মোহন মিয়ার অসুখ

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ০৩/০৬/২০১৮ - ৮:০৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এক।।

রাত একটা বাজতেই মোহন মিয়ার চায়ের তেষ্টা পায়। তবে তেষ্টা পেলেই তো আর উঠে যাওয়া যায় না, সব কিছুরই একটা নিয়ম রয়েছে। বিরক্ত মুখে কী বোর্ডের দিকে হাত বাড়ালেন তিনি। টেবিলের উপর একগাদা বই, কিছু খবরের কাগজ, একটি কালির দোয়াত, আর দোয়াতের পাশেই রুপোর মতো ঝকঝকে একটা পার্কার কলম পড়ে। মোহন মিয়া পুরনো দিনের মানুষ, টাইপ করার আগে একবার কাগজে না লিখলে তাঁর চলে না।

বিচিত্র সব বিষয় নিয়ে লেখেন তিনি। দিনের সময়গুলো সব প্রহর গুনে ভাগ করা- সকালে কবিতা, দুপুরে ক্লাসের অবসরে প্রবন্ধ, সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে গল্প। রাত বারোটার পর লিখতে বসেন বিখ্যাত মানুষদের জন্ম-মৃত্যু আর কীর্তি নিয়ে, ঘড়ি ধরে এক ঘণ্টা। আজ মার্চের এগারো তারিখ, আলেকজান্ডার ফ্লেমিং এর প্রয়াণ দিবস। গত বছরও ফ্লেমিংকে নিয়ে লিখেছিলেন, আজ সেই পুরনো লেখাটিকেই খানিকটা ঘষামাজা করছেন। ফেসবুকে দেয়ার জন্য খুব বেশি কিছুর প্রয়োজন নেই। এক দুটো নতুন তথ্য, নতুন কিছু বিশ্লেষণ, আর কয়েকটি ছবি পেলেই হোলো। লেখা প্রায় শেষ হয়ে এসেছিলো, এমন সময় ইন্টারনেট ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ জানতে পারলেন আলেকজান্ডার ফ্লেমিং লন্ডনের চেলসি আর্ট ক্লাবের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। জলরঙের প্রতি ছিলো তাঁর বিশেষ দুর্বলতা।

চিত্রকলা নিয়ে মোহন মিয়ার খুব একটা পড়াশোনা নেই। খেটেখুটে একটি প্যারাগ্রাফ যোগ করতে অনেকক্ষণ লেগে গেলো।

স্বামীর লেখালেখি নিয়ে প্রথম প্রথম রাগারাগি করলেও শান্তা ম্যাডাম আজকাল আর কিছুই বলেন না। চা বানিয়ে ফ্লাস্কে ঢেলে ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি। খোলা জানালা দিয়ে আছড়ে আসা দমকা হাওয়ায় এলোমেলো তাঁর চুল। এই একটি দৃশ্য কখনও পুরনো হয় না। মোহন মিয়া ঘুমন্ত স্ত্রীর দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে অবাক হয়ে ভাবলেন, আহা, জীবন কী অপূর্ব!

শান্তা ম্যাডাম শুধু লিকারটা বানিয়ে রাখেন। আয়োজন করে চা খাবার অভ্যাস তাঁর স্বামীর। রান্নাঘরের একটা তাকে চিনি, মধু, ঝোলা গুড়, আর তাল মিছরির গুঁড়ো পাশাপাশি রাখা। বিয়ের পর স্বামীকে মিছরি দিয়ে চা বানাতে দেখে হেসে দিয়েছিলেন তিনি। সেই নিয়ে কতো রাগ, কতো অভিমান! তিন মাস বাড়িতে মিছরি আসেনি তারপর।

