বাংলার প্রথম মহিলা নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর বাড়িতে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ২১/০৫/২০১৬ - ৯:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সরকার সিএনজি’র কিলোমিটার প্রতি ভাড়া বাড়ানোর পর প্রথম কিছুদিন বেশ ভাল গেল। সিএনজি ড্রাইভারকে ভাড়া জিজ্ঞেস করলেই বলত “মামা, মিটারে যা আসে তাই দিয়েন।“ বাহ, কি চমৎকার। একইসাথে আমি আনন্দিত এবং পুলকিত। কিছুদিন পর ড্রাইভারগণের বিনীত নিবেদন “মামা, মিটারে ভাড়া যা আসবে তার থেকে ২০ টাকা বেশি দিয়েন।“ ভাগনেদের এমন বিগলিত ব্যবহারে অন্তরাত্মা দ্রবীভূত না হয়ে কি পারে? হাসিমুখে এইটাও মেনে নিলাম। আর এখন যেই লাউ সেই কদু। মিটারে উনারা যাবেনই না। আবারও আগের মতোই বাগবিতন্ডা, চিল্লাচিল্লি, খেপাখেপি এবং সবশেষে পরাজয় স্বীকার করে সিএনজি যাত্রা। মধ্যবিত্ত হওয়ার অনেক জ্বালা। সবথেকে বড় সমস্যা এই যে জীবনের প্রতিটা ক্ষেত্রেই কম্প্রোমাইজ করতে হয় এবং কম্প্রোমাইজ এর এই ধারা মৃত্যু পর্যন্ত চলতেই থাকে।

গ্রীষ্মের কোন এক দুপুরে এমনই এক পরাজয়ের গ্লানি মাথায় নিয়ে সিএনজি ভ্রমণ শেষ করে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এসে পৌঁছুলাম। উদ্দেশ্য অফিসের কাজে কুমিল্লা ভ্রমণ। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসের আরামদায়ক আসনে গা এলিয়ে দিয়েও কিছুক্ষণ আগের পরাজয়ের গ্লানি ভুলতে পারছিলাম না। কি আর করা, মস্তিষ্ক ঠাণ্ডা করার নিমিত্তে মান্ধাতা আমলের স্মার্টফোনখানা হাতে নিয়ে ফেসবুকে ঢুঁ মারলাম। ফেসবুকে Travellers of Bangladesh নামে একটা গ্রুপ আছে যেখানে পরিভ্রমণ করতে আমার বেশ ভাল লাগে। কি মনে করে সেখানে প্রবেশ করতেই লাকসামের নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর উপর একটা লেখা চোখে পড়ল। লেখাটা পড়ার পর আবারও বুঝতে পারলাম আসলেও আমি কত কিছুই জানি না। এত কাছে এমন একজন গুণী মহিলার নিবাস ছিল সেই বিষয়ে অজ্ঞানতার অপরাধে নিজেকে কি শাস্তি দেওয়া যায় ভাবছিলাম। শেষে সিদ্ধান্ত নিলাম উনার বাড়ি থেকে ঘুরে আসব। তাহলেই হয়ত অজ্ঞানতার এই অপরাধের যৎকিঞ্চিত প্রায়শ্চিত হতে পারে।

