দেশ থেকে দেশে

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: শনি, ০২/০৫/২০২০ - ১২:৩৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই দেশ ছেড়ে যাচ্ছি। সিদ্ধান্তটা একরকম হুট করেই নেয়া। আট বছর এক দেশে থাকার পর কোনো প্রস্তুতি ছাড়া আরেক দেশে যাওয়াটা ঝামেলার ব্যাপার। এখন যাচ্ছি অনেক উত্তরে। প্রথম কয়েক দিন তেমন কিছু টের পাই নি, এখন বেশ খারাপ লাগছে। এই আট বছরে কত স্মৃতি, কত মানুষের সাথে পরিচয়, কত সুখ দুঃখের ঘটনা। আমার এই এক সমস্যা, কোনো কিছু একবার ব্যবহার করলে তার প্রতি মায়া জন্মে যায়। যেকোনো কিছু একবার ব্যবহার করলে তার প্রয়োজন শেষ হলেও মায়া কাটেনা। এইকারণে কলম, ক্যালেন্ডার, নষ্ট হেডফোন, কিছুই ফেলি না, জমিয়ে রাখি। জিনিসপত্র যা ছিল বেশিরভাগই দান করে দিয়েছি আশেপাশের মানুষদের। দিয়ে দেয়ার সময় যথেষ্ট মন খারাপ হয়েছে। মনে হয়েছে, আহা কিছুদিন আগেও তো কি সুন্দর এইসব ব্যবহার করতাম। মানুষের ভালোবাসা শুধু জীবের প্রতি না, জড়ের দিকেও প্রবাহিত হয়। শেষবার যেই বাসায় ছিলাম, তাতেই কাটিয়ে দিয়েছি একটানা পাঁচ বছর। কত রাত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিয়ে, হৈ হল্লা করে, রান্নাবান্না করে এই বাসায় কাটিয়ে দিয়েছি কিন্তু আজকে থেকে আর এই বাসায় ফেরা হবেনা। বাসা থেকে শেষবার বেরোনোর সময় মনে হয়েছে হাউমাউ করে কিছুক্ষন কাঁদি। মানুষের জীবনটাই এমন, যা করতে মন চায় তা করা যায়না। কাছের বন্ধুবান্ধব অনেকেই এয়ারপোর্টে এলো। বন্ধু মাহবুব ঠাট্টা মশকরা শুরু করলো, বললো "ধুর শালা কুক করলে ফিনল্যাণ্ড থিকা শুনা যায় আর তুই মেয়েমানুষের মতো কান্নাকাটি শুরু করছত। আগে গিয়া গুছগাছ কর এরপরে আইতাসি আগামী মাসে, অবশ্য আইসা কোনো ফায়দা নাই, সুন্দরী মেয়েমানুষ ওই দেশে নাই বললেই চলে, খামাখা পয়সা নষ্ট, তবুও দেখি চইলা আসমু আগামী মাসেই। আর সাউনা জিনিষটা কি বুঝা দরকার, গিয়াই খোঁজ খবর নিবি কি সমাচার"। বাকিদের মধ্যে কেউ সান্তনা দিল, কেউ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। একসময় সবাই বিদায় নিলো।

