মৃত্যু উপত্যকায় বেড়ে ওঠা শিশুরা

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শুক্র, ০২/০৬/২০১৭ - ৯:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

হরিপূর্ণ ত্রিপুরা


[এই ছবির ব্যাকগ্রাইন্ড হিস্ট্রি জানার আগ্রহীরা নিচের সংবাদের লিঙ্ক পড়লে জানতে পারবেন ]

পিঠে ব্যাগ নিয়ে পলায়নরত শিশুটির ছবি ফেসবুকে সকালে দেখার পর যেন কিছুতেই ভুলতে পারছিনা ৷ শিশুটির কি নাম, ধাম আমি কিছুই জানি না ৷ কিন্তু কোথায় বুঝি কি যেন আছে , মন বলছে সে আর আমি কোন ভিন্ন সত্তা নয় ৷ তার পলায়নত ছবি যেন আমার স্মৃতির ঝাঁপি খোলে আমার ছেলেবেলাকার স্মৃতিকে সামনে নিয়ে আসতে চায় ৷ তার মধ্যে আমি যেন নিজেকে দেখছি ৷

আমার ভাগ্যও নিশ্চয় সেই শিশুটির মতোই ছিলো ৷ আমার জীবনে ছোটবেলাকার স্মৃতি, বেড়ে ওঠার স্মৃতি , পৃথিবীর সাথে প্রথম পরিচয়ের স্মৃতি বলতে যা মনে পড়ে তা হলো ঠিক - এই ছোট শিশুটির মতো মৃত্যু আতংক নিয়ে পালানোর স্মৃতি ৷ আমরা একই রকম দূর্ভাগ্য পীড়িত , একই পথের পথিক ৷ পৃথিবীতে আমাদের জীবনের শুরু বুঝিবা এইভাবে হয় , আমরা বেড়ে ওঠি ওর মধ্যে , বেঁচেও থাকি এই দুঃসহ বাস্তবতায় আর অতীত দুঃস্বপ্নকে স্বপ্ন দেখে - সেগুলো আমাদের জীবনের সত্তার অংশ হয়ে গেছে ৷

আশির দশকের মাঝামাঝিতে আমি বয়সে বোধহয় ঠিক সে শিশুটির মতো বা আরো ছোট ৷ য়াঁজুই তান্নি ফাইদংফুং ( বাঙ্গালিরা আমাদের কেটে ফেলার জন্য আসতেছে ) - এমন খবরে পুরো পাড়ার মানুষদের মধ্যে কি শ্বাসরুদ্ধকর হুড়াহুড়ি আর কান্না ; ভয়ে- আতংকে হাতপা থরথর কাঁপা সবার - কোন মূহুর্তে বাঙ্গালিরা না জানি দা বল্লম হাতে পৌঁছে যায় !

স্পষ্ট মনে পড়ে তখনো সূর্য পশ্চিমের কোণে জ্বলজ্বল ৷ পাড়ার মহিলারা তখন রান্নাবান্নায় ব্যস্ত ৷ তার আগের দিন রামবাডেবাতে পাহাড়িদের উপরে হত্যাযজ্ঞ চালানোর খবর পাড়ার লোকজনরা বলাবলি করতেছিলো ৷ এখানেও আসতে পারে এমন আশংকা সবার মনে ৷ সে কারনে বোধহয় প্রায় দুপুরে এমন রান্না বান্নার কারন ৷ আরেকটি বিষয় হলো তখন গ্রামের লোকেদের সূর্যডোবার আগেই সন্ধ্যার ভাত খাওয়ার অভ্যাস ৷ যে মুহূর্তে বাঙ্গালি আসতেছে - এমন খবর এমুখ ওমুখ হয়ে পুরো পাড়াময় ছড়িয়ে পড়লো মুর্হূতের মধ্যে রান্নাবান্না সব বন্ধ ৷ বাড়ির অনুপস্থিত সদস্যদের জন্য চিৎকার- কান্না, প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো যতদ্রুত সম্ভব পুটলাপুটলি করে ফেলা, বয়স অনুসারে কে কোনটা নিবে ঠিক করা আর পাড়ার কেউ কেউ বেরিয়ে পড়লে আতংক আরো দ্বিগুন বেড়ে সবকিছুতে হুড়াহুড়ি- চিৎকার - কান্নায় এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ৷

