ফসল বিলাসী হাওয়া (প্রথম পর্ব)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: সোম, ১৫/০৮/২০১৬ - ১০:৩৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক।।

ঃ বুঝলে আহমেদ, আমরা ছিলাম এগারো ভাই। আমি সবার ছোটো। বড় ভাইয়ের সাথে আমার আঠারো বছরের তফাৎ। কেনিয়া তে এটা অবশ্য তেমন কোন ব্যাপারই না। বিশেষ করে আমরা যে গ্রামে থাকতাম সেখানে।
ঃ তোমাদের গ্রামের নাম কি হামফ্রে?
ঃ নাম জেনে কী করবে? উচ্চারণ করতে পারবেনা। ধরে নাও সোহালি।
ঃ এ নামটাও মন্দ নয়। বাংলাদেশে কাছাকাছি নামের একটা গ্রাম রয়েছে।
ঃ তাই নাকি? কী নাম সে গ্রামের?
ঃ সোহাগি, অবশ্য সত্যি সত্যি আছে কিনা বলতে পারবোনা। একটা উপন্যাসে পড়েছি।
ঃ সোহালি কিন্তু কোথাও নেই।
ঃ নেই বলছ কেন!
ঃ আফ্রিকার ম্যাপ দেখেছো?
ঃ দেখেছি, কিন্তু ম্যাপের সাথে তোমার গ্রামের সম্পর্ক কি?
ঃ সম্পর্ক আছে। আচ্ছা, আফ্রিকার ম্যাপ দেখে তোমার কী মনে হয়?
ঃ মনে হয় জ্যামিতির বইয়ের কথা।
ঃ আসলেই তাই। আফ্রিকাকে ভাগ করা হয়েছে ইউরোপিয়ান কলোনিয়ালিস্টদের ইচ্ছে অনুযায়ী, রুলার টেনে টেনে। বেশির ভাগ দেশই দেখবে কেমন যেন ত্রিভুজ কি চতুর্ভুজ টাইপের। ম্যাপে অ্যাঙ্গোলাও যা, নামিবিয়াও তা। পশ্চিমের কেনিয়ার সাথে পুবের টোগোর খুব একটা পার্থক্য খুঁজে পাবেনা তুমি।
ঃ সোহালির কী হয়েছিলো?
ঃ নানান জাতের মানুষ থাকে আফ্রিকাতে, হাজারো গোত্র, হাজার রকমের সংস্কৃতি। এখনকার মতো এত এত দেশ তো আর সেকালে ছিলনা, ছিল জনপদ, গোত্রের নামে তাদের নাম। আমি কিসি গোত্রের মানুষ। উগান্ডা আর কেনিয়ার বড় একটা অংশ জুড়ে ছিল কিসিদের বসতি। এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও ডজন খানেক গোত্র থাকলেও রিফট ভ্যালির পূর্ব দিকটায় আমরাই ছিলাম সংখ্যাগুরু। দাগ কেটে ভাগ করার পর কিসিদের একটা অংশ আটকে গেলো কেনিয়ায়, উপত্যকার পশ্চিম প্রান্তে। সব মিলে ধর শ তিনেক গ্রাম, তারই একটা সোহালি। সোহালির গা ছুঁয়েই সুয়াম নদী, অন্য পারে কালেঞ্জিনদের বসতি। কালেঞ্জিনরা নিচু জাত, নিচু জাত বললাম বলে আমাকে আবার খারাপ ভেবনা। এক এক জায়গার একেক চল, এক এক সময়ের একেক ভাবনা।

ঃ খারাপ ভাবতে যাবো কেন হামফ্রে? তবে তুমি যেভাবে বলছ তাতে করে মনে হচ্ছে কিসিদের সাথে কালিঞ্জানদের খুব একটা বনিবনা ছিলোনা।
ঃ সে আর বলতে! আমার পূর্ব পুরুষেরা ওদের উপর কম অত্যাচার করেননি, রুল টানার আগে আমরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলাম কিনা। কালিঞ্জানরা ভোলেনি কিছুই, এবার ওদের ফিরিয়ে দেবার পালা। আমার বাপ দাদারা তাও দুটো প্রজন্ম কষ্টে সৃষ্টে কাটিয়ে দিতে পেরেছিলেন। সব কিছু পাল্টে গেলো আমার জন্মের তেরো বছর পর। আফ্রিকায় তখন দারুণ খরা। সেই খরা, যার কথা তোমরা কাগজে পড়েছ, টিভিতে দেখেছো। এমন দুঃসময়েও রিফট ভ্যালি ছিল আগের মতোই সবুজ। কালিঞ্জান দের চোখ তো টাটাবেই।

এটা উনিশ শ বিরানব্বইয়ের কথা, আমার তখন পনেরো বছর। কালিঞ্জানরা এসেছিলো রাতের অন্ধকারে, দল বেঁধে হায়েনার মতো। সে রাতে মারা পড়েছিল পাঁচ হাজার কিসি, ঘর ছাড়া প্রায় এক লাখ। সোহালি পুড়ল, আমার তিন ভাই, মা আর একটা কাকাকে হারালাম। বাকিরা পালিয়ে এলাম উগান্ডায়। কিন্তু উগান্ডাও তো আফ্রিকাতেই, আফ্রিকা জুড়েই তখন গোত্রে গোত্রে, জাতিতে জাতিতে হানাহানি। এ মারছে ওকে, ও মারছে তাকে, আর সবাই মিলে মারছে আমাদের মতো সব হারানো মানুষদের। বছর খানেক টিকতে পেরেছিলাম উগান্ডায়। সেখান থেকে রুয়ান্ডা, তারপর বুরুন্ডি, শেষমেশ কীভাবে কীভাবে যেন এই ক্যানাডায়। ভাবতে পারো আহমেদ, এত বড় পরিবারে বেঁচে রয়েছি কেবল দুজন মানুষ! আমি আর আমার আঠারো বছরের বড় সেই ভাই। কোথায় আছে, কেমন আছে, জানতে চেয়ো না।

ঃ আমি খুবই দুঃখিত, হামফ্রে।
ঃ আরে না না, নাহ। তুমি কেন দুঃখিত হবে। এমনতো হয়েই থাকে, বরং বেঁচে আছি, আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার মাইল দুরের একটা জঙ্গলে রীতিমতো তাঁবু ফেলে আগুন জ্বেলে মাংস সেঁকে খাচ্ছি একি কম কথা!

মাংসটা সত্যিই অসাধারণ সেঁকেছে হামফ্রে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বিফ স্টেক অমৃতের মতো অনুভূত হচ্ছে জিভে, সেই সাথে ঝলসানো মাশরুম, তেঁতো বিয়ার। লন্ঠনের আলো আর বারবিকিউএর আগুন মিলে অদ্ভুত একটা পরিবেশ। পাশেই দাঁড়িয়ে আমাদের ঘণ্টা তিনেকের পরিশ্রমের ফসল, কোলম্যান কোম্পানির ক্যাম্পিং টেন্ট।

হামফ্রে গিয়েছে গাড়ি থেকে আরও কিছু জিনিসপত্র নামিয়ে আনতে। আমি একটা ফোল্ডিং চেয়ারে গা এলিয়ে তাঁবুর পাশে বসে আছি। দমকা হাওয়ায় মেঘ কেটে গিয়ে ঝকমক করছে খোলা আকাশ। আকাশ জুড়ে তারার মেলা। মাথার ঠিক উপরে, অনেক অনেক উপরে, অযুত নিযুত মাইল পেরিয়ে, অসীম অনন্ত সে আকাশে ছড়িয়ে আছে আলোয় ভেসে যাওয়া একটা পথ, ছায়াপথ। আমাদের ছায়াপথ, এন্ড্রমেডার সহোদরা, উরসা মেজরের সঙ্গী, মিল্কিওয়ে। মিল্কিওয়ে নামটা ভীষণ আটপৌরে, আমার ভালো লাগে আকাশগঙ্গা। আকাশগঙ্গা নামটা কার দেওয়া?

অরণ্যের দিনরাত্রিতে একটা জায়গা আছে, সুনীলের নয় - সত্যজিতের অরন্যে সৌমিত্রের দিনরাত্রিতে। সৌমিত্র, মানে গল্পের অসীম মাথার নিচে দুহাত রেখে একমনে আকাশের দিকে তাকিয়ে। সে আকাশে কোন তারা নেই, ঘোলাটে ঘোলাটে আকাশ, মেঘে ঢাকা বর্ণহীন প্রাণহীন বিষণ্ণ একফালি আকাশ। অসীমের তুলনায় অনেক ভাগ্যবান আমি।

বুনো হাঁসের একটা ঝাঁক উড়ে আসছে চাঁদের সীমানা ছুঁয়ে। এরা চলে যাচ্ছে দক্ষিণে, যেখানে রয়েছে উষ্ণ জলাধার, নরম মাটি। এখানকার লেক, ঝরনা, পুকুর ঠাণ্ডায় জমে বরফ হয়ে যাবে আর কিছুদিন পর। মাটি হয়ে উঠবে পাথরের মতো শক্ত। মাটির আস্তর ভেঙ্গে, বরফের আবরণ ভেদ করে খাবারের কাছে পৌঁছুতে পারে কোন হাঁস?

ঝাঁক থেকে হঠাৎ খসে পড়লো একজন, হাঁসের দলের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। তারা উড়ছে যেমন উড়ছিল একটু আগে, নিঃশব্দে। তাদের ডানায় প্রাণের স্পন্দন, অথচ পাখনায় মৃত্যুর শিহরণস। কতদিন হলো উড়ছে এরা? কতজন ছিল শুরুতে, খসে গেছে কয়জন? ক’জন পারবে শেষ পর্যন্ত গন্তব্যে পৌঁছুতে? কত ঘণ্টা, কত দিন, কত সপ্তা পর!

