বর্ষীজোড়া ইকো পার্কের নিস্তব্ধতা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ৩১/০৭/২০১৫ - ৫:০২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আজ রাতে ঢাকা শহর থেকে যদি ৫০ লাখ মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয় তাহলে আগামীকাল সকালে ঢাকা শহরকে কেমন দেখাবে? ঢাকা তখন আমস্টারডাম না হলেও মৌলভীবাজার হয়ে যাবে। নাহ, ঢাকা শত চেষ্টা করেও মৌলভীবাজারের মত সুন্দর শহর হতে পারবে না। দুইটা দিন মৌলভীবাজার শহর এবং আশেপাশে ঘুরাঘুরি শেষ করে পরদিন সকাল ৬ টায় গেস্ট হাউজের বেলকনিতে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করতে করতে এই কথাটাই মনে হল।

অফিসের মিটিং ছিল সিলেটে। সেখান থেকে মৌলভীবাজার এসেছি ফিল্ড ভিজিট করবার জন্য। ফিল্ড ভিজিট মানে সত্যিকার অর্থেই ফিল্ড ভিজিট। দুইদিনে মৌলভীবাজারের প্রতিটা থানায় পা রাখার সুযোগ হয়েছে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে পা ভিজিয়েছি মাধবকুণ্ড জলপ্রপাতে; ভেংচি কেটেছি লাউয়াছড়ার অরণ্যের বানরগুলোকে; সাতরঙা চা পান করেছি শ্রীমঙ্গলের নীলকণ্ঠ চায়ের দোকানে; আর বাইকের পিছনে বসে মাইলের পর পাড়ি দিয়েছি চা বাগানের ঢেউ খেলানো সবুজ কার্পেট। দুঃখ একটাই, হামহাম ঝর্ণায় গোসল করতে পারি নি।

ঢাকার বাস সকাল ১০ টায়। শহরটাকে ঘুরে দেখার সময় তো এখনই। যে কোন শহরের রাতের সৌন্দর্য একরকম, আর ভোরের সৌন্দর্য সম্পূর্ণ অন্যরকম। ঝটপট কাপড়চোপড় গায়ে চাপিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। উদ্দেশ্য বর্ষীজোড়া ইকো পার্ক।

বর্ষীজোড়া ইকোপার্ক এর অবস্থান মৌলভীবাজার শহর থেকে মাত্র দুই কিলোমিটার ভিতরে। এই ইকোপার্ক নিয়ে খুব একটা লেখালেখি হয় না বলে অনেকের কাছেই এটি অপরিচিত। ৮৮৭ একর আয়তনের ইকোপার্কটির উত্তরে বর্ষীজোড়া, দক্ষিণে বিমান বাহিনীর রাডার স্টেশন ও প্রেমনগর চা বাগান, পূর্বে দেওরা ছড়া চা বাগান এবং পশ্চিমে জগন্নাথপুর অবস্থিত। ২০০৬ সালের জুলাই মাসে এটিকে ইকোপার্ক ঘোষণা করা হলেও ১৯১৬ সালে এটিকে রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোষণা করা হয়েছিল। মিশ্র চিরহরিৎ প্রকৃতির এই বনে একসময় মায়াহরিণ, চিতাবাঘ ও উল্লুক দেখা গেলেও এখন তা বিলুপ্ত। তবে এখনও বানর, হনুমান, শিয়াল, মেছোবাঘ, কাঠবিড়ালি সহ বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী; ঘুঘু, শালিক, কাঠঠোকরা, বাবুই সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এবং শাল, গর্জন, শিমুল, সেগুন সহ বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ দেখা যায়।

ইকোপার্কে যখন ঢুকলাম তখন সকাল সাড়ে ছয়টা। ফেব্রুয়ারি মাসের সকালটা বেশ স্নিগ্ধতার আবেশ ছড়িয়ে রেখেছিল চারপাশে। তার সাথে ছিল কুয়াশার মিতালী। এত সকালবেলা কেউ থাকবে না সেটাই স্বাভাবিক। আমরা সহজেই ভিতরে প্রবেশ করলাম। প্রবেশপথের কাছেই পুরো পার্কের একটা মানচিত্র দেয়া আছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রায় ৫ মিনিট খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখার পরেও কিছুই বুঝতে পারলাম না। হয় আমার মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কম কিংবা মানচিত্র আঁকিয়ের সৃজনশীলতা বেশি ছিল।

