আমার ঠাকুদা একাত্তরে শহীদ হয়েছিলেন। সাদা শাড়ির ঠাকুমার বাকি জীবনটা কেটেছে গাছের সাথে। প্রতিটা গাছ ছিল তাঁর ভালোবাসা! বড় গাছগুলোতে ছিল কত রকমের পাখির বাসা। কুড়া নামে ঈগলের একটা প্রজাতি আছে। বাড়ির পুকুরের পাশে বড় একটা গাছে ছিল ওদের বাসা। রাতে ঘুম ভাঙ্গলে শুনতাম ক্রুরর-ক্ররর-ক্ররর স্বরে ঈগল ডেকে যাচ্ছে। বাবুই পাখির বাসা ছিল ছিপছিপে তালগাছটায়। স্কুলের বইতে যখন "বাবুই পাখিরে ডাকি, বলিছে চড়াই..." পড়ছিলাম, পুরো কবিতাটা কি যে ভালো লাগত। বিশাল রেইনট্রি গাছটা ছিল অনেক দিনের পুরানো। ঠিক সন্ধ্যা নামার আগে হাজারখানেক তোতা পাখি গাছটায় বসে চেঁচামেচি করত। "আতা গাছে তোতা পাখি" পড়ার সময় ভাবছিলাম তোতা তো থাকে রেইনট্রি গাছে! হরিতকী আমলকী আর আম গাছের পথ ধরে একটু সামনে গেলে বাঁশ ঝাড়। সেটাই ছিল বাড়ীর সীমানা। সন্ধ্যা হতেই সেখান থেকে শোনা যেত শিয়ালের হুঁকা হুয়া ডাক। আর তক্ষক মনে হয় সারা রাত ‘তক্-ক্কা’ ডেকে যেত। ছেলেবেলায় রবীন্দ্রনাথের সহজ পাঠ বইতে পড়েছিলামঃ
নাম তার মোতিবিল, বহু দূর জল—
হাঁসগুলি ভেসে ভেসে করে কোলাহল।
পাঁকে চেয়ে থাকে বক, চিল উড়ে চলে,
মাছরাঙা ঝুপ ক’রে পড়ে এসে জলে।
এ কবিতার সবকিছু পরিচিত। গ্রামে হাতে গোনা কিছু পাকা ভবন ছিল। আমার ছেলেবেলার স্কুল ছিল এদের মধ্যে একটা। তবে গ্রামের পাকা বাড়ির সংজ্ঞাটা অনেকের সঙ্গে না মেলাটাই স্বাভাবিক। ইট সিমেন্টের চার দেয়ালের উপর টিনের ছাদ। দিদির হাত ধরে ধুলার রাস্তায় হেঁটে প্রথম স্কুলে যাওয়ার স্মৃতিটা মনে আছে। আমার হাতে একটা লজেন্স দিয়ে দিদি চলে গেলেন। স্কুলের পাকা ভবনের পাশে বাঁশের বেড়ার ছোট ঘরগুলো ছিল প্রাইমারি স্কুলের। স্যার মাঝে মাঝে ক্লাসে আসতেন। আমার প্রিয় বন্ধুর নাম ছিল মশা। নাম হিসাবে মশা খুব হাস্যকর, এ সাধারণ জ্ঞান তখন আমার ছিল না। নাম নিয়ে হাসতাম না বলে হয়ত সে আমাকে পছন্দ করত। মশার বাবা দেবদেবীর মূর্তি বানাতেন। স্যার না আসার দিনগুলোতে ওদের বাড়িতে খেলতে যেতাম। তাঁদের বাড়ির উঠানে থাকত কৃষ্ণ-রাধা-লক্ষী- মনসা-কার্তিক-সরস্বতী।
আমার স্কুলের প্রথম শ্রেণির বাংলা বইটা অনেক বদলে গেছে! হাশেম খান আমাদের বইতে সাদা কালো ছবি আঁকতেন, এখন সব রঙিন! রঙ ছাড়া আরো অনেক পরিবর্তন। প্রথম পাতায় আছে "নিজের সম্পর্কে বলি"। তৃতীয় পাতায় "ক্লাসের সহপাঠীদের সাথে পরিচিত হই"। সেখানে ঐশী, উর্মি, এনাম ঈশিতাদের মধ্যে ঔছন আর উমং আছে (ছবি-১)। আমাদের অবহেলিত এবং নির্যাতিত আদিবাসী সম্প্রদায় পাঠ্যপুস্তকে জায়গা পেয়েছে!