হামফ্রে যেন পরিযায়ী হাঁস, পার্থক্য একটাই। উষ্ণ আফ্রিকা থেকে হাজার মাইল পাড়ি দিয়ে হাড় কাঁপানো শীতের দেশে এসেছে সে, উষ্ণতার সন্ধানে।

ঃ সারা রাত কি বাইরেই কাটিয়ে দেবে আহমেদ? গ্রিল নিভিয়ে তাঁবুতে চলে আসো, লন্ঠনটা জ্বলতে থাকুক। এদিকে যদিও ভালুক টালুক চোখে পড়েনা, তবু, সাবধানের মার নেই।

খাসা একটা তাঁবু। হামফ্রে বুদ্ধি করে দুটো স্লিপিং ব্যাগও নিয়ে এসেছে। কোম্পানিগুলোর বুদ্ধির বলিহারি যাই, ব্যাগ গুলো দেখতে অনেকটা তুতানখামেনের কফিনের মতো। জিপার খুলে ঢুকে পড়লাম একটার ভেতরে। কী দিয়ে বানায় এ জিনিস! বাইরে ঠাণ্ডা কিন্তু ব্যাগের ভেতরটা কুসুম কুসুম গরম হয়ে উঠলো ধীরে ধীরে। ঘুমিয়ে পড়লাম সহজেই।

দুই।।

ঃ উঠে পড়, উঠে পড়। সকাল হয়ে গিয়েছে।

হামফ্রের কর্কশ সম্ভাষণ আর সেই সাথে বিচ্ছিরি একটা শব্দ। চোখ খুলে পিট পিট করে তাকিয়ে দেখি হাতে একটা কোকের ক্যান নিয়ে সমানে চামচ দিয়ে পিটিয়ে চলেছে সে। উঠতে গিয়েই ধড়াম করে পড়ে গেলাম, ভুলেই গিয়েছিলাম কটেজের কোন বিছানায় নয়, শরীরটা আটকে রয়েছে একটা স্লিপিং ব্যাগের ভেতরে। হাত দিয়ে ব্যাগের জিপার খুলতে খুলতে জিগ্যেস করলাম,

ঃ চা কফি কিছু কি এনেছো মনে করে?
ঃ আগে ব্যাগ থেকে বের তো হবে!

তাঁবুর বাইরে এসে মন জুড়িয়ে গেলো। ঝিরি ঝিরি একটা বাতাস বইছে, পুবের আকাশটা রাঙা, যেন একটা রঙের বোতল উপুড় করে ঢেলে দিয়েছে কেউ। শহরের যান্ত্রিক কোলাহল নেই, আবার শহরতলির মতো নিঃশব্দও নয় চারিদিক। পাখির কলরব, স্কুইরালের খ্যাঁক খ্যাঁক, আর বুনো শুয়োরের ঘোঁত ঘোঁত মিলে বেজে চলা অসাধারণ একটা অর্কেস্ট্রা আচ্ছন্ন করে রেখেছে আমার পৃথিবী। কোন অ্যাম্ফিথিয়েটারের সাধ্য নেই এমন একুস্টিক তৈরি করে।
গ্রিলের উপর একটা কেতলিতে টগবগ করে ফুটছে কফির পানি। সেখান থেকে সাদা সাদা বাষ্পের একটা স্রোতধারা সরু হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে বাতাসে।

কফিতে চুমুক দিতে দিতেই আমার পৃথিবী দুলে উঠলো, চাপে এবং আতংকে। এখন কী হবে? এটার কথা তো ভাবিনি!

ঃ ইয়ে মানে হামফ্রে, ওটার কোন ব্যাবস্থা ট্যাবস্থা আছে কি?
ঃ কোনটার?
ঃ বলছিলাম কি ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে কোন টয়লেট থাকেনা?
ঃ কাম অন আহমেদ! ইউ ক্যান শিট এনি হোয়্যার ইন দ্যা উডস। কেবল মনে করে টয়লেট পেপার আর ওই বেল্ট টা নিয়ে যেও।
ঃ কোন বেল্ট! বেল্ট দিয়ে কী হবে?
ঃ ধরা যাক তুমি তখন মাঝ পথে, হই হই করছে। এমন সময় একটা হরিণ অথবা বুনো শুয়োর এসে দাঁড়ালো তোমার ঠিক পেছনে। না পাড়বে বসে থাকতে, না পাড়বে উঠে দিতে দৌড়। এই যে বেল্টটা দেখছ, এটাকে বলে শিটিং ক্যাডি। না না, হেসো না। এটাই নাম, যেকোনো ক্যাম্পিঙের দোকানে গিয়ে বললেই পেয়ে যাবে। শক্ত পোক্ত একটা গাছ বেছে তড়তড় করে উঠে যাও মাঝ বরাবর। তারপর বেল্টটা কোমরে বেঁধে নিয়ে, বাকিটা আর নাই বা বললাম। তোমার টয়লেট ট্রেনিং আছে নিশ্চয়ই।

এ এক অদ্ভুত অভিজ্ঞতা। গাছের গুড়িতে লটকে থেকে ভাবছি ভাগ্যিস এ দেশে বানর টানর নেই। বাংলাদেশের বন্যা বাদাড়ে শিটিং ক্যাডি চলবে না, ওখানে সব সিটিং সার্ভিস। হঠাৎ খ্যাঁক খ্যাঁক শব্দ শুনে চোখ তুলে দেখি একটা স্কুইরাল, সিটিং হয়ে আছেন, ঠিক আমার মাথার উপর, মনে হচ্ছে একই উদ্দেশ্যে। দিশেহারা হয়ে তারস্বরে চিৎকার শুরু করলাম, স্কুইরালটা ভারি বিরক্ত হয়ে দিগুণ জোরে খ্যাঁকাতে লাগলো। আমিও প্রাণপণে চেঁচাচ্ছি। এরই মাঝে কানে ভেসে এলো আরেকটা খ্যাঁক খ্যাঁকানি, তাঁবুর কাছে দাঁড়িয়ে পেটে হাত দিয়ে হাসছে হামফ্রে। একটা সময় রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে গেলো স্কুইরাল।

ঃ সরি আহমেদ, ছাতার কথাটা বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
ঃ নরকে যাও তুমি।

তাঁবু থেকে লেক পর্যন্ত সহজ কোন রাস্তা নেই। অনেক খুঁজে পেতে সরু একটা ঢাল মিলেছে কিন্তু এবড়ো থেবড়ো পাথরে বোঝাই সে পথ। পাথরের চাঁই গুলো পেরিয়ে নেমে আসতেই পায়ে ঠেকল নরম বালি। সামনেই ইংরেজি এস এর মতো আঁকাবাঁকা সরু লেক, পরিষ্কার টলটলে পানি, খানিকটা নীলচে সবুজ। লেকের একটা বাঁক ঘিরে রয়েছে এভারগ্রিনের জঙ্গল। উপর থেকে জঙ্গলটা চোখে পড়েনা। আশেপাশের ধূসর বালি, রুক্ষ পাথর আর পাতাঝরা গাছেদের ভিড়ে দারুণ বেমানান এই কনিফারের সারি।

ঃ ট্রাঊট ধরার জন্য এর চেয়ে ভালো জায়গা হয়না।
ঃ কোন জায়গার কথা বলছ?
ঃ কনিফারের জঙ্গলটা।
ঃ তা তো বটেই! এখান থেকেই দেখতে পাচ্ছি গাছের ডালে ডালে কেমন দোল খাচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ট্রাউট।

আমার রসিকতা গায়ে মাখলো না হামফ্রে।

ঃ একটু রোদ উঠলেই দেখবে পানিতে কেমন ছায়া পড়ে। লেকের অন্য অংশের তুলনায় এই জায়গাটা বেশ ঠাণ্ডা, ট্রাউটের জন্য একেবারে আদর্শ। আমাদের জন্যও, সারাদিন রোদে পুড়ে সানবার্ন হবার টেনশন নেই।
ঃ হা হা হা, নভেম্বরে সানবার্নের টেনশন! ভালোই বলেছ তুমি।
ঃ সারাদিন রোদের মধ্যে বসে তো থাকোনি কখনও, সানবার্নের তুমি কী বুঝবে?
ঃ সারাদিন বসে থাকার কী দরকার? ঝটপট কয়েকটা মাছ ধরে চলে গেলেই হয়! দুজনে আর কটাই বা খাবো?

উত্তর না দিয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে পা চালায় হামফ্রে।

সূর্যের দিকে পিঠ দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমি। বাতাসে এখনও সোঁদা একটা গন্ধ, শিশিরের। গাছের ডালে, পাথরের খাঁজে, আর ঘাসের ডগায় জমে রয়েছে মুক্তোর দানার মতো বিন্দু বিন্দু জলের কণা। হামফ্রে যে ওস্তাদ মেছুরে সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই, কুশলী হাতে ঝটপট গুছিয়ে ফেলেছে সব কিছু। চারটে ছিপ, কয়েক বাক্স টোপ, একতাড়া বড়শি, দুটো বালতি, দুটো জাল, দুটো ফোল্ডিং চেয়ার, নেই কেবল তিনটি জিনিস। একটা টেবিল আর ছাতা বসানো দুটো পানীয়ের গ্লাস।

লক্ষ্যভেদ করার ক্ষমতা সকলের থাকেনা। আমার নেই, কোন কালেই ছিলনা। হামফ্রেকে বলতেই হো হো করে হেসে উড়িয়ে দিলো।

ঃ তোমাকে তো তিরান্দাজি করতে বলছিনা যে লক্ষ্যভেদ করতে হবে। পুরো লেকটাই তোমার টার্গেট। বাম হাতে ছিপটা ধরে ডানহাতে সুতোয় বাঁধা বঁড়শিটা ঘোরাবে, এক, দুই আড়াই। দুটো ফুল টার্ন আর একটা হাফ। আড়াই বলে হাত থেকে সুতোটা ছেড়ে দিলেই ব্যাস, লেকের কোন না কোন একটা জায়গায় গিয়ে পড়বে ওটা।

আমাকে দিয়ে হবেনা, কিছুতেই হবেনা জানি। কিন্তু হামফ্রের হাসিটা গায়ে জ্বালা ধরিয়ে দিয়েছে। ছিপের সুতোটা হাতে নিয়ে দাড়াতেই অদ্ভুত একটা অনুভূতি হোলো। সুতোটা যেন একটা ল্যাসো, আমার সামনে দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে একদল বুনো ঘোড়া।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো সুতো ঘুরিয়ে চলেছি আমি, আমার মাথার উপর বন বন করে ঘুরছে ল্যাসোর ফাঁস। কতক্ষণ বলতে পারবোনা, হঠাৎ কানের কাছে খেঁকিয়ে উঠলো হামফ্রে

ঃ বলি সুতোটা ছাড়বে নাকি ছাড়বেনা?