"এয়ারপোর্ট" জিনিষটা আমার ভালোই লাগে। অনেকের কাছে এয়ারপোর্টে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করা নরক যন্ত্রণার সমান। এই কারণে পয়সা বেশি খরচ করে তারা কম ট্রানজিটের বিমান নেন। আমার কাছে দুধভাত। বিমানবন্দরের ব্যস্ততা, বিমানের উঠানামা, যাত্রীদের কোলাহল সবই ভাল লাগে। হুট করে একটা কাউন্টারে লোকজন জড়ো হওয়া শুরু করে, ঘন্টাখানেক পর পুরো কাউন্টার ফাঁকা, ইতিমধ্যে সবাই উড়াল দিয়ে দিয়েছে। কেউ হয়তো যাবে দুবাই, কেউ জাপান, আমেরিকা, বা অস্ট্রেলিয়া। বিমানের উঠানামার দেখার মধ্যেও মজা আছে। বিমান আকাশে টেক অফ করার সময় কেমন জানি বীরের মতো আকাশে উঠে যায় কিন্তু নামার সময় অনেকটা ভীতু ভীতু লাগে, মনে হয় এই বুঝি মাটিতে আছড়ে পড়লো। বাস্তবে, যাত্রী হিসাবে বিমান ভ্রমন করার সময় আমার একটু ভয় ভয় লাগে, অনেকসময় টেক অফ করার সময় ভয়ে আর উত্তেজনায় পাশের যাত্রীর হাত ধরে ফেলি, এতে তারা বিব্রত হন। একবার বার্লিন থেকে মিলান যাওয়ার সময় উল্টো ঘটনা ঘটলো। ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে এর মধ্যেই বিমান টেক অফ করলো, পাশে বসা মহিলা সজোরে আমার হাত চেপে ধরলেন। একটু পরে অবশ্য লজ্জিত হয়ে ছেড়ে দিলেন। তবে আমার ভালো লেগেছে এইকারণে যে ভয় শুধু আমি একলা পাই না, আরো লোকজন আছে। একজন পাইলটের সাক্ষাৎকার দেখেছি যেখানে উনি বলছিলেন যে বিমান ল্যান্ড করানোটা সব পাইলটদের জন্যই অনেক চ্যালেন্জিং। কিন্তু যাত্রাপথের পুরো সময়টা অস্বস্তিতে থাকা আমার ল্যান্ড করার সময়ই খুব ভালো লাগে।এইতো আর কিছুক্ষন, এরপরেই শান্তি। বুক থেকে পাথর নেমে যাবার সমান অনুভূতি হয়। জানালা দিয়ে দেখা দূরের অস্পষ্ট নগরী আস্তে আস্তে স্পষ্ট হয়ে আসে।

বিমান ভ্রমণ আমার মতে পৃথিবীর সবচেয়ে বাজে ভ্রমণ। কেন জানি ভ্রমণকালীন কোনো কিছু করে শান্তি পাওয়া যায়না। কোনো কিছু ভাল লাগেনা। খেতে ভাল লাগেনা, ঘুমাতে ভালো লাগেনা, বই পড়তে ভাল লাগেনা, এমনকি সিনেমা দেখতেও ভাল লাগেনা। এইকারণে ভ্রমণের পুরো সময়টা কাটে অশান্তিতে। কিছু মানুষ আছে যারা বিমানে উঠা মাত্র নাক ডেকে ঘুম দেন, তাদের ঘুম ভাঙে বিমান ল্যান্ড করার আগে আগে। আমি ঘুমাতে পারি না। ইতিউতি করে এদিক ওদিক তাকিয়ে সময় পার করি। বিরক্তিকর ব্যাপার। এবার অন্য ঝামেলাও আছে। আমাকে এয়ারপোর্ট থেকে বাসায় নিতে আনা নামের এক মেয়ের আসার কথা, আসবে কিনা কে জানে। ইমেইলে বাসা কনফার্ম করা। সে হচ্ছে বাসার মালিকের নাতনি। তার দাদির একটা বাড়ি আছে শহরের একটু বাইরে। আপাতত ওখানেই উঠছি। ঘন্টা তিনেক পর এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করে বাইরে বেরিয়েই আনাকে দেখলাম, যাক এসেছে তাহলে। টুকটাক আলাপের পর তার গাড়িতেই চললাম গন্তব্যে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতেই দেখি মানুষজনের ভিড় তেমন নেই। রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। ইতালি, জার্মানি বা ফ্রান্সের বড় শহরগুলাতে লোকজনের ভিড় লেগেই থাকে, সেই তুলনায় স্ক্যান্ডিনেভিয়া আর বাল্টিক দেশগুলোতে মানুষজন খুব একটা চোখে পড়েনা। শহরের বাইরে গেলে তো শ্মশান। কোনো যানজট ছাড়াই গাড়ি সামনে এগিয়ে চলছে। প্রচুর পার্ক আর জঙ্গল দেখা যাচ্ছে রাস্তার দুপাশে। ইউরোপের উত্তরের দেশগুলোর সৌন্দর্য এখানেই, বিশুদ্ধ বাতাস, বিশুদ্ধ পানি আর চারদিকে প্রচুর গাছপালা, একটু বেশি ই প্রাকৃতিক। শেষপর্যন্ত যেই বাড়ির সামনে গাড়ি এসে থামলো, এটা কি বাড়ি নাকি হরর মুভির সেট কিছুই বুঝলাম না। জঙ্গলের পাশে পুরানা আমলের দোতালা বাড়ি, চারদিকে দুনিয়ার গাছপালা, দেখে মনে হয় ঠিকমতো পরিষ্কারও করা হয়না, লম্বা লম্বা ঘাস দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে বাড়িঘরের নাম নিশানাও নাই। বাড়িতে ঢুকার আগেই মনটা কেমন কেমন করতে লাগলো। আমার অবস্থা টের পেয়ে আনা বললো "তোমাকে দেখে উদ্বিগ্ন মনে হচ্ছে, চিন্তার কিছু নাই। তোমার জন্য উপরতলায় থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। নিচে থাকে এক চাইনিজ ছেলে, পিটার নাম। তার সাথে আমার ফোনে কথা হয়েছে, বাইরে গেছে, এসে পড়বে কিছুক্ষনের মধ্যেই। তুমি ভিতরে গিয়ে রেস্ট নাও, আমি উইকেন্ডে এসে আবার দেখা করবো"। একবার মনে হলো বলি যে, আরেকটু থাকো আমার ভয় ভয় লাগছে, আবার মনে হলো মেয়েমানুষের সামনে এইসব বলা মানে ইজ্জত পাংচার। "ওকে" বলে বিদায় দিলাম। পিটার কোনসময় আসবে কে জানে। এদিকে চারদিক অন্ধকার হয়ে আসছে।

