রিলিভ দ্যা পিপল অব বাংলাদেশ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ০১/০৮/২০১৬ - ৮:৪৩অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

তাঁদের প্রথম দেখা লন্ডনে এক বন্ধুর বাড়িতে। তেইশ বছরের তরুণ "দ্যা বিটলসের" গিটারিস্ট জর্জ হ্যারিসনের তখন তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা। প্রথম দিনের আলাপে ছেচল্লিশ বছরের রবিশঙ্কর লাজুক এবং নিরহংকার হ্যারিসনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। লন্ডন থেকে সামান্য দূরে ছিল জর্জ হ্যারিসনের বাংলো। তবলাবাদক আল্লা রাখাকে নিয়ে রবিশঙ্কর সেতার শেখাতে তাঁর সে বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাঁদের দ্বিতীয় এ সাক্ষাতে জন লেনন আর রিংগো স্টারও ছিলেন। সেতার শেখার সময়টাতে টেলিফোন বেজে উঠল। সেতারটা নিচে রেখে পা দিয়ে ডিঙ্গিয়ে জর্জ হ্যারিসন ফোন ধরতে যাচ্ছিলেন। সে মুহুর্তে রবিশঙ্কর তাঁর পায়ে আঘাত করে বললেন "তোমার জানা উচিত বাদ্যযন্ত্রের প্রতি সম্মান হচ্ছে সঙ্গীতের প্রথম শিক্ষা"। যুক্তরাজ্য থেকে রবিশঙ্কর ভারত ফিরে আসলেন। মাসখানেক পর জর্জ হ্যারিসন সেতার শিক্ষার জন্য ভারতে ছুটে এলেন। বড় গোঁফ আর লম্বা চুল ছোট করার পরেও ভারতীয় এক সাংবাদিক তাকে চিনে ফেলেছিল। বোম্বের তাজমহল হোটেলের রাস্তায় পরদিন থেকে হাজারখানেক তরুণ-তরুণীর ভিড়। "জর্জ" "জর্জ" চিৎকারে সেতার তো দূরে থাক, রাতের ঘুম পর্যন্ত বন্ধ হবার অবস্থা। রবিশঙ্কর সংবাদ সম্মেলন করে জর্জ হ্যারিসনের আসার কারণ জানিয়ে হোটেলের সামনে ভিড় না করার অনুরোধ করেছিলেন। বোম্বে থেকে পালিয়ে কাশ্মীর বেনারসের মত বিভিন্ন জায়গা ঘুরে ঘুরে জর্জের সেতার শিক্ষা চলছিল। কঠোর নিয়ম মেনে ছয় সপ্তাহের টানা পরিশ্রম শেষে জর্জ হ্যারিসন বুঝলেন "এ যন্ত্র ঠিকভাবে বাজাতে আমার চল্লিশ বছর সময় লাগবে"। এরপর তিন/চার বছর তিনি সেতার শিখেছিলেন। রবিশঙ্কর তাঁকে নিজের শিকড় গীটারের কাছে ফিরে যেতে বললেন। পাশ্চাত্য সঙ্গীতের দুই কিংবদন্তী এরিক ক্ল্যাপটন আর জিমি হেনড্রিক্সও একই কথা বললেন। জর্জ হ্যারিসন নিজে উপলব্দি করলেন "বড় সেতার বাদক আমি হতে পারব না। হয়ত আমার গীটারেই ফিরে আসা উচিত।" তবে তিন/চার বছরের সেতার শিক্ষা তাঁর সঙ্গীতবোধকে সমৃদ্ধ করেছিল। জর্জ হ্যারিসন গান লিখতে শুরু করেছিলেন। সেতারের সুরস্রষ্টাদের মত নিজের লেখা গানগুলোতে তিনি বিশেষ সময় অথবা মুহুর্তের নিজেকে প্রকাশ করেছেন। যেমন "বাংলাদেশ" গানটি নিয়ে তিনি লিখেছেন "ওয়ান সাচ সং ওয়াজ বাংলাদেশ, এ সং ফর দ্যা টাইমস, টেরিবল টাইমস ইন দ্যা আনহ্যাপি সেভেন্টিজ"।

