শকুন আর শেয়ালের খাদ্য

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ৩০/০১/২০১৬ - ৬:৫১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেকগুলো বছর ধরে ফেব্রুয়ারি মাসে আমার অন্যতম লক্ষ্য ছিল যত বেশিবার সম্ভব বইমেলায় যাওয়া। বইমেলায় বেশি বেশি গিয়ে কী লাভ? বাংলা একাডেমি আয়োজিত ‘একুশের গ্রন্থমেলা’তে যিনি জীবনে একবারও গেছেন তিনিমাত্র জানেন এটা নিছক বই কেনাবেচা করার জায়গা নয়। সারা দেশে ছড়িয়ে থাকা অনেক প্রিয় মুখ আছে যাদের একত্রে সহজে দেখা পাবার একমাত্র জায়গা এই বইমেলা। বই দেখা, বই কেনা, বইয়ের আর লেখকের গল্প শোনার বাইরে আরও অনেক বেশি আকর্ষণীয় প্রিয়জনদের সাথে এই আড্ডা। ফলে প্রতিবারের চেষ্টা থাকতো যত বেশিবার সম্ভব বইমেলায় যাওয়া। যাতে আরও বেশি জনের সাথে দেখা হয়, কথা হয়, আড্ডা হয়। ছাত্রজীবনে কয়েক বছর তো ফেব্রুয়ারির প্রতিটা দিন বইমেলায় গেছি। এতোগুলো বছরের মধ্যে শুধু ২০১৩ সালটা ব্যতিক্রম ছিল। সেবার বইমেলায় গিয়েও কিছুক্ষণের মধ্যে কী করে যেন পায়ে পায়ে বইমেলা থেকে বেরিয়ে অদূরে শাহ্‌বাগে পৌঁছে যেতাম।

শাহ্‌বাগের দিনগুলোতে যে বিষয়টা একটু একটু করে স্পষ্ট হচ্ছিল সেটা হচ্ছে একটা পরিষ্কার মেরুকরণ। এই মেরুকরণটা শুধু যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের পক্ষে বিপক্ষে নয়, এই মেরুকরণটা মুক্তবুদ্ধি চর্চ্চার পক্ষে বিপক্ষেও বটে। রাজীব হায়দারের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে যে স্পষ্টিকরণ শুরু হয়েছিল শাপলা চত্ত্বরের ঘটনায় সেটা পূর্ণতা পায়। এরপর একের পর এক মুক্তবুদ্ধি চর্চ্চার সপক্ষের মানুষের হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে দেশ অন্ধকারের পথে আগাতে থাকে। বইমেলার মতো জিনিস অন্ধকারের কাণ্ডারীদের নজরের বাইরে থাকবে এটা ভাবা বাতুলতা। সেই ভুল তারা যে করেনি তার প্রমাণ ২০১৫-এর বইমেলা থেকে রোদেলা প্রকাশনীকে উৎখাত করা আর বইমেলার অদূরে অভিজিৎ রায়কে পৈশাচিকভাবে হত্যা ও রাফিদা আহমেদ বন্যাকে কোপানোর ঘটনা। ব্ল্যাকমেইল, হুমকি, ধমকি, ধাওয়া করা আর চড়চাপড় মারার ঘটনার তো শেষ নেই। চাপাতির কোপের প্রবল প্রতাপে সেগুলোর কথা আর কেউ উল্লেখ করেন না। ভিকটিমরা কিল খেয়ে কিল হজম করে যান — প্রতিদিন একটু একটু করে মারা যান।