ওহ তাইতো! সুতোটা তো ছাড়ার কথা। কিন্তু কখন ছাড়বো? ফুল টার্নে নাকি হাফে? আর তাছাড়া কোনটা যে ফুল আর কোনটা হাফ সেটাও ঠিক বুঝতে পারছিনা। সব কিছু তালগোল পাকিয়ে গিয়েছে। বুদ্ধি করে ফুল আর হাফের মাঝামাঝি একটা টার্নে সর্বশক্তি দিয়ে ছুড়ে মারলাম বঁড়শি। পাশ থেকে ‘অ্যাঁই বাপ’ বলে চিৎকার দিয়ে এক লাফে সটান মাটিতে শুয়ে পড়েছে হামফ্রে। ঠিক ‘অ্যাঁই বাপ’ নয়, মাতৃভাষায় কিছু একটা বলেছে সে, কিন্তু আমি নিশ্চিত ওটা ‘অ্যাঁই বাপ’ না হয়ে যায়না। হামফ্রের কান ঘেঁষে, গোঁত্তা খাওয়া বোলতার মতো ছুটে গিয়েছে আমার বঁড়শি। আটকেছে কনিফারের একটা ডালে।

ঃ তোমাকে আগেই বলেছিলাম আমার হাতের টিপ ভালো না।
ঃ সমস্যা তোমার হাতে নয়। খামাখা দুটো ডলার ঝুলিয়ে দিলে গাছের ডালে।

গজগজ করতে করতে নিজেই সবগুলো বঁড়শি ছুঁড়ল হামফ্রে।

হ্যামিল্টন শহর ছেড়ে বের হবার মুখেই একটা চীনা দোকান চোখে পড়েছিল। ড্রাইভ করে গেলে এতক্ষণে ঠিক ঠিক সেখান থেকে মাছ কিনে ফিরে আসতে পারতাম। বসে থাকতে থাকতে পায়ে খিল ধরে গিয়েছে। কোন দুঃখে যে মানুষ মাছ ধরতে আসে! কই, গরুর মাংস খেতে ইচ্ছে করলে কেউ তো ছুরি চাপাতি নিয়ে বাথানে দৌড়য় না।

ঃ তুমি কি নিশ্চিত এই লেক এ মাছ আছে?
ঃ সব লেকেই মাছ আছে আহমেদ।
ঃ তাহলে দু ঘণ্টায় একটারও দেখা পেলামনা কেন?
ঃ তুমি পাঁচ মিনিট পরপর ‘ওই যে, ওই যে’ বলা না থামালে দুই ঘণ্টা কেন, দুই দিনেও কিছু মিলবেনা।

হামফ্রে বলেছিল ফাতনার দিকে নজর রাখতে। এতো বড় লেকের মাঝে ওইটুকুন ফাতনার দিকে নজর রাখা কি চাট্টি খানি কথা! দুর থেকে কেমন করে বুঝবো ওটা বাতাসে নড়ছে নাকি মাছের ঠোকরে?

তিন মিনিটও যায়নি, মনে হোলো একটা ফাতনা যেন দুলে উঠলো। বলবো না বলবো না ভেবেও বলেই ফেললাম,

ঃ ওই যে! ওই যে!

হামফ্রের হাতে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেলো। কোন হ্যাঁচকা টান নয়, অর্কেস্ট্রার কন্ডাক্টরের মতো আলতো একটা ঝাঁকুনি কেবল, তাতেই ছিপের ডগাটা বেঁকে গিয়ে সুতোটা টানটান হয়ে গিয়েছে। কিছু একটা রয়েছে অপর প্রান্তে। একহাতে ছিপটা ধরে আরেক হাতে ধীরে ধীরে হুইল ঘুরিয়ে সুতো গুটিয়ে আনে হামফ্রে। মাছটাকে দেখা যায়, জলের ঠিক তলায়, ক্ষীণ একটা রেখা এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে।

ঃ জালটা তৈরি রাখো, কাছে এলেই আটকে ফেলবে।

উত্তেজনায় আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাতজালটা পানিতে ডুবিয়ে অপেক্ষা করছি কখন সে আসে।

ঃ একটা মজা দেখবে?

আমি জবাব দেবার আগেই হামফ্রে আলগোছে একটা টান দিয়ে মাছটাকে পানির উপর তুলে ফেললো। পানিতে নেই টের পেতেই মাছটা ছটফট করে ওঠে। আমি মুগ্ধ, হা করে দেখছি মাছটা কেমন বেঁকেচুরে শরীর মুচড়ে প্রাণপণে লড়াই করছে অমোঘ নিয়তির সাথে। মাছ ধরা সার্থক।

ঃ এই যে এইভাবে মাছের মাথাটা চেপে ধরতে হয়।

তর্জনী আর বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে মাছটাকে বঁড়শি থেকে ছাড়িয়ে নেয় হামফ্রে।

ঃ ভালো করে দেখে নাও আহমেদ, দেখেছো কি? এবার ছেড়ে দিচ্ছি।

ছেড়ে দিচ্ছি মানে! বদমাইশি নাকি? মাছ ধরে ছেড়ে দেওয়া আর লটারি জিতে টিকিট ছিঁড়ে ফেলার মধ্যে তফাৎ আছে কোনো?

ঃ আমি তোমার কথা বুঝতে পারছিনা হামফ্রে। যতদূর জানি আমরা মাছ ধরতেই এখানে এসেছি। তোমার সমস্যা কি?
ঃ মাছটা ছোটো, আট ইঞ্চির নীচে ট্রাউট ধরা বেআইনি। এটা বড় জোর ইঞ্চি ছয়েক হবে।
ঃ তুমি কী করে জানলে এটা আট ইঞ্চির চেয়ে ছোট, রুলার দিয়ে মেপে দেখেছো?
ঃ ও আমার আন্দাজ আছে।

নিজের কানকে আমি বিশ্বাস করতে পারছিনা। ছয় ইঞ্চি মানেতো দুটো কই মাছ, নিদেন পক্ষে চারটে পুঁটি! চওড়ার দিকটা না হয় নাই ভাবলাম। আমার মৎস্যলোভী বাঙালি মনটা আকুলি বিকুলি করে ওঠে। শেষ চেষ্টা হিসেবে বললাম,

ঃ না হয় হোলোই খানিকটা ছোটো, দেখছে কে? কে আসছে এই ধ্যারধেরে জঙ্গলে আইন ফলাতে!

হামফ্রে অবাক হয়ে সরু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকায়।

গেল, চলেই গেল। আমার জীবনের প্রথম শিকার, জলজ্যান্ত একটা ট্রাউট যার কিনা থাকার কথা ছিল বারবিকিউএর গ্রিলে, তেলে মশলায় আবৃত হয়ে এই বাঙালির ওষ্ঠ ছুঁয়ে জিভে জড়িয়ে হৃদয় জুড়ে, সে চলে গেল সাঁতার কেটে, যেমন চলে যায় প্রথম প্রেম, বুকের ভেতর চিরস্থায়ী একটা ক্ষত রেখে।

ঃ নাহ, পিঁপড়ের ডিমের টোপে হবেনা। কেঁচো দরকার, কেঁচোর বাক্সটা কোথায় দেখতো।
ঃ তোমার পায়ের কাছে।
ঃ ওহ, তাই তো। আমার বঁড়শির প্যাকেটে একটা ব্লেড রয়েছে, ওটা বের কর।
ঃ ব্লেড দিয়ে কী করবে?
ঃ আমি কিছু করবোনা, তুমি কেবল ব্লেড দিয়ে একটা কেঁচোকে দু ভাগ করে দুটো বঁড়শিতে গেঁথে দেবে।

হামফ্রে নিশ্চয়ই আমার সাথে রসিকতা করছে। কেঁচো টেচোর মধ্যে আমি নেই।

ঃ তুমিই কেটে নাও।
ঃ কিন্তু আমিতো কেঁচো ছুইনা! আচ্ছা কেঁচো বাদ। ফড়িঙের বাক্সটা কোথায়?
ঃ আবার তেলাপোকা কেন? তোমার কি ধারণা ফড়িঙে আমার আপত্তি নেই?
ঃ আরে না চিন্তা করোনা। ফড়িঙে আমি অভ্যস্ত, কাটাকুটির ঝামেলা নেই, বঁড়শিতে গেঁথে দিলেই হোলো । সবচে ভালো হোতো বুলফ্রগের বাচ্চাগুলো দিতে পারলে।

তেলাপোকার বাক্সটা খুঁজে পাওয়া গেলনা।

ঃ তুমি ছিপগুলোর দিকে নজর রাখো, আমি তাঁবুতে গিয়ে বাক্সটা নিয়ে আসছি।
ঃ কী দরকার? যেভাবে চলছিল চলুক না। আর তাছাড়া কতটা পথ ঘুরে যেতে হবে ভেবেছ? তোমার যেতে আসতে অনেকক্ষণ লেগে যাবে। আমি একা একা কী করবো যদি মাছ টাছ পেয়ে যাই?
ঃ বেশিক্ষণ লাগবেনা। ঘুরে যাবো বলল কে? পেছনের পাথুরে খাড়াইটা টপকে চলে যাবো। আর মাছ টোপ গিললে স্রেফ হালকা একটা টান দেবে ছিপে, আমাকে দেখলে না?