একাত্তরের জুনে হলিউডে "রাগা" এলবামের কাজ চলছিল। একদিন স্টুডিওতে জর্জ হ্যারিসনকে রবিশঙ্কর মুখ অন্ধকার করে বলছিলেন "আমি একটা কনসার্ট করতে চাই। তুমি আমাকে সাহায্য করবে? আমি ২৫ হাজার ডলার তুলতে চাই। বাংলাদেশে না খেয়ে মানুষ মরছে। ওদের জন্য। তুমি যদি আমার এই প্রোগ্রামের প্রচারণার কাজটা করতে পারবে... পিটার সেলার্সকে যদি একটু বলে দেখবে...কিছু একটা যদি করতে পার...।" তিনি জর্জকে সংবাদপত্র আর বিভিন্ন ম্যাগাজিনের কাটিং দেখাতে লাগলেন। যুদ্ধ আর শরনার্থী জীবনের নির্মম রিপোর্টগুলো পড়ে জর্জ হ্যারিসনের মনে হল "আই শ্যুড হেল্প হিম ডু ইট"। দ্যা বিটলসের দর্শন ছিল "যদি কিছু করার পরিকল্পনা কর, ছোট না, বিশাল কিছু কর"। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন ১ আগস্টের "কনসার্ট ফর বাংলাদেশের" জন্য ভাড়া নেয়া হল। জুন থেকে আগস্ট-- জর্জ হ্যারিসন এ তিন মাস কনসার্টের জন্য কাজ করে গেছেন। তাঁর লেখা "বাংলাদেশ" গানটার কথা ধরা যাক। জর্জের মনে হল গানটায় কিছু একটা বাদ পড়েছে। "এই কনসার্টের পেছনের কথা তো বাদ পরে গেছে!" গানটার শুরুতে যোগ করা হল "মাই ফ্রেন্ড কেইম টু মি/উইথ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ...।"

কনসার্টে অংশ নিতে এরিখ ক্ল্যাপ্টন এসেছিলেন যুক্তরাজ্য থেকে, ক্লাউস ভুরম্যান জার্মানি, রিঙ্গো স্টার স্পেন থেকে। বব ডিলানও এতে অংশ নিতে রাজি হয়ে গেলেন। কনসার্টের আগের রাতে ম্যাডিসন স্কয়ারে এসে এত এত ক্যামেরা, মাইক্রোফোন আর বিশাল আয়োজন দেখে তিনি জর্জ হ্যারিসনকে বলে বললেন "আমি ভাবতে পারি নাই এটা এত বড় আয়োজন। এত বড় ইভেন্টের জন্য আমি প্রস্তুত না।" বব ডিলান বেশ কয়েক বছর ধরে বড় কোন কনসার্ট করেন নাই। সেজন্য তিনি ভীত ছিলেন। জর্জ হ্যারিসনের অবস্থাও ছিল বব ডিলানের মত। তিনি সাম্প্রতিক সময়ে বড় কোন মঞ্চে পারফর্ম করেন নাই। তিনি ডিলানকে বোঝাতে চাইলেন। ১ আগস্ট কনসার্ট শুরু হয়ে গেছে। জর্জ হ্যারিসন পারফর্মারদের লিস্টে বব ডিলানের নামের পাশে প্রশ্নবোধক চিহ্ন দিয়ে রাখলেন। মাঝে মাঝে পেছন ফিরে বব ডিলানকে খুঁজছিলেন। তাঁর প্রশ্নবোধক চিহ্নকে মুছে দিয়ে একুস্টিক গিটার আর হারমোনিকা নিয়ে বহু পরিচিত ভঙ্গিতে বব ডিলান মঞ্চে আসলেন। আসলে কনসার্টের কো-প্রডিউসার ফিল স্পেকটর ছুটে গিয়েছিলেন বব ডিলানের এপার্টমেন্টে। তিনি তাঁকে রীতিমত ধরে-বেঁধে নিয়ে এসেছিলেন!

