অপমানের দিনরাত্রি

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: বুধ, ১১/০৫/২০১৬ - ২:১৪অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

২০০৫ বা ২০০৬ সাল হবে। একটা ঘরোয়া নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। খুব বেশি জন মানুষের আয়োজন না তাই পরিচিত-অর্ধপরিচিত-অপরিচিত সবাই মিলে আলাপ জমে উঠতে সমস্যা হয়নি। এমন আড্ডার বিষয়সূচীতে যা যা থাকে তার মধ্যে রাজনীতি যে থাকবে সে’কথা বলাই বাহুল্য। রাজনীতির আলাপের একটা পর্যায়ে আমার অপরিচিত একজন বললেন, আমার একটা সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতার কথা বলি।

ভদ্রলোক যা জানালেন — তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা, ঢাকার বাইরে পোস্টেড। তিনি যেখানে কর্মরত সেই জায়গাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ না, কিন্তু আর পাঁচটা গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় যেতে হলে সেখান দিয়ে যেতে হয়। দিন সাতেক আগে এক বিকালে হঠাৎ তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ফোন আসে যে শিল্পমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী ঐদিন রাতে তার যাত্রাপথে ঐখানে ঘন্টা দুয়েকের যাত্রা বিরতি করবে। বিরতির সময়টাতে তাকে শিল্পমন্ত্রীর দেখভাল করতে হবে।

একজন মন্ত্রী কোথাও গিয়ে যত মিনিট বা যত ঘন্টা থাকুন না কেন তার জন্য নূন্যতম অবকাঠামোগত সুবিধা থাকতে হয়। সব জায়গায় সেই সুবিধা থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। বস্তুত ঢাকার বাইরে খুব অল্প জায়গা ছাড়া কোথাও অমন উপযুক্ত ব্যবস্থা নেই। এর জন্য স্থানীয় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মোটেও দায়ী নন্‌, কিন্তু সেকথা কে শুনবে! তার ওপর মন্ত্রী মহোদয়ের সাথে থাকা পারিষদ দলের গরম সূর্যের চেয়ে বেশি। সুতরাং পান থেকে চুণ খসলে ছাপোষা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভোগান্তির শেষ থাকে না। আর মন্ত্রী মহোদয় যদি কোন কিছু চেয়ে না পান বা কোন কারণে অসন্তুষ্ট হন তাহলে ঐ কর্মকর্তা অচিরেই দেশের দুর্গম কোন অঞ্চলে বদলি হবার আশংকা করতে পারেন। অমন নড়বরে ব্যবস্থা নিয়েই ভদ্রলোক তার ওপর ন্যস্ত দায়িত্ব সেরে সেদিন মাঝরাতের পরে বাসায় ফেরেন।

তিনি যে পদে ছিলেন তাতে মাঝে মধ্যে এমন বাড়তি ডিউটি দেয়াটা বিচিত্র কিছু নয়। সেজন্য তার কোন ক্ষোভ নেই। কিন্তু শিল্পমন্ত্রীর পদে থাকা মতিউর রহমান নিজামীকে প্রটোকল দেয়া নিয়ে তার ব্যাপক ক্ষোভ আছে। এই ভদ্রলোক ছাত্রজীবনে একটা বাম ছাত্র সংগঠনের সাথে যুক্ত ছিলেন। রাজনীতিতে খুব সক্রিয় না থাকলেও নব্বইয়ের দশকে জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দেয়া কর্মসূচীগুলোতে নিয়মিত যেতেন। তার ছাত্রজীবনে নিজের শিক্ষায়তনসহ দেশের যে কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ইসলামী ছাত্র শিবির তাণ্ডব বা হত্যাকাণ্ড ঘটালে যেসব বিক্ষোভ কর্মসূচী হতো তিনি সেগুলোতেও অংশ নিতেন। আর আজ মেধার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকর্তা হবার পর তাকে আল বদর কমান্ডারের খেদমত করার জন্য পাঠানো হচ্ছে!

গল্পটা শেষ হবার পর আমি নির্লজ্জের মতো ভদ্রলোকের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে ছিলাম। দেখি সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘পাদটীকা’ গল্পের পণ্ডিত মশাইয়ের মুখের মতো “সে মুখ লজ্জা, তিক্ততা, ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গিয়েছে”। আমি মাথা নিচু করে চুপ করে রইলাম। অন্য কেউও কোন কথা বললেন না। এক সময় সবাই ওঠার তোড়জোর শুরু করলেন। বাসায় ফিরতে ফিরতে আমি ভাবলাম, ১৯৭১ সালে এই ভদ্রলোক নিতান্তই শিশু ছিলেন, তবু মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযোদ্ধা, দেশ, জাতি আর পতাকার অসম্মানটি তাঁর বুকে বেজেছে। আর শিল্প মন্ত্রণালয়ে কর্মরত যারা ১৯৭১-এ সরাসরি অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেছেন তাঁদেরকে প্রতিদিন কী অপমানের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে! রাষ্ট্রের যারা হর্তাকর্তা তাদের মাথায় কি এই প্রকার কোন চিন্তাভাবনার উদ্রেক হয়, নাকি ক্ষমতার মোহে তারা সব কিছু ভুলে গিয়ে পিতার ঘাতক আর মাতার ধর্ষককে মাথায় তোলাটাকে ঠিক মনে করে?