খাড়াই টা দারুণ খাড়া, হামফ্রে তারপরেও কেমন করে যেন একটার পর একটা পাথর টপকে অনায়াসে উঠে যাচ্ছে। ভুলেই গিয়েছিলাম উপত্যকায় বড় হওয়া ছেলে সে।

হামফ্রে প্রায় উঠে গিয়েছে, হঠাৎ দেখি একটা ছিপ সড়সড় করে পানির দিকে চলে যাচ্ছে। মাছ! টোপ গিলেছে। আমি লাফ দিয়ে উঠতে না উঠতেই ছিপ পানিতে। কী যেন হয়ে গেল আমার, আলসে আমি, ভীরু আমি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে চেপে ধরলাম ছিপ। সেকি টান মাছের! নির্ঘাত বড়সড় একটা ট্রাউট।

ঃ হামফ্রে, নেমে আস জলদি। বড় কিছু একটা পড়েছে, টেনে ধরে রাখতে পারছিনা।

বলতে না বলতেই হঠাৎ পানির অতল থেকে বেরিয়ে এলো সে। লাফিয়ে উঠলো শূন্যে। চারিদিকে যেন হাজারটা রংধনুর ছটা। মাছের ভেজা শরীরে দুপুরের রোদের স্পর্শ, চোখ ধাঁধিয়ে যেতে চায়। বিশাল একটা ট্রাউট।
হামফ্রের চোখেও পড়েছে। খাড়াই বেয়ে সে নেমে আসছে পাহাড়ি ছাগলের ক্ষিপ্রতায়।

ঃ ছিপ ছেড়ো না আহমেদ। টানাটানি না করে হুইল ঘুরিয়ে সুতো ছেড়ে দাও, আমি আসছি।

হামফ্রে তর তর নামতে থাকে। আর মাত্র বিশ কি তিরিশ ফুট।

হামফ্রে কি লাফিয়ে পড়লো? অত উঁচু থেকে! হামফ্রের শরীরটা শূন্যে। একটা, দুটো, তিনটে পাঁক খেয়ে পড়লো নিচের পাথর গুলোর উপর। একটা শব্দ হোলো, নারকেল ফাটলে যেমন হয়।
আমি ঠিক ধরে উঠতে পারছিনা কী হয়ে গিয়েছে। একবার মনে হোলো ভুল দেখেছি। আবার ভাবলাম, রসিকতা নয় তো! হামফ্রে কে বিশ্বাস কী?

কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, এই বুঝি হা হা করে হাসতে হাসতে কনিফারের জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসে হামফ্রে।

ঃ হামফ্রে? হা……ম……ফ্রে……? তুমি ঠিক আছো?

কোন সাড়া নেই।

আমার সারা শরীর যেন সীসার মতো ভারি হয়ে গিয়েছে। স্রেফ ইচ্ছেশক্তি দিয়ে কোন মতে পা টেনে টেনে পৌঁছুলাম খাড়াই টার কাছে।

ওই যে হামফ্রে। উপুড় হয়ে পড়ে আছে একটা পাথরের উপর, মুখটা পিঠের দিকে অদ্ভুত ভাবে ঘোরানো। মাথার একদিকে থেঁতলে গিয়েছে। সেখান থেকে ছোপ ছোপ রক্ত এসে জমে রয়েছে চোখের কোনে। চোখ দুটো খোলা, প্রাণহীন। কেনিয়ার রিফট ভ্যালিতে বেড়ে ওঠা, কালিনজানদের তাড়ায় পালিয়ে আসা কিসি গোত্রের ছেলে, আমার বন্ধু হামফ্রে কিসিম্বে লাশ হয়ে পড়ে আছে লেক অন্টারিওর দুর্গম একটা বাঁকে, আফ্রিকা থেকে হাজার হাজার মাইল দুরে। আমি দুঃস্বপ্ন দেখছি।

আমি কি জানতাম দুঃস্বপ্নের কেবল শুরু!

তিন।।

ঃ কী চাও হামফ্রে?
ঃ মাছটা তুমি ধরতে পেরেছিলে?
ঃ না। ধরার কথা মাথায়ও আসেনি। এককথা আর কতবার বলবো তোমাকে?
ঃ আমার ছিপটা কোথায়? পানিতে ভেসে গিয়েছি কি? খুব প্রিয় ছিল ওটা। সাতান্ন ডলার দিয়ে কিনেছিলাম, আবু গারসিয়া কার্ডিনাল 100i, হাতলটা ফাইবার গ্লাসের।
ঃ চার বছর হয়ে গিয়েছে হামফ্রে, এখনও ছিপের দুঃখ ভুলতে পারো নি?
ঃ চার বছর! আমার তো মনে হয় এই গত পরশু রওনা দিলাম বাড়ি থেকে।
ঃ হ্যাঁ চার বছর। কালকেও তোমাকে বলেছি, আগের দিন, তার আগের দিন, এমন কোন দিন নেই যে বলিনি।
ঃ কী করবো বল, আমার কিছুই মনে থাকেনা আজকাল। মাথাটা বোধকরি একেবারেই গিয়েছে। আচ্ছা, মাছটা তো বঁড়শি গিলে লাফিয়ে উঠলো। কী হয়েছিলো তারপর?
ঃ তুমি খাড়াই থেকে পিছলে গেলে। তোমার মাথাটা আছড়ে পড়েছিল নিচের পাথরে।
ঃ তাইতো বলি, সেই তখন থেকে মাথাটা এমন ঝিমঝিম করছে কেন। ফেটে যায়নি তো! রক্তে আমার ভীষণ ভয়।
ঃ হামফ্রে, এটা চার বছর আগের কথা। অসংখ্যবার বলেছি তোমাকে। এখন দয়া করে বিদেয় হও।
ঃ যাচ্ছি। একটা কথা ছিল আহমেদ।
ঃ কী বলবে বলে ফেলো।
ঃ তোমার কাছে কলম হবে?
ঃ কেন, কলম দিয়ে কী করবে তুমি?
ঃ ভাই কে চিঠি লিখবো। একটা সাদা কাগজও দিও।
ঃ তুমি দুর হও। চলে যাও এখান থেকে। যাও বলছি।

হামফ্রে চলে গিয়েছে। যেতে চায়নি, আমি একরকম জোর করেই ওকে তাড়িয়ে দিয়েছি। কেন যে ও আসে! ক্যাম্পিং থেকে ফিরে আষাঢ় পর ওকে প্রথম দেখি পিয়ারসন এয়ারপোর্টে যাবার পথে, শাহানাকে আনতে গিয়েছিলাম যেদিন। সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ দুটো ঢুলে এসেছিলো, ট্যাক্সিটা রাস্তায় একটা ঝাঁকুনি খেতেই চোখ মেলে দেখি পাশের সিটে হামফ্রে, শূন্য দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। কপাল ভালো শিখ ড্রাইভারটি নবিশ ছিলনা। নইলে আমার ভয়ার্ত চিৎকারে দুর্ঘটনা একটা ঘটেই যেতো। সাবধানে ট্যাক্সিটাকে রাস্তার পাশে থামিয়ে জানতে চাইলো কী হয়েছে। আমি তখন কথা বলার অবস্থাতে নেই, কোন মতে হাত দিয়ে ইশারা করে বোঝালাম কিছু হয়নি, সে যেতে পারে। কী করে বোঝাবো কী হয়েছে, পাশের সিটে তো কেউ নেই!

প্রথম প্রথম খুব ভয় লাগতো। চোখ বন্ধ করলে হামফ্রে, চোখ খুলে রাখলে হামফ্রে, ডাইনে, বাঁয়ে, ঘরে বাইরে, সবখানে, যখন তখন - সিন্দাবাদের বুড়োর মত হামফ্রে হামফ্রে হামফ্রে…………। শাহানা ধরে বেঁধে একদিন হাসপাতালে নিয়ে গেলো, সেখান থেকে ৫৯৬ ডেভিড ড্রাইভ। নামে 'রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টার ফর মেন্টাল ট্রমা' হলেও আসলে এটা একটা পাগলা গরদ। সাদা এপ্রন পড়া একজন ডাক্তার, দুজন নার্স আর মুশকো মুশকো চেহারার কিছু লোক, আমি ঠিক বুঝে ওঠার আগেই প্রায় পাঁজা কোলা করে একটা ঘরে নিয়ে শুইয়ে দিলো আমাকে। শাহানার সাথে ওটাই শেষ দেখা, একলা জীবনেরও সেই শুরু, একলা বললে অবশ্য ভুল হবে। হামফ্রে যায়নি।

ডক্টর লাহামকে দেখলে মনেই হয়না সে পাগলা গারদের ডাক্তার। হাসিখুশি, সুদর্শন, অনেকটা টেলিভিশনের লেট নাইট শোর হোস্ট জিমি কিমেলের মতো।

ঃ কী খবর আহমেদ?
ঃ কী খবর আশা কর ডক্টর? সকালে ডিম দিয়ে পাউরুটি খেয়েছি, তবে অরেঞ্জ জুসটা মনে হয় এক্সপায়ার করে গিয়েছিলো।
ঃ তাই নাকি? আমি কিচেনে বলে দেব। তারপর বল, হামফ্রের খবর কী?

এখানে এই একটা চমৎকার দিক। এরা আমার কথা বিশ্বাস করে। আমি যে হামফ্রেকে দেখতে পাই সেটা নিয়ে কারো কোন সন্দেহ নেই। পারলে ডক্টর লাহামের সাথে হামফ্রের পরিচয় করিয়ে দিতাম। কিন্তু হামফ্রে কেমন যেন বদলে গিয়েছে। আগের সেই মজলিশি মেজাজটা তার আর নেই, মানুষ দেখলেই লুকিয়ে পড়ে।

ঃ হামফ্রে আছে ওর মতোই, ইচ্ছে হলে আসে, ইচ্ছে হলে চলে যায়।
ঃ কথা টথা হয় কোনো?
ঃ আগে হোতো না, এক্সারসাইজ টা শুরু করার পর থেকে আজকাল হয় মাঝে মাঝে।
ঃ কী বলে ও?
ঃ প্রতিদিনই ওই একই কথা, জানতে চায় ওর ছিপটা কোথায় রেখেছি।
ঃ কোথায় রেখেছো বলে দিলেই পারো।
ঃ বলেছিতো! অনেকবার বলছি ওকে, কিন্তু ওর নাকি কিছুই মনে থাকেনা। ছিপটা আমার লকারে, ২২২ অ্যারো রোড, ক্যানাডা পোস্ট । আমাকে ছেড়ে দাওনা ডক্টর, হামফ্রের ছিপটা ওকে দিয়ে দেই।
ঃ সে নাহয় দেখা যাবে। এক্সারসাইজটা করছ তো মন দিয়ে?
ঃ করছি।
ঃ অলরাইট দেন, বিকেলে আবার দেখা হবে।
ঃ বাই ডক্টর।
ঃ বাই আহমেদ।

ডক্টর লাহাম চলে যায়। যাবার সময় একটা শব্দ হয় দরজার ওপাশ থেকে, তালা বন্ধ করার।

আজকাল একাই আসেন লাহাম, আগে সাথে দুজন মেল নার্স থাকতো। তখন দারুণ ভায়োলেন্ট ছিলাম কিনা। এক্সারসাইজে কাজ হচ্ছে, হামফ্রে এখন আর সারাক্ষণ আমার সাথে থাকেনা।

পাগলা গারদে ক্যালেন্ডার নেই। প্রথম প্রথম দিন গুনতাম, একটা সময় মনে হোলো কী দরকার। ডক্টর লাহামের দেওয়া এক্সারসাইজ করি, খাই দাই, আর ঘুমাই। এই চলছিলো। একদিন অসময়ে ডক্টর লাহাম এলেন, সাথে একজন রাশভারী লোক।

ঃ কেমন আছো আহমেদ?
ঃ ভালোই আছি মনে হচ্ছে ডক্টর।
ঃ শেষ কবে এসেছিলো হামফ্রে?
ঃ দু দিন আগে।
ঃ ভালো, এক্সারসাইজটা চালিয়ে যাও। আচ্ছা, এখানে কে কে আছে তোমার।
ঃ কেউ নেই, এখানেও নেই, ওখানেও নেই। আমি বাবা মা’র এক মাত্র সন্তান। তাঁরা মারা গিয়েছেন আমি যখন কলেজে পড়ি।
ঃ তোমার বউয়ের কী খবর?
ঃ বলতে পারবোনা, কোন যোগাযোগ নেই আমার সাথে। চিঠিপত্র আসলে তোমরা তো জানাতে, তাইনা?
ঃ আমি দুঃখিত আহমেদ, এই চার বছরে তোমার কোন চিঠি আমরা পাইনি।
ঃ তোমার দুঃখিত হবার কোন কারণ দেখছিনা।
ঃ আহমেদ, তোমাকে রিলিজ দেওয়া হচ্ছে। আমি বলছিনা তুমি পুরোপুরি ঠিক হয়ে গিয়েছ, কিম্বা পুরোপুরি ঠিক হয়ে যাবে একদিন। এক্সারসাইজটা ছেড়ো না। হামফ্রের আসা হয়তো একেবারে বন্ধ হয়ে যাবেনা, তবে তুমি তোমার জীবন চালিয়ে নিতে পারবে। প্রতিটি মানুষেরই কোন না কোন সমস্যা থাকে, তার মধ্যে দিয়েই বেঁচে থাকি আমরা।

এই খবরটা আমি প্রত্যাশা করিনি, মাথাটা কেমন যেন দুলে উঠলো। কোথায় যাবো আমি?

ঃ ও হ্যাঁ, তোমার সাথে এঁর পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। আলফ্রেড হগ অন্টারিও সোশ্যাল সার্ভিসেস এর ডিরেক্টর। এখন থেকে তোমার দায়িত্ব আলফ্রেডের।

রাশভারী লোকটা তাহলে ডাক্তার নন!

ঃ হ্যালো আহমেদ, তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম।
ঃ থ্যাঙ্ক ইউ আলফ্রেড, আমি যে কত খুশি হয়েছি তোমাকে বলে বোঝাতে পারবোনা।

অন্টারিও সোশ্যাল সার্ভিসেস একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান, আমার মতো অচল আধুলিদের ঘষে মেজে চকচকে করে আবার বাজারে পাঠানোই এদের কাজ। আলফ্রেড কাজের লোক, দুমাসের মধ্যেই আমার জন্য একটা চাকরি যোগাড় করে দিয়েছে। একটা পিৎজার দোকানে ধোয়া-পাল্লার কাজ, থাকি দোকানের উপরেই ছোট্ট একটা কামরায়। এভাবেই জীবনটা কাটিয়ে দেব ভাবছি, বড় কোন স্বপ্ন দেখার ইচ্ছে কিম্বা তাড়না কোনটাই আর অনুভব করিনা আজকাল। ঢাকায় ফোন করেছিলাম একদিন, তুলি ফোন ধরে হ্যালো বলার পর কাঁপা কাঁপা গলায় বলেছিলাম ‘কেমন আছ তুলি? শাহানা কেমন আছে?’ তুলি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটু পর লাইনটা কেটে দিয়েছিল। তুলি শাহানার ছোটো বোন, এইটুকু দেখেছি ওকে, এখন নিশ্চয়ই কলেজে যায়! আর ফোন করিনি কোন দিন। কী লাভ?

হামফ্রে এখনো আসে, হঠাৎ হঠাৎ। ছিপ খোঁজে, কলম চায়, কাগজ চায়। মন ভালো থাকলে ওর সাথে কথা বলি, যেদিন মন খারাপ থাকে, দুর দুর করে তাড়িয়ে দেই ওকে। একদিন কী একটা কাজে ফিঞ্চ অ্যাভিনিউতে গিয়েছি, যেতে যেতে চোখে পড়লো অ্যারো রোড। লকারটার কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। বাস থামিয়ে নেমে পড়লাম অ্যারো রোডের মোড়ে, ভাগ্যিস চাবির তাড়ায় লকারের চাবিটাও ছিল।

পুরনো লকারের একটা গন্ধ থাকে, দরজা খুললেই আছড়ে পড়ে নাকের উপর। এই ভ্যাপসা গন্ধটাই আমার কী যে ভালো লাগলো। ওইতো আমার বই গুলো। কত যত্ন করে পয়সা বাঁচিয়ে কেনা জিন টিরোলের ফাইনান্সিয়াল ইকনমিক্স, মারটিন অসবোর্নের গেম থিওরি। আমার কম্পিউটার, রান্নার জিনিস, সুটকেস ভরা জামা কাপড়, আরও কত কী! মনে মনে শাহানাকে কৃতজ্ঞতা না জানিয়ে পারলামনা।

হামফ্রের ছিপটা পড়ে ছিল লকারের একটা কোনে। বাড়ি ফিরে ছিপ হাতে নিয়ে বসে থাকি, যদি হামফ্রে আসে। হামফ্রে আসেনা, এক দিন যায় দুদিন যায়, সপ্তা গিয়ে মাস ফুরায়। হামফ্রের দেখা নেই অনেক দিন। ছিপটা সত্যিই সুন্দর, ফাইবার গ্লাসের হাতলটা এখনো চকচকে যেন হাতির দাঁতে তৈরি। একদিন হাতে নিয়ে নাড়াচারা করতে করতে দেখি হাঁটলের তলায় একটা ছোট্ট গুটুলি। ভাবলাম চাপ দিয়ে দেখি, কিছুই হলনা। ভালো করে তাকাতেই চোখে পড়লো গুটুলির গায়ে প্রায় অদৃশ্য একটা খাঁজ। চাবির ডগা দিয়ে মোচড় দিতেই হাতল খুলে এলো, ভেতরটা ফাঁপা, আঙ্গুল ঢুকিয়ে অনুভব করলাম একটা কাগজ সেঁটে রয়েছে।

একটা ফ্যামিলি ট্রি, হামফ্রের চোদ্দ গুষ্টির ঠিকুজি এখানে, সবার জন্ম সাল আর মৃত্যু সাল দেয়া আছে। কেবল দুজনের মৃত্যু সালের ঘরটা ফাঁকা। একজন হামফ্রে কিসিম্বে, আমার বন্ধু। অপরজন ওদুবে কিসিম্বে, হামফ্রের বড় ভাই নিশ্চয়ই। আহারে, ওদুবে জানলোই না! কাগজের উল্টো পিঠে একটা ম্যাপ, ম্যাপের একটা জায়গায় লাল কালিটা আঁকা একটি বৃত্ত। পাশে গুটি গুটি করে লেখা “ইন দ্যা রিফট ভ্যালি, নিয়ার দ্যা ওল্ড বাওবাব, সোহালি।
হামফ্রে তাহলে আমার মনের কল্পনা নয়! আমি সিজোফ্রেনিয়ার রোগী নই। হামফ্রে সত্যি সত্যিই আসে। ছিপের হাতলে লুকিয়ে আছে ওর ইতিহাস।

চার।।

চাকরিটা একেবারে আমার মন মতো। খুব একটা কাজ কর্ম নেই, নামে ডিশ ওয়াশার হলেও কাউন্টারেই বসে থাকি দিনের বেশির ভাগ সময়। আমাদের সব বাঁধা কাস্টমার। কালে ভদ্রে এক দুজন নতুন ক্রেতার দেখা মেলে, তারা আর দ্বিতীয়বার এমুখো হয়না। দোকানের মালিক আরিগো পেনুচ্চি, দারুণ অলস। তার চেয়েও আলসে এ নেইবারহুডের মানুষগুলো। নইলে এমন অখাদ্য পিৎজা দিনের পর দিন বিক্রি হয় কি করে! দোকানের নাম ওয়ান টু পিৎজা,ওয়ান টু থ্রি নয়, স্রেফ ওয়ান টু। থ্রি পর্যন্ত যাবার কষ্টটা পেনুচ্চি করেনি। একদিন জিগ্যেস করেছিলাম সব ছেড়েছুড়ে টরন্ট এলো কেন। প্রায় পাঁচ মিনিট চোখ বন্ধ করে ভাবার পর ইংরেজি আর ইটালিয়ান মিলিয়ে যে জবাব দিলো তাতে বুঝলাম, সিসিলির লোকজন খুব আলসে, সে নাকি হাঁপিয়ে উঠছিল সেখানে।

দোকানে টিভি আছে কিন্তু সেটা বন্ধই থাকে। একটা রেডিওতে ইটালিয়ান কী এক স্টেশন বেজে চলে সারাক্ষণ। পেনুচ্চি বসে বসে ঝিমায়, আমি খবরের কাগজে নাক ডুবিয়ে শুনি প্যাগানিনির কনচার্টো কিম্বা বার্তোল্লির অপেরা।

ঃ ভাষাটা শিখে নিলেই পারো আহমেদ। বার্তোল্লির গান কি শুধু সুর দিয়ে উপভোগ করা যায়?
ঃ সিনিওর ব্র্যান্ডিনো যে! কখন এলে বুঝতেই পারিনি। কী নেবে আজকে? পানজারাত্তো চাইলে দিতে পারবোনা বলে রাখছি। কিচেনে পেপারনি নেই, পেনুচ্চি অর্ডার দিতে ভুলে গিয়েছে।
ঃ সে নাহয় নেব কিছু একটা, গানটা শেষ হোক।

