কড়ি দিয়ে কিনলাম – বিমল মিত্রের 'রামায়ণ' উপাখ্যান

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ২৯/০১/২০১৬ - ৭:০৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১.

দোকানদার প্রথমেই একটা বেড়ে প্রশ্ন করে বসল ...

“আসল বই কিইন্যা কী করবেন?”

আমি তার দিকে খানিকটা সরু চোখে তাকিয়ে রইলাম। ব্যাটার মতিগতি ঠিক বুঝা যাচ্ছে না।

সে তার মত করে গম্ভীরভাবে বলতে থাকলো, “ইন্ডিয়ান বাংলার যত বই আছে, তার মধ্যে কেবল আনন্দ পাবলিশার্সের বাঁধাই-ই সবচেয়ে ভালো। অন্যগুলো অত টেকসই না। দু-তিনদিনেই ছিঁড়ে যায়, এমন অবস্থা।”

আচ্ছা! এতক্ষণে ক্লিয়ার হল। দোকানদারের নিজস্ব বইয়ের তাকে যে পাইরেটেড বইজোড়া আছে, তা আমাকে গছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। কিন্তু তা ত হবার নয়! এই যে আমি গোটা টিএসসির ফুটপাত ছেড়ে, নীলক্ষেতের রঙিন বইয়ের প্রলোভন উপেক্ষা করে কিংবা ইন্টারনেট ভর্তি ই-বুকের মায়া ত্যাগ করে নিউমার্কেটে এসেছি কেবলই ‘আসল’ কপির আশায়, তা কি ব্যাটা বুঝে না? নাকি বুঝেও না বুঝার ভান!

আমি মাথা নেড়ে বললাম, “না ভাই, আমার আসলটাই লাগবে। থাকলে দ্যান। না থাকলে চলে যাই।”

“আইচ্ছা দেখি দাঁড়ান” বলে দোকানি চলে গেল। কিছুক্ষণ পর প্রথম পার্টটা হাতে নিয়ে এসে বলল, "একটাই পাইলাম। চলবে? বাকিটা ঐ দেশিটাই নিয়া যান!"

নাহ্‌, হবে না – বলে বের হয়ে এলাম। বাইরে বেশ গরম। গ্রীষ্মকাল শুরু হয়ে গেছে। তার উপর দুপুরের কড়া রোদ। এখন মিডিয়াম সাইজের হোয়াইট বোর্ডটা হাতে ধরে সিএনজি যোগাড় করতে হবে। বাসায় যাবার সময় হয়ে গেছে।

সেদিন আর হল না। পরে আজিজ সুপার মার্কেটের ‘তক্ষশিলা’য় ঢুঁ মারতেই পেয়ে যাই।

“কড়ি দিয়ে কিনলাম হবে?”

চশমা পরা এক সম্ভ্রান্ত মহিলা বসে আছেন। কিছু একটা লিখছিলেন। মুখ তুলে বললেন, “বিমল মিত্রের? হ্যাঁ হবে।” এরপর অ্যাসিস্টেন্টকে ডাকাডাকি করে বই বের করা হল। লাল রঙা দুইটা বই। উপরে হলুদের মধ্যে লেখকের নাম আর শিরোনাম লেখা। আর নীচে শাড়ির পাড়ের মত হলদে একটা পাড়। আর নামের সার্থকতার জন্য গোটা কয়েক কড়ি ছিটোনো।

এই-ই বেশ। জানতাম যে ‘মিত্র অ্যান্ড ঘোষ’ বই বাঁধাইয়ে ‘আনন্দে’র মত পারবে না। একটু হালকা, দূর্বল হবেই। তবুও নিউমার্কেটের স্মৃতি টাটকা থাকায় জিজ্ঞেস করে নিলাম, “আসল ত?”

সম্ভ্রান্ত মহিলা দ্রুতবেগে মাথা নেড়ে বললেন, “হ্যাঁ হ্যাঁ, একদম আসল।” তাঁর কথার যৌক্তিকতা টের পেলাম বিলটা হাতে নিয়ে। দাম চার অঙ্কে পৌঁছে গেছে!

দুঃখ করার কিছু নেই। আসল বই পড়ার কিংবা ধরার যে সূক্ষ্ম সুখানুভূতি, তা আমি দেশিগুলাতে পাব না। তার উপর যে বই পড়ার জন্য হুমায়ূন আহমেদকে রীতিমত খাটের তলায় শুয়ে অন্ধকারে চোখ ব্যথা করতে হয়েছে, তার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা ত লাগবেই।

আমি অতি যত্নের সাথে বই দুইটা ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলাম।

২.