ঝাড়া দুই ঘন্টা বাসার সামনে চাবি নিয়ে শীতের মধ্যে বসে থাকলাম, পিটারের দেখা নাই। একলা এই বাসার মধ্যে ঢুকা অসম্ভব। ভয়েই তো মারা যাবো। তাছাড়া আশেপাশের জঙ্গল থেকে অদ্ভুত সব আওয়াজ আসছে। হিংস্র কিছু আছে কিনা কে জানে। শেষপর্যন্ত পিটারকে দেখা গেলো। একবার মনে হলো ঝেড়ে একটা ধমক দেই, পরে সামলে নিলাম। দিনকাল আর আগের মতো নাই। চাইনীজরাও আগের মতো মিনমিনে নাই। তাছাড়া দূর থেকে দেখা যাচ্ছে পিটারের মাথায় চুল নাই। কোথায় যেন শুনেছি, বেল মাথা চাইনিজ ভয়ঙ্কর। কথা মনে হয় সত্য। কিছুদিন আগে একটা চাইনিজ মুভি দেখছিলাম, একশন মুভি। ওই মুভিতেও বেল মাথা এক ভিলেন ছিল। এরে মারে তারে ধরে, বিরাট গুন্ডা। শেষ পর্যন্ত সামান্য কারণে সবচেয়ে কাছের বন্ধুকে খুন করে ফেলে। খোদা না করুক পিটার যদি এই বাসায় আমাকেও মেরে গুম করে ফেলে, কেউ টেরও পাবেনা। ঝামেলায় যাওয়ার দরকার নাই। হাই হ্যালো বলার পর একসাথে বাসায় ঢুকলাম। যা ভেবেছিলাম তাই, বাসা অনেক পুরানো, সামান্য হাঁটাচলা করলেও ক্যাচক্যাচ শব্দ হয়। তাছাড়া রুমের মধ্যে কেমন জানি একটা গুমোট গন্ধ, অনেক পুরানো প্যালেসে এই জাতীয় গন্ধ পাওয়া যায়। নিচতলায় পিটারের রুম, বাথরুম আর রান্নাঘর, উপরের তলায় আমার দুইটা ছোট ছোট রুম। বাসায় বিদ্যুৎ আছে তবুও কেমন যেন অন্ধকার অন্ধকার ভাব। পাশের জঙ্গল থেকে অনবরত নানা ধরণের শব্দ আসছে। এই পাখির ডাক, এই ঘড়ঘড় শব্দ। পিটার এই বাসায় এতদিন একা একা কিভাবে থেকেছে কে জানে। শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে আসছে। মনে হচ্ছে এখনই শুয়ে পড়ি। তবুও বাথরুমে গিয়ে গোসল করে টুকটাক খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ঘুম এলো না , এপাশ ওপাশ করতে লাগলাম। মাঝরাতে বিকট স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙে গেলো। স্বপ্নে দেখলাম "পিটার দুই হাতে বড় দুই বাঁকানো ছুরি নিয়ে আমাকে খুন করতে আসছে। তার হাবভাব সিনেমায় দেখা সেই ভিলেনের মতো, সারা গায়ে উল্কি আঁকা। ছুরির গায়ে বড় করে লেখা মেড ইন চায়না"। কেমন জানি অস্বস্থি লাগতে লাগলো। ঘুমানোটা আমার জন্য জরুরি। একেতো শরীর অনেক ক্লান্ত তার উপর কালকে অনেক কাজ, সকালে উঠেই বেরিয়ে পড়তে হবে। শেষে বাতি জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম।