সেই মেজাজ এখন আর নেই। তবে সংসারে মেজাজ জিনিসটা শক্তির মতোই, অনিত্য। এক দিকে কমলে আরেক দিকে বাড়ে। পড়ালেখার টেবিল আর রান্নাঘরের এই তাকটাই যা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে মোহন মিয়ার। এ নিয়ে অবশ্য কোন দুঃখবোধ নেই তাঁর। শান্তা ম্যাডামের রাজত্বে বরং বেশ সুখেই আছেন তিনি।

আজ ঠিক করেছেন গুড়ের চা খাবেন। ফ্রিজ খুলে দুধের জগটা বের করতে গিয়েই থতমত খেয়ে গেলেন। ভেতরে জুবুথুবু হয়ে বসে একটা বেড়াল।

বেড়ালটার তুলতুলে গা, সেই গা ভর্তি বড় বড় লোম, দেখলেই ইচ্ছে করে কোলে তুলে জড়িয়ে ধরতে। মোহন মিয়া হাত বাড়াতেই হিসিয়ে উঠলো সে, থাবা বসিয়ে পালিয়ে গেলো দু পায়ের ফাঁক দিয়ে। ‘বেড়ালের নিকুচি করি’ বলতে বলতে লুঙ্গী সামলে চামচ হাতে দাঁত খিচিয়ে উঠলেন মোহন মিয়া।

কিন্তু বেড়ালটা গেলো কোথায়!

রান্না ঘরের দরজা বন্ধ, জানালার গ্রিল জুড়ে নেটের পর্দা, একটা মশাও ঢুকতে পারেনা সে পর্দা গলিয়ে।

মোহন মিয়া মেঝেতে উবু হয়ে বসে চুলার পেছনটা দেখলেন ভালো করে, নেই। তবে কি মিটসেফে! শান্তা ম্যাডাম পুরনো আসবাবের দোকান থেকে খুঁজে পেতে পাল্লা ভাঙা এই অদ্ভুত জিনিসটা কিনে এনেছেন তিন মাস আগে। ফ্রিজের যুগে মিটসেফ কেন সে কথা আর তাঁকে জিগ্যেস করা হয়নি। অবশ্য জিগ্যেস করলেও যে খুব লাভ হতো তা নয়। এই জাতীয় প্রশ্নের একটাই উত্তর- তোমাকে এ নিয়ে ভাবতে হবে না।

মিটসেফের কাছে যেতেই গন্ধে নাড়িভুঁড়ি উল্টে আসার জোগাড়। বেড়ালটা ইঁদুর মেরে এনেছে নাকি! আঙুল দিয়ে নাক চেপে ভাঙা পাল্লার ফাঁক দিয়ে তাকালেন মোহন মিয়া। কই, কিছুই তো চোখে পড়ছে না! তাক তিনটে একেবারে ফকফকা, ইঁদুর তো দূরের কথা, একটা হাঁড়ি কিংবা বাটিও নেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন তিনি। বেড়াল ছিলো, বেড়াল নেই। গন্ধ আছে, অথচ ইঁদুর নেই! কিছু একটা গোলমাল হচ্ছে কোথাও। ভাবতে ভাবতে সামনের দিকে এগোতেই চটচটে মেঝেতে পা পিছলে আছাড় খেয়ে পড়লেন। বদমাশ বেড়ালটা নিশ্চয়ই ঝোলা গুড়ের বৈয়াম উল্টে দিয়েছে। ন্যাকড়া নিয়ে মেঝে মুছতে গিয়ে তাঁর খটকা লাগলো। গুড় এতো লাল! কী যা তা মেশায় এরা?