‘গল্প’টা মূলত দীপঙ্করের। সেই সাথে দুই নারীর – লক্ষ্মীদি ও সতী। পার্শ্বচরিত্রে আছে মিঃ ঘোষাল এবং নয়নরঞ্জিনী দাসী।

জন্ম বর্ধমানের কোন গ্রামে হলেও দীপঙ্করের বেড়ে ওঠা কলকাতায়, উনিশের একের বি ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনে। বিধবা মা স্বামী হারিয়ে সেই কবে এসে জুটেছিল অঘোরদাদুর বাসায়। এরপর থেকে এখানেই রান্নাবান্নার কাজ। তার বদলে থাকা-খাওয়ার বন্দোবস্ত। বিপত্নীক অঘোরদাদু বর্ণে-পেশায় ব্রাহ্মণ। পূজোয় ফাঁকি মেরে যজমানদের কাছ থেকে জিনিসপাতি এনে জমানোটাই তাঁর মূল কাজ। তাঁর মতে, “কড়ি দিয়ে সব কেনা যায়রে মুখপোড়া!” তাই কড়ি জমানোই সই।

অঘোরদাদুর বাড়িতেই একদিন ভাড়াটে হয়ে এলো কাকাবাবুরা। সাথে লক্ষ্মীদি। রোজ রাতে ঘুঙুরের ধ্বনি শুনে একদিন দিপু গিয়েছিল দেখতে। তখনই ধরা পড়া এবং লক্ষ্মীদির সাথে পরিচয়। বড্ড শাসনে রাখা লক্ষ্মীদিটা ভালোওবাসত তাকে। ছোট দিপুও তার জন্য প্রতি সকালে চিঠি নিয়ে যেত দাতারবাবুর কাছে। দাতারবাবুর ছাড়াও লক্ষ্মীদির কাছে শোনা যেত তার ছোটবোনের কথা, সতীর কথা। একদিন সেই সতীও বর্মা থেকে চলে এলো এই অঘোরদাদুর বাসায়। শুরু হল কাহিনী।

এরপর সতীর সাথে সখ্যতা, লক্ষ্মীদির বাড়ি ছেড়ে পালানো, সতীর ভালোবাসাকে উপেক্ষা করা, অতঃপর তার বিয়ে হয়ে যাওয়া। যেইসেই পরিবারে না, কলকাতার একেবারে উপরের স্তরের ধনবান পরিবারে। সেখানেই নয়নরঞ্জিনী দাসীর আবির্ভাব সতীর শাশুড়ি হিসেবে। আর বর হন সনাতনবাবু। যাঁর কিনা বই পড়া ছাড়া সারা দিনে কোন কাজ নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হবার বহু আগেই অ্যাডলফ হিটলারের সম্পর্কে তাঁর জানাশোনা ছিল – এমনই তাঁর জ্ঞানের বাহার।

ততদিনে দিপুবাবুর রেলঅফিসে চাকরি হয়ে গেছে। তেত্রিশ টাকার ঘুষে যার শুরু, নিষ্ঠাগুণে একদম উচ্চপদে চলে যাওয়া। অফিসে ফিসফাস শুরু হয়, “রবিনসন সাহেবের কুকুরকে বিস্কিট খাইয়ে সেন সাহেবের এ প্রমোশান!” শুরু হয় আরেক লণ্ডনফেরত অফিসার মিঃ ঘোষালের সাথে ব্যক্তিত্বের সংঘর্ষ। কিন্তু এসবের কিছুই দিপুকে কষ্ট দেয় না, যতটা মনঃপীড়া সে পায় তার ‘তেত্রিশ টাকার ঘুষ’-এর কথা মনে পড়লে। রেলঅফিসের দুর্নীতির শিকার গাঙ্গুলীবাবু যখন দারিদ্র্যের কষাঘাত সহ্য করতে না পেরে আত্মহত্যা করে, তখন দীপঙ্করের মন কেঁদে উঠে। প্রাণবন্ধু কিরণ যখন স্বদেশের টানে নিরুদ্দিষ্ট হয়, তখন তার বিধবা অসহায় মা-কে সাহায্য করবার জন্য দিপু ছুটে যায়। অর্থাভাবে লক্ষ্মীদির নৈতিক স্খলনে তার ঘৃণা হয়। এমন-ই তার সততা!