যতবার কুমিল্লা’তে যাই ততবার এরিয়া ম্যানেজার টিকলু সাহেব অনুরোধ রাখেন, “স্যার একবার লাকসাম থেকে একটা চক্কর দিয়ে যান।“ কেন জানি যাওয়া হয় না। গেল দু’বছরে কুমিল্লার আনাচে কানাচে প্রায় সবখানেই ঢুঁ মেরেছি কিন্তু লাকসামে যাওয়া হয় নি। এইবার কি আর সে সুযোগ ছাড়া যায়? কুমিল্লা’য় মিটিং শেষ করে পরদিন সকালে রওনা দিলাম লাকসামের উদ্দেশ্যে। কাজও হবে, নওয়াবের বাড়িও দেখে আসা যাবে।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী ছিলেন বাংলার প্রথম মহিলা নওয়াব। ১৮৩৪ সালে কুমিল্লা জেলার লাকসাম থানাধীন প্রসিদ্ধ পশ্চিমগাঁও জমিদার পরিবারে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ঊনবিংশ শতক পূর্ববাংলার সমাজব্যবস্থা নানাভাবে পশ্চাৎপদ ছিল। তারপরও সেই পিছিয়ে পড়া সমাজকে এগিয়ে নিয়ে একজন নারী হয়ে সবার অগ্রভাবে ছিলেন ফয়জুন্নেসা। রক্ষণশীল সমাজের অন্তঃপুরবাসিনী এই নারী নিজের চেষ্টায় জ্ঞান অর্জন করেছিলেন তেমনি নিজেকে বিদ্বৎ সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। শিক্ষা, সমাজ-কল্যাণ ও সেবায় তিনি যে উদাহরণ রেখে গেছেন তার তুলনা হয় না। কেবল সমাজসেবায় নয়, তিনি সাহিত্য সাধনায়ও অনন্য অবদান রেখেছিলেন তার উদাহরণ 'রূপজালাল' কাব্যগ্রন্থ। এই উপাখ্যানটি ১৮৭৬ সালে ঢাকা গিরিশ মুদ্রণযন্ত্রে শেখ মুন্সী মওলা প্রিন্টার্স কর্তৃক মুদ্রিত হয়। এই গ্রন্থের অর্ধেকের বেশি পদ্যে লিখিত এবং অবশিষ্টাংশ গদ্যে লিখিত। এটি সম্ভবত বাংলার একজন মুসলিম মহিলা কর্তৃক প্রথম রচিত একটি পূর্ণাঙ্গ সাহিত্যকর্ম। সিপাহী যুদ্ধোত্তরকালে ব্রিটিশ ভারতের মুসলিম সমাজ নানাভাবে অধিকার বঞ্চিত হন। এ গ্রন্থে একজন মুসলিম বীরপুরুষ চরিত্রের রূপদানের মাধ্যমে ফয়জুন্নেসা তাঁর সময়ের মুসলিম সমাজকে হতাশা ও নৈরাশ্য থেকে মুক্ত করে আশা ও প্রেরণা জোগাতে প্রয়াসী হন। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর সঙ্গে সংস্কৃত সাহিত্যের গভীর সম্পর্ক ছিল। ওই সময় তার 'রূপজালাল' গ্রন্থটি মধ্যযুগের কবি আলাওলের রচনার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছিল। সাহিত্য সাধনায় তার কৃতিত্ব তাকে পার্থিব জীবনে এনে দিয়েছে সুউচ্চ সম্মান, অন্যদিকে তেমনি অমরত্ব।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর পিতা আহমদ আলী চৌধুরীও ছিলেন অত্যন্ত বিদ্যোৎসাহী মানুষ। তারই প্রথম কন্যা ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী। তার আরও তিন সন্তান ছিল ইউসুফ আলী চৌধুরী, ইয়াকুব আলী চৌধুরী, লতীফুন্নেসা। জমিদার বাড়ির আরাম-আয়েশের মাঝেও তার জমিদার পিতা শিশুকাল থেকে মেয়ের পড়াশোনার ব্যাপারে গভীর মনোযোগ রেখেছিলেন। এমনকি পড়াশোনার দিকে মেয়ের অকৃত্রিম আগ্রহ লক্ষ্য করে তার জন্য উপযুক্ত গৃহশিক্ষার ব্যবস্থা করেছিলেন। ফয়জুন্নেসার নিজের একটি লাইব্রেরি ছিল। সেখানে তিনি বিভিন্ন সাহিত্য ও ধর্মবিষয়ক গ্রন্থাদি পাঠ করতেন। ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে পিতার মৃত্যুর পর তার মা আফরান্নেছা বেশিদিন জমিদারি চালাতে পারেননি। কিছুকাল পরেই ফয়জুন্নেসার উচ্ছৃঙ্খল বড়ভাই নিজ হস্তে জমিদারি গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে তার ফুফাতো ভাই জমিদার গাজী চৌধুরীর সঙ্গে ফয়জুন্নেসার বিয়ে হয়। বিবাহিত জীবনে তিনি দুই কন্যা আরশাদুন্নেছা ও বদরুন্নেসার জননী ছিলেন। তবে ফয়জুন্নেসার সংসার জীবন বেশিদিন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। একসময় ফয়জুন্নেসা নিজেই জমিদারির হাল ধরেন। কিছুদিনের মধ্যে তিনি প্রজাদের কাছে প্রিয়জন হয়ে উঠেছিলেন।