২০১৬-এর বইমেলাকে সাফসুতরো রাখার কাজটা ২০১৫-এর অক্টোবরেই সম্পন্ন করা হয়েছে। জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফীন দীপনকে হত্যা, শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর কর্ণধার আহমেদুর রশীদ টুটুল, লেখক রণদীপম বসু আর কবি তারেক রহিমকে কোপানোর মধ্য দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে উলটাপালটা বই প্রকাশ করলে পরিণতিটা কেমন হবে। এর আগে মার্চে ওয়াশিকুর রহমান বাবু, মে’তে অনন্ত বিজয় দাস আর অগাস্টে নীলাদ্রী চট্টোপাধ্যায়কে কুপিয়ে ফালাফালা করে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে উলটাপালটা লেখালেখির পরিণতিটা কেমন হতে পারে। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক জাগৃতি নিয়ে বা আহমেদুর রশীদ টুটুল শুদ্ধস্বর নিয়ে এবারের বইমেলার আসার দুঃসাহস দেখাতে পারবেন কিনা জানি না। রোদেলা এবারের বইমেলায় কোন স্টল বরাদ্দ পাবে কিনা তাও জানি না। যদি জাগৃতি-শুদ্ধস্বর-রোদেলা বইমেলাতে আসেও কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই তাদেরকে গতবারের মতো উলটাপালটা বই রাখতে দেবে না। সুতরাং ধারণা করা যায় ২০১৬-এর বইমেলা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হবে।

ধারণা করা যায় আগের অনেক বারের মতো এবারের বইমেলাতেও সেলেব্রেটিদের লেখা চওড়া মার্জিনে বড় বড় ফন্টে ছাপা প্রতি পৃষ্ঠার দাম ৫ টাকা বা তারচেয়ে বেশি পরে এমন অন্তঃসারশূন্য বই বের হবে, উত্তরাধিকারদের রয়্যালটি না দিয়ে প্রয়াত বিখ্যাত লেখকদের রচনাবলী বের হবে, কপিরাইট আইনের তোয়াক্কা না করে জনপ্রিয় বিদেশি বইগুলোর অননুমোদিত বঙ্গানুবাদ বের হবে, প্রগতি-রাদুগা-মীর প্রকাশনীর এতিম বইগুলোকে অনেকে আপন মনে করে নিজেরা ছাপিয়ে গলাকাটা দাম লিখে রাখবে। এর বাইরে কাশেম বিন আবু বকরদের শরীয়তি প্রেমের উপন্যাস, আবুল আসাদদের শরীয়তি স্পাই থ্রিলার, আধুনিক প্রকাশনী আর তার ভাইবেরাদরদের প্রকাশিত নানা জ্ঞানের বই আর সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রকাশিত তেল চুপচুপ বইগুলো তো আছেই। সুতরাং এবারের বইমেলা বেশ জমজমাট হবে বলে ধারণা করা যায়।

যে আড্ডার লোভে বইমেলাতে যেতাম সেটা কি একেবারেই হবে না? লিটল ম্যাগ চত্ত্বরে, একাডেমির পুকুরপাড়ে, শিববাড়ীর চা-পুরি’র দোকানে, রমনা কালীমন্দিরের পাশে, টিএসসিতে, ছবির হাটে – কোথাও কি কোন আড্ডা হবে না? আড্ডা অবশ্যই হবে। সেখানে কেউ না কেউ তো আড্ডা দেবেই। তবে সেখানে কোপ বা কিল হজমকরাদের কেউ থাকবে না, সুতরাং সেসব আড্ডা বেশ পরিচ্ছন্ন ও গঠনমূলক হবে। সেখানে কেউ কারো অনুভূতিতে আঘাত দেবে না। সবাই খুব সুন্দর সুন্দর গোল গোল আলোচনা করবে।