সকালে ঘুম থেকে উঠে অনেক ফ্রেশ লাগলো। নিচতলায় নেমেই দেখলাম পিটার রান্নাবান্না করছে। আমিও রেডি হয়ে নাস্তা করে বেরিয়ে পড়লাম। অফিসে আজকে প্রথম দিন। ভাবটা আগে বোঝা দরকার। বসের রুমে গিয়ে হাজির হলাম। উনার নাম হান্না, বয়স চল্লিশের মতো। আমাকে উনি ফিনিশ কালচার আর রীতি নীতি সম্পর্কে ধারণা দিলেন। বললেন ফিনিশরা তুলনামূলক কম কথা বলে, এইখানে সবাই পার্সোনাল স্পেস মেইনটেইন করে এইসব হাবিজাবি। একবার মনে হলো বলি যে, কথা কম কেন বলে? সবার গলায় ব্যথা? দুনিয়া চলে কথার উপরে। পরে ভাবলাম বলাটা ঠিক হবেনা। মাইন্ড করে বসতে পারে। কাজ সম্পর্কে কথা অল্পই বললেন। বললেন যে, কয়েকদিন আগে ঘুরাঘুরি করো, সবার সাথে পরিচিত হও, তারপর শুরু করা যাবে। কিছু বুকলেট হাতে ধরিয়ে ডেস্কে গিয়ে পড়তে বললেন। দুই একজন কলিগের সাথে পরিচয় হলো। এরমধ্যে একজন ইতালিতে চার বছর কাজ করে এসেছে, একারণেই মনে হয় প্রচুর কথা বলে। আবহাওয়া আর খাওয়াদাওয়া নিয়ে অনেক কথা হলো। বিকেলে বাসায় ফিরে হাটতে বের হলাম। রাস্তায় মানুষজন নেই বললেই চলে। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে রাস্তা। একবার মনে হলো যাই দেখে আসি ভিতরে কি আছে, আবার মনে হলো দরকার নাই, অচেনা রাস্তা, হারিয়ে গেলে বিপদের সমূহ সম্ভাবনা। জঙ্গলের পাশ দিয়ে হাটতে লাগলাম। বেশ ভাল লাগলো। অচেনা সব বড় বড় গাছ, ঝোপঝাড়ে ভর্তি, নানান রঙের ফুল। নতুন অনেক পাখি দেখলাম। কালেভদ্রে দুই একজন রাস্তায় দেখা গেল। সন্ধ্যার আগে আগে ঘরে ফিরে আসলাম।