বেড়াল খোঁজার উত্তেজনায় এতক্ষণ টের পাননি, হাঁটুর কাছে লুঙ্গীটাও কেমন চটচটে আর ভেজা ভেজা হয়ে আছে, আর হাঁটুর চাকিটার ঠিক উপরে একটা হালকা জ্বালাপোড়া অনুভূতি।

ঠিক তখনই মোহন মিয়ার মনে পড়লো তাঁদের কোন বেড়াল নেই, বেড়াল কখনো ফ্রিজে থাকে না, ফ্রিজ জিনিসটা খোলা বুক শেলফ নয় যে বেড়াল এসে সেখানে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকবে।

যে ভয়টা তাঁর পনেরো মিনিট আগেই পাবার কথা ছিলো, সেই ভয়টা, কলজে হিম করা সেই ভয় জানালার শার্সি বেয়ে গড়িয়ে পড়া বৃষ্টির ছাঁটের মতো ছড়িয়ে পড়লো মোহন মিয়ার শরীর জুড়ে। চীৎকার করে স্ত্রীকে ডাকবেন সেই বোধটুকুও উধাও হয়ে গিয়েছে তাঁর। তীব্র আতংকে গলা দিয়ে কেবল একটি আওয়াজ বেরুলো- মিয়াও।

দুই।।

শান্তা ম্যাডামের উলের গুটি ফুরিয়ে গিয়েছে আধ ঘণ্টা আগে। গল্প করার মতো কেউ থাকলে খুব ভালো হতো। সুমনা ভাবীকে বলেছিলেন আসতে, তিনি এটা সেটা বলে এড়িয়ে গিয়েছেন। কোন কিছু না করে চুপচাপ বসে থাকতে অসহ্য লাগছে তাঁর।

হাসপাতালের এই ওয়ার্ডে লোকজন খুব একটা নেই। পাঁচটা বেডের তিনটাই খালি, একটায় নাক ডাকছেন তাঁর স্বামী, অন্যটায় আধশোয়া হয়ে খুক খুক করে কেশে চলেছে এক বৃদ্ধ। তার পাশে বসে মোবাইল নিয়ে ব্যাস্ত উনিশ বিশ বছরের একটি তরুণী। এরা কাল রাতে এসেছে। মাঝে মাঝে হন হন করে ছায়ামূর্তির মতো উঁকি দিয়ে যাচ্ছে সাদা ইউনিফর্ম পড়া একজন নার্স। ডাক্তার আসবেন আরও তিন ঘণ্টা পরে।

বৃদ্ধের কাশি থামার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। শান্তা ম্যাডাম উলের কাঁটা হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন, কথা বলার জন্য প্রাণ তাঁর আইঢাই করছে। মেয়েটি তাঁকে দেখেই মিষ্টি করে হেঁসে বললো,

“আফনের রুগী তো দেহি খালি গুমায় আর গুমায়। উনার অইসে কী?”

এমন রূপবতী তরুণীর মুখ থেকে এই ভাষা তিনি আশা করেনি। কথা বলার ইচ্ছে পুরোপুরি উবে গিয়েছে। ছোট্ট করে জবাব দিলেন,

“পড়ে গিয়ে পা ভেঙেছে।”

“হায় আল্লা! পাও ভাঙলে তো মাইনসে চিক্কুর পাইড়া কান্দে, উনি গুমান ক্যান?”

ঠিক এমনটি না হলেও কাছাকাছি একটি প্রশ্নই তিনি করেছিলেন ডাক্তার তওহিদকে। ভয় ছিলো মাথায় গুরুতর কোন চোট লেগেছে কিনা। ডাক্তার বলেছেন তাঁর স্বামী কোমায় নেই, কোন এক বিচিত্র কারণে ঘুমটা ভাঙছে না।

“কেন ঘুমাচ্ছেন আমি জানিনা। ডাক্তারও জানেন না।”

“তাইলে খালাম্মা উনারে আফনে বাইত লইয়া জান। হুদাই পয়সা নষ্ট। গুমাইতে অইলে বাইত গিয়া ঘুমাক।”

কথাটা যে তিনি ভাবেন নি তা নয়। ডাক্তার আরও কয়েকটা দিন দেখতে চান।

“আফনেরে খালাম্মা কইলাম দেইখা আবার কিছু মনে করলেন না তো!”