বাড়ি হতে বেরিয়ে সারিসারি মানুষের দলের সাথে ভীড়ে কলাপাড়া নামক আমাদের গ্রাম হতে কিছুদূরের উচু পাহাড়ের গ্রামে পৌঁছলাম - উচ্চকন্ঠের বহু মানুষের 'আল্লাহ আকবর, নারায়ে তকবির' ধ্বনি ৷ জীবন আর মৃত্যুর মাঝে কিছু মুহূর্তের ব্যবধান মাত্র ৷ একটু বেরোতে দেরি হলে সবাই সাবাড় হয়ে যেতো ৷ পিছনে ফিরে দেখি - পাহাড়ের মতো বিশাল আগুনের ফুলকি, ধোঁয়ার কুন্ডলিতে পুরো আকাশ ছেঁয়ে আছে ৷ বাড়িতে ব্যবহৃত বাঁশগুলো আগুনে গুলির মতো শব্দ করেছে ৷ আগুনে পুড়ো প্রিয় ঘর , ফেলে আসা প্রিয় জিনিসপত্র-ধান-গরু-মহিষ কোন কিছুর জন্য শোক প্রকাশ করার সময় নেই ৷ মুহূর্ত পিছন তাকিয়ে সবাই ছুটছে রুদ্ধশ্বাসে ৷ ...

পৃথিবীতে আমাদের বেড়ে ওঠার স্মৃতি কিংবা বর্তমান অস্তিত্বের অনুভূতি হচ্ছে এই ৷ এই কেমন আমার সোনার বাংলাদেশ ? যেখানে জীবন শুরু হয় এই ভাবে, বেঁচে থাকতে হয় রাষ্ট্রীয় গড়া অদৃশ্য এক মৃত্যু উপত্যকায় ৷

লিঙ্ক:

১। 1 killed as Adivasi villages torched in Langadu, http://www.dhakatribune.com/bangladesh/nation/2017/06/02/adivasi-houses-torched-longodu/
২।লংগদুতে পাহাড়িদের ৩ শতাধিক ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, ৭০ বছরের বৃদ্ধাকে পুড়িয়ে হত্যা, http://www.chtnews.com/%E0%A6%B2%E0%A6%82%E0%A6%97%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A7%87-%E0%A6%AA%E0%A6%BE%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A7%9C%E0%A6%BF%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A7%A9-%E0%A6%B6%E0%A6%A4%E0%A6%BE%E0%A6%A7/


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

যেই জাতির ১৯৭১ এর মত একটা ঘটনা আছে, অনেক পরিবারেই উদ্বাস্তু হওয়া মানুষের উত্তরসুরী আছে -সেই দেশে এমন ঘটনা কিভাব ঘটে? জঘন্য এই ঘটনাগুলো ঘটার পর কিভাবে বাকিরা চুপ করে থাকে? কি হচ্ছে এইসব?

একটা অপ্রিয় সত্য হল, সমতলের অনেক বাঙালিরই জমির উপর লোভ খুব বেশি। খুব সামান্য (আক্ষরিক অর্থেই) জমির জন্য যেখানে মানুষ ভাইকে খুন করে ফেলে, জাল দলিল বের করে অন্যের জমির উপর হামলে পড়ে, ভাইবোনকে জমির ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে পাশবিক আনন্দ পায় -তাদের কাছে আর কি আশা করা যায়? তখনই মনে পড়ে, এদের মনের মাঝেই আছে ৭১ এ সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি গ্রাস করে বড়লোক হওয়ার রূপকথা। আমরা আসলে কী? আমাদের আশেপাশে আসলে কারা??

দেবদ্যুতি এর ছবি

কেমন কষ্ট লাগে এইসব খবরে, বাঙালি হবার জন্য অপরাধবোধে ছোট হয়ে যাই

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

আজ এই দিনেই মনের মুকুরেতে এই পোস্ট ভেসে এল? মনের মুকুরে অদ্ভুত!

ওদিকে চিরকাল পাহাড়ি সহপাঠিকে 'ব্যাটা নাকবোঁচা' বলে গালি দেয়া ইতরটাও আজ বর্ণবাদ সংক্রান্ত ফেসবুক বিপ্লব করে আমেরিকা-ইউরোপ দখল করে ফেলেছে। ফেসবুকও অদ্ভুত! মন খারাপ

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।