কুমিল্লার তদানীন্তন জেলা প্রশাসক মি. ডগলাস ওই জেলার জন্য জনহিতকর সংস্কারমূলক একটা পরিকল্পনা হাতে নিয়ে অর্থাভাবে বড় বিপদে পড়েন। তৎকালীন অর্থশালী বিত্তবান হিন্দু জমিদারদের কাছে তিনি প্রয়োজনীয় অর্থ ঋণ হিসেবে চেয়েছিলেন। কিন্তু অর্থের পরিমাণ শুনে সবাই তাদের অপারগতা জানান। মি. ডগলাস কিন্তু কোনো মুসলমান জমিদারের কাছে এ আবদার জানাননি। তার বদ্ধমূল ধারণা ছিল যে মুসলমানদের কাছ থেকে তিনি কোনো সাহায্যই পাবেন না। কারণ ইংরেজদের প্রতি তারা ছিলেন বিরূপ মনভাবাপন্ন। তাছাড়া পশ্চিমগাঁওয়ের জমিদার ছিলেন একজন নারী। এলাকার সংস্কার প্রকল্পে যখন কোনো হিন্দু পুরুষ জমিদার সাহায্যের হাত বাড়ালেন না, তখন একান্ত নিরুপায় হয়ে মি. ডগলাস জমিদার ফয়জুন্নেসার সাহায্য কামনা করেন। দূরদর্শী জমিদার ফয়জুন্নেসা মি. ডগলাসের সংস্কারমূলক পরিকল্পনার খুঁটিনাটি সবিশেষে মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং জনকল্যাণ কতটুকু হবে তা ভেবে দেখার জন্য সময় নেন। এরপর তিনি প্রকল্পটি ভালোভাবে পরীক্ষা করে দেখেন। একপর্যায়ে জনকল্যাণের কথা ভেবে প্রয়োজনীয় অর্থের সম্পূর্ণটাই একটা তোড়ায় বেঁধে একখানি চিঠিসহ মি. ডগলাসের কাছে পাঠিয়েছিলেন। তিনি চিঠিতে মি. ডগলাসকে লিখেছিলেন- 'আমি জনকল্যাণমূলক যেসব কাজ করতে চেয়েছিলাম তা আপনার হাত দিয়েই হোক, এই আশা করি। ... ফয়জুন্নেসা যে টাকা দেয় তা দান হিসেবেই দেয় কর্জ হিসেবে নয়।'

সুদূর বাংলাদেশের নিভৃত পল্লীর একজন নারী জমিদারের সমাজসেবা ও উদার হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীও অত্যন্ত অভিভূত হয়েছিলেন। মহারানী ভিক্টোরিয়া তার সভাসদের পরামর্শক্রমে মি. ডগলাসকে নির্দেশ দেন জমিদার ফয়জুন্নেসাকে মহারানীর আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে সরকারিভাবে 'বেগম' উপাধি দিয়ে সম্মানিত করা হোক। ডগলাস সাহেব ফয়জুন্নেসাকে এ ঘটনা জানালে তিনি সরাসরি মহারানীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি জানান 'জমিদার হিসেবে নিজে জমিদারিতে 'বেগম' হিসেবে তিনি এমনিতেই সবার কাছে পরিচিত। সুতরাং নতুন করে 'বেগম' খেতাবের কোনো প্রয়োজন নেই।' তেজস্বী এই মহীয়সী জমিদারের কাছে ব্রিটিশ সম্রাজ্ঞীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান হলে মি. ডগলাস বড়ই বিপাকে পড়েন। ডগলাস নিরুপায় হয়ে তিনি সম্পূর্ণ ঘটনাটি পুনরায় মহারানীকে জানান। মহারানীর প্রস্তাব প্রত্যাখানের কথা শুনে রানী ফয়জুন্নেসার তেজস্বীতায় একাধারে অভিভূত এবং অন্যধারে গভীর সমস্যায় পড়েন। তারপর তাঁকে ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দে 'নওয়াব' খেতাব দেওয়া হয়।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা ছিলেন প্রজারঞ্জক ও জনকল্যাণকামী জমিদার। প্রজাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য মাঝে মাঝে পালকি চেপে তিনি জমিদারি তদারকিতে বেরোতেন। বিভিন্ন মৌজায় গিয়ে প্রজাদের সুবিধা-অসুবিধা বুঝে ব্যবস্থা নিতেন। নিরক্ষর, অসুস্থ মানুষের নিরাময়, সুখ-শান্তি কামনাই ছিল ফয়জুন্নেসার একান্ত কাম্য। এ জন্য তিনি একাধারে পরিখা খনন, স্কুল, কলেজ, মসজিদ, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করেন। লাকসামের পশ্চিমগাঁওতে ১৮৯৭ সালে তিনি হাসপাতাল নির্মাণ করেন। বর্তমানে এটি লাকসাম সরকারি দাতব্য চিকিৎসালয় নামে পরিচিত। ১৮৯৩ সালে প্রতিষ্ঠা করেন 'ফয়জুন্নেসা জানানা হাসপাতাল'। এই হাসপাতালটি ফয়জুন্নেসার এক অবিস্মরণীয় কীর্তি। কুমিল্লায় সুপেয় পানির অভাব ছিল সে জন্য তিনি পরিখা খনন ও পানির ট্যাঙ্ক বসান। ফয়জুন্নেসা তার ওয়াক্ফ এস্টেটের অধীনে ১৪টি কাছারির প্রতিটি সংলগ্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়, স্কুল এবং একটি করে পুকুর খনন করেন। স্বগ্রামে অর্থাৎ পশ্চিমগাঁওয়েও তিনি দুটি পুকুর খনন করেন। এর একটি দশ গম্বুজ মসজিদ সংলগ্ন যেটির পশ্চিম দিকে শান বাঁধানো ঘাট আছে। নওয়াব ফয়জুন্নেসা লাকসামের পশ্চিমগাঁও থেকে সংযোগ সড়ক, রাস্তা-ঘাট প্রভৃতি নির্মাণ করেছিলেন। পশ্চিমগাঁওয়ে 'ফয়েজিয়া মাদ্রাসা' নামে যে একটি অবৈতনিক মাদ্রাসা স্থাপন করেছিলেন তা এক উজ্জ্বল উদাহরণ।