জীবন ধরাবাধা হয়ে গেছে। একই কাজ বারবার করা, একই দিনের পুনরাবৃত্তি করা, মাকুর মতো একই চক্রে ঘুরা। রুটিনটা এরকম, সকালে উঠে অফিসে যাই। সারাদিন পার করে ক্লান্ত হয়ে বিকেলে ঘরে ফিরি, ফিরেই বাইরে হাঁটতে বেরিয়ে পড়ি - যা দেখি তাই ভাল লাগে। সন্ধ্যার পর পর বাসায় এসে রান্নাবান্না করে খেয়েদেয়ে ঘুম। মাঝেমধ্যে বই পড়া, সিনেমা দেখা, পিটারের সাথে গল্পগুজব করা। এক মাস পর হটাৎ জ্বরে পড়লাম। আগের রাতে ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করার কারণেই বোধহয় কাঁপিয়ে জ্বর আসলো। সারাদিন শুয়ে বসে থাকি, কিছু করতে ভাল লাগেনা। খাওয়াদাওয়ার একটু সমস্যা যাচ্ছে। ফ্রিজ ভর্তি পিটারের খাবার দাবার। আমার কিছু রাখার জায়গা নাই। শুকনো খাবার আর ফল দিয়ে এতদিন পার করেছি। একবার ভাবলাম কিছু একটা রান্না করে খাই। রান্না শুরু করার আগে মাথা চক্কর দিতে উঠলো। বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লাম। পিটার বললো, বন্ধু, চিন্তার কিছু নাই , আমার খাবার মানে তোমার খাবার, যা দরকার ফ্রিজ থেকে নিয়ে খাবে, কোনো সমস্যা নাই। আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম যে তার প্রয়োজন নাই, ফ্রিজটা একটু খালি রাখলেই খুশি হবো। এই ছেলের সঙ্গে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলছি। এর প্রধান কাজ তিনটা, দিনের বেশিরভাগ সময় ঘুমিয়ে থাকা, সন্ধ্যার পরে গাজা খাওয়া, আর রাতে নতুন নতুন মেয়েমানুষ ঘরে নিয়ে এসে ফুর্তি করা। একেক দিন ঘরে একেক মেয়ে দেখে একটু অবাকই লাগে, সারাদিন ঘুমিয়ে থেকে এই ছেলে এইসব মেয়ে কিভাবে জোগাড় করে সে এক রহস্য। আর তার অপ্রধান কাজ হচ্ছে সময়ে অসময়ে আমার রুমে উঁকি মারা। যদি দেখে কিছু করছি না তাহলে গল্প জুড়ে দেয়া। কখনো তো একে পড়াশুনা বা কাজকর্ম করতে দেখি না। তাহলে করছেটা কি এই দেশে কে জানে। গতকাল সকালে বাথরুমে গোসল করতে ঢুকে দেখি আরেক মেয়ে গোসল করছে, ছিটকিরিও লাগায় নি। ছিটকে বেরিয়ে এলাম। লজ্জা লাগলো আবার রাগও উঠলো। আরে বেটা তুই যাকে খুশি তাকে ঘরে আন, কোনো সমস্যা নাই কিন্তু আমাকে বলবি তো আগে। বিকালে জিজ্ঞাসা করায় বললো, "কিছু ভালো লাগেনা বন্ধু, কি করি বল? এই টুকটাক ফান করি আরকি"। খোঁজ নিয়ে জানলাম সে এইদেশে এসেছে এইসব করার জন্যই। তার বাবা চায়নার অনেক বড় বিজনেস টাইকুন। আচ্ছা টাইকুন জিনিসটা কি? সম্ভবত বেশুমার টাকাপয়সা থাকলে তাকে টাইকুন বলে। একটু কথা বার্তা না বললে খারাপ দেখা যায়, এইকারণে বললাম , "পিটার" তো চাইনিজ নাম না, তোমার আসল নাম কি? বললো চান ওয়েন। নাম পরিবর্তনের কারণ জিজ্ঞাসা করাতে বললো আসার আগেই আমাদের স্থানীয় একটা নাম পছন্দ করতে হয় ঝামেলা এড়ানোর জন্য। রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়েও টুকটাক আলাপ হলো। জানলাম, কিভাবে চায়না তার বিশাল জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করেছে, গণতন্ত্র চর্চা না করেও কিভাবে তার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রেখেছে। এইসব শুনা মানে ঘনঘন দীর্ঘশ্বাস ফেলা। আমাদের দেশে কোনো তন্ত্রই কাজ করেনা। আরো কিছুক্ষন আলাপের পর সে তার রুমে ফেরত গেলো। আমি একটা বই নিয়ে বসলাম, দেখি ভাল লাগে নাকি।

বন্ধু মার্কাসের পরামর্শে একটা বই পড়া শুরু করেছিলাম। টোভ জানসনের দি মুমিনস এন্ড দি গ্রেট ফ্লাড। আগে খুব একটা ভালো লাগে নাই, জ্বর গায়ে পড়তে বেশ লাগছে। একটা জিনিস খেয়াল করেছি যে জ্বর গায়ে বই পড়ার রুচি অনেকটাই বদলে যায়। তখন ভালো না লাগা বইও পড়তে ভালো লাগে। টোভ জানসনের "মুমিনস" ফিনল্যাণ্ড সহ স্কান্ডেনেভিয়াতে তো বটেই, এমনকি বাল্টিক দেশগুলোতেও অনেক জনপ্রিয়। এই সিরিজের মোট নয়টা বইসহ কমিক্স এমনকি টিভি সিরিজও আছে। ইউটিউবে কয়েকটা ভিডিও দেখলাম। এদের থিমটা বেশ ভাল লাগলো। মুমিন হচ্ছে জলহস্তীর মতো দেখতে একটা প্রাণী যে কিনা প্রকৃতির সাথে মিলেমিশে পরিবার আর বন্ধুদের নিয়ে মুমিনভ্যালি তে থাকে। মাঝে মধ্যে তারা এডভেঞ্চারের নেশায় মুমিনভ্যালি ছেড়ে দলেবলে বেরিয়ে পড়ে।