কিন্নর কণ্ঠী উপমাটি যেন বার্তোল্লির জন্যই তৈরি হয়েছে। সুরের কারুকার্য আর কণ্ঠের মাধুর্য সে তো অনেকেরই থাকে, বার্তোল্লিকে অনন্য সাধারণ করেছে তাঁর বিষণ্ণতা। কী যেন একটা রয়েছে প্রক্ষেপণে, অবর্ণনীয় এক দ্বৈত অনুভূতির স্রোতে ভেসে যাই আমি। আনন্দে আপ্লুত হতে হতেই অনুভব করি সে আনন্দের আড়ালে কোথায় যেন লুকিয়ে রয়েছে বুক ভেঙ্গে দেওয়া এক গভীর বেদনার স্মৃতি। কী যায় আসে ইটালিয়ান না জানলে!
ব্রান্ডিনো অতিবৃদ্ধ, যেন দুরন্ত বাতাসে একলা দাঁড়িয়ে থাকা কাসফুলের ন্যুব্জ শাখা। প্রথম দেখে আঁতকে উঠেছিলাম। একমাথা সাদা চুল আর ততোধিক শুভ্র দাঁড়ি-গোঁপ নিয়ে একটা লাঠিতে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দোকানের দরজায়। বাইরে মাইনাস পনেরো অথচ মাথায় কোন টুপি নেই, নেই গলায় মাফলার। দৌড়ে দরজা খুলে দিয়ে বললাম,

ঃ জমে যাবে তো, ভেতরে এসে বসো।

খুব ধীরে, যেন বাতাসে উড়তে থাকা নিজের দাঁড়িকে শুনিয়ে বলল সে,

ঃ সিসিলিতে এখন বসন্ত।
ঃ সে নাহয় বুঝলাম, কিন্তু এখানে এখন ঘোর শীত। কী দেব, চা না কফি?
ঃ একটু গ্রাপ্পা পেলে মন্দ হতোনা। আর সাথে একটা পানজারাত্তো, পেপারনি দিয়ে। ভেজিটেবল পানজারাত্তো আমার রোচেনা, কেমন যেন ঘাস ঘাস লাগে মুখে।

হাতের লাঠিটা টেবিলের সাথে ঠেকিয়ে রেখে জুবুথুবু হয়ে বসলো বুড়ো।

ঃ দুঃখিত সিনিওর, আমাদের লিকার লাইসেন্সে নেই।
ঃ ব্র্যান্ডিনো, মার্কো ব্র্যান্ডিনো। তোমার নাম কি হে ছোকরা?
ঃ আহমেদ, পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। পানজারাত্তো তৈরি হতে সময় লাগবে, মিনিট পনেরো অপেক্ষা করতে পারবে?
ঃ সময়ের কোন অভাব নেই আমার। কফিটা এখনই দিয়ে যাও, ওয়ান মিল্ক নো সুগার।

ব্র্যান্ডিনো আসে দুপুরে, কখনো পানজারাত্তো কখনো পিৎজা, সাথে এক পেয়ালা কফি এই তার বাঁধা মেনু। ঘণ্টা খানেক কাটিয়ে চলে যায় সামনের বাস স্টপেজে। একটা হলদে রঙের স্কুল বাস এসে থামে। আমি দোকান থেকে দেখতে পাই ফুটফুটে একটি কিশোরী বাস থেকে নেমে জড়িয়ে ধরে বুড়োকে, ওর নাতনি। দুজনে গল্প করতে করতে মিলিয়ে যায় পথের বাঁকে।

খাওয়া-ঘুমানো আর কাজের বাইরেও একটা জীবন রয়েছে। যে জীবন যান্ত্রিক নয় জৈবিক নয়। সে এক অন্য জীবন, সেখানে প্রতীক্ষা বলে একটা শব্দ থাকে। প্রতীক্ষার কত রূপ, কত স্তর! এই যে বুড়ো ব্র্যান্ডিনো, লাঠিতে ভর দিয়ে ঠুক ঠুক করে চলে, এই মানুষটাই কেমন বদলে যায় বাসস্টপেজে যাবার সময়। লাঠিটা তখন নিতান্তই একটা অনুষঙ্গ মাত্র। স্টপেজে বসার একটা বেঞ্চি আছে, বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারেনা ব্র্যান্ডিনো, উঠে দাড়ায়, পায়চারি করে, স্টপেজের দেয়ালে সাঁটা খবরের কাগজে চোখ বুলোয়। আমি টের পাই তার মন পড়ে রয়েছে পথের বাঁকে, বাসের প্রতীক্ষায়। বুড়ো পকেট খুলে পুরনো দিনের একটা ট্যাঁক ঘড়িতে সময় দেখে। ঘন ঘন তাকায় আকাশের দিকে, পথের বাঁকের দিকে, হাতের লাঠির দিকে। প্রতীক্ষার পারদ চড় চড় করে বাড়তে থাকে মিনিটে মিনিটে। বাস সময় মতন ই আসে, কোনদিন হয়তো দুমিনিট আগে, কোনদিন দুমিনিট পর।

দোকানের বাইরের পৃথিবীটা দারুণ গতিময়। বুড়ো ব্র্যান্ডিনোর মতো একদুজন ছাড়া আর সবাই সারাক্ষণ হন্তদন্ত হয়ে ছুটে চলেছে। কেউ কেউ হয়তো থমকে দাড়ায়, অপেক্ষা করে ট্যাক্সি কিম্বা বাসের জন্য, কিন্তু সেটা অপেক্ষাই, প্রতীক্ষা নয়। প্রতীক্ষার একটা গন্ধ রয়েছে, বেলীফুলের মতো তীব্র নয় যে হঠাৎ করেই নাকে এসে আছড়ে পড়বে, বরং হেমন্তের শিশিরে ভেজা ভোরের শিউলির মতো ক্ষীণ, অপস্রিয়মাণ। বুড়ো ব্র্যান্ডিনোর প্রতীক্ষার শিহরণ স্টপেজ ছাড়িয়ে, রাস্তা পেরিয়ে, হিমেল বাতাসে ভিজে, কাঁচের দেয়ালের আড়ালে আঁটকে থাকা আমাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়, কেমন পাগল পাগল লাগে। বার্তোল্লির গান, প্যাগানিনির কনচার্টো, ভিভালদির সিম্ফনি, সব বেসুরো হয়ে বাজতে থাকে বুকের গহীনে। টলতে টলতে কিচেনে যাই, চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাপটা দিয়ে ফিরে আসি কাউন্টারে। সেখানে আধবোজা চোখে পেনুচ্চি ঝিমায়, ঝিমায় তার বর্ণ-গন্ধ-শব্দ হীন শুন্যতায়।

ব্যাতিক্রম শনিবার, সিরি আ’র খেলা থাকে এই দিন। বেলা গড়াতে গড়াতে একজন দুজন করে ভিড় জমায়, প্রাণ ফিরে পায় সপ্তাভর বন্ধ থাকা মান্ধাতার আমলের টেলিভিশনটা। দুপুরের আগেই লোকে লোকারণ্য ওয়ান টু পিৎজা। আমি অর্ডার নিতে নিতে হিমসিম খাই। পেনুচ্চিকে এদিন চেনাই যায়না।। চুলে জেল, পরনে পাঁট ভাঙা ডিজাইনার ভেস্ট, পায়ে চকচকে ড্রেস শু। এ টেবিল থেকে থেকে সে টেবিল, এক আড্ডা থেকে আরেক আড্ডা, মাঝবয়েসী পেনুচ্চি ছুটে বেড়ায় যেন সদ্য কলেজ পাশ দিয়ে বের হওয়া উচ্ছল যুবক।

দিন শেষে কিচেনে থালা বাসনের টুং টাং ছাপিয়ে টের পাই পেনুচ্চি বেরুলো, তার বাহুলগ্না কোন এক তরুণীর আদুরে গলা ভেসে আসে আমার কানে। পুরো সপ্তা ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে এই শনিবার দিনটির জন্যই যেন বেঁচে থাকে পেনুচ্চি। পেনুচ্চি কি প্রতীক্ষা করে, নাকি অপেক্ষা?

আমি কারো প্রতীক্ষায় নেই, আমার জন্য প্রতীক্ষা করছেনা কেউ। এই শব্দটি, জীবনের এই দিকটা হারিয়ে ফেলেছি। হামফ্রের ম্যাপ যেন চাবুক মেরে জাগিয়ে দিয়েছে আমাকে এ নিস্তরঙ্গ জীবন থেকে। দিন গুনছি আফ্রিকায় যাওয়ার। আপাতত টাকা জমাচ্ছি। জমছে ভালোই, আমার আর খরচ কি! পেনুচ্চির দোকানে দুই শিফট মিলিয়ে দিনে বারো ঘণ্টা, ঘণ্টায় এগারো করে দিনে একশ বত্রিশ ডলার, সপ্তায় সাতশো বিরানব্বই। রোববার আমার ছুটি। আমি চলে যাই পাবলিক লাইব্রেরি তে, আফ্রিকা সম্পর্কে কিছুই তো জানা হয়নি এতকাল।

কোনো এক বিচিত্র কারণে পেওলা আমাকে সহ্য করতে পারেনা। পেওলা পেনুচ্চির ছোটো বোন, স্বভাবে পেনুচ্চির একেবারেই উল্টো। পঁচিশ ছাব্বিশের মতো বয়স, কথা বলে অষ্টাদশীর ঢঙে, ন্যাকা ন্যাকা আদুরে গলায়। মাঝে সাঁঝে দোকানে আসে, এসেই ঝড় তুলে দেয়, কারণে অকারণে আমার ভুল ধরে।

ঃ পেওলা তোমার প্রেমে পড়েছে আহমেদ।
ঃ কী যে বল ব্র্যান্ডিনো! তোমার বুদ্ধিশুদ্ধি ঠিক আছে?
ঃ আমার বয়েস কতো বল তো?
ঃ কত আর হবে, আশি?
ঃ এই সামারে তিরাশিতে পড়ব। বয়েসটা তো আর বাতাসে বাড়েনি, এই যে সাদা চুলগুলো দেখছ, একটা সময় ছিল যখন সোনার মত চকচক করতো। এগুলো পেকেছে অভিজ্ঞতায়। এখন মানুষ দেখলেই বুঝতে পারি।
ঃ তুমি থাকো তোমার অভিজ্ঞতা নিয়ে।
ঃ রেগে যাচ্ছ কেন? পেওলা কি দেখতে খারাপ? চেহারার কথা না হয় বাদই দিলাম, ওর বুকটা দেখেছো? আমারই তো কলজে শুকিয়ে আসে, আর তুমি হলে সেদিনের ছোকরা।
ঃ পেওলার বুক নিয়ে আপাতত মাথা ঘামাতে চাইছি না সিনিওর।
ঃ হা হা হা, একেবারে লাল হয়ে গেলে যে! আচ্ছা যাও বুকের কথা থাক…..

