যায় চলে যায় দিন

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: মঙ্গল, ২২/০৮/২০১৭ - ১:১৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সে অনেক অনেক দিন আগের কথা, আমার বয়স তখন ছয় কি সাত। পাড়ার এক খালাম্মা এসেছেন আম্মার সাথে গল্প করতে। আমি একটা ভাঙা গাড়ি নিয়ে খেলতে খেলতে কান পেতে শুনছি তাঁদের কথা।

“আর বইলেন না আপা, আমাদের দেশের বাড়ির এক বউ বটি নিয়ে বসেছিলো কুমড়া কাটতে। তার শাশুড়ি 'আরে করস কি বউ করস কি’ বলতে না বলতেই বউ দিলো বটিতে টান। দুই মাস পরে যখন বাচ্চা হোলো তখন দেখা গেলো বাচ্চার উপরের ঠোটটা কাটা।”

আম্মা শিউরে উঠে বিড়বিড় করে কী যেন একটা পড়ে বুকে ফুঁ দিলেন, আমাকে ডেকে আমার মাথায় ফুঁ দিলেন গোটা কয়েক।

খালাম্মা বললেন

“ভয়ের কিছু নেই আপা, বিপদ কেবল বাচ্চা হবে যাদের।”

আম্মা সেদিন চালকুমড়া দিয়ে ইলিশ রেঁধেছিলেন। ইলিশ আমার খুব প্রিয়, চালকুমড়াও।

কেউ কেউ বলেছিলো পুরনো এক্সরে ফিল্মের ভেতর দিয়ে দেখলে কোন বিপদ নেই। আমি তখনো খুব শান্তশিষ্ট ছেলে, হাত পা ভাঙেনি, বাসায় তাই কোন এক্সরে ফিল্ম নেই। আমরা সম্ভবত একটা মাটির গামলায় পানি ভরে সেখানে দেখেছিলাম অপস্রিয়মাণ ছায়া।

উপরের গল্পটা আমার বানানো। ভাবতে বসলেই কেন যেন এমনই একটা ছবি ভেসে উঠে মনে, আর বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে খুব।

আমার ছেলের বয়স এখন দশ ছুঁই ছুঁই। ভারি দুরন্ত, কিছুদিন আগে আঙুল ভেঙে ঘরে বসেছিল দুই মাস। এক্সরে হয়েছে গোটা তিনেক, তবে বাড়িতে কোন ফিল্ম নেই। যুগ বদলে গিয়েছে কিনা, এখন সিডিতেই ভাঙা হাড়ের ছবি দিয়ে দেয়। অবশ্য ফিল্ম থাকলেই বা কী? প্রতিদিন খবরে বলছে বিশেষ ভাবে প্রস্তুত চশমা ছাড়া এই চেষ্টা না করাই ভালো। আর চশমাও খুব সহজলভ্য, মাত্র দুই ডলার দাম। কিনি কিনি করে কেনা হয়নি।

পাঁচদিন আগে অনলাইনে খুঁজতে গিয়ে দেখি কোথাও নেই, লোকজন কিনে সব শেষ করে ফেলেছে। এদিকে টিভির খবরে বলছে কিছু কিছু দোকানে নাকি চিনে তৈরি ভেজাল চশমার সন্ধান পাওয়া গিয়েছে, না চিনে যেন না কিনি। ভাবছিলাম ছেলেকে বলে দিই দেখা হবেনা।

ই-মেইলটা কেন যেন চোখ এড়িয়ে গিয়েছিলো। ভাগ্যিস কাল চোখে পড়লো! আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মহাকাশ বিদ্যা বিভাগ রীতিমতো আয়োজন করে দেখাচ্ছে। বেলা একটা থেকে চারটার ভেতর স্টেডিয়ামে গেলেই পাওয়া যাবে চশমা। থাকবে টেলিস্কোপ, আর প্রথম দুইশ জনের জন্য বিনামূল্যে আইসক্রিম।

এ দেশে লোকজন কম, ভিড়টির তেমন একটা হয় না। তারপরও কী মনে করে ছেলেকে নিয়ে পৌঁছে গেলাম বারোটায়। পার্কিং লট থেকে মিনিট পনের হেঁটে গেলে পরে স্টেডিয়ামের গেট। যা ভেবেছিলাম তাই, চারিদিক শুনশান, দুটো বাচ্চা দৌড়ে গেলো স্টেডিয়ামের দেয়াল ঘেঁষে। তাঁদের বাবা মা হেলে দুলে পেছন পেছন। মনে হচ্ছে অনেক আগেই চলে এসেছি। সামনে একজন বয়স্ক মহিলা হাতে ভারি একটা বাক্স নিয়ে হেঁটে চলেছেন। বাক্সটা বেশ ভারি। কাছে গিয়ে বললাম,

“আমাকে দেবে বাক্সটা? এই রোদে তোমার কষ্ট হচ্ছে।”

শনের মত পাকা চুলের মহিলাটি অবাক হয়ে একটা ধন্যবাদ দিয়ে বাক্সটা আমাকে দিয়ে দিলেন। আগে লক্ষ্য করিনি, ইনি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের মান মন্দিরের পরিচালক। আমার ছেলের দিকে তাকিয়ে মৃদু হেঁসে বললেন,

“আইসক্রিম খেতে ভালো লাগে তোমার?”

সে কোন বাচ্চার লাগেনা!

ভদ্রমহিলা ফিসফিস করে বললেন,

“কাউকে বোলোনা কিন্তু, এই বাক্সের ভেতরে একটা খাম আছে। সেখানে আইসক্রিমের ফ্রি কুপনগুলো রেখেছি আমি। তোমাদেরকে লাইনে দাঁড়াতে হবেনা, এক্ষুনি দুটো দিয়ে দিচ্ছি।”

আমি বলতে যাচ্ছিলাম, না না তা কেন? আমরা নাহয় লাইনে দাঁড়িয়েই নিয়ে নেবো। কিন্তু মুখ খোলার আগেই তিনি খাম খুলে কুপন দুটো গুঁজে দিলেন আমার হাতে।

স্টেডিয়ামের গেটে এসে দেখি মানুষ আর মানুষ, সব এসেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরের দিক দিয়ে। আর লাইন! কোথায় যে তার শুরু কে জানে? প্রথম দু’শ কেন, দু’হাজারের মধ্যে থাকি কিনা সেটাই সন্দেহ।
প্রচণ্ড রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে দরদর করে ঘামছি। ছেলে একটা গাছের তলায় বসে মন দিয়ে বই পড়ছে। বউ ফোন করে জানিয়েছে সে ও এসে পড়বে এক্ষুনি। আমি ভাবছি অন্য কথা, এত লোকের চশমা এদের কাছে আছে তো?

অল্পক্ষণ নাকি অনেকক্ষণ! বারোটা তিপ্পান বাজে, বেলা একটায় শুরু হবার কথা। অমিয়র অবস্থা কাঁদো কাঁদো।

“বাবা কী হবে যদি আমরা চশমা না পাই? লাইনটা এগুচ্ছে না কেন?”

সুমুকে বললাম, এতো লোক এলো কোত্থেকে?

“আশেপাশের সব স্কুলের বাচ্চারা এসেছে মনে হয়। সামারের ছুটি চলছে কিনা।”

শুধু কি বাচ্চা! বাচ্চাদের বাবা-মা-চাচা-চাচি-খালা-খালু-মামা-মামি-ফুপা-ফুপু-নানা-নানি-দাদা-দাদি কেউ আর বাকি নেই। মানুষ আসতে আছে বানের লাহান।

জনস্রোতে ভেসে ভেসে একটা সময় স্টেডিয়ামের ভেতর ঢুকলাম, কিন্তু চশমা নাকি শেষ। তবে এই বান্দা ছাড়ার পাত্র নয়, হাজার মানুষের সাথে রীতিমতো কুস্তি করে ঢাকা আর মিরপুর স্টেডিয়ামে খেলা দেখার টিকিট জোগাড় করে গিয়েছি বছরের পর বছর।

চোখের উপর চশমা লাগিয়ে তাকিয়ে আছে আমার ছেলে। থেকে থেকে অবাক বিস্ময়ে চিৎকার করছে।

“অসাম বাবা! জাস্ট অসাম!”

আমি অস্থির হয়ে বলছি,

“এখন চোখ সরাও বলছি। এতক্ষণ একটানা দেখতে নেই।”

সুমু এইসব দিনরাত্রির দিলারা জামানের মতো কটকটে গলায় বলে,

“তুমি এত বিরক্ত কর কেন? তিন সেকেন্ডও হয়নি তাকিয়েছে!”

টেলিস্কোপের লাইনটা অনেক বড়। আমরা গুটিগুটি পায়ে সেদিকে এগোই।

গ্রহণ চলেছিল ঘণ্টা তিনেক। বাসায় এসে জানলাম বাংলাদেশেও গ্রহণ লেগেছে, এ গ্রহণ কোনোদিন কাটবার নয়।

বিদায় নায়ক রাজ।


মন্তব্য

মেঘলা মানুষ এর ছবি

ভালো লেগেছে টুকরো অভিজ্ঞতাটুকু।

শুভেচ্ছা হাসি

অতিথি লেখক এর ছবি

মন খারাপ থেকে বাঁচিয়ে দিলেন মেঘলা মানুষ। কেউ পড়েনি ভাবতে এতো খারাপ লাগছিলো!

----মোখলেস হোসেন

হাতুড়ি এর ছবি

কী যে বলেন মোখলেস ভাই, আপনার লেখা পড়ি না শুধু, গোগ্রাসে গিলি। অপেক্ষায় থাকি, কবে নুতন কিছু আসবে। ফসল বিলাসী হাওয়ার পরের পর্ব কবে আসবে?

অতিথি লেখক এর ছবি

খুব ব্যাস্ত একটা একাডেমিক বছর কাটলো ভাই। ভেবেছিলাম সামারে দুইমাস ক্লাস নেই তখন লেখাগুলো শেষ করবো। কিন্তু ছেলেটা হাত ভেঙে এই দুইমাস বাসায় বসে। একটা নয়বছরের ছেলের সাথে সারাদিন কি চাট্টিখানি কথা! লেখার কোন অবকাশই নেই। কাজের কাজ একটা অবশ্য হয়েছে, ছেলেকে বাংলা শিখিয়ে ফেলেছি।

মোখলেস হোসেন।

সোহেল ইমাম এর ছবি

ছেলেটার কথা ভেবে খারাপ লাগছে হাত ভেঙ্গে চুপচাপ বসে থাকাটা আরো কঠিন। বাংলা শেখানোর বিষয়টায় দু’জনকেই অভিনন্দন। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

সোহেল ইমাম এর ছবি

মোখলেস ভাই আপনার কোন লেখাই না পড়ে ছাড়িনা। কমেন্ট করিনা ইচ্ছে করেই, রাগে, ক্ষোভে। কয়টা কাহিনি ঝুলিয়ে রেখেছেন, সেই সাথে পাঠকের মনটাও। ভালো থাকবেন।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভাইরে, আর লজ্জা দিয়েন না। সময়ের সংকট।

---মোখলেস হোসেন

দেবদ্যুতি এর ছবি

আপনি যে কী করে লেখেন!

...............................................................
“আকাশে তো আমি রাখি নাই মোর উড়িবার ইতিহাস”

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ দেবদ্যুতি।

---মোখলেস হোসেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।