পুরোপুরি সুস্থ হতে মোটামুটি এক সপ্তাহের মতো লাগলো। এই কয়দিনে বই পড়া আর বিকালে বাইরে ঘুরতে যাওয়া ছাড়া তেমন কিছুই করা হয়নি। নিঃসঙ্গতা অনেক খারাপ জিনিস, জ্বরের চেয়ে এটাই ভুগিয়েছে বেশি, সামনে হয়তো আরো ভোগাবে। সারাদিন কাজ করে শূন্য ঘরে ফিরতে ইচ্ছে করেনা। তবুও ফিরতে হয়, অনিচ্ছার কাজ করতে হয়, সবাইকে খুশি রাখতে হয়, নিজে খুশি থাকার ভান করতে হয়, নতুন দিনে বিগত দিনের পুনরাবৃত্তি করতে হয়, এর নামই জীবন।

এক বছর পার হয়েছে। এই সময়ে কাজের ব্যস্ততা অনেক গুণ বেড়েছে। ইতালি থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধবরা সবাই এসে বেড়িয়ে গিয়েছে। পিটার তার এক ডাচ বান্ধবীকে নিয়ে আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছে। আনা তার বয়ফ্রেন্ডকে নিয়ে পিটারের রুমে এসে উঠেছে। আমি চলে এসেছি সিটি সেন্টারের কাছাকাছি, অফিস থেকে হাঁটা দূরত্বে। যদিও আগের মতো বিকালবেলা জঙ্গলের পাশ দিয়ে হাঁটা হয়ে উঠে না। তবুও ঘুরাঘুরি থেমে নেই, এরমধ্যে কয়েকবার ঘুরে এসেছি বাল্টিক দেশ এস্তোনিয়া আর লাটভিয়া থেকে। অফিসে কথাবার্তা চলছে, সম্ভবত মাস দুয়েকের মধ্যে তারা আমাকে পাঠিয়ে দেবে এস্তোনিয়াতে। এখানের পাঠ শেষ করে চলে যেতে হবে নতুন দেশে, নতুন পরিবেশে। শুরু হবে নতুন কোন গল্প। এইভাবে পরিবর্তন চলতেই থাকবে, এক দেশ থেকে আরেক দেশে, এক সময় থেকে অন্য সময়ে।

রকি


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

অনেকদিন পর খুবই ভালো একটা লেখা পড়লাম। আপনার আরো লেখা পড়তে চাই। বিষন্নতা, ফানি আর বিভিন্ন দেশের আর মানুষের ভিন্ন ভিন্ন আচার আপনার দৃষ্টিতে দেখতে চাই। ভালো থাকবেন।

রকি এর ছবি

অনেক অনেক ধন্যবাদ মাহবুব ভাই। হাসি
রকি

কর্ণজয় এর ছবি

বাহ্!
মানুষের গল্প, চলে যাওয়া
এক বাস্তবতা থেকে আরেক বাস্তবতায়
এক সত্য থেকে আরেক সত্যে
ক্রমাগত
নতুন কোন গল্পের খোঁজে-
গল্পটা আসুক

রকি এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ। হাসি
রকি

সোহেল ইমাম এর ছবি

বাহ!! চমৎকার, চলুক লেখা। চলুক

---------------------------------------------------
মিথ্যা ধুয়ে যাক মুখে, গান হোক বৃষ্টি হোক খুব।

রকি এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ।
রকি

এক লহমা এর ছবি

লেখা ভালো লেগেছে।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

রকি এর ছবি

হাসি হাসি হাসি

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

টোভ জানসনের "মুমিনস" ফিনল্যাