চলচ্চিত্র বীক্ষণ : লুই বুনুয়েল (পর্ব ২)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ০৮/০৮/২০১৭ - ৪:২১অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

বুনুএল যখন কপর্দকশূণ‍্য অবস্থায় মেক্সিকোতে এসে পৌঁছলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন সদ‍্য শেষ হয়েছে, আর ঠিক সেই সময়েই মেক্সিকোর ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রি ফুলেফেঁপে উঠছে। মেক্সিকোতে এসে অস্কার দানসিজার্স এর সঙ্গে আলাপের পরেই বুনুএলের জীবনের মোড় ঘুরে গেল। অস্কারের ছিল একটা প্রোডাকশন স্টুডিও, আর সেই সুবাদে বুনুএল পরপর বেশ কয়েকটা ছবি করার সুযোগ পেয়ে গেলেন।যদিও প্রথম দিকের কাজগুলোকে ফরমায়েশি ছবিই বলা যায়। এই পর্যায়ের প্রথম ছবি Gran Casino হল সুপার ফ্লপ, কিন্তু দ্বিতীয় ছবি El Gran Calavera তেই বুনুএল বাণিজ্যিক সাফল্যের স্বাদ পেলেন। আর এই সাফল্যের সুবাদেই পরের ছবিতে তিনি কিছুটা হলেও নিজের মত করে কাজ করার স্বাধীনতা পেলেন। ১৯৫০ এ তৈরি Los Olvidados ছবিতে বুনুএল ফিরে এলেন স্বমহিমায়। কিছু বঞ্চিত পথশিশু/কিশোর-কিশোরীর চোখ দিয়ে দেখা যে সমাজকে বুনুএল পর্দায় হাজির করলেন তা বেশ নিরাশাজনক, আশার কথা শোনানো যে তার স্বভাববিরুদ্ধ! এ ছবিতেও দেখা গেল বুনুএলীয় চিত্রকল্প - গোয়ালঘরে মৃত কিশোর পেদ্রো, তার রক্তাক্ত শরীরের ওপর চড়ে রয়েছে একটা মুরগিছানা। প্রসঙ্গত, বুনুএলের প্রায় সব ছবিতেই জীবজন্তুর ব্যবহার বেশ লক্ষণীয়।

Los Olvidados ওরফে The Young and the Damned ছবিটা বুনুএলের একটা বেশ উল্লেখযোগ্য সৃষ্টি। পথশিশুদের দারিদ্র বা জীবনসংগ্রামকে এখানে তিনি মহিমান্বিত করার কোনো চেষ্টা তো করেনই নি, উল্টে তাদের দেখিয়েছেন নির্মম নিষ্ঠুর হিসেবে, এমনকি তাদের অত্যাচারের শিকার যারা, তাদের প্রতিও খুব একটা সহানুভূতি দেখাননি। মেক্সিকোতে এই ছবি নিয়ে বুনুএলকে প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে হয়। ছবিতে সমাজের এইরকম নেতিবাচক চিত্রায়ণ দেখতে তখন কেউই অভ্যস্ত ছিলেন না, তাই প্রথম বাধা আসে ইউনিটের ভেতর থেকেই। ছবির চিত্রগ্রহণের সময়েই বুনুএল একাধিকবার কলাকুশলীদের সঙ্গে বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়েন। ছবির প্রিমিয়ারে দর্শকেরাও ভয়াবহ প্রতিক্রিয়া দেখান - এক দৃশ্যে যেখানে একটি চরিত্র সরাসরি ক্যামেরার দিকে তাকে করে পচা ডিম ছুঁড়ে মারে - দর্শকেরা আতঙ্কে চিৎকার পর্যন্ত করে ওঠেন। স্বভাবতই দর্শকেরা এই ছবিকে মেক্সিকোর জাতীয় চেতনার অপমান হিসেবে নিয়েছিলেন। ছবির শেষে বুনুএলের ওপর শারীরিক হামলাও হয়। সন্ত্রস্ত প্রযোজক অস্কার ছবিটা হল থেকে তুলে নেন। তবে বুনুএল অযাচিত সাহায্য পান অন্য দিক থেকে। কবি অক্টাভিও পাজ (পরবর্তীতে নোবেলজয়ী) তখন মেক্সিকো সরকারের কূটনৈতিক বিভাগে কাজ করতেন। তিনি ছবি দেখে এতই মোহিত হন যে নিজের উদ্যোগে ১৯৫১ র কান চলচ্চিত্র উৎসবে মেক্সিকোর প্রতিনিধি হিসেবে ছবিটাকে পাঠান, স্বয়ং ছবিটা নিয়ে প্রচারও করেন। কান এ শ্রেষ্ঠ পরিচালকের সম্মান অর্জন করেন বুনুএল, আর এক লহমায় হয়ে যান একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী। এরপর ছবিটা আবার মেক্সিকোতে রিলিজ হয় এবং দুমাস ধরে ভালো ব্যবসা করে!!!

