কার্ড খেলা) খেলার আমন্ত্রন জানায় " আজ আমারো অফ চলো ভাই খেলি ,জীবনে সমস্যা থাকবে ,এর ফাঁকে একটু আনন্দও খুজে নিতে হবে কি বল ?"। খেলার এক পর্যায়ে "বিয়ে তো করনি এখন মজা করে নাও,সংসারের ঘানি টানা শুরু হলে জীবন তেজপাতা হয়ে যাবে। আমার এক বন্ধু বলে বিয়ের পর নাকি ছেলেরা "মরহুম হয়ে যায়। তাই বিয়ের পর তাদের উচিত নামের শেষে মরহুম টাইটেল ধরা। বুঝলে------সকালে উঠেই বউ বাজারের লিষ্ট ধরিয়ে দিবে----হুম---কিছুক্ষন পর শফিকে বুঝল কথা গুলো মুনা আপাকে ক্ষেপানোর জন্য বলা হচ্ছে। আপা এসেছিল রসগোল্লার একটা পেপারে সই করাতে। আপা ঐ মহিলাকে বিদায় জানাতে চলে যেতেই তার কন্ঠে অন্য সুর। " বুঝলে ভাই দেশে আমার ভরা পরিবার কিন্তু এখানে তেমন কেউ নাই। তোমার আপাটা বাচ্চাকে নিয়ে সব সময় টেনশনে থাকে। তাকে ঐ জায়গা থেকে সরাতে মাঝে মাঝে এমন করি। বলতে বলতে খেলায় চাল দেয়।

" আয় আয় চাঁদ মামা/টিপ দিয়ে যা/চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা/
তায় তায় নানা বাড়ি যায়/ নানা খেল গরুর গুতা/পালায় পালায়/
আয় আয়,তায় তায়/চাঁদ মামা নানা বাড়ি যায়/নানা খেল গরুর গুতা ,চাঁদের কপালে চাঁদ টিপ দিয়ে যা/'"
(পাশের রুম থেকে মুনা আপার ছড়ার আওয়াজ ভেসে আসে)

এই হল রসগোল্লাকে খাওয়ানোর অভিযানের অংশ। 'দেখো অবস্থা,ছেলেটাকে খাওয়ানো হল সবচেয়ে কঠিন কাজ, খিচুড়ি খাওয়াতে গিয়ে প্রতিদিন এভাবে তার মা ছড়ার খিচুড়ি বানিয়ে ফেলে। সবশেষে দেখা যাবে খাওয়া বাটির অর্ধেকও নড়েনি" তার বাবার কথা শুনছে আর চাল দিচ্ছে শফিক। চলে আমেরিকার অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে নানা কথাও। কথা প্রসঙ্গে চলে আসে শফিকের রেষ্টুরেন্টের একটি ঘটনা। দুই জোড়া যুগল খেতে এসেছিল। বিল হয়েছিল একশ চল্লিশ ডলার। খাওয়া শেষে বিল দিতে গিয়ে সৃষ্টি হয় ঝামেলা। কারো কাছে টাকা নাই। ঘটনার সুরাহা হয়েছিল সিকিউরিটি পুলিশের হস্তক্ষেপে। তারা পুলিশকে জানায় 'অমুক ভেবেছে তমুক খাওয়াচ্ছে" আর তমুক ভেবেছে অমুক খাওয়াচ্ছে" এভাবে তাদের খেতে আসা। আদতে দুজনের পকেটে সব মিলিয়ে আছে পঞ্চাশ ডলার। পরে মালিক এসে সব শুনে যুগলদ্বয়কে মাফ করে দেন। "এদেশে আবার যুগল ! সব ওয়ান টাইম,তার উপর এই অপমান ,খবর নিলে দেখবে ঐদিনই মেয়েরা ছেলে দুটারে ছেড়ে চলে গেছে " ঘটনা শুনে হেসে হেসে বলে রসগোল্লা বাবা।
ঘড়ি দেখে শফিক যাওয়ার কথা ভাবে। দেশে এখন রাত আর তৃণা অপেক্ষা করছে তার ফোনের। শফিকদের বাসা থেকে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার কথা চলছে। কিন্তু মোবাইল গেল কই---সবাই এক সাথে খোঁজা শুরু করে । আপা রসগোল্লার এমন কান্ডে অত্যন্ত দুঃখিত চেহারা নিয়ে সব ঊল্টিয়ে খুজঁছে। হঠাৎ শফিক বলে উঠে " আপা বাথরুমে একটু চেক করা দরকার" । নাহ সেখানেও পাওয়া গেল না। রসগোল্লা খাচ্ছিল,তাকে কোলে করে বসার রুমে এনে আপা জিজ্ঞেস করে " বাবা বুম বুম কোথায়? বাবা বাবা হ্যালো কোথায়? উত্তরে সে শুধু বুম বুম ছাড়া আর কিছু বলে না।

কিছুক্ষন পর গার্বেজ ক্যান থেকে সেটি হদিস মিলে। কখন সে ফেলে দিয়েছে কেউ খেয়াল করেনি। রসগোল্লা একদিন তার মাকে গার্বেজে ময়লা টিস্যু ফেলতে দেখার পর থেকে নাকি সে প্রায় ঘরের প্রয়োজনীয় কিছু না কিছু গার্বেজে ফেলছে। অন্যদিকে তাকে দুপুরের খাবার না খাইয়ে ছাড়বে না তারা। অবশেষে থাকতে হল তাকে। আর খাওয়ার কথা বড় বোনকে জানাতে গিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে দেখে কল যাচ্ছে না। সেটিংসে দেখা গেল কলিং মুড চ্যাঞ্জ হয়ে আছে। বুঝতে বাকী নেই এটা রসগোল্লার কান্ড।