আমার রেজোয়ান সাহেবের কথা মনে পড়ে, যিনি শিল্প মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একটা দপ্তরের একজন নিম্নপদস্থ কর্মকর্তা। ভদ্রলোককে আমি বহু বছর ধরে একই পদে কাজ করে যেতে দেখেছি। চাকুরিতে তার পদন্নোতি যে হয়নি তা না। হয়েছে, তবে খুবই ধীরে। তাছাড়া তাঁকে কোন স্থানে পদায়নের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষকে ভাবতে হয়েছে কাজটা তিনি করতে পারবেন কিনা, কারণ রেজোয়ান সাহেব মুক্তিযুদ্ধ করতে গিয়ে ডান হাঁটুর কাছে গুলি খেয়েছিলেন। যুদ্ধাহত হবার অভিশাপে অনেক সময়ই তিনি প্রাপ্য পদায়ন পাননি। সামান্য ব্যতিক্রম ছাড়া এই দেশের অবকাঠামো যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার চলার উপযুক্ত করে বানানো নয়। নিজের প্রাপ্যটা না পাবার হতাশায় রেজোয়ান সাহেব যতটা না কষ্টে থাকার কথা তারচেয়ে ঢেড় বেশি অপমানের জ্বালা তাকে সহ্য করতে হয়েছে নিজের মন্ত্রণালয়ের চূড়ায় মইত্যা রাজাকারকে দেখে। একই জ্বালা সহ্য করেছেন রেজোয়ান সাহেবের মতো আরও অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারী — যারা মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন।

খুব দুর্ভাগ্যজনক কোন ঘটনা না ঘটলে আর কয়েক ঘন্টা বা কয়েক দিনের মধ্যে মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির আদেশ কার্যকর হবার কথা। এই ফাঁসিতে রেজোয়ান সাহেব বা প্রথমোক্ত ভদ্রলোকের বুকের জ্বালা হয়তো কিঞ্চিত জুড়াবে, কিন্তু তাঁদের অপমান করার কলঙ্কটা থেকে যাবে। নিজামী বাংলাদেশের প্রথম রাজাকার মন্ত্রী নয়, এবং শেষও নয়। মন্ত্রীর বাইরে এমপি, স্থানীয় সরকারের প্রতিনিধি, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা পদে স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়োগ অব্যাহত গতিতে হয়েছে, এবং এখনো তাদের অনেকে সগৌরবে স্বপদে বহাল আছে। সেসব জায়গায় রেজোয়ান সাহেবদের প্রতিদিনকার অপমানের পথ খোলাই আছে।

এসব নিয়ে কখনো বিশেষ কথা হয় না। মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তান-পোষ্য-উত্তরাধিকারদের জন্য সরকারি চাকুরিসহ বিভিন্ন স্থানে কোটা সংরক্ষণ নিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম হলেও বহাল তবিয়তে পদ দখল করে থাকা স্বাধীনতাবিরোধীদের হঠানোর কথা কেউ বলে না। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীনতাবিরোধীদের দ্বারা লুটপাটকৃত সম্পদ বা দখলকৃত সম্পত্তি মূল মালিক বা তার উত্তরাধিকারীদের কাছে ফিরিয়ে দেবার কথা কেউ বলে না। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ প্রমাণিত হয় তাদের কাছ থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের ক্ষতিপূরণ আদায় করার বিধান রাখার কথা কেউ বলেনা।

নিজামী বা অনুরূপ যুদ্ধাপরাধীদের বিচার-শাস্তি ইত্যাদি প্রসঙ্গে যখন কোন আলোচনা হয় তখন উপস্থিত ব্যক্তিদের প্রতিক্রিয়া বা লিখিত মন্তব্যগুলো খেয়াল করলে দেখা যায় তাদের মধ্যে বিপুল পরিমাণ মনুষ্য নামধারী আছে যারা এদের অতীত কর্মকাণ্ড ও বর্তমান আচরণ সমর্থন করে। শুধু সমর্থনই করে না এর সপক্ষে লড়ারও চেষ্টা করে। দুনিয়ার আর কোন দেশ, যেটা মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন হয়ঞ্ছে, সেখানে এমন দৃশ্য দেখা যাবে বলে মনে হয় না। মন্ত্রণালয়ের চূড়ায় বসা বা গাড়িতে লাল-সবুজ পতাকা ওড়ানোর চেয়ে নিজামীদের এই সাফল্যটা বড়। তারা তাদের মতো নিমকহারাম, ইতর একটা শ্রেণী তৈরি করে রেখে যেতে পারছে। এবং এরা সরকার ও রাষ্ট্রযন্ত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে।

আমাদের প্রতিদিনকার অপমানের পথ কিন্তু খোলাই থাকছে।

****************************************************************

You have made us a byword among the nations; the peoples shake their heads at us.
We can't escape the constant humiliation; shame is written across our faces.
All we hear are the taunts of our mockers. All we see are our vengeful enemies.

(Psalm 44:14 – 44:16)


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

অপমানের এই যন্ত্রনাটা থাকুক আরো তীব্র হোক। এক সময় আগ্নেয়গিরির মত ফেটে বেরিয়ে আসুক।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

ভদ্রলোকের অপমান কিছুটা অন্তত লাঘব হয়েছে বোধহয়...

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।