সুন্দরপুরে সন্দেহ (দ্বিতীয় কিস্তির পর)

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ১৩/০১/২০১৯ - ১১:১৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(লিখতে লিখতে টের পাচ্ছি অনেক সম্পাদনার প্রয়োজন রয়েছে। আগে শেষ করি)

ইনছান আলির কাছে সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়ে গৌহাটি শহরে ছোট্ট একটি ব্যাবসা শুরু করেন নারায়ণমাধব। সদ্য স্বাধীন ভারতে তখন পুরোদমে চলছে অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ। গড়ে উঠছে নতুন নতুন জনপদ, তৈরি হচ্ছে রাস্তাঘাট, কল-কারখানা, দালান কোঠা। এই বিপুল কর্মযজ্ঞের সাথে জড়িত লক্ষ লক্ষ প্রতিষ্ঠানের একটি মাধব এন্ড সন্স। প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নারায়ণমাধব। বড় ছেলে কিশোরীমাধব তখন সাত বছরের বালক, পণ্ডিতের টোলে ঘুম ঘুম চোখে বসে, ঢুলে ঢুলে সংস্কৃত শিখছে। ছোট ছেলে হরিমাধবের তখন দুধ দাঁতও ওঠেনি।

উনিসশ একষট্টি সালে যখন কামাখ্যা মন্দিরের সংস্কারকাজ শুরু হয়, কিশোরীমাধব তখন সতেরো বছরের টিকি দোলানো বামুন। সংস্কৃত সাহিত্য এবং পুরাণে তার বিপুল আগ্রহ। কামাখ্যা মন্দিরের কাহিনীও তার অজানা নয়।

পুরাকালে ব্রহ্মার পুত্র প্রজাপতি দক্ষ আয়োজন করেছিলেন এক মহা যজ্ঞের। সে যজ্ঞে সকল দেবতার আসন থাকলেও নিমন্ত্রন পাননি মহাদেব শিব। অথচ শিব তাঁর জামাতা, প্রাণপ্রিয় কন্যা সতীর স্বামী! এই বিয়েতে তাঁর সায় ছিলো না।

দক্ষের অন্যান্য মেয়েরা নামডাক আলা দেবতাদের সাথে গাঁঠছড়া বাঁধলেও, কনিষ্ঠা কন্যা সতীর বাসনা মালা দিতে হলে তিনি শিবের গলাতেই দেবেন। শিব যদিও দেবতা, চলনে বলনে সাক্ষাৎ ছোটলোক। মদ-গাঁজা-ভাং-সিদ্ধি খেয়ে পড়ে থাকেন ভূত প্রেতদের নিয়ে।

আসলে সকলই নিয়তির বিধান। সতী ছিলেন অর্ধশক্তির অবতার। অর্ধশক্তি শিবেরই অংশ, উত্তম অংশ। জগতে সামঞ্জস্য নিশ্চিত করার জন্য শিব একদিন অর্ধশক্তিকে ত্যাগ করেছিলেন। যেন নিয়তির লেখন পূর্ণ করতেই দক্ষের নিষেধ অমান্য করে সতী চলে যান হিমালয়ে। দীর্ঘ তপস্যায় তুষ্ট করেন শিবকে। দক্ষ রুষ্ট হলেও সম্মতি দেওয়া ছাড়া তাঁর আর কোন উপায় ছিলো না।

সেই জ্বালা মেটাতেই আয়োজন এই যজ্ঞের। যেখানে নিমন্ত্রিত নন মহাদেব শিব।

যজ্ঞের খবর জানতে পেরে দুঃখ পেলেন সতী। শিবকে রাজি করাতে না পেরে ঠিক করলেন একাই যাবেন। কন্যার উপস্থিতিতে দক্ষ সমবেত অতিথিদের সামনে শিবের নিন্দা করলেন যাচ্ছেতাই ভাবে। মনের দুঃখে আত্মাহুতি দিলেন সতী।

কৈলাসে বসে এই দুঃসংবাদ শুনে মত্ত হাতির মতো ছুটে এলেন শিব। যজ্ঞের অনুষ্ঠানে ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে শেষমেশ মাথা কেটে নিলেন দক্ষের। ব্রহ্মা তখন শিবের কাছে কাকুতি মিনতি করে পুত্রের প্রাণ ভিক্ষা চাইলেন, ক্ষমা চাইলেন পুত্রের অপরাধের। শিবের রাগ কমলো। দক্ষের ছিন্ন মস্তকের জায়গায় একটা ছাগলের মুণ্ডু বসিয়ে দিয়ে সতীর মৃতদেহ কাঁধে নিয়ে ফিরে চললেন তিনি। কিন্তু কৈলাসে ফিরলেন না। হাঁটতে শুরু করলেন অনির্দিষ্ট পথে। পড়ে রইলো সকল দায়িত্ব। বিশ্বে ঘনিয়ে এলো ঘোর দুর্বিপাক।
দেবতারা বিচলিত হয়ে বিষ্ণুর কাছে গেলেন প্রতিকারের আশায়। বিষ্ণু শিবের পথ আটকে, সুদর্শন চক্র ছুঁড়ে, কেটে ফেললেন সতীর দেহ। সতীর খণ্ডবিখণ্ড দেহ ছড়িয়ে পড়লো পৃথিবী জুড়ে।

যেখানে যেখানে সতীর দেহ মাটি স্পর্শ করেছিলো, কালের পরিক্রমায় সেইসব স্থানে গড়ে উঠেছে মন্দির। এই মন্দিরগুলো সতীপিঠ নামে পরিচিত। কামাখ্যা মন্দির সেই একান্ন সতীপিঠের একটি।

মাধব এন্ড সন্স মন্দির সংস্কারের কাজ পেয়েছে জানতে পেরে উত্তেজনায় কিশোরীমাধবের রাতের ঘুম উবে গেলো। কিন্তু বাবার সাথে এ নিয়ে কথা বলার সুযোগ মিলছে না। নারায়ণমাধব ব্যাস্ত মানুষ, দিনরাত ব্যাবসা নিয়েই পড়ে থাকেন। একদিন সন্ধ্যা আহ্নিক সেরে কেবল পুঁথি নিয়ে বসেছে কিশোরীমাধব, এমন সময় দরজায় টোকা পড়লো।

নারায়ণমাধব ভেতর বাড়িতে সাধারণত আসেন না। আজও তিনি কাচারি ঘরে কাজের মধ্যে ডুবে ছিলেন। প্রধান পুরোহিত একগাদা কাগজ পত্র বুঝিয়ে দিয়ে চলে গিয়েছেন ঘণ্টা দুয়েক আগে। মন্দিরের ভেতরটা আগে কেমন ছিলো, কালে কালে কী পরিবর্তন হয়েছে, তারই নকশা আর বর্ণনায় ভরা ঝুরঝুরে সব পুঁথি, অসমিয়া আর সংস্কৃতে লেখা। দুটো ভাষাতেই সড়গড় নারায়ণমাধব। কিন্তু পড়তে পড়তে একটা দলিলে এসে আটকে গেলেন তিনি। সংস্কৃতেই লেখা, কিন্তু সেই লেখার কোন অর্থ হয় না। পুরোহিতের কাছে গিয়ে বুঝে নিতে হলে আরও দুটো দিন চলে যাবে। সময় নষ্ট মানেই অর্থ নাশ। বিরক্ত হয়ে সিন্দুকে কাগজগুলো রাখতে গিয়েই ভাবলেন ছেলেকে একবার দেখিয়ে নিলে কেমন হয়। সারাদিন তো এইসব নিয়েই থাকে সে।

পুঁথিটা অন্যগুলোর মতো পুরনো নয়। কামাখ্যা মন্দিরের প্রাক্তন একজন সেবক এটি লিখেছেন, কিন্তু কোথাও তাঁর নাম উল্লেখ নেই। সারা রাত জেগেও লেখার কোন অর্থ উদ্ধার করতে না পেরে কিশোরীমাধব ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলো সে।

মন্দিরের চাতালে একা একা এক্কা দোক্কা খেলছে একটি মেয়ে। মেয়েটির বয়স বড়জোর পনেরো কি ষোল। খেলতে খেলতে ছড়া কাটছে,

উকুলি মুকুলি দুকুলি কাঁহি
নাক ডৌ ডৌ দোমর দাঁহি
কি কি চরাই কি কি নাও
সোনর চরাইর কথা কও

সুন্তি পান্তি রজা ঘরর ধোমতি

অহমীয়া ভাষার শিশুতোষ ছড়া, বাংলায় যেমন এলাটিং বেলাটিং। কোন অর্থ হয়না।

পুঁথিটা নিয়ে আবার বসতেই মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো কিশোরীমাধবের। এক্কা দোক্কার মতো লাফিয়ে লাফিয়ে, মানে যে অক্ষরটা দেখা যাচ্ছে সেটা বাদ দিয়ে, পরবর্তী না দেখা অক্ষরটা পড়লে কেমন হয়! ব্যাপারটা যে এতো সহজে সমাধান হয়ে যাবে এটা সে ভাবতেই পারেনি। কিশোরীমাধব তন্ময় হয়ে পড়তে থাকে-

“আমার নাম পার্থ সারথি বসু। মন্দিরের গর্ভগৃহের দায়িত্বে নিয়োজিত সেবক আমি। যে ইতিহাস আমি লিখিয়া যাইতেছে তাহা বড়ই লজ্জার। ভাবিয়াছিলাম এই লজ্জা নিজের বুকে লুকাইয়া রাখিয়াই ধরাধাম ত্যাগ করিবো। কিন্তু ইহধাম ত্যাগ করিলেই কি আমার নিষ্কৃতি মিলিবে! যে পাপ আমি করিয়াছি তাহার শাস্তি জন্ম জন্মান্তর ধরিয়া ভোগ করিয়া যাওয়াই আমার নিয়তি। তথাপি মনে ক্ষীণ আশা, কোন পুণ্যাত্মা হয়তো এই লিপির পাঠোদ্ধার করিয়া আমাকে নরক বাস হইতে মুক্ত করিবেন।

যুবাকালে সন্ন্যাস ধর্ম পালন করিবার ব্রত লইয়া আমি গৃহ ছাড়িয়াছিলাম। নানান স্থলে ঘুরিয়া ফিরিয়া নীলাচল পাহাড়ের কোলে মা শক্তির মন্দিরে আশ্রয় লইয়াছি আজ প্রায় তিরিশ বৎসর হইতে চলিলো। মা শক্তি রজস্বলা। বৎসরে একবার, আষাঢ় মাসে, তাঁহার শোণিতের স্পর্শে অম্বুবাচি নদীর জল লোহিত হইয়া ওঠে। ভাবিয়াছিলাম মা শক্তির সেবা করিয়া জীবন কাটাইয়া দিবো।

চতুর্দশ বৎসর পূর্বে একটা ঘটনা ঘটিলো।

শ্রাবণ মাসের তৃতীয় সপ্তাহের এক মঙ্গলবার অম্বুবাচি নদীর ঘাটে দাঁড়াইয়া সন্ধ্যা আহ্নিক করিতেছিলাম। অকস্মাৎ ক্রন্দনধ্বনি শুনিয়া পশ্চাতে ফিরিয়া দেখি তিন চারি বৎসরের একটি কন্যা শিশু একাকী দাঁড়াইয়া রোদন করিতেছে। কোথা হইতে আসিলো এই ফুলের মতো শিশুটি? মন্দিরের কাছেপিঠে তো কোন জনপদ নাই! চারিদিকে অবলোকন করিয়া দ্বিতীয় কোন জন মনুষ্য দেখিলাম না। নাম জিজ্ঞাসা করিতে সে বলিলো তাহার নাম তারা। কোথা হইতে আসিয়াছে? জবাবে হাত দিয়া পাহাড়ের চুড়ার দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়া মিটিমিটি হাসিলো সেই বালিকা।

তখন অন্ধকার ঘনাইয়া আসিতেছে। একাকী একটি শিশুকে কী করিয়া নদীর ধারে রাখিয়া যাই!

মন্দিরে আসিয়া পৌঁছাইবার পর হুলুস্থুল পড়িয়া গেলো। মা শক্তির মন্দিরে পশুবলি হয়। নারী এবং শিশুদের এইস্থলে প্রবেশাধিকার নাই। আমি প্রধান পুরোহিতের পা জড়াইয়া কহিলাম, মা শক্তি রজস্বলা। এ তাহারই কন্যা।

কী ভাবিয়া শেসে প্রধান পুরোহিত সম্মতি জ্ঞাপন করিলেন।

সেইদিন হইতে আমিই তারার বাবা, আমিই উহার মা। সংসার ত্যাগ করিবার নিমিত্তে সন্ন্যাস ব্রত লইয়াও নিয়তির অঙ্গুলি হেলনে আমি জড়াইয়া পড়িলাম সংসারের মায়ায়। তারা হাসে, তারা কাঁদে, তারা ঘুরিয়া বেড়ায়, খেলিয়া বেড়ায় মন্দিরের সর্বত্র।

এইরূপে কাটিয়া গেলো সপ্তাহ, মাস, বৎসর। তারা বয়ঃপ্রাপ্ত হইলো।

না হইলেই বুঝিবা উত্তম হইতো। কেন কহিলাম এইরূপ কথা!
তখন বসন্তকাল। মন্দিরের উন্নয়ন কাজ চলিতেছে। জনা কুড়ি মজুর অষ্টপ্রহর প্রাণাতিপাত করিয়া তিলে তিলে গড়িয়া তুলিতেছে ইন্দ্রপুরীসম একটি মর্মর উদ্যান। প্রধান পুরোহিত আমার স্কন্ধে সকল তদারকির ভার তুলিয়া দিয়াছেন। বর্ষা আসিবার পূর্বেই উদ্যান সমাপ্ত হওয়া চাই। আমি গর্ভগৃহের দায়িত্ব তারার হস্তে সমর্পণ করিয়া দিনমান মজুরদের সাথে পড়িয়া থাকি।

একদিনের কথা। উদ্যানের কাজে ব্যাস্ত থাকিয়া ভুলিয়া গিয়াছিলাম কখন দুপুর গড়াইয়া বিকাল হইয়া পড়িয়াছে। হঠাৎ পশ্চিম আকাশে হেলিয়া পড়া দিবাকরের পানে নেত্র পড়িতেই তারার কথা মনে আসিলো। মা আমার দ্বিপ্রহরে আহার লইয়া আসে। অদ্দপি তাহার ব্যতিক্রম হয় নাই। কিন্তু আজিকে সে আসে নাই! কিঞ্চিৎ বিচলিত হইয়া মন্দিরে ফিরিয়া আসিয়া দেখি গর্ভগৃহের এক কিনারে আলুথালু কেশ লইয়া মা আমার মৃতবৎ পড়িয়া রহিয়াছে। কপালে হস্ত রাখিয়া দেখি জ্বরে পুড়িয়া যাইতেছে তাহার শরীর।

উপায়ন্তর না দেখিয়া ছুটিয়া গেলাম প্রধান পুরোহিতের কক্ষে। তিনি দেখিয়া শুনিয়া গম্ভীর কণ্ঠে জানাইলেন, তারা সন্তান সম্ভবা।

আমার মাথায় যেন আকাশ ভাঙিয়া পড়িলো।

সেই রাত্রিতে পিতা কন্যার ডাক পড়িলো প্রধান পুরোহিতের কক্ষে। কে করিয়াছে এই দুষ্কর্ম! তারা নিরুত্তর। আমি নিরুপায়।

পরদিন প্রত্যুষে ঘুম ভাঙিয়া দেখি তারা নাই। যেমন আসিয়াছিলো তেমনি, যেন প্রভাতের রবিকিরণে মিলাইয়া যাওয়া শিশির বিন্দুর ন্যায় উধাও হইয়া গিয়াছে আমার জীবন হইতে। সেই সাথে উধাও গর্ভগৃহে সংরক্ষিত মা শক্তির গহনা সকল।

এইক্ষনে বলিয়া রাখি একটি কিংবদন্তির কথা। বিষ্ণুর চক্রে ছিন্নভিন্ন সতীর হস্ত দুইখানি আসিয়া পড়িয়াছিলো কামাখ্যায়। সেই হস্তে শোভিত ছিলো এক জোড়া স্বর্ণমণ্ডিত বালা। স্বয়ং শিব দিয়াছিলেন সতীকে, বিবাহের উপহার।

কিছুক্ষণ পর খবর আসিলো মন্দিরের কার্যে নিয়োজিত মজুরদের একজনকে নাকি খুঁজিয়া পাওয়া যাইতেছে না।

প্রধান পুরোহিত বলিলেন কাক পক্ষীও যেন জানিতে না পারে তারা সন্তানসম্ভবা হইয়াছিলো। স্বর্ণালংকার চুরির কথাও গোপন রাখিতে কহিলেন। গহনা নতুন করিয়া গড়াইয়া লওয়া যাইবে, কিন্তু মন্দিরের সম্মান একবার ক্ষুণ্ণ হইলে তাহা আর পুনরুদ্ধার হইবে না। কেবল একটি বিষয় লইয়াই তিনি চিন্তিত। বালাদ্বয় অমিত শক্তির অধিকারী। ভুল হস্তে পরিলে সমূহ বিপদ। জগৎ নাশের সম্ভাবনা রহিয়াছে।

দুই দিবস পর। ভগ্ন হৃদয়ে অম্বুবাচির তীরে ঘুরিয়া বেড়াইতেছি। সূর্য অস্ত গিয়াছে বহুক্ষণ হয়। হঠাৎ গৃধিনীদের কর্কশ শব্দে চমকিত হইয়া তাকাইয়া দেখি নদীর জলে একটি দেহকে লইয়া টানাটানি করিতেছে পশুর দল। ছুটিয়া গিয়া যাহা দেখিলাম তাহা কেমন করিয়া প্রকাশ করিবো? নদীর তটে জলসিক্ত বালুতে ঊর্ধ্বপানে মুখ রাখিয়া পড়িয়া রহিয়াছে একটি দেহ। আমার তারা। তখনো তাহার প্রাণবায়ু গত হয় নাই।

কেমন করিয়া সেই দেহ মন্দিরে টানিয়া আনিলাম বলিতে পারিবো না। জ্ঞান ফিরিতে তারা শুনাইলো তাহার কাহিনী।

মন্দির হইতে পালাইয়া তাহারা অম্বুবাচির বক্ষে ক্ষুদ্র একটি ডোঙ্গায় করিয়া ভাসিয়া যাইতেছিল। অকস্মাৎ একদল দস্যু আসিয়া উপস্থিত হয়। সমুদয় স্বর্ণালংকার কাড়িয়া লইয়া তাহাদের মাঝ নদীতে মরিবার জন্য রাখিয়া যায় দস্যুদল। নৌকায় খাদ্য নাই, জল নাই, নাই কোন বৈঠা। তাহার পর ঝড় উঠিলো। সেই ঝড়ে ছত্রখান হইলো ডোঙা।

তারার কথা শুনিতে শুনিতে বুঝিতে পারিনাই কখন যে প্রধান পুরোহিত আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন আমার কক্ষের দ্বারে। তাহার চক্ষুদ্বয় হইতে যেন অগ্নি বর্ষিত হইতেছে। আমার দিকে তাকাইয়া কেবল একটি কথাই কহিলেন তিনি,

“আইসো আমার সাথে। পাপিষ্ঠাকে লইয়া যাই যূপকাষ্ঠে।”

আমি অনুনয় করিলাম, মিনতি করিলাম, কাঁদিলাম বক্ষ বিদীর্ণ করিয়া। কিন্তু বিধান, সেতো বিধানই। তারা কোন কথা কহিলো না।

যূপকাষ্ঠে আমার মা কে রাখিয়া খড়গ হস্তে দাঁড়াইলাম পাপিষ্ঠ আমি।

পরদিন আষাঢ়স্য প্রথম দিবস। অম্বুবাচি যথা নিয়মে লোহিত বর্ণ ধারণ করিলো। সেই জলে মিশিয়া গেলো আমার দুই মাতার শোণিত। মা শক্তি আর মা তারা।

বলির পূর্ব মুহূর্তে মা আমার কহিয়াছিলো,

উকুলি মুকুলি দুকুলি কাঁহি
নাক দৌ দৌ দোমৰ দাঁহি
কি কি চৰাই কি কি নাও
সোনৰ চৰাইৰ কথা কও

সুন্তি পান্তি ৰজা ঘৰৰ ধোমতি।

অর্থহীন একটি ছড়া। শিশুকালে খেলিতে খেলিতে তারা আপন মনে গুনগুন করিয়া গাহিতো।

সেই কালখড়গ নামাইয়া আনিতে আনিতে একবার যেন শুনিলাম তারা বলিলো, তিনি বাঁচিয়া আছেন।

এই পুঁথির পাঠোদ্ধার যিনি করিতে পারিবেন তাঁহার নিকট আমার আকুল নিবেদন, সেই পাষণ্ডকে যেন খুঁজিয়া বাহির করেন যাহার কারণে বৃদ্ধ বয়সে আমি পুনর্বার অনাথ হইয়াছি। পারিলে যেন ফিরাইয়া আনেন সতীর বালা। নইলে জগতে ধ্বংস অনিবার্য।”

কিশোরীমাধব হতভম্ব হয়ে বসে রইলো কিছুক্ষণ। একবার ভাবলো পার্থ সারথি বসু নামের এই সেবক হয়তো বানিয়ে বানিয়ে একটি গপ্ল লিখেছে। সন্ন্যাস জীবনের একঘেয়েমি ঘোচানোর জন্য কতো কিছুই তো করে মানুষ! গর্ভগৃহের স্বর্ণালংকার চুরি যাওয়ার মতো এতো বড় একটা ঘটনা নিশ্চয়ই এতদিন ধরে চাপা থাকতে পারে না। কিন্তু পরক্ষনেই মনে পড়লো স্বপ্নে দেখা সেই কিশোরীর কথা। এক্কা দোক্কা খেলতে খেলতে যে ছড়াটি সে বলেছিলো, পুঁথির শেষে সেই ছড়াটিই তো লেখা রয়েছে অসমীয়া ভাষায়!

কামাখ্যা মন্দিরে একবার তাকে যেতেই হবে।

---চলবে

প্রথম কিস্তির লিংক
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/57288

দ্বিতীয় কিস্তির লিংক
http://www.sachalayatan.com/guest_writer/57308#new


মন্তব্য

এক লহমা এর ছবি

"এইক্ষনে বলিয়া রাখি একটি কিংবদন্তির কথা। বিষ্ণুর চক্রে ছিন্নভিন্ন সতীর হস্ত দুইখানি আসিয়া পড়িয়াছিলো কামাখ্যায়। সেই হস্তে শোভিত ছিলো এক জোড়া স্বর্ণমণ্ডিত বালা। স্বয়ং শিব দিয়াছিলেন সতীকে, বিবাহের উপহার।" - কামাখ্যায় যে দেহাংশ পড়েছিল বলে এতাবৎকাল শুনে বা পড়ে এসেছি, সে তো হাত নয়! বর্তমান গল্পের কিংবদন্তীর উৎস কি?