বুড়ো আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলো, তার আগেই আড়মোড়া ভেঙ্গে, চোখ কচলাতে কচলাতে পেনুচ্চি জেগে উঠলো।

ঃ তোমার কাছে তিনশ ডলার হবে আহমেদ?

পেনুচ্চির এই একটা অদ্ভুত ব্যাপার, নিজের দোকান অথচ ক্যাশ বাক্সে কখনো হাত দেবেনা। একটা ব্লক পরেই টিডি ব্যাঙ্ক কিন্তু দশ মিনিট হেঁটে গিয়ে টাকা তুলে আনার মধ্যেও সে নেই।

ঃ তিনশ নেই, আড়াই শ’র মতো দিতে পারি। চলবে?
ঃ ওতেই হবে। পেওলা আসলে দিয়ে দিও। আমার শরীরটা আজকে ভালো নেই, ঘুমিয়ে গেলে ডেকো না।

ঘুমিয়ে গেলে কে কবে পেনুচ্চিকে ডেকেছে! আর ডাকলেই কি সে ওঠে?

ঃ তোমার তো কপাল আজকে আহমেদ, হে হে হে।

গা জ্বালানো হাসি বুড়োর।

পাঁচ । ।

পেওলার কথা যে আমি ভাবি না তা নয়। সে আসে রূপের সম্ভার নিয়ে, দোকানের কাঠের মেঝেতে তার উঁচু বুটের মেজাজি খটখট, চশমার ফ্রেমের উপর দিয়ে বিচ্ছুরিত তীক্ষ্ণ চাহনি, তীব্র উপেক্ষা আমাকে কষ্ট দেয়, আহত করে। কিন্তু আমার পাঁজরের তলায় লুকিয়ে থাকা প্রাগৈতিহাসিক ঢাকের দিরিম দিরিম কাঁপুনিকে অস্বীকার করি কী করে? তাই পেওলার কথা ভাবি, সময় পেলেই ভাবি, কারণে ভাবি, ভাবি অকারণে। ভাবতে ভাবতে একটা সময় পেওলা হারিয়ে যায়, শাহানাকে মনে পড়ে। সেই মেজাজ, সেই কটাক্ষ, সেই নিদারুণ উপেক্ষা - আমার আরেকটা জীবন জুড়ে জড়িয়ে থাকা একজন মানুষ, চলে গিয়েও যে হারিয়ে যায়নি সেই শাহানাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে মাঝে মাঝে। কী হাস্যকর আর অচল ভাবনা!

দিন দিন দুর্বল হয়ে পড়ছি, আজকাল মনে হয় কী হবে আফ্রিকা গিয়ে! না হয় ব্র্যান্ডিনোর মতই প্রগাঢ় বৃদ্ধ হবো, কোন এক তুষারাবৃত পথের বাঁকে একটা লাঠিতে ভর দিয়ে প্রতীক্ষায় কাটবে বিবর্ণ বিকেল, বাস থেকে নেমে বিনুনি দুলিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরবে আমার উত্তর প্রজন্ম। আবার ভাবি, পেনুচ্চির জীবনটাই বা মন্দ কিসের?

ঃ কী এতো ভাবছ আহমেদ?

ভাবনার জাল ছিঁড়ে বর্তমানে ফিরে আসি, লাঠিতে থুতনি ঠেকিয়ে সরু দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বুড়ো ব্র্যান্ডিনো।

ঃ আচ্ছা বুড়ো, তুমি তো ক্যাথলিক, স্বর্গে বিশ্বাস কর তাইনা?
ঃ তা তো করিই। হঠাৎ স্বর্গের কথা কেন হে?
ঃ স্বর্গে মানুষের সময় কাটে কী করে?
ঃ এটা কোন প্রশ্ন হোল? সময় বলে কিছু থাকলে না কথা ওঠে সময় কাটানোর!
ঃ সময় বলে কিছু নেই স্বর্গে?
ঃ কী করে থাকে? স্বর্গে অনন্ত জীবন, অফুরন্ত সময়, যার শেষ নেই তাকে নিয়ে তাই ভাবনাও নেই। সময় কাটে পৃথিবীতে, তোমার বয়স কম বলে তুমি বুঝতে পারো না। আমার আর ক’টা দিন বল? ঘুম থেকে উঠলেই টের পাই জমানো সময় থেকে আরও খানিকটা চলে গেলো। কত কিছুই করা হয়নি, দেখা হয়নি কত কি!
ঃ খুব কি বেশি আক্ষেপ?
ঃ না, তা নয়। সময় তো ফুরতোই, একটাই জীবন। অপ্রাপ্তি যেমন রয়েছে, প্রাপ্তিও অনেক।
ঃ আমার কিন্তু সময় কাটছেনা।
ঃ তোমার জীবন এখনো শুরু হয়নি। হলে পরে দেখবে সময় কত কম, কী দ্রুতই না কেটে যায়!
ঃ তুমি কিছুই জানো না বুড়ো, কিস্যুনা। জীবন আমার শুরু হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু হারিয়ে ফেলেছি। মানুষের জীবন একটা নয়, অনেক গুলো, বুঝলে? কোন জীবনে সময় থমকে থাকে, কোনটায় ছুটে চলে যেন সিন্ধু সারস।
ঃ হবে হয়তো। এবার উঠে দরজাটা খোলো, সিন্ধু সারস বাইরে দাঁড়িয়ে।

তাকিয়ে দেখি দরজার দরজার মুখে পেওলা, কেমন যেন এলোমেলো দেখাচ্ছে ওকে। ঝলমলে রোদ পেছনে ফেলে একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে ভেতরে এসে কাউন্টারের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ায়। আর দশটা দিনের মত খটখট আওয়াজ তুলে নয়, ক্লান্ত পদক্ষেপে।

ঃ ঘুমুচ্ছে, তাইনা? কতক্ষণ হোলো?
ঃ দুপুর থেকেই, ডাকতে মানা।
ঃ কিছু টাকা দেবে বলেছিল, উঠলে বলে দিও আমি নেইনি। দরকার নেই।

কাউন্টারে যে একরাশ ময়দা পড়ে আছে পেওলা সেটা লক্ষ্যই করেনি। অন্য দিন হলে এই নিয়ে দশটা কথা বলতে ছাড়তো না।

ঃ টাকাটা আমার কাছে, তুমি বরং রেখেই দাও পেওলা। পরে না হয় ওকে ফিরিয়ে দিও।
ঃ টাকা আমার লাগবেনা আহমেদ।

আমার কী যেন হয়েছে আজকে। ব্র্যান্ডিনোর সাথে বিকেলের আড্ডা, নাকি বাইরের ঝলমলে রোদ, নাকি পেওলার বিষণ্ণতা! কখনো যেটা করিনা, পেওলাকে প্রশ্ন করে ফেললাম,

ঃ কেন লাগবেনা পেওলা? কী করতে টাকাটা দিয়ে?

করেই ঘাবড়ে গিয়েছিলাম, এই বুঝি রেগে যায়!

ঃ কাল রাতে বার্তোল্লির কনসার্ট আছে মেজলিনি হলে। নিকোর সাথে আমার যাওয়ার কথা ছিল। দুপুরে আমাদের ব্রেকআপ হয়ে গিয়েছে। এবার খুশি তো?

রীতিমতো মন খারাপ করা খবর, আমার খুশি হওয়ার কোন কারণ নেই, কিন্তু সত্যিই কেন যেন খুশি খুশি লাগছে। আজকের দিনটাই অন্যরকম। মুখ ফসকে বলে ফেললাম,

ঃ আমার সাথে যাবে তুমি, পেওলা?

ব্র্যান্ডিনোর হাত থেকে লাঠিটা ঠাস করে পড়ে গিয়েছে মেঝেতে। তাকিয়ে দেখি বড় বড় চোখ মেলে পেনুচ্চি আমাদের দিকে তাকিয়ে। লাঠির শব্দে ওর ঘুম ভাঙেনি।

পেওলা নিরুত্তর। আমার দম বন্ধ হয়ে আসে। একদিকে পেনুচ্চি, আরেক দিকে বুড়ো ব্র্যান্ডিনো, দুজনেই স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে রয়েছে পেওলার দিকে। সেই পেওলা, যে আমাকে সহ্য করতে পারেনা, যার কথা ভেবে ব্র্যন্ডিনোর মতো থুড়থুড়ে বুড়োরও কলজে শুকিয়ে আসে।

ঃ রাত আটটায় আমাকে তুলে নিও, ফাইন আর্টস ডিপার্টমেন্টের গেটে থাকবো। এখন চলি আহমেদ।

ছয়।।

ডেটে যাবার মত জামা কাপড় আমার নেই। প্রথমে ভেবেছিলাম কিনেই ফেলি একটা ব্লেজার, কত আর দাম! ব্র্যান্ডিনো কিনতে দিলনা, বলল “ভাড়ায় পাওয়া যায়, পয়সাটা দিয়ে বরং পেওলার জন্য একটা কিছু কেন”।

শপিং মলে গিয়ে কেমন যে লাগলো! কতকাল কারো জন্য কিছু কিনিনা!

অনেক রাত করে বাড়ি ফিরলাম, বাস নেইনি, ট্যাক্সি নেইনি। দারুণ ফুরফুরে লাগছিলো হাঁটতে। ঘরে ঢুকেই টের পেলাম খিদে লেগেছে। খাবার গরম করতে করতেই গন্ধটা পেলাম, তীব্র গন্ধ নয় নয় কিন্তু উপেক্ষা করা যাচ্ছেনা। ময়লা ফেলতে ভুলে গিয়েছি কি? নাক চেপে ধরে কিচেনের কাবার্ড টা খুললাম, গার্বেজ বিন খাল।! সম্ভবত হিটারের ফিল্টার থেকে আসছে, বোধ করি ময়লা জমে জ্যাম হয়ে গিয়েছে। আর সেজন্যেই বোধহয় ঘরটা অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশ ঠাণ্ডা। পুরনো বাড়ির যে কত সমস্যা!