সেই দিপুর জীবনে আবারও সতীর আগমন ঘটে, যখন শাশুড়ির দাপট মেয়েটা সহ্য করতে পারে না। মিঃ ঘোষালের মত ধুরন্ধর ব্যক্তি সুযোগমত এবার তাদের মাঝে ঢুকে পড়ে। তখন শুরু হয় আরেক দ্বন্দ্ব। অদ্ভূত এই দিপু-সতীর ভালোবাসা! কত আঘাত, কত কষ্ট। তবুও পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা কখনো মুখ ফুটে তারা বলে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে যখন জাপানিরা কলকাতায় বম্বিং করে চলেছে, সেই ধ্বংসাত্মক রাতেও তাদের মধ্যকার প্রেম কেবল সৌজন্যতায় আটকে থাকে। সুযোগ পাওয়া সত্ত্বেও দিপু তাই সতীকে তার স্বামীর কাছে ফিরিয়ে দেবার চেষ্টা করে। একবার নয়, বারবার ... ...

সততার প্রকৃষ্ট উদাহরণ!

শেষমেষ আর কিছু জুটে না তার কপালে। সব ছেড়ে সে বাংলার জেলায় জেলায়, গ্রামে গ্রামে ঘুরতে থাকে। স্কুল-কলেজে পড়াতে থাকে। সেই থাকে চলতে থাকে তার লক্ষ টাকা ঋণের দাম মেটানো। কারণ সে কড়ি দিয়ে সুখ কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু সম্ভব হয়নি। তবুও সে তার জীবনের মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয় না। তাই যখন ছাত্রদের থেকে সে বিদায় নেয়, তখন বলে উঠে W H Auden এর কবিতার লাইন ...

All I have is a voice
To undo the folded lie
The romantic lie in the brain
Of the sensual man-in-the-street
And the lie of Authority
Whose buildings grope the sky:
There is no such thing as the State
And no one exists alone;
Hunger allows no choice
To the citizen or the police;
We must love one another or die.

এই-ই দীপঙ্করের জীবন, এই-ই ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ ...

৩.

উপন্যাসের বিস্তৃতি মূলত প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ পর্যন্ত। ফলে তৎকালীন কলকাতা নগরীর অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার উল্লেখ এখানে আছে। দেশবন্ধুর মৃত্যু, জালিয়ানওয়ালা-বাগ হত্যাকাণ্ড ও রবীন্দ্রনাথের প্রতিবাদ, স্বদেশী আন্দোলন, কংগ্রেসের ভারত-ছাড় আন্দোলন, তেতাল্লিশের মন্বন্তর, কলকাতায় জাপানিদের বম্বিং, মিলিটারি কনট্র্যাক্টের মাধ্যমে কতিপয়ের আঙুল ফুলে কলাগাছ হওয়া ... কী নেই! এছাড়াও ইতিহাসখ্যাত রাশিয়ান বিপ্লব, থাইসেন-হিটলারের উত্থান, উইনস্টল চার্চিলের উল্লেখ কিংবা ঐদিকে সূর্যসেনের চট্টগ্রাম দখল – প্রসঙ্গান্তরে সবই এসেছে। ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনের মধুসূদনের রোয়াকে দুনিকাকা-পঞ্চুদা’রা যে আড্ডা বসাতেন, সেখানেই মূলত রাজনীতির নানা হাল-চাল ফুটে উঠত।

যেমন, সি আর দাশের মৃত্যুর পর –

দুনিকাকা বলছে – মরে গেছে বেশ হয়েছে, ওসব চরকা-ফরকা কেটে কী লাভ হতো ভাই, চরকা কেটে আয়ার্ল্যান্ড স্বাধীন হয়েছে? না চরকা কেটে আমেরিকা স্বাধীন হয়েছে? বল্‌, বুঝিয়ে দে আমাকে?
মধুসূদনের বড়দা বললে – গান্ধীরই সুবিধে হলো জানলেন দুনিকাকা, গান্ধীর কথা প্রোটেস্ট করবার মত আর লোক রইল না কেউ –
পঞ্চুদা দাঁড়িয়েছিল। বললে – ও গান্ধী-ফান্ধীর কম্ম নয় বুঝলে হে, ছিল একটা বাঙালি সে-ও চলে গেল। এখন বুঝতে পারছেন না আপনারা, পরে বুঝবেন – দাঁত থাকতে তো দাঁতের মর্যাদা বূঝে না লোকে –
ছোনেদাও দাঁড়িয়েছিল একপাশে। বললে – এখন ঐ জে এম সেনগুপ্তই ভরসা। আমাদের সবেধন নীলমণি-
পঞ্চাদা কথাটা লুফে নিলে। বললে – আরে রাখ্‌ রাখ্‌, কার সাথে কার তুলনা! সেই কথায় বলে না হাতি ঘোড়া গেল তল্‌ ...
দুনিকাকা সবজান্তা মানুষ। তার এক-একটা কথার ফুৎকারে তা-বড় তা-বড় লোক নস্যাৎ হয়ে যায়। দুনিকাকা গোটা পৃথিবীটাকেই তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতে ওস্তাদ, এক বৃটিশ গভর্নমেন্ট ছাড়া। সেই দুনিকাকা বললে – ওরে যার নাম আরশোলা তারই নাম ছারপোকা, ও তোদের সুভাষ বোসই বল্‌ আর জে এম সেনগুপ্তই বল্‌, এক-একটা টিপুনিতেই সব কুপোকাৎ -

তখনকার রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি এমন ঘরোয়াভাবে ফুটিয়ে তোলার ব্যাপারটি ইতিহাসপ্রিয়দের জন্য নিঃসন্দেহে এক বিশাল পাওয়া।

৪.

বাল্মীকির রামায়ণ-ই যে ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর মূল অনুপ্রেরণা, তা বিমল মিত্র প্রথমেই বলে নিয়েছেন। তাঁর মতে, সমাজের বিভিন্ন স্তরে এখনো রামায়ণের চরিত্রগুলো বিরাজ করছে। এখনো এ সংসারে সীতা-হরণ হয়, সীতার বনবাস কিংবা পাতাল প্রবেশ – সবই অহরহ হচ্ছে। এসবই লক্ষ্মীদি, দীপঙ্কর, সতী কিংবা ঘোষাল সাহেবের মাধ্যমে আমরা উপন্যাসে দেখি। তবে উপন্যাসের শুরু মহাভারতের অনুকরণে। শেষ দিয়ে শুরু করা।

১৯৬২ সালে প্রথম ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ প্রকাশ পায়, তখন-ই তা গোটা ভারতবর্ষের বৃহত্তম উপন্যাস হিসেবে স্বীকৃতি পায়। শুরুটা হয়েছিল ‘দেশ’ পত্রিকার মাধ্যমে, যা কিনা বাংলা সাহিত্যের বহু শক্তিশালী লেখকের জন্মদাতা। পত্রিকাটির সম্পাদক সাগরময় ঘোষ নাকি প্রথম খণ্ড হাতে নিয়ে লেখককে বলেছিলেন,

“বইটি হাতে নিয়ে অনুভব করলাম কী বিরাট কীর্তি আর কী অসাধ্যসাধনই না করেছেন। এরপর আছে দ্বিতীয় খণ্ড।”

এখন বৃহত্তম হলেই যেমন ‘এপিকধর্মী’ খেতাব পাওয়া যায়, তেমনি নানা বাঁকা কথাও সহ্য করতে হয়। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সম্পর্কে যেমন বলা হয়, বাংলা সাহিত্যে তাঁর মত বেশি কাগজ আর কেউ নষ্ট করেননি। তেমনি এক লেখকও নাকি ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ সম্পর্কে বলেছিলেন, তিনি চাইলে এই হাজার পৃষ্ঠার বইকে আড়াইশোতে নামিয়ে আনতে পারবেন। তারমানে এতে ‘বাজে বকবক’ অনেক বেশি। কথাটা খানিকটা হলেও সত্য বটে। কারণ গোটা উপন্যাসটাই দীপঙ্কর-সতী-লক্ষ্মীদিতে এতটা পরিপূর্ণ যে কোন কোন অংশে একঘেয়ে লাগাটা অস্বাভাবিক না। আমার মনে আছে, আমি প্রথম একশ পৃষ্ঠা পড়তে গিয়ে প্রায় এক মাস কাটিয়ে দিয়েছিলাম। পরে অবশ্য পড়ার গতি বৃদ্ধি পেয়েছে। কাজেই ‘সবুরে মেওয়া ফলে’-তে বিশ্বাস রাখাই উত্তম।