খাবার টেবিলে সবার সাথে রসগোল্লাকে তার বিশেষ চেয়ারে বসিয়ে দেয়া হল। তার বিশেষ মিকি মাউস প্লেটে মা তাকে অল্প ভাত দিয়েছে। এটা তার প্রশিক্ষন পর্ব "কিভাবে হাতে খেতে হয়"। সবার খাওয়া শুরু ।রসগোল্লাও একটি একটি করে ভাত মুখে দিচ্ছে। এর বেশি সে নিতে পারছে না। কিছুক্ষন পর ভাত নিয়ে খেলছে দেখে মায়ের শাসনের সুরে সে রাগ করে দুই হাতে সমানে ভাত ছিটিয়ে যায়। একসময় পুরো প্লেট উল্টিয়ে মাথায় তুলে দেয়। সারা শরীরে ভাত। আপা তাকে পরিষ্কার করতে নিয়ে যায়।'শফিক খাও খাও,এটা নিত্য চিত্র,আমার ছেলে প্রতিদিন নতুন নতুন কান্ড করে। খাওয়া শেষে তোমাকে মজার একটা ভিডিও দেখাবো" বলতে বলতে মাছের মাথা তুলে দেয় শফিকের থালায়।

যাওয়ার আগে শফিক রসগোল্লাকে আরেকটু আদর করার জন্য অপেক্ষা করছে। ঘরের ভিভিআইপি পরিষ্কার হয়ে আসতে আসতে শফিক সে মজার ভিডিও দেখছে। রসগোল্লাকে নার্স ওজন নিতে এসেছে। সঠিক ওজনের জন্য রসগোল্লার শরীরে কোন কাপড় রাখা হয়নি । ডায়পারটা খুলতে খুলতে নার্স বলছে "নো পি পি,নো পি পি বেবি" যেই ট্রেতে বসাতে যাবে অমনি সে নার্সের গায়ে নামিয়ে দিল এক পশলা বৃষ্টি " উঁই ঊঁই "।

আদরের পর্ব সেরে বিদায়ের পর্ব। পরিবারটিকে ভাল লেগে গেছে শফিকের। তারাও শফিককে ভাল ভাবে গ্রহন করেছে। মাঝে মাঝে আসার আমন্ত্রন করেছে। শফিক রসগোল্লার কান্ড সম্বলিত ডায়রী পড়ার শর্তে মাঝে মাঝে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রসগোল্লা তার বাবার কোলে করে শফিককে রাস্তা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে আসে। রসগোল্লার বাবা বেশ রসিক মানুষ । শফিকের সাথে বিদায়ী করমর্দন সারতে সারতে বলেন " এখনো কাঁচা ডালের জীবন , মাঝে মাঝে বেরিয়ে যেও"। শফিক বুঝেনি দেখে ,শফিকের আগ্রহে তিনি রাস্তায় দাঁড়িয়ে কাঁচা ডালের গল্প ব্যাখ্যা করেন।

" বুঝলে যখন আমি ডিবি নিয়ে আমেরিকা আসি ,শুকনো ব্রেড খেয়ে আমি আর পারছিলাম না। বাঙ্গালির ডাল-ভাতের পেট ,বুঝলে না। দেশে আমার বড় চার ভাই ,ভাবীদের রান্না খেয়ে দিন পার। এখানে কেউ নাই। বাধ্য হয়ে পেটের দায়ে রান্না ঘরে ঢুকি। চড়ুই ভাতির অভিজ্ঞতা থেকে ভাতের ভিতর ডিম আর আলু দিয়ে । থ্রি ইন ওয়ান রান্না করি। ডাল রান্না বড় কঠিন লাগে। বাড়িওয়ালী সিলেটি ভাবিকে ফোন দিয়ে রেসিপি নিয়ে ডাল সিদ্ধ পর্যন্ত করতে পেরেছিলাম কিন্তু বাগার দিতে পারিনি। তাই কেমন যেন কাঁচা কাঁচা গন্ধ থেকে গিয়েছিল বাগার আমার কাছে পৃথিবীর জটিলতম কাজ মনে হয়েছে। তাই দেশি স্বাদ আর পেলাম না। তোমার আপা আসার পরদিনই আমি রসুনের সুন্দর পুড়া ঘ্রাণের , সুগন্ধিযুক্ত ডাল খেলাম তৃপ্তির সাথে। তখন আমার কাছে মনে হল বউহীন জীবন বাগারহীন ডাল। আর বউ থাকলে জীবনে তুমি সুঘ্রাণ পাবে-- বলে অট্টহাসিতে শফিকের পিঠে চাপড় দিলেন কয়েকটি। শফিকও যোগ দিল সে হাসিতে। তারপর বিদায়।

মনে মনে শফিক নিজেকে ধন্যবাদ দিল। আসার সিদ্ধান্ত না নিলে ভাল মনের এই মানুষগুলোর সাথে পরিচয় হতো না। শফিক অনেককেই দেখেছে যারা পোশাকে -কথাবার্তায় নিজেকে আর সাথে সন্তানদেরও এদেশী বানাতে ব্যস্ত থাকে গর্বের সাথে। এদের কথায় বা চলনে তা নেই। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সেও আপার মত করে তাদের সন্তানের প্রতিটি মুহুর্ত ধরে রাখবে । যেতে যেতে তৃণার সাথে তার সুখের সংসার চোখে ভাসে।
এ্যানি মাসুদ
আগের পর্ব
( আপাতত রসগোল্লার ইতি টানলাম,রসগোল্লাকে নতুন নতুন কান্ড ঘটানোর সময় দিলাম। ভবিষ্যতে আবার শুরু হবে)


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।