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনি ধরে ফেলেছেন ঠিক ঠিক। যে অঙ্গ এসে পড়েছিলো তা লিখতে গিয়ে লিখতে পারলাম না। প্রথমত বাঙালি মধ্যবিত্তের চিরায়ত সুশীলতা। দ্বিতীয়ত, গল্পের গরু ঠেলে নদীতে আনা। যে কারণে পুরাণ না বলে কিংবদন্তী বলেছি। এক্ষেত্রে লীলেনের একটা কথা উল্লেখ করতে পারি। একবার দেবদেবী সংক্রান্ত একটা ঘটনা উল্টে পাল্টে নিজের ইচ্ছে মতো লিখে ওকে বললাম, আচ্ছা জ্ঞানী লোকেরা যদি ক্ষেইপা যায়? তখন লীলেন জবাব দিলো, তাইলে জিগাইও তোমার কথা যে ঠিক না সেইটা প্রমাণ করতে।

যাই হোক, আগে গল্প শেষ করি। তারপর প্রয়োজন মাফিক ডিটেইলের কাজগুলো সম্পাদনা করতে বসবো। গল্প কেমন লাগছে বললেন না তো এক লহমা!

---মোখলেস হোসেন

এক লহমা এর ছবি

গল্প কেমন লাগলঃ
(১) গল্প লেখা - আপনি গুছিয়ে লেখেন। সেটা পেয়েছি।
(২) গল্প বলা - আপনি গুছিয়ে বলেন। সেইটা এবার ছড়ানো লেগেছে। দক্ষ-শিব-সতী-বিষ্ণু কাহিনীকে এই গল্পের জন্য জরুরী হিসেবে উপস্থাপন করতে গিয়ে গল্পের বুনট ঢিলে হয়েছে বল মনে হয়েছে। ঐ অংশে কাহিনীরও গোলমাল লেগেছে।সেটাও খানিকটা অস্বস্তি ঘটিয়েছে। আমি এই গল্পের সম্পাদক হলে এই অংশ নির্মমভাবে ছেঁটে ফেলে কাহিনীকে কামাখ্যার বদলে অন্য কোথাও ঘটাতাম।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ এক লহমা। সম্পাদনার কথাটা আমারও মনে হয়েছে। এই কিস্তির শুরুতেই তার উল্লেখ করেছি। লেখা শেষ করে আমিও চেষ্টা করবো যতোটা সম্ভব নির্মম হতে।

---মোখলেস হোসেন

আয়নামতি এর ছবি

উল্লেখিত কিংবদন্তির কিছুই জানিনা, আর গল্পের ভেতর আরেক গল্পের দেখা পাওয়াটা মন্দ লাগেনি। গল্পের পরিণতি জানার অপেক্ষায় থাকলাম।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ আয়নামতি। আমারও ওই একই কথা। আগে গল্প শেষ হোক।

---মোখলেস হোসেন

সোহেল ইমাম এর ছবি

দুর্দান্ত চলছে কাহিনি, অনেকদিন পর এসে পেড়ে মনটা ভরে গেলো।

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

অতিথি লেখক এর ছবি

ধন্যবাদ সোহেল ইমাম। অনেকদিন হয়ে গেলো আপনার লেখা পড়ি না। কেন যেন মনে হয় রিচার্ডকে নিয়ে অনেক কিছু লেখার ছিলো আপনার। লিখবেন দয়া করে।

---মোখলেস হোসেন

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।