এই বাহুল্যতার কথা ভেবেই সম্ভবত এক লেখক প্রকাশককে বলেছিলেন, বইটা তেমন বিক্রি হবে না। কিন্তু সেসব কিছু হয়নি। বই প্রকাশিত হয়েছে, বিক্রি হয়েছে দেদারসে, রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়েছে, বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা, মানুষের ভালোবাসা পেয়েছে। কোন এক হিন্দিভাষীর অনিদ্রা রোগ দূর হয়েছে এ উপন্যাস পড়ে। ডাবল মিনিংয়ের সুযোগ আছে যদিও, তা সত্ত্বেও লেখক এতে অনুপ্রাণিতই হয়েছে।

এসবই তাঁর ‘মুখবন্ধে’ লেখা।

৫.

গত বছর বলতে গেলে অনেক লেখকের বই-ই পড়তে হয়েছে যেখানে লেখক পরিচিত হলেও তাঁর লেখার সাথে প্রথম পরিচয়। সে হিসেবে তারাশঙ্করের ‘কবি’ যেমন আসে, তেমনি হাওয়ার্ড অ্যান্টনের ক্যালকুলাসও আসে। আর নতুন সেমিস্টারের চোথা লেখকগুলো ত আছেই। কিন্তু দিনশেষে বিমল মিত্রের ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’ বেছে নেওয়া কারণ কন্টেন্টের সাথে ‘রিলেট’ করার ব্যাপারটা এর ক্ষেত্রেই বেশি হয়েছে। বিশেষ করে দীপঙ্করের সংগ্রাম, সততার সাথে আপোষহীন মনোভাব, সঠিক মানুষ সমাজে খুঁজে বেড়ানো অথবা মানুষকে ভালোবেসে তাদের ঘিরে বাঁচার ব্যাপার ... এ ব্যাপারগুলো মনে সহজেই দাগ কেটে যায়। আমার ত মনে হয়, যারা জীবনে অন্তত একদিন হলেও ভালোবেসে, সৎভাবে বাঁচার চেষ্টা করে, এমন মানুষেরা দিপুর মাঝে নিজেদের ছায়া খুঁজে পাবেই। উপন্যাসের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তাও সেদিকে ইঙ্গিত করে। আর ‘কড়ি দিয়ে কিনলাম’-এর সার্থকতা এখানেই!

‘আমার ভালো লেগেছে, বইটি পড়বেন’ – এ ধরনের কথা ক্লাসিক উপন্যাসের রিভিউ শেষে বলাটা হাস্যকর ঠেকে। তাই ওটা বলতেও চাই না। তবে দু-একটা ব্যাপারে একটু নজর দিতে বলি। প্রথমত, যদি পশ্চিমবঙ্গের আসল প্রিন্ট কিনে পড়েন তাহলে একটু সাবধানে থাকবেন। কারণ প্রথম পার্টে কিছু পেইজ মিসিং। তখন আমায় বাধ্য হয়ে ই-বুক নামাতে হয়েছিল। আর দ্বিতীয়ত, উপন্যাসে শেষে ডঃ শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায়ের ‘নির্ঘণ্ট’ নামক যে সাধুভাষায় রচিত রিভিউখানি আছে, তা ভুলেও পড়বেন না। অন্তত উপন্যাস শেষ হবার সপ্তাহখানেকের মধ্যে ত নই-ই। কারণ অত্যন্ত কঠিন ভাষার লেখাটি সাথেসাথে পড়লে উপন্যাসের ঘোর কেটে যেতে বাধ্য। কাজেই সাবধান!

আর শেষে বলতে চাই, বিমল মিত্রের লেখার জাদুর সাথে পরিচিত হবার পরপরই কিন্তু তা থেমে যায়নি। প্রমাণ বুলশেলফে থাকা ‘সাহেব বিবি গোলাম’ বইখানি! শীঘ্রই পড়া হবে আশা রাখি। আপাতত সুনীলের ‘পূর্ব-পশ্চিম’ নিয়ে আছি। ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হচ্ছে, কড়ি দিয়ে কিনলামের টাইমলাইনের ঠিক পরপরই সুনীলেরটা শুরু।

যাই হোক, হ্যাপি রিডিং!