প্রথমে ইট বিছানো সোজা রাস্তা। রাস্তার দুইধারে উঁচু উঁচু গাছ। অনেকদূর গিয়ে রাস্তাটা একটা তেমাথায় এসে পৌঁছেছে।

একপাশে টিলার উপর ছোট্ট একটা গার্ডপোস্ট। কেউ আসেনি তখনও। প্রথমে বামপাশের রাস্তা ধরে এগিয়ে চললাম।

এই রাস্তা দিয়ে জিপগাড়ি চলে সেটা বোঝাই যায়। যতই এগুচ্ছি গাছের উচ্চতা ততই বাড়ছিল। বিশাল বিশাল ইউক্যালিপটাসগুলোর আকাশ ছোঁয়ার প্রাণান্ত চেষ্টা ছিল মনোমুগ্ধকর এবং দৃষ্টির জন্য প্রশান্তিময়।

রাস্তা ছেড়ে পাহাড়ে উঠলাম। জঙ্গলের ভিতর এক পাহাড় থেকে আরেক পাহাড়ে হাঁটার মজাই অন্যরকম।

হঠাত করেই পাহাড়ের উপর একটা বিশ্রামাগার চোখে পড়ল। পাহাড়ে হাঁটাহাঁটি করে কিছুটা ক্লান্ত হয়েছিলাম। এখানে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে নিলাম। শীতের শেষভাগ হওয়ায় পুরো অরণ্য জুড়েই ছিল ঝরা পাতার রাজত্ব। গাছগুলো প্রস্তুতি নিচ্ছিল বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার। শালগাছের সংখ্যাই বেশি ছিল।

আমরা ফিরে আসলাম সেই তেমাথায়। এবার ডানদিকের রাস্তা ধরে যাত্রা করলাম। এই রাস্তাটা মাটির এবং চারপাশের জঙ্গল বেশ ঘন। দর্শনার্থীদের জন্য বেশ কিছু নির্দেশনা সম্বলিত একটা সাইনবোর্ড চোখে পড়লেও সেই নির্দেশনাগুলো কয়জন মেনে চলেন সেই বিষয়ে আমার বেশ সন্দেহ আছে।

এই রাস্তার শেষপ্রান্তে একটা ওয়াচ টাওয়ারের সন্ধান পাওয়া গেল। এখান থেকে চারপাশটা দেখতে খুব একটা খারাপ লাগে না।

অরণ্যের ভিতরে প্রবেশ করবার খুব শখ হল। এই শখ পূরণ না করে ফিরে আসা অসম্ভব। বনের ভিতর ঢুঁকে তাই ইচ্ছামত ঘুরলাম। গভীর অরণ্য সত্যিই অসাধারণ। কিছু কিছু জায়গায় তো সূর্যই দেখা যাচ্ছিল না। আর ছিল নাম না জানা হরেক রকম ফুলের সৌন্দর্য আর পাখির কলতান। সাথে তারেক অণু আর রনি ভাই থাকলে এই ফুল আর পাখিগুলো হয়তো চিনে নিতে পারতাম।

আরে, দর্শনার্থীদের জন্য টয়লেটের ব্যবস্থাও আছে দেখছি। কিন্তু ভুলেও সেদিকে যাবেন না। কারণ এতটাই নোংরা যে স্বয়ং অনন্ত জলিলের পক্ষেও এখানে প্রাতঃক্রিয়া সম্পন্ন করা অসম্ভব।

ফিরে চললাম। এক পাহাড়ে মাটির সিড়ি দেখে কিছুটা কৌতূহল হল। জয়তু কৌতূহল। দেখা যাক উপরে কি আছে।

ওয়াও, দারুণ একটা গেস্ট রুম। তালা দেয়া অবশ্যই। এখানে রাত কাটাতে পারলে ভালই লাগবে। মাথায় রাখলাম, বিয়ের পর হানিমুনের জন্য জায়গাটা মন্দ না।

যারা ঘুরতে যেতে আগ্রহী তাঁদের জন্য

ঢাকা থেকে সরাসরি বাসে করেই মৌলভীবাজার যেতে পারবেন। সময় লাগবে সাড়ে ৪ ঘণ্টা। ট্রেনে সরাসরি যাওয়া যায় না। প্রথমে শ্রীমঙ্গল যেতে হয়। সেখান থেকে বাসে করে মৌলভীবাজার শহর। থাকবার জন্য শহরেই বেশ কয়েকটা হোটেল আছে। আর ইকোপার্ক শহরের একদম কাছেই। ভোরে ঘুম থেকে উঠে হেঁটেই যেতে পারবেন।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক


মন্তব্য

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

৬ নং ছবিতে দু'ভাগ করা রাস্তার মা'জেজা কি? দু'চাকার জন্য দু'টি অংশ? চিন্তিত

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

ফরেস্ট অফিসারের ৪ চাক্কার জীপ গাড়ি এই রাস্তা দিয়ে যায় কি না। দুই চাক্কার জন্য দুই লেন না রাখলে কি চলে ভায়া? অফিসার বলে কথা।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বিশাল বিশাল ইউক্যালিপটাসগুলোর

এই দুষ্কর্মটা করলো কে?

অতিথি লেখক এর ছবি

বন বিভাগের কর্মীরাই করেছিল। একসময় নাকি বাংলাদেশে সরকারীভাবেই ইউক্যালিপটাস লাগানোর জোয়ার বয়ে গিয়েছিল। সেই সময়েই এই আকামটা হয়েছিল। অবাক লাগে, অন্য গাছের বৃদ্ধির জন্য ক্ষতিকর এই গাছ লাগানোর অনুমতি দেওয়ার সময় বৃক্ষ বিশেষজ্ঞরা কি করছিলেন?

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

মৌলভীবাজারে গিয়েছি, কিন্তু বর্ষীজোড়া ইকোপার্কের কথা শুনিনি আগে। নতুন একটা হীরক খনির সন্ধান দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ, রূপক ভাই।

আপনার লেখা পড়তে গিয়ে অন্য রকম আনন্দ পেয়েছি, আপনি যেন একাই ঘুরছিলেন না, আমাদেরও সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন সবকিছু, রাস্তাঘাট, গাছ, ফুল, গেস্ট রুম, ওয়াচ টাওয়ার, বিশ্রামাগার ইত্যাদি সবকিছু।

তাছাড়া, আমরা অনেকেই ভ্রমন করলেও এত খুঁটিয়ে দেখি না, বা, মনেও রাখি না। আপনার কাছ থেকে ভবিষ্যতে আরও সুন্দর ভ্রমনকাহিনি উপহার পেতে চলেছি বলেই আমার ধারণা।

দুঃখ একটাই, হামহাম ঝর্ণায় গোসল করতে পারি নি।

এই ঝর্নাটার নামও আগে শুনিনি, মৌলভিবাজারের কোথায় আছে এটি ?
।।।।।।।।।।
অনিত্র

অতিথি লেখক এর ছবি

হামহাম ঝর্ণার অবস্থান কমলগঞ্জ জেলায়। মৌলভীবাজার শহর থেকে অনেক দূরে। যাওয়ার রাস্তা বেশ দুর্গম। রাজকান্দি রিজার্ভ ফরেস্টের ভিতর দিয়ে যাওয়া আসা মিলিয়ে ৫ ঘণ্টা হাঁটতে হয়। সেই সাথে আছে জোঁকের ভয়। এইসব কিছু জয় করতে পারলে একটা ভ্রমণ দিয়ে আসুন। যারাই সেখানে গিয়েছেন তারাই উচ্চকিত প্রশংসা করেছেন। আমি যাই নি এখনও। গেলে মিস করবেন না আশা করি।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

না পারলে চাঁটগা গিয়ে হুমহাম কাদের চৌধুরীকে দেখে আসুন, ওটিও দর্শনীয়। চাল্লু

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক

আয়নাল এর ছবি

অনেক সুন্দর লাগলো ভাই

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বহুবার মৌলভীবাজার গেলেও এখানে যাওয়া হয়নি আমার
ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনাকেও ধন্যবাদ পড়বার জন্য। হাসি সুযোগ করতে পারলে চলে যান। ঠকবেন না নিশ্চিত।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সুলতানা সাদিয়া এর ছবি

সুন্দর।

-----------------------------------
অন্ধ, আমি বৃষ্টি এলাম আলোয়
পথ হারালাম দূর্বাদলের পথে
পেরিয়ে এলাম স্মরণ-অতীত সেতু

আমি এখন রৌদ্র-ভবিষ্যতে

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

তারেক অণু এর ছবি

যাব -

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাইয়া, আপনার অনেক ভালো লাগবে। ভোরে প্রচুর পাখি দেখা যায়, আমি তো চিনতে পারি নি। আপনি নিশ্চিত পারবেন।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।