গরম ভাত আর আলু ভর্তার ঘ্রাণ ছাপিয়ে গন্ধটা বেড়েই চলেছে। সমস্যাটা ফিলটারের বলে ননে হচ্ছেনা। ইঁদুর টিদুর মরে পচে আছে নাকি ঘরে? খাটের নিচটা একবার দেখা দরকার। খাওয়া থামিয়ে ঝাঁটা হাতে কিচেন থেকে বেরিয়েই দেখি, হামফ্রে।

আমার বিছানার পেছনে দাঁড়িয়ে, মাথার একটা পাশ থ্যাঁতলানো, বাম চোখ আধবোজা, চোখের কোনে শুকিয়ে আসা রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। হামফ্রে তো কতবারই এসেছে, এমন ভাবে এই প্রথম। আমার ভয় ভয় লাগে।

ঃ তোমার কাছে কোন পেইন কিলার আছে আহমেদ? সারা গায়ে অসহ্য ব্যাথা। মনে হচ্ছে শরীর থেকে মাংসগুলো যেন খুবলে নিচ্ছে কেউ। বিশ্বাস না হলে দেখো।

হামফ্রে একটা হাত আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়। টিউব লাইটের কাঁপা কাঁপা আলোয় আমার চোখে পড়ে এক সারি সাদা হাড়, যেখানে আঙ্গুল গুলো থাকার কথা ছিল। কোনমতে দেয়ালটা খামচে ধরে দাঁড়াই আমি, হামফ্রে তার অক্ষত চোখটায় একরাশ ঘোলাটে হলুদ বিষণ্ণতা নিয়ে আমার দিকে তাকায়।

ঃ মাছটা তুমি ধরতে পেরেছিলে আহমেদ?

আবার সেই একঘেয়ে প্রশ্ন, হামফ্রের কোন কিছুই মনে থাকেনা আজকাল। কথা না বলে ছিপটা এগিয়ে দিই ওর দিকে। সাতান্ন ডলারে কেনা আবু গারসিয়া কার্ডিনাল 100i, হাতলটা ফাইবার গ্লাসের। হামফ্রে হাত বাড়িয়ে ধরতে যায়, ছিপের সাথে ছোঁয়া লাগতেই খোঁচা খাওয়া কেঁচোর মতো কুঁকড়ে গিয়ে ছিটকে পড়ে, ওর ঘোলাটে চোখে তীব্র অবিশ্বাস।

ঃ কী ব্যাপার বলতো? তোমার তো কিছু হচ্ছেনা!

কী বলবো ওকে, বলে কী লাভ, হামফ্রের তো কোন কিছুই মনে থাকেনা আজকাল। এপারের কোনকিছুই স্পর্শ করতে পারেনা ও।

ঃ আমি জানি তুমি কী খুঁজছ হামফ্রে।
ঃ তুমি জানো! হাতলটা খুলেছিলে, তাইনা? কাগজটা পেয়েছ? ম্যাপটা চোখে পড়েছে তোমার?

বহু বছর পর যেন সেই চিরচেনা হামফ্রে ফিরে এসেছে, গলায় সেই অসহিষ্ণুতা, সেই পুরনো উত্তেজনা।

ঃ ম্যাপটা দেখেছি। দেব তোমাকে?
ঃ নাহ টেবিলের ওপরেই বিছিয়ে রাখো।

হামফ্রে কে একটু বিভ্রান্ত দেখায়, বুঝতে পারছেনা ম্যাপটা ধরবে কি ধরবেনা। একটু সময় নেয়, তারপর খুব সাবধানে ম্যাপটার একটা কোনা স্পর্শ করতেই ছিটকে পড়ে চেয়ারে। ভীষণ বিপন্ন লাগে ওকে।

ঃ ম্যাপটা যে ছুঁতে পারছিনা আহমেদ! লেখাগুলো রয়েছে, আঁকাগুলো দেখা যায়, কিন্তু পড়তে গেলেই যে হারিয়ে যাচ্ছে!
ঃ তোমার জগত টা বদলে গিয়েছে হামফ্রে। মাছ ধরতে গিয়ে একটা খাড়াই থেকে পিছলে পড়েছিলে। তুমি বেঁচে নেই। চলে যাও, চলে যাও হামফ্রে যেখান থেকে এসেছ। তোমার জন্যে এখানে কিছু নেই। এই পৃথিবীর রূপ, রস, রং, গন্ধ, স্পর্শ কোন কিছুই তোমার জন্য নয়। তুমি যাও।

হামফ্রে এক মুহূর্ত স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর হতাশ ভঙ্গিতে মাথাটা নাড়ায় দুবার, ডান থেকে বামে, বাম থেকে ডানে। আবারও একরাশ দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে ঘরে। গন্ধের ব্যাপারটি নতুন। এর আগে কখনো গন্ধ নিয়ে আসেনি হামফ্রে। সেই গন্ধে তলিয়ে যেতে যেতে আমি শুনতে পাই,

ঃ তোমার মাথাটা একেবারেই গিয়েছে আহমেদ। আমি নাকি বেঁচে নেই! হা- হা-হা- হা-হা…

প্রায়ান্ধকার ঘরে হামফ্রের হাসি দেয়াল থেকে দেয়ালে, ছাদে, মেঝেতে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে ফিরে আসে আমার কানে। হঠাৎ হাসি থামিয়ে কী যেন ভাবে একবার।

ঃ এক কাজ করি। চল আফ্রিকা ঘুরে আসি।
ঃ তুমি যাও, আমি বেশ ভালোই আছি এখানে।
ঃ কিন্তু তোমাকে ছাড়া কেমন করে যাবো?
ঃ কেমন করে মানে? যেভাবে আমার কাছে আসো সেভাবে যাবে!
ঃ তোমার কাছে আমি কীভাবে আসি! কী ভাবে?

হামফ্রেকে আবারও বিভ্রান্ত দেখায়।

ঃ এই যে তুমি এসেছ, সে কি হেঁটে, গাড়িতে, নাকি বাসে?
ঃ মনে পড়ছে না আহমেদ, কিচ্ছু মনে পড়ছে না। হঠাৎ দেখলাম আমি এই ঘরে, তুমি কিচেনে কী যেন করছ। কিন্তু এলাম কী করে? কোথা থেকে! আমি কোথায় থাকি আহমেদ?

হামফ্রে থাকে লেসলি রোডে। ৩২৫ লেসলি রোড, দ্য নিউ হোপ সেমেটারি, ওয়ালনাট গাছগুলোর বা দিক থেকে তিন নম্বর কবরটা।

ঃ আজ তুমি যাও হামফ্রে। আমি খুব ক্লান্ত, খুব ব্যাস্ত একটি দিন গিয়েছে।

হামফ্রে যেতে চায়না, গোঁজ ধরে বসে থাকে। আমি রেগে যাই, ওকেও দারুণ রাগি রাগি লাগে। অনেকটা সময় নেয় চলে যেতে। কিছু একটা হয়েছে। আগে একটু চাপাচাপি করলেই হামফ্রে চলে যেতো। ঘ্যান ঘ্যান করলেও রেগে যেতে দেখিনি কখনো।

পেওলার সাথে গান শুনতে যাওয়া হবেনা আমার। আমি জানি হামফ্রে আবার আসবে, পেওলা ওকে দেখতে পাবেনা। ওর গায়ের দুর্গন্ধ এসে আছড়ে পড়বে আমার নাকে, আমি উদ্ভ্রান্তের মতো পালিয়ে যেতে চাইব বার্তোল্লির কনসার্ট থেকে। হামফ্রে আমাকে থিতু হতে দেবেনা। আফ্রিকা না যাওয়া অবধি আমার মুক্তি নেই।

----চলবে


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

অপর পৃষ্ঠার জন্য মন আটকে থাকে। এখনই যদি পৃষ্ঠাটা ওল্টানো যেত। আপনার লেখা মানেই তন্ময় হয়ে ডুবে যাওয়া। পরের কিস্তির অপেক্ষায় থাকলাম।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সোহেল ইমাম। আপনি যা বলছেন তা কিন্তু ঠিক নয়। লেখাটি কেউ পড়েনি। আমার লেখার ধরন এবং বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে।

---মোখলেস হোসেন

কাকাতুয়া  এর ছবি

সত্যি সত্যি একটি ভাল লেখা। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ কাকাতুয়া আপনাকে। পরের পর্ব কবে প্রকাশিত হবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে সচলয়তনের মডারেটরদের উপর।

----মোখলেস হোসেন

হাতুড়ি এর ছবি

আপনার "অবন্তি" গল্পটা প্রথমে বুঝি নাই, -- সেটা আমার ব্যর্থতা। আপনার বিশ্লেষন পড়ার পর গল্পটা সুন্দর লেগেছে।
এই উপন্যাসটি শুরু থেকেই অদ্ভুত সুন্দর।
সচলের অনেকের লিখাই খুব ভাল লাগে, নিরবে পড়ে চলি। নিজে লিখতে পারি না তো, তাই চুপচাপ থাকি। সত্যি, কীভাবে যে লেখেন আপনারা।

অতিথি লেখক এর ছবি

মন্তব্যের জন্য ধন্যবাদ হাতুড়ি।

----মোখলেস হোসেন।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাই, ক্যানাডা কতই না সুন্দর দেশ। এমন সুন্দর দেশে গ্রীষ্মকালে থুক্কু, "সামারে" জঙ্গল-মঙ্গলে গিয়া ক্যাম্পিং-ম্যাম্পিং করা যায়, ফিশিং-মিশিং করা যায়, গাছে উইঠা হাগা যায়, হাগতে হাগতে কত গল্পের প্লট বারায়। গোদাগাড়ীতে জমির আইলে হাগছি ১০ বছর, কিছুই বারাইলোনা ভাই, অহন ক্যনাডা গিয়া গাছে ঝুইলা হাগতে মুঞ্চায়। আমারে লইয়া যান ক্যানাডা। ক্যানাডা যামু ট্যাকা দ্যান।

আর ভাই, আরেকটা ব্যপার, পিপড়ার ডিম দিয়া টোপ হয়না, হয় "চার"।

অতিথি লেখক এর ছবি

পিঁপড়ার ডিমের টোপ হয়না, হয় "চার"। ভুলের জন্য ক্ষমা করবেন।

----মোখলেস হোসেন

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।

----মোখলেস হোসেন।

কর্ণজয় এর ছবি

দীর্ঘ লেখাটা অবিচ্ছিন্নভাবে পড়ে গেলাম। ভাল লাগলো। কোথাও কোথাও নতুনও.... ভাল লাগার কথাটা পুনরায় জানিয়ে গেলাম...

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ কর্ণজয়।

---মোখলেস হোসেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।