মানুষিক সৈনিক


মন্তব্য

ঘুমকুমার এর ছবি

অনেক পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে গেল। কড়ি দিয়ে কিনলাম এর দুটো খন্ডই ছিল বাসায়। আলগা হয়ে যাওয়া বাঁধাই আবার যত্ন করে মলাট করা ছিল। এত মোটা উপন্যাস, তাও আবার দুই খন্ড - ধরার সাহসই হয়নি অনেকদিন। কলেজে থাকতে সম্ভবত পড়ার সাহস সঞ্চয় করতে পেরেছিলাম। আবারও পড়ার আগ্রহ তৈরি হলো। রিভিউ ভাল লেগেছে।

অতিথি লেখক এর ছবি

নতুন করে পড়তে গেলে অনেক ধৈর্য লাগবে বলা যায় ...

শুভকামনা!

এক লহমা এর ছবি

রিভিউ ভালো লেগেছে।

হাইস্কুলের দিনগুলোতে প্রায় একটানা, নাওয়া-খাওয়া-ভুলে পড়া বই। অত্যন্ত আলোড়িত হয়েছিলাম সে বয়সে। এখন ফিরে পড়তে গেলে ভিন্ন রকম পাঠপ্রতিক্রিয়া হবে, অত বড় বই হয়ত আর পড়েই উঠতে পারবনা। কিন্তু, পড়াটা কাজের ছিল, আমার মানসিক গঠনের বিকাশে নিশ্চিত ভূমিকা রেখেছিল।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

"... মানসিক গঠনের বিকাশে নিশ্চিত ভূমিকা রেখেছিল"

এটাই বড় কথা। আর একটা পর্যায়ে চলে গেলে আসলে এধরনের ফিকশান কেন জানি ঠিক হজম হতে চায় না। তাই পাঠপ্রতিক্রিয়া খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক।

আমি ভাবছি এখন সিনেমাটা দেখার চেষ্টা করব। অপর্ণা সেন লক্ষ্মীদি চরিত্রে আর মৌসুমী চ্যাটার্জি সতী চরিত্রে, ঐদিকে তাপস পালের প্রথম দিককার ইনোসেন্ট অ্যাটিটিউড দীপঙ্করের সাথে ভালোভাবেই মিশে যাবার কথা। দেখি এখন পাই কিনা।

শুভকামনা!

মানুষিক সৈনিক

দুনিয়া  এর ছবি

কোথায় পড়েছিলাম মনে নেই । বিমল বাবু বলেছিলেন ফি সপতাহে ১ ফরমা লেখা দিলে বাজার খরচ হয়ে যায় টাই লিখতে লিখতে বইটা বড় হয়ে গেল আর কি !

অতিথি লেখক এর ছবি

হা হা হা!! সম্ভব, ভালোভাবেই সম্ভব এ কাহিনী!

আমার ত ধারণা যাঁরা নিয়মিত পত্রিকাগুলোতে ধারাবাহিক উপন্যাস লেখেন, তাঁদের সকলেরই একই কাহিনী! বিশেষ করে শীর্ষেন্দু'র 'চক্র' উপন্যাসটা পড়তে গিয়ে এটা খুব ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম। উফ্‌!

মানুষিক সৈনিক

অতিথি লেখক এর ছবি

এককালে ঝিনুক পুস্তিকা বাংলাদেশে ভারতীয় বই প্রকাশের অনুমোদিত প্রকাশনী ছিল। ঝিনুক দুই খণ্ডে কড়ি দিয়ে কিনলাম বের করেছিল। মূল্য বিশ টাকা করে মোট চল্লিশ টাকা। হার্ডকাভারের বই না, তবে সে বইয়ের বাঁধাই আলগা হয়ে খুলে পড়তো না বা একটু যত্ন করে পড়লে ত্রিশ-চল্লিশ বছরেও কিছু হতো না।

যদি পশ্চিমবঙ্গের আসল প্রিন্ট কিনে পড়েন তাহলে একটু সাবধানে থাকবেন। কারণ প্রথম পার্টে কিছু পেইজ মিসিং। তখন আমায় বাধ্য হয়ে ই-বুক নামাতে হয়েছিল।