পৃথিবীর ইতিহাসে প্রথম চ্যারিটি কনসার্টের শুরুতে রবিশঙ্কর বলেন "বন্ধুরা, এই কনসার্ট কেবল সাধারণ একটি অনুষ্ঠান নয়, এর একটি বার্তা আছে। আমরা রাজনীতি করার চেষ্টা করছি না। আমরা শিল্পী। তবে আমরা সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের হাহাকার, তীব্র যন্ত্রণা ও দুঃখের ঘটনা আপনাদের জানাতে চাই। বাংলাদেশ থেকে ভারতে আসা শরণার্থীদের কথা আপনাদের জানাতে চাই"। রবিশঙ্কর-আলী আকবর খাঁ-আল্লা রাখা-কমলা চক্রবর্তীর সমবেত বাদ্যযন্ত্রে বেজে উঠল বাংলার মাটির সুর। বাংলাদেশের জন্য কনসার্টের এর চাইতে ভালো সূচনা আর কি হতে পারত! শেষটায় ছিল জর্জ হ্যারিসনের "বাংলাদেশ" যেখানে বার বার তিনি গেয়ে গেলেন "রিলিভ দ্যা পিপল অব বাংলাদেশ"। গান শেষে তিনি গীটারটা মঞ্চে রেখে দর্শকদের অভিবাদন জানিয়ে বিদায় নিলেন। তখনও মিউজিক বেজে যাচ্ছে। তিনি লিখেছেন, এখনো বাঙ্গালি কোন রেস্টুরেন্টে গেলে শুনি "আপনি তো মিস্টার হ্যারিসন? যুদ্ধের দিনগুলোতে শুনেছিলাম আপনি বাংলাদেশের পাশে আছেন। আমাদের অসম্ভব ভালো লেগেছিল।"

একাত্তরের ৩০ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিভিন্ন দেশে তাঁদের দূতাবাস এবং মিশনকে সতর্কমূলক বার্তায় লিখেছিল "এ কনসার্টের এলবামে পাকিস্তানবিরোধী প্রচারণা রয়েছে"। তাই তাদের সব রকম যোগাযোগের মাধ্যমে এর "সম্প্রচার বন্ধ করে দিতে হবে"। পাকিস্তানে এ রেকর্ড সরকারিভাবে নিষিদ্ধ করা হয়।

তথ্যসূত্রঃ
George Harrison, I, Me, Mine, Chronicle Books, 2002
Ravi Shankar, My Music, My Life, Mandala Publishing, 2007

সৌমিত্র পালিত

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

হয়ত অনেকের পুরো কনসার্ট দেখা হয়নি। এটা তাদের জন্যঃ
https://vimeo.com/66413717

-----------------
সৌমিত্র পালিত

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ভাল লাগলো, এই কন্সার্ট নিয়ে যতবারই পড়ি, যতবারই শুনি সবসবমই চোখ ভিজে উঠে।
ধন্যবাদ লেখাটির জন্য।

অনন্যা

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ, পড়ার জন্য।
_________
সৌমিত্র

সোহেল ইমাম এর ছবি

ভালো লাগলো। সুন্দর লিখেছেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

সোহেল ভাই, ধন্যবাদ।
_________
সৌমিত্র

অতিথি লেখক এর ছবি

এই কনসার্টের গল্প আমাকে বরাবরই মুগ্ধ করে চলছে। যতই পড়ি, যতই জানি "কনসার্ট ফর বাংলাদেশ" এর শিল্পীদের জন্য শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়ে আসে।

হারিসন, রবীশঙ্কর, ডিলান.... যে যেখানেই আছেন ভাল থাকবেন, শান্তিতে থাকবেন। পৃথিবী আপনাদের ভুলে গেলেও যেতে পারে কিন্তু বাংলাদেশীরা আপনাদের ভুলবে না... ইতিহাসের একটা অংশ জুড়ে আপনারা আছেন থাকবেন।
___________________
আহমাদ মুহাইমিন

অতিথি লেখক এর ছবি

সচলায়তন পোস্টের মেন্যুবারে সমস্যা হচ্ছিল বলে এই ছবিগুলো দিতে পারি নাই। জর্জ হ্যারিসনের খাতায় "বাংলাদেশ" গানের তিনটি খসড়া! হয়ত ভবিষ্যতে কারো কাজে আসবে। সেজন্য মূল্যবান এই ছবিগুলো আপলোড করে রাখলাম।

http://i.imgur.com/qJLpCpy.png

http://i.imgur.com/QFo7epj.png

http://i.imgur.com/s76n2Uk.png

___________
সৌমিত্র

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।