কিছু কিছু মানুষ আছে যারা বলে — তারা কখনো আশা হারায় না। তারা সব সময় দিগন্তে সিলভার লাইনিং দেখতে পায়। পৃথিবীতে কোন কিছুই চিরস্থায়ী নয়। সুতরাং কোন না কোন সময়ে ঘোর অমা রজনীর অবসান ঘটবেই। সেই হিসাবে দিগন্তে সিলভার লাইনিং সবসময়ই আছে। তবে অমা রজনীর অবসান হতে কত সময় লাগবে সেটা হিসাব করার বিষয়। সেই সময়ের দৈর্ঘ্য দেশের মানুষের গড় আয়ুর চেয়ে বেশি হলে বুঝতে হবে সেই প্রভাত আলো বর্তমানে জীবিতদের কারো নসিবে নেই। চিরআশাবাদী লোকজনের কথাবার্তা শুনলে বুকটা আশায় ভরে ওঠে, চোখের কোনে পানি চিকচিক করে ওঠে, দৃপ্ত শপথে হাত মুঠ হয়ে যায়। কিন্তু সেসব কথা শুনলে যেটা বোঝা যায় না সেটা হচ্ছে এসব প্রেরণাদায়ী বক্তৃতা বড্ড বেশি আপাত অরাজনৈতিক। সেখানে অচলায়তন ভাঙার কথা বলা হয় না, অন্ধকারের সাথে সংঘর্ষের কথা বলা হয় না, চিন্তার রুদ্ধতাকে চ্যালেঞ্জ করার কথা বলা হয় না। সেসব কথায় অতীত ভুলে সবাইকে মিলেমিশে একসাথে এগিয়ে যাবার কথা বলা হয়। এগুলো যে আসলে অন্ধকারের রাজনীতির সহায়ক কথাবার্তা সেটা বুঝতে দেয়া হয় না। এসব সুন্দর, পরিচ্ছন্ন, গোল গোল উপদেশভরা কথামালা অমা রজনীর দৈর্ঘ্যকে কেবল বাড়িয়েই যায় — এক জীবন থেকে কয়েক জীবন, কয়েক শতাব্দী। এবারের বইমেলাতেও নিশ্চয়ই সেসব চিরআশাবাদী লোকজন তাদের বাণী চিরন্তনীর ডালা নিয়ে হাজির হবে। বস্তুত বছরকার ব্যবসা কোন বেকুব নষ্ট করতে চায়!

এমন বইমেলাতে আমার মতো দু’চারটা অঘামঘা গেলেই কি, আর না গেলেই কি! আমরা তো লেখকও না, প্রকাশকও না। দু’চারটা বই কিনে বা কয়েক ঘন্টা আড্ডা দিয়ে আমরা নিশ্চয়ই জগতসংসার উলটে ফেলতে পারবো না। তাই সবার বৃহত্তর স্বার্থে একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-অনুভূতিশীল-আশার বাণীভরা বইমেলাই টিকে থাকুক। আর কয়েক শতাব্দী ধরে শকুন আর শেয়াল আমাদের হৃদয় ছিঁড়েখুঁড়ে খেয়ে মোটাতাজা হোক।


মন্তব্য

ওডিন এর ছবি

এমন বইমেলাতে আমার মতো দু’চারটা অঘামঘা গেলেই কি, আর না গেলেই কি! আমরা তো লেখকও না, প্রকাশকও না। দু’চারটা বই কিনে বা কয়েক ঘন্টা আড্ডা দিয়ে আমরা নিশ্চয়ই জগতসংসার উলটে ফেলতে পারবো না। তাই সবার বৃহত্তর স্বার্থে একটা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন-অনুভূতিশীল-আশার বাণীভরা বইমেলাই টিকে থাকুক।

ওডিন এর ছবি

যে আড্ডার লোভে বইমেলাতে যেতাম সেটা কি একেবারেই হবে না? লিটল ম্যাগ চত্ত্বরে, একাডেমির পুকুরপাড়ে, শিববাড়ীর চা-পুরি’র দোকানে, রমনা কালীমন্দিরের পাশে, টিএসসিতে, ছবির হাটে – কোথাও কি কোন আড্ডা হবে না? আড্ডা অবশ্যই হবে। সেখানে কেউ না কেউ তো আড্ডা দেবেই। তবে সেখানে কোপ বা কিল হজমকরাদের কেউ থাকবে না, সুতরাং সেসব আড্ডা বেশ পরিচ্ছন্ন ও গঠনমূলক হবে। সেখানে কেউ কারো অনুভূতিতে আঘাত দেবে না। সবাই খুব সুন্দর সুন্দর গোল গোল আলোচনা করবে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।