- চার অঙ্কের দাম দিয়ে সম্ভ্রান্ত লোকজনের সম্ভ্রান্ত দোকান থেকে 'আসল' বই কেনার পর যদি ই-বুকই নামাতে হয় তাহলে আর কী লাভ! অবশ্য এই সম্ভ্রান্ত লোকজনের সম্ভ্রান্ত দোকানটি থেকে চড়া দামে 'আসল' ভারতীয় বই কেনার পর ফর্মা ধরে পাতা না পাওয়ার অভিজ্ঞতা এই অধমেরও আছে। এই ব্যাপারে অভিযোগ জানালে তারা বই রেখে দেন - পাল্টেও দেন না, টাকাও ফেরত দেন না।

কড়ি দিয়ে কিনলাম উপন্যাসের আকর্ষণীয় চরিত্র ছিটে আর ফোঁটা। প্রথম জীবনে তারা বখাটে, যাবতীয় কুঅভ্যাসে অভ্যস্ত। পরবর্তীতে ফোঁটা খদ্দর পরে রাজনীতি করে, জেলে যায় আর ছিটে ফোঁটার প্রভাব খাটিয়ে ব্যবসা করে। দিনশেষে ব্যবসার লাভ দুই ভাই ভাগাভাগি করে নেয়। তাদের ঠাকুরদা' আবার ধর্মগুরু। তার জীবদ্দশায় দুই ভাই তার পথে না হাঁটলেও তার প্রয়াণের পর তাকে ছবি বানিয়ে তার ধর্মব্যবসার সম্পদ হাতায়। এমন উইন-উইন ডিলের সিমবায়োটিক জীবন আমাদের চারপাশে আছে। দেশ স্বাধীন হতে না হতে তার রাজনৈতিক চরিত্রটি কীভাবে গড়ে উঠছিল বিমল মিত্র সেটা ভালোভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

এই ব্যাপারে অভিযোগ জানালে তারা বই রেখে দেন - পাল্টেও দেন না, টাকাও ফেরত দেন না।

এক প্রিণ্টে প্রবলেম থাকা মানে ত পুরো এডিশানেই ঝামেলা থাকা। সেক্ষেত্রে ফেরত দিয়েও খুব একটা লাভ নেই। একারণে সে চেষ্টা করিও না। তার উপর বাইরের দেশের ... কবে ফেরত যাবে, আবার আসবে ... ঝামেলা!

হুম, পুরো উপন্যাসে ছিটে-ফোঁটা বেশ আকর্ষণীয় চরিত্রই বলা যায়। প্রথমে ভেবেছিলুম এরা বুঝি দীপঙ্করের জীবনে খলনায়ক হিসেবে উপস্থিত হবে। কিন্তু অমনটা হল না। শুধু তার নামটা ভেঙে কংগ্রেসে ঢুকেছিল। বাকিটা ত বলেই দিলেন।

পুরো উপন্যাসে আসলে দীপঙ্কর-সনাতনবাবু-দাতারবাবু-প্রাণমথবাবু'র মত এত ভালো চরিত্রের সমাগম যে এর মাঝে মিঃ ঘোষাল, ছিটে-ফোঁটা কিংবা নয়নরঞ্জিনী দাসীর মত পার্শ্বনায়কদের আনাগোণা বেশ ভালোই লাগে। একটা বৈচিত্র্যতা আসে। আর সন্তোষ কাকার মেয়ে ক্ষীরোদার কথা মনে আছে? মেয়েটা শেষ পর্যন্ত দিপুর সাহচর্য পেলো না দেখে মন খারাপ হয়ে গেছিল ...

শুভকামনা রইল। কিন্তু 'নিক'টা জানা হল না!

মানুষিক সৈনিক

অতিথি লেখক এর ছবি

এক প্রিণ্টে প্রবলেম থাকা মানে ত পুরো এডিশানেই ঝামেলা থাকা।

- না, এমনটা নাও হতে পারে। সম্ভ্রান্ত বুক শপে ঝামেলা থাকা বইয়ের একই সংস্করণ যখন তার খুব কাছের আরেকটা বুক শপ থেকে কিনেছি তখন ঝামেলা পাইনি। কে যে 'আসল' বই আনে তা বোঝা মুশকিল। কলকাতা থেকে বই আনলেই যে সেটা 'আসল' বই হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই। আর 'আসল' বই কিনলে তার রয়্যালটি যে লেখক বা তার উত্তরাধিকারদের কাছে পৌঁছায় তার গ্যারান্টি আছে কিনা সেই প্রশ্ন আর করলাম না।