নওয়াব ফয়জুন্নেসা হজে যাওয়ার আগে নিজের বসতবাটিসহ সমস্ত সম্পদ জনকল্যাণে দান করেছিলেন। তিনি তার ওয়াক্ফ দলিলের প্রারম্ভেই বলেছেন- 'জগৎপিতা জগদ্বীশ্বরের কৃপায় আমি পার্থিব সর্বপ্রকার মান-সম্ভ্রম ও ঐশ্বর্য এবং ঐহিক সুখ-স্বচ্ছন্দতা বিপুল পরিমাণে ভোগ করিয়াছি। এই ক্ষণ আমার বৃদ্ধাবস্থা উপস্থিত বিধায় ইহকালের বৈষয়িক চিন্তাজাল হতে নিষ্কৃতি লাভ পারমার্থিক এ পারত্রিক উপকারজনক কার্যে মনোনিবেশ করাই সর্বেব্ববভাবে কর্তব্য।' পবিত্র হজ পালনের জন্য মক্কা নগরীতে গিয়েও সেখানে মানুষের জলকষ্ট নিবারণের জন্য বহু অর্থ ব্যয় করে 'নাহরে জুবাইদা' পুনঃখনন করেন। তিনি ১৯০৩ সালে প্রয়াত হন।

নওয়াব ফয়জুন্নেসার বাড়িতে যখন আমরা পৌঁছাই তখন মধ্য বিকেল। চমৎকার নির্মাণশৈলীর বাড়িটি একাকী দাঁড়িয়ে আছে। সামনে ছোট্ট এক টুকরো বাগান। পুরাতন প্রাসাদে আসলেই আমার কেমন জানি হাহাকার লাগে। কত কিছুই না আমরা সৃষ্টি করি, অথচ মৃত্যুর সময় সবকিছুই ফেলে যেতে হয়। এই বাড়ি একসময় লোকজনে গমগম করত। আর আজ কালের সাক্ষী হয়ে নিশ্চুপ দাঁড়িয়ে আছে। প্রাণের কোন স্পন্দন পাচ্ছি না। বাড়ির ভেতরটা অন্ধকার। ভিতরে ঢুঁকেই সরু এক প্যাসেজ। হাতের ডানপাশে অন্ধকারে সময়ের আক্রমণে ক্ষয়িষ্ণু সিঁড়িগুলো ধাপে ধাপে উপরে উঠে গেছে। দেয়াল হাতড়ে দোতলা পেরিয়ে ছাদে যাওয়ার পথেই মানুষের কথাবার্তা কানে আসল। একদম নিষ্প্রাণ তাহলে নয় এই বিল্ডিং। কারও প্রাইভেসিতে ব্যঘাত ঘটানো সমীচীন হবে না ভেবে ছাদে যাওয়ার আশা পরিত্যাগ করলাম।

কৌতূহল হচ্ছিল লোকজন এখানে বাস করে কি করে সেটি ভেবে? এত প্রাচীন ভবনে থাকার পরিবেশ আছে বলে মনে হচ্ছিল না। সিঁড়ি বেয়ে নিচের সরু প্যাসেজে নেমে অল্প একটু এগুতেই প্রশ্নের জবাব পেয়ে গেলাম। এই বাড়ির পিছনে আরও একটা বাড়ি আছে যেখানে লোকজনের বসবাসের চিহ্ন দৃশ্যমান। তার মানে দাঁড়াচ্ছে পেছনের বাড়িটাতে সবাই থাকে আর সামনের পুরাতন ভবনে হয়ত আসা যাওয়া করে। চারপাশটা ভাল করে ঘুরে দেখার জন্য অন্দরমহল থেকে বের হয়ে আসলাম। পাশেই আরও একটা পুরনো ভবন। এই ভবনে যে কেউ থাকে না এবং যায়ও না সেটা একদম স্পষ্ট। সম্ভবত অতিথিশালা ছিল এই ভবনটি। আর অতিথিশালার পাশের ঘরগুলো সম্ভবত ভৃত্যদের আবাসস্থল ছিল। ভবনগুলোর গঠন এবং অঙ্গসজ্জা দেখে সেরকমই লাগছিল।

মূল চত্বর থেকে আবারও রাস্তায় বেরিয়ে এলাম। রাস্তার অপর পাশেই ডাকাতিয়া নদী। এই নদী প্রথম দেখেছিলাম চাঁদপুরে। সেখানে ডাকাতিয়া মেঘনা’র সাথে মিলিত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই প্রমত্তা ডাকাতিয়ার সেই রূপের সাথে লাকসামের ডাকাতিয়ার রূপ মেলাতে পারছিলাম না। এখানে ডাকাতিয়ার অবস্থা ছোট এক খালের মত। নদীর পাশেই নওয়াব ফয়জুন্নেসার নামে প্রতিষ্ঠিত সরকারী কলেজ।

রাস্তার ডানপাশে নওয়াব ফয়জুন্নেসা প্রতিষ্ঠিত ১০ গম্বুজওয়ালা চমৎকার মসজিদ এবং তৎসংলগ্ন ঈদগাহ। ঈদগাহ এবং মসজিদের মাঝামাঝি জায়গাটুকুতে আছে নওয়াব পরিবারের সদস্যদের কবর। মসজিদের পশ্চিম পাশে নওয়াবের উদ্যোগে খননকৃত পুকুর এবং তৎসংলগ্ন ঘাট।

ফিরবার সময় এপিটাফগুলো দেখছিলাম। বিশেষ কিছু লেখা নেই। এক সারিতে মৃত্যুর সময়ের ক্রমানুসারে সাজানো সবগুলো কবর। নওয়াব ফয়জুন্নেসার কবরের সামনে দাঁড়িয়ে সেই সময়ের সাহসী এই মহীয়সী রমণীর প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা নিবেদন করলাম। জীবন তো এমনই অর্থবহ হওয়া উচিৎ, যেন মৃত্যুর পরও সবাই তাঁর কীর্তিকে স্মরণ রাখতে পারে।

তথ্যসূত্রঃ
(১) কিংবদন্তি নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী
(২) নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানী-উইকিপিডিয়া
(৩) রূপজালাল-বাংলাপিডিয়া

ফাহমিদুল হান্নান রূপক


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

সুন্দর পোষ্ট। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরানীর শুধু নামটাই জানতাম, এই তথ্য গুলো জেনে ভালো লাগলো। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

সময় নিয়ে পড়বার জন্য ধন্যবাদ। আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- সম্ভব হলে ঘুরে আসুন। ডাকাতিয়া নদীর পাশে বসে হাওয়া খেতে ভালোই লাগবে।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

জীবনযুদ্ধ এর ছবি
অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

আবারও পপ্পন নিয়া চইলা আসলেন ভাইডি? এই পপ্পন কি কোনদিন শেষ হবে না?

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

ভ্রমন ও ইতিহাস বিষয়ক তথ্যাদি জানানোর জন্য আপনাকে অসংখ্যক ধন্যবাদ। পড়ে খুব ভাল লাগলো, আশা আছে সেখানে একবার ভ্রমনে যাব।
AMD. Abdullah

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়বার জন্য ধন্যবাদ। ঘুরে আসুন, ভাল লাগবে।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো লাগলো। আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যবিষয়ক লেখা। লেখককে ধন্যবাদ।

সাইয়িদ রফিকুল হক

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা- আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

তামজীদ  এর ছবি

আমি কয়েক মাস পূর্বে এ জমিদার বাড়ীতে গিয়েছিলাম, কিন্তু তার ইতিহাস আজকে জানলাম। আমার জানামতে স্থানীয় অনেকে এর ইতিহাস সম্পর্কে খুব বেশী অবগত নয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ঠিক ধরেছেন। অনেকেই নওয়াব ফয়জুন্নেসার ইতিহাস জানেন না। আমি নিজেই জানতাম না। ঘুরতে গিয়ে জানতে পারলাম।

ফাহমিদুল হান্নান রূপক

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।