বুনুএলের এই প্রাথমিক মেক্সিকো পর্বের সব ছবিই সমান গুরুত্বপূর্ণ নয়, অল্প কয়েকটা ছাড়া বেশিরভাগই মেলোড্রামা, পরিচিত নাটকীয়তা, আর আঞ্চলিকতাদুষ্ট। এইসমস্ত ছবিতে বুনুয়েল সবসময় স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ পাননি, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে অন্তত মনের মতো বিষয় পেয়ে গেছিলেন, তাই সেই সমস্ত ছবিতে তার প্রতিভার স্ফূরণ ঠেকানো যায়নি। ১৯৫২ তে তৈরি El Bruto ছবিতে তিনি দেখালেন, পুঁজিপতি কারখানা মালিকের আশ্রিত গুন্ডা, কীভাবে শ্রমিকদের সংস্পর্শে এসে নিজের হারিয়ে যাওয়া শ্রেণীচেতনা ফিরে পেল। দানিয়েল দুফোর বহুপরিচিত গল্প 'রবিনসন ক্রুসো' অবলম্বনে ছবি করতে গিয়ে বুনুএল নতুন মাত্রা যোগ করলেন চরিত্রটাকে বুর্জোয়া হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে, সূক্ষ্মভাবে ধর্মকে ব্যঙ্গও করলেন। ধর্ম-অধর্ম নিয়ে বিশ্লেষণ বুনুএলের সিনেমার একটা অত্যাবশ্যক উপাদান। ধর্মবিশ্বাস, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের আড়ালে রাজনীতি আর ভণ্ডামি তার বরাবরের কটাক্ষের বিষয়। ধর্মের প্রভাবে যৌন অবদমন এবং তার থেকে উদ্ভূত বিকৃতিকে বুনুএল তুলে ধরলেন El ছবিতে। এই ছবির সৎ এবং ধার্মিক নায়ক ফ্রান্সিসকো চার্চের মধ্যেই একটা মেয়ের প্রতি আকৃষ্ট হয়, সামাজিক প্রভাব খাটিয়ে মেয়েটির ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে বিয়ে করে, শারীরিকভাবে সুখী হয়না, নানা বিকৃত উপায় অবলম্বন করে এবং শেষে উন্মাদ হয়ে যায়! অসামান্য চলচ্চিত্রভাষার প্রয়োগ দেখা যায় ফ্রান্সিসকোর এক কল্পনাদৃশ্যে, যেখানে চার্চে ধর্মানুষ্ঠানের সময় সকলে তাকে লক্ষ্য করে বিদ্রুপের হাসি হাসছে। বুনুএলের এই ধর্মচেতনা যেন পরিচিতি পায় ১৯৫৮য় বানানো Nazarin ছবিতে। ধর্ম এবং মানবতার মধ্যে বিরোধটা প্রতীয়মান হয় ছবির কেন্দ্রীয় চরিত্র যাজক নাজারিওর মাধ্যমে, ঘটনাচক্রে কয়েকজন তথাকথিত অসামাজিক ব্যক্তিত্ত্বের সংস্পর্শে এসে যে নিজের নীতিবাগীশ ধার্মিক খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসে এবং একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করে; কিন্তু নাজারিওর এই রূপান্তর চরমপন্থীদের কাছে তার পতন হিসেবেই চিহ্নিত হয়! Nazarin ছবিটিও কান চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কৃত হয়। এরপর ঘটনাচক্রে বুনুএল নিজের মাতৃভূমি স্পেনে গিয়ে ছবি বানানোর আমন্ত্রণ পান, তৈরী হয় আরেকটা অসামান্য ছবি Viridiana, আর শুরু হয় বুনুএলের আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রজীবনের পরবর্তী অধ্যায়!

(চলবে)

- ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র (অতিথি লেখক)

ছবি: 
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন
24/08/2007 - 2:03পূর্বাহ্ন

মন্তব্য

হাসিব এর ছবি

চলচ্চিত্র আঞ্চলিকতাদুষ্ট হওয়া মানে কী? এটা হলে কী খারাপ সেটা? হলে কেন খারাপ?

অতিথি লেখক এর ছবি

দর্শকের রুচির আঞ্চলিকতা থাকে। মেক্সিকোর দর্শক যে ধরণের মেলোড্রামা পছন্দ করেন, বলিউডের দর্শকের তা ভালো নাও লাগতে পারে, আবার হয়ত উল্টোটাও সত্যি... অথচ দুটোই মেলোড্রামা! আসলে এই সময় বুনুএলকে, বিশেষ করে মেক্সিকোর দর্শক কী পছন্দ করবেন আর করবেননা সেই অনুযায়ী, ছবি বানাতে হয়েছিল, সেই অনুষঙ্গেই 'আঞ্চলিকতা' শব্দটা লেখা হয়েছে।
চলচ্চিত্রে আঞ্চলিকতা মানেই খারাপ, এমন নয়। বিশ্ব চলচ্চিত্রের ইতিহাসে 'ভালো আঞ্চলিকতা' র অনেক উদাহরণ আছে যেখানে ভাবনার সমৃদ্ধি আঞ্চলিকতাকে অতিক্রম করে বৃহত্তর দর্শকমণ্ডলীর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছে।

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

শঙ্খ এর ছবি

ভাল লাগছে পড়তে

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। এই ভালোলাগাই তো লেখার প্রেরণা।

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

সোহেল ইমাম এর ছবি

পড়ছি। চলুক লেখা। কিছু ছবি নিয়ে একটু বিস্তৃত ভাবে জানতে ইচ্ছে করছে, বিশেষ করে নাজারিন ছবিটা সম্পর্কে।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার মন্তব্যে উৎসাহ পেলাম, বুনুএল সম্পর্কে আপনার কৌতূহল জাগাতে পেরেছি! নাজরিন এর উইকিপেডিয়া পেজ আছে (অন্য ছবিরও আছে), যদিও ইংরিজি, সেখানে গল্পটা বিস্তারিত বলা আছে। রিভিউ এর জন্য নিউ ইয়র্ক টাইমস (nytimes) দেখতে পারেন! আসলে আমাদের হয়ত উচিত বাংলা উইকিপেডিয়া পেজ গুলো ডেভেলপে আরেকটু বেশি সময় দেওয়া!

ক্ষৌণীশ ভারতীপুত্র

সুমন চৌধুরী এর ছবি

বছর ঘুরে এলো। পরের পর্ব কৈ? রেগে টং

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।