অতিথি লেখক এর ছবি

সম্ভ্রান্ত বুক শপে ঝামেলা থাকা বইয়ের একই সংস্করণ যখন তার খুব কাছের আরেকটা বুক শপ থেকে কিনেছি তখন ঝামেলা পাইনি।

আচ্ছা! এধরনের সমস্যাতে কি আসলে দোকানিকে দোষারোপ করে খুব লাভ আছে? সে নিশ্চয়ই ইচ্ছে করে ঠকায় না। তাকেও ত মোটা টাকা দিয়ে আমদানি করতে হয়।

এ ধরনের ব্যাপারটা আমি খেয়াল করিনি। তবে একই বই এক 'সম্ভ্রান্ত' দোকানে একরকম, আরেক 'সম্ভ্রান্ত' দোকানে আরেকরকম অবস্থায় দেখেছি। এবং প্রথম দোকান থেকে কেন আগবাড়িয়ে ছেঁড়াটা কিনতে গেলাম, সেজন্য চুল ছিঁড়তেও ইচ্ছে করছিল। এটা অবশ্য সম্পূর্ণ দোকানির দোষ। প্রকাশকের কিছু করার নেই।

কলকাতা থেকে বই আনলেই যে সেটা 'আসল' বই হবে এমন কোন গ্যারান্টি নেই। আর 'আসল' বই কিনলে তার রয়্যালটি যে লেখক বা তার উত্তরাধিকারদের কাছে পৌঁছায় তার গ্যারান্টি আছে কিনা সেই প্রশ্ন আর করলাম না।

কলকাতা থেকে আনলেই আসল হবে না, তা ঠিক। কিন্তু আসল বই ধরলে কিন্তু বোঝা যায় যে কোন কোয়ালিটির জিনিস। তাই নয় কি?

আর রয়্যালটি! বাঙালির আফসোস। এ নিয়ে আর কিইবা বলতে পারি!

মানুষিক সৈনিক

সোহেল ইমাম এর ছবি

প্রথম খণ্ডটা পড়েছিলাম বাড়িতে দ্বিতীয় খণ্ডটা ছিলনা, ইচ্ছা আছে দুটো খণ্ডই কিনে পড়বো একদিন। বাড়ির প্রথম খণ্ডটা সম্ভবতঃ এর মধ্যেই লাপাত্তা, দুটোই কিনতে হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

কিনুন তাহলে!

শুভকামনা!

মানুষিক সৈনিক

আব্দুল্লাহ এ.এম. এর ছবি

বাড়ীতে ছিল, তাই কিশোর বয়সেই গুটি গুটি করে পড়ে ফেলেছিলাম। তখন এর অন্তর্নিহিত কিছু ব্যাপার ঠিক বুঝতে না পারলেও বয়স বাড়ার পর সেসব বুঝেছি। বইটি আসলে জীবনেরই রামায়ণ মহাভারত। অপরিণত মননে শুধুমাত্র এই বইটি পড়ার কারনেই জীবন যেন সব্দিক থেকেই অনেক পরিণত হয়ে উঠেছিল, আমি এই বইটির কাছে অনেক ঋণী।
প্রথম যখন কলকাতা যাই, তখন কালীঘাটে যেয়ে ঈশ্বর গাঙ্গুলী লেনটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছিলাম। একজনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম এখানে দীপঙ্কর, কিরণ, অঘোর ভট্টাচার্য, ছিটে, ফোঁটা এরা থাকতো, সেটা ঠিক কোথায় জানেন কি? লোকটি অবশ্য এদের চিনতে পারে নি, জিজ্ঞেস করেছিল- কারা এরা? খুব বিখ্যাত কেউ?

অতিথি লেখক এর ছবি

হি হি! মজার ব্যাপার।

জানেন ত, এমন একটা ব্যাপার টালিগঞ্জের এক সিনেমায় দেখেছিলাম। নাম সম্ভবত 'নোবেল চোর'। সেখানে একজন ধরে ধরে লোকজনকে জিজ্ঞাসা করছিল রবীন্দ্রনাথের নোবেল চুরির ব্যাপারে। অনেকে পালটা উত্তর দিচ্ছিল, "ঠাকুর? কোন ঠাকুর?" বুঝুন অবস্থা!

শুভকামনা!

☼ মানুষিক সৈনিক ☼

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।