(ছবি-১)
ক্লাসের এ পরিচয় পর্বটার শেষে যদি বইয়ের ছবি নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার মত বিষয় থাকত (ছবি-২)! স্কুলের প্রথম দিনটা সবার জন্য খুব মজার হত! আমাদের প্রথম শ্রেণির বইতে পাঠদানের এই উপাদানটা অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
(ছবি-২)
বইতে পাঠ ৩ এর পরিবর্তনটা দেখে আনন্দে বুক ভরে গেছে। নুতন সংস্করনে "খেলার সময় খেলি" ছবিটাতে (ছবি-৩) শারীরিক প্রতিবন্ধী একজন শিশু অন্য ছেলে মেয়েদেরদের সাথে খেলছে।
(ছবি-৩)
এই বইতে গল্প আছে, ছড়াও আছে (ছবি-৪)।
(ছবি-৪)
তবে ভালো হত যদি বাচ্চাদের নিজেদের মত করে কিছু গল্প বানানোর কাজ দেয়া হত। যেখানে ছবি দেখে ছেলেমেয়েরা মুখে মুখে গল্পও বানিয়ে বলবে (ছবি-৫)।
(ছবি-৫)
অনেক আগে থেকে বর্ণ কার্ড (Alphabet Card) ব্যবহার করে শব্দ শেখার ধারনাটা চলে আসছে। আমাদের বইতে এ পদ্ধতি অনুসরন করা হয়নি। পাশাপাশি দুটো বর্ণ বসলেই যে অর্থপূর্ণ শব্দ হয় না এটা আবিষ্কারের মধ্যেও তো আনন্দ আছে (ছবি-৬)।
(ছবি-৬)
প্রথম শ্রেণির বাংলা বইটার শেষ দিকে আছে যুক্তাক্ষর শিক্ষা। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বর্ণপরিচয় অথবা রবীন্দ্রনাথ সহজ পাঠের প্রথম খণ্ডে যুক্তাক্ষর এড়িয়ে গেছেন। হয়ত ৫/৬ বছরের শিশুদের জন্য যুক্তাক্ষর একটা কঠিন বিষয়। তবে সহজ পাঠের দ্বিতীয় খন্ডের শেষ কবিতায় ছিল যুক্তাক্ষরের মেলাঃ
অঞ্জনা নদীতীরে চন্দনী গাঁয়ে
পোড়ো মন্দিরখানা গঞ্জের বাঁয়ে
জীর্ণ ফাটল-ধরা— এক কোণে তারি
অন্ধ নিয়েছে বাসা কুঞ্জবিহারী।
আত্মীয় কেহ নাই নিকট কি দূর,
আছে এক ল্যাজ-কাটা ভক্ত কুকুর।
আর আছে একতারা, বক্ষেতে ধ’রে
গুন্ গুন্ গান গায় গুঞ্জন-স্বরে।
গঞ্জের জমিদার সঞ্জয় সেন
দু-মুঠো অন্ন তারে দুই বেলা দেন।
সাতকড়ি ভঞ্জের মস্ত দালান,
কুঞ্জ সেখানে করে প্রত্যূষে গান।
খোঁজ নিয়ে দেখলাম পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের প্রথম শ্রেণির বইতে রবীন্দ্রনাথ নামের যুক্তাক্ষর এড়ানোর জন্য লেখা হয়েছে রবি ঠাকুর। এমনকি নজরুল রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখাতে স্কুলের পরিবর্তে ইসকুল ব্যবহার করা হয়েছে (ছবি-৭)। ভাষা শেখার সাথে অবশ্যই বয়সের সম্পর্ক আছে। আমি শিক্ষাবিদ না, পাঠ্যপুস্তক কমিটির বিশেষজ্ঞরা এটা নিশ্চয় জানেন!
(ছবি-৭)
লেখাটার শুরুতে আমার স্কুলের বন্ধু মশার কথা বলেছিলাম। দ্বিতীয় শ্রেণিতে আমি গ্রাম ছেড়ে শহরের 'ভালো স্কুলে' চলে আসি। তাঁর সাথে একবার দেখা হয়েছিল। প্রতি পৌষমাসে দীঘির পাড়ে মেলা বসত; নাম ছিল ভূতের মেলা। মশা সেখানে মূর্তি বিক্রি করছিল। লেখাপড়া তাঁর কাছে কঠিন মনে হত। আমাদের গরিব স্কুলে তো কোন আনন্দ ছিল না। শুধু মুখস্থ আর মুখস্থ। পরীক্ষায় লেখার সময় বানান কিংবা দাঁড়ি কমায় ভুল করলে ফেল। বেচারা ফেল করে পড়ালেখা ছেড়ে দিয়েছিল।
'Early Childhood Education' নিয়ে প্রতিবছর প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। সেখানে শিশুদের শিক্ষাদানের অনেক অভিনব পদ্ধতি উঠে আসছে। আমাদের পাঠ্যপুস্তক কমিটির সদস্যরা কি তা দেখেছেন? পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবছর পাঠ্যপুস্তক এবং ক্লাসে পাঠদান পদ্ধতির কিছু না কিছু সংস্কার হচ্ছে। আমাদের ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের প্রথম শ্রেণির বাংলা পাঠ্যবইয়ের সংস্কারের শেষ তিনটি হয়েছিল ২০০২, ২০০৯, এবং ২০১৩ সালে।
ছবিঃ আমার বই, প্রথম শ্রেণি, পশ্চিমবঙ্গ প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদ।
সৌমিত্র পালিত
মন্তব্য
------------------------------------------------------------------
মাভৈ, রাতের আঁধার গভীর যত ভোর ততই সন্নিকটে জেনো।
_____________
সৌমিত্র পালিত
এখনকার ছবিতে রংচং এসে হাশেম খানের ছবির মত স্নিগ্ধতা হারিয়ে ফেলেছে।
আশা করি অদূর ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা একদিন দুটিই পাবে...
____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?
প্রথম শ্রেণির 'আমার বাংলা বই' এর গ্রাফিক্স/মাল্টিমিডিয়া ভার্সন আছে। নিচের লিংকে দেখতে পারেন।
http://digitalcontent.ictd.gov.bd/index.php/tutorial/watch?id=550
_____________
সৌমিত্র পালিত
ভালো বলেছেন। সৃজনশীল করে শিশুদের গড়ে তোলার বিষয়টা মনে হয় অনেক সময়ই ভুলে যাওয়া হয়।
সোহেল ইমাম
পড়ার জন্য ধন্যবাদ, সোহেল ভাই।
_____________
সৌমিত্র পালিত
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল
পড়ার জন্য !
_____________
সৌমিত্র পালিত
নতুন মন্তব্য করুন