“না না, মনে করবো কেন? আমি যাই তাহলে, বসে থেকে খিল ধরে গিয়েছে। বারান্দা থেকে একটু ঘুরে আসি।”

বারান্দার দিকে পা বাড়াতেই মেয়েটি উঠে এসে তাঁর কানের কাছে ফিস ফিস করে বললো,

“খালাম্মা, খাওন দাওন ডাইক্কা যান। আসপাতালে বিলাই আছে। রাইতভর খালি কান্দে। আমি তো চুক্ষের পাতা মুঞ্জাইতেই পারি নাই কাইল।সেয়ানা বিলাই, সুয়াত্থন উটলেই চুপ। কই যে লুহায়!”

কথার জবাব না দিয়ে ক্লান্ত পায়ে বেরিয়ে গেলেন শান্তা ম্যাডাম। ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে তাঁর।

হাসপাতালে যে বেড়াল নেই সে কথা তিনি ভালো করেই জানেন। কিন্তু বেড়ালের ডাক আছে। শব্দটা দিনের বেলা করেন না তাঁর স্বামী। রাত গভীর হলে ঘুমের মাঝেই থেমে থেমে ডেকে যান। শান্তা ম্যাডামের ঘুম খুব গাঢ় বলে তিনি টের পান নি। ডিউটি নার্সের কাছে সব শুনে উল্টো রেগে গিয়েছিলেন। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা নিচ্ছে অথচ ঘরের ভেতরে বেড়াল, এর চেয়ে সরকারি হাসপাতালে গেলেই ভালো হয়! ডাক্তার তওহিদ অবশ্য বলেছেন ঘাবড়াবার কিছু নেই, ট্রমা থেকে এরকমটা হতেই পারে, সেরেও যায়।

হাসপাতালের বারান্দাটা তাঁর মনে ধরেছে। এইরকম একটা গ্রিল দেওয়া টানা বারান্দার খুব শখ ছিলো একটা সময়। স্বামীর পৈত্রিক বাড়ির শেয়ার বিক্রি করে টাকা পয়সা যা পেয়েছিলেন তাতে মোটামুটি একটা ফ্ল্যাট পেলেও বারান্দার অতৃপ্তিটা রয়েই গিয়েছে। যা জুটেছে সেখানে পাশাপাশি দুটো চেয়ার পাতার জায়গা নেই, ফুলের টব তো দূরের কথা। তাঁর স্বামীর অতো সখটখ নেই। বরং বেশ হাসি হাসি মুখ করে বলেছিলেন, ‘ভালোই হোলো, কাপড় শুকাতে তোমার আর ছাঁদে যেতে হবে না’। তবে বারান্দার দুঃখ কিছুটা হলেও ঘুচিয়ে দিয়েছে রান্নাঘরটা। বিল্ডারের ডিজাইনে অবশ্য বেশ ছোটোই ছিলো। তিনি বলে কয়ে রিডিং কর্নারটা রান্নাঘরের সাথে জুড়ে দিয়েছেন। নামে রিডিং কর্নার, আসলে একটা খুপরি, জানালা টানালা কিসসু নেই, ও দিয়ে হবে কী? আর মোহন মিয়া শোবার ঘর ছেড়ে নড়লে তো!? মোহন মিয়া শোবার ঘর ছেড়ে নড়লে তো!

ফ্ল্যাটে আসা অবধি চলছে তাঁর রান্নাঘর গোছানো পর্ব। জিনিসপত্রের যা দাম আজকাল! ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, চুলা আর তার সাথে মানাসই হাঁড়িকুঁড়ি কিনতেই বাজেট শেষ। এতো বড় ঘরটা কেমন যেন খালি খালি লাগতো। একদিন সুমনা ভাবীর সাথে পুরনো ফার্নিচারের দোকান গিয়ে চোখ কপালে উঠে গেলো শান্তা ম্যাডামের। পরদিন একাই গেলেন। সে প্রায় বছর দেড়েক আগের কথা।

রান্নাঘরটা মোটামুটি ভরিয়ে এনেছেন তিনি। শেষবার গিয়েছিলেন আলনা কিনতে। সানন্দা না কোথায় যেন দেখেছিলেন আলনা থেকে শিকা দিয়ে ছোটো ছোটো গাছ ঝুলিয়ে রাখা যায়। সেটা অবশ্য ড্রইং রুমের জন্য, কিন্তু তিনি ঠিক করেছেন রান্নাঘরেই রাখবেন, সকাল থেকে দুপুর অবধি তো এখানেই কাটে। মিটসেফটা চোখে পড়েছিলো দোকানে ঢুকতেই। দোকানদার টের পেয়ে হেঁসে বলেছিলন,

“ভালো জিনিস আপা। পছন্দ হলে নিয়ে যান, সস্তায় ছেড়ে দিচ্ছি।”

তাঁর আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই মিটসেফ কিনে নিয়ে যাবেন বাড়িতে। কিন্তু কেন যেন আলনা দেখতে দেখতে ওটার দিকেই চোখ চলে যাচ্ছিলো বারবার। এমন আহামরি কিছু নয়, বরং বেশ জবড়জং দেখতে, ভীষণ ভারী, তার উপর একটা পাল্লা আবার ভাঙা। রঙটা কালো হতে হতেও ঠিক কালো নয়, কেমন যেন পোড়া পোড়া।

“পুরনো ঢাকার জিনিস। আধভাঙা একটা বাড়িতে পড়ে ছিলো অনেকদিন। মালিকানা নিয়ে মামলা শরিকদের ভেতর, সেই মামলা ফুরোতে ফুরোতে বাড়িই ফুরিয়ে গেলো, হা হা হা। তিন শরিকের তরফ থেকেই কোর্ট অর্ডার, বাড়িতে কেউ থাকতে পারবে না। কেউ থাকেওনা। এর মাঝে একদিন ডাকাতি হয়ে গিয়েছে বাড়িতে। শরিকরা তাই ভেতরের সব জিনিসপত্র বেঁচে দিচ্ছেন। এই একটা ব্যাপারে তাদের কোন সমস্যা নেই। বিকাল বেলা বাইরের উঠানে চেয়ার পেতে সবাই মিলে গল্প করে আর হুক্কা খায়। লোকজন এসে জিনিসপত্র খুলে খুলে নিয়ে যায়। সেই টাকায় আবারও হুক্কা খায়, হা হা হা। পুরাণ ঢাকার মানুষ আপা, পুরাণ ঢাকার মানুষ। দিনের বেলায় যেই কে সেই, যার যার উকিল নিয়ে কোর্ট কাচারিতে দৌড়। জিনিস দিয়ে কী হবে বলেন আপা, দাম তো আসলে মাটির!”

মোর্তজা সাহেবের এই একটা দোষ, কথা বললে আর থামতে জানেন না।

“কথাটা আসলে ঠিক না আপা। বেকুবের দল সব, পুরনো জিনিসের কদর বুঝলোনা। আমি খবর পেয়ে যেতে যেতে সব শেষ। খালি এই মিটসেফটা বাকি। নিয়েতো আসলাম, কিন্তু পাল্লা ভাঙা দেখে কেউ আর কিনতে চায় না। খামাখা জায়গা নষ্ট। আপনি নিলে আমি পানির দামেই দিয়ে দেবো।”

পানির দাম যে আড়াই হাজার টাকা হবে কে জানতো! কিন্তু মিটসেফটা তাঁর মনে ধরে গিয়েছে।

পায়ের শব্দে পেছন ফিরলেন শান্তা ম্যাডাম, মেয়েটা বেরিয়ে এসেছে। বারান্দার গা ছুঁয়ে বেড়ে ওঠা নারকেল গাছের পাতার আড়াল থেকে এক ফালি রোদ এসে পড়েছে তার মুখ। ওয়ার্ডে যা মনে হয়েছিলো তার চেয়েও বাচ্চা দেখাচ্ছে মেয়েটিকে। শান্তা ম্যাডাম কোমল গলায় জিগ্যেস করলেন,

“কাশি থেমে গিয়েছে?”

“হ খালাম্মা, থামছে।”

“উনার খুব কষ্ট হচ্ছিলো।”

“বুইড়া মাইনসের হাজার কষ্ট, আইজ কাশি, কাইল পেডে ব্যাদনা, পরশু বাতের বিষ। কষ্টের কুনু শ্যাষ নাই।”

“উনি তোমার কে হন, দাদা?”

ঝংকার তুলে হাসতে হাসতে ওয়ার্ডে ফিরে গেলো মেয়েটি। শান্তা ম্যাডামের কানে ভেসে আসে বিষণ্ণ একটা কণ্ঠস্বর,

“সোয়ামি গো খালাম্মা। তাইনে আমার পরানের সোয়ামি।”

তিন।।

তেষ্টায় বুক ফেটে যাচ্ছে মোহন মিয়ার। মাথার উপরে গনগনে সূর্য যেন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে চায়। ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকালেন তিনি, জায়গাটা খুব অচেনা লাগছে তাঁর। এটা সম্ভবত একটা গলি, কিন্তু গলির দু ধারের দেয়াল যেন পাহাড়ের মতো উঁচু।

কিছুদূর যেতেই কুকুরটাকে চোখে পড়লো। কুকুর তিনি একদম পছন্দ করেন না। কুকুরেরাও সেটা জানে। এই কুকুরটা বিশাল, বড়সড় একটা রাম ছাগলের চেয়েও বড়, দাঁত খিচিয়ে তাকিয়ে রয়েছে তাঁর দিকে। আতংকে জমে গিয়েছেন মোহন মিয়া, হাতে ছাতা টাতা থাকলেও একটা ভরসা ছিলো।

কুকুরটা একপা এগিয়ে টেনে ধরা স্প্রিঙের মতো টানটান হয়ে দাঁড়ালো, মোহন মিয়া আর অপেক্ষা না করে পেছন ফিরেই দিলেন ছুট। কুকুরটাও ছুটছে, তার হলদে হলদে দাঁতের বিচ্ছিরি গন্ধ টের পাচ্ছেন তিনি।

ছুটতে ছুটতে খটকা লাগলো তাঁর। এই বয়সে এতো জোরে দৌড়ুচ্ছেন কী করে! ছোটার প্রচণ্ডতায় আশেপাশের কিছুই ভালো করে দেখতে পাচ্ছেন না তিনি। সাই সাই করে পেছনে চলে যাছে দেয়ালের সব লেখা, ছেঁড়াখোঁড়া পোস্টার, মাছের গন্ধে ভনভন করতে থাকা ডাস্টবিন। মোহন মিয়া ছুটে চলেছেন, যেন বাঁধন হারা কিশোর কোন।

কুকুরটাও ক্লান্তিহীন, কিছুতেই সরছে না পেছন থেকে। সামনে ওটা কী? বাড়ি? খোলা দরজা দিয়ে ঢুকে পড়লেন তিনি।

এখানে কি মানুষ থাকে, না দৈত্য দানব! তাঁর সামনেই একটা খাট, কম করে হলেও বিশ জন মানুষ শুতে পারে সেই খাটে। খাটের পাশে একটা আলমারি, তবে ঠিক আলমারি নয়, যেন… যেন যে কী বুঝেও উঠতে পারছেন না তিনি।

খুব বেশি ভাবার অবকাশ পেলেন না মোহন মিয়া। ঘরে এসে ঢুকেছে তিনটি দানব। তিরিশ ফুটের কম নয় কেউই। তিন জনের হাতেই বিশাল বিশাল অস্ত্র। কোথায় দেখেছেন এমন অস্ত্র! হ্যাঁ, মনে পড়ে গিয়েছে, কোথাও দেখেন নি, একটা বইয়ে পড়েছেন। নর্ডিক দেবতা থরের হাতুড়ির মতো সেই অস্ত্র গুলো দিয়ে উন্মাদের মতো ভাংচুর শুরু করলো দৈত্য গুলো। আতংকে সিটিয়ে গেলেন মোহন মিয়া। মেঝেতে ঘষটে ঘষটে ঢুকে পড়লেন আলমারির মতো ওই জিনিসটায়। একটা ফুটো দিয়ে বিস্ফারিত চোখে চেয়ে দেখতে লাগলেন দানবদের ধ্বংসযজ্ঞ।

মাথার উপরে বাজ পড়ার মতো আওয়াজ হোলো একটা। দানবদের কেউ ভেঙে ফেলেছে এই আলমারি না কী যার মধ্যে তিনি লুকিয়ে রয়েছেন তার দরজা। একটা কোনায় গা ঘেঁষে লেপটে পড়ে রইলেন তিনি।

দুটো রোমশ হাত আঁতিপাঁতি করে কিছু একটা খুঁজছে। কী খুঁজছে কে জানে!

হাত দুটো বেশ কয়েকবার তাঁর মাথার কাছ ঘেঁষে চলে গেলো।

মোহন মিয়ার ভীষণ ভয় লাগছে। একটা দুর্দমনীয় ইচ্ছে তাঁকে ভাবাচ্ছে, নাড়াচ্ছে, তাড়াচ্ছে। দরজার ওই ভাঙা জায়গাটা দিয়ে বেরিয়ে যেতে প্রয়োজন একটা লাফ।

লাফটা তিনি দিয়েই ফেললেন।

শূন্যে থাকতেই অনুভব করলেন পাঁজরে তীব্র একটা যন্ত্রণা। ঘুরতে ঘুরতে ছিটকে এসে পড়লেন সেই আলমারি না কী যেন তার ভেতরেই।

মোহন মিয়ার ফুসফুসটা খুব ভারী। মোহন মিয়ার চোখে ভীষণ অন্ধকার । তলিয়ে যেতে যেতে শুনতে পেলেন কে যেন বলছে,

"বাইত্তে সোনাদানা টেকা পয়সা কিছুই নাই। হালায় ফকিরা পাট্টি। এর লেইগ্যা নি বিলাইর খামচি খাইতে লইছিলাম!"

চার।।

শান্তা ম্যাডাম ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। অদ্ভুত একটা গোঙানির শব্দে মাথা তুলে তাকাতেই চোখে পড়লো মোহন মিয়া শোয়া থেকে উঠে আধবসা হয়ে চেয়ে রয়েছেন শূন্য দৃষ্টিতে। দারুণ অচেনা সেই দৃষ্টি।

গোঙানির শব্দে ঘুম ভেঙে গিয়েছে সেই মেয়েটিরও। ভয়ে ভয়ে শান্তা ম্যাডামের কাছে এসে সে বললো,

“খালাম্মা, খালুজানের তো দেহি বিলাই চউখ!”

কথাটা কানে যেতেই মোহন মিয়া হিসিয়ে উঠলেন শ্বাপদের মতো। ঝাঁপিয়েই পড়তেন, কিন্তু প্লাস্টার বাঁধা পায়ে টান খেয়ে যন্ত্রণায় চীৎকার করে উঠলেন। নবজাতকের কান্নার মতো শোনালো সে আর্তনাদ। তারপর সব চুপ।

মোহন মিয়া ঘুমিয়ে পড়েছেন আবার। মেয়েটি ছুটে বেরিয়ে গিয়েছে নার্সের খোঁজে। এখনও আসার নাম নেই।

শান্তা ম্যাডামের হঠাৎ খুব শীত শীত লাগছে, যদিও এখন শেষ চৈত্রের রাত। এমনটা তাঁর মাঝে মাঝেই হয়। তখন স্বামীর বুকের কাছে গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকেন। এই তো ঘুমিয়ে আছে মানুষটা। নিশ্বাসের তালে তালে উঠানামা করছে তাঁর বুক। কী যে একটা অসুখ বাঁধালো!

কোথায় যেন একটা বেড়াল ডাকছে। চমকে উঠে পেছনে তাকালেন শান্তা ম্যাডাম। ডাকটা এসেছে বৃদ্ধলোকটির বিছানা থেকে।

মোহন মিয়া চোখ মেলেছেন। বিড়াল চক্ষু নয়, দীঘির জলের মতো কালো সে চোখের মনি। কিছু একটা বলতে চাইছেন, কিন্তু বেদম কাশির তোড়ে হারিয়ে যাচ্ছে সেই কথা।


মন্তব্য

সোহেল ইমাম এর ছবি

গল্পটার শুরু থেকে সাংঘাতিক আগ্রহ নিয়ে পড়ছিলাম, কিন্তু হোঁচট খেলাম। যে জায়গায় আশা করছিলাম “চলবে” লেখা সেখানে কিছু নেই।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

তাহলে তো ভাই কিছুটা হলেও সার্থক আমি। একটা ছোট গল্পই লিখতে চেয়েছিলাম। তাঁর উপর আমার আবার যা রেপুটেশন!

---মোখলেস হোসেন

নীড় সন্ধানী এর ছবি

পড়তে পড়তে শিউরে উঠলাম। ভয়াবহ রূপান্তর। অনেক বছর আগে বিটিভিতে ম্যানিমেল নামে একটা সিরিজ দেখাতো, একজন মানুষ ঈগলে পরিণত হতো কোন কোন বিশেষ সময়ে। সেটার কথা মনে পড়ে গেল।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি তো দেখছি আমার মতো সত্য যুগের মানুষ! ম্যানিমেলের কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আশির দশকে বেশ জনপ্রিয় হয়েছিলো এটি। সমকালীন আরও একটি সিরিজের কথা মনে পড়ছে, ম্যান ফ্রম আটলান্টিস। কী দারুণ সময়ই না কেটেছে! আমার লেখাটি পোড়ার জন্য ধন্যবাদ।

---মোখলেস হোসেন

আয়নামতি এর ছবি

ইয়ে, মানে... বেশ একটা শিরশিরে ভাব হলো গল্প পড়ে। বেশ গল্প ভাই। চলুক

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ আয়নামতি।

---মোখলেস হোসেন

কর্ণজয় এর ছবি

পড়ে গেলাম। কিছু একটা সামনে ছিল
তার লোভে লোভে পুরোটাই পড়লাম
পেলাম কি পেলাম না বুঝতে পারলাম না

অতিথি লেখক এর ছবি

লোভের জয় হোক। পড়ার জন্য ধন্যবাদ কর্ণজয়।

---মোখলেস হোসেন

রংতুলি এর ছবি

ঝড়ের মতো লাগলো গল্পটা। গা শিরশির অনুভূতি নিয়ে সে গতিতেই পড়ে গেলাম। শেষে এসে যদিও মাথা একটু এলোমেলো হয়ে গেল।

অতিথি লেখক এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ রংতুলি।

---মোখলেস হোসেন

শহীদুল্লাহ্  এর ছবি

গল্পটা প্রথমে ফেসবুকে পুরো পড়তে পারিনি চলবের জ্বালায়। কিন্তু শেষে এসে কেন চলবে নেই এই আক্ষেপে বাঁচছি না। শেষে আরো কত কি হতে পারতো!
লেখক মোখলেসের কাছে দাবী, আরেকটা পর্ব চাই মোহনের।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ শহিদুল্লাহ। নটে গাছটি মুড়িয়ে গিয়েছে।
---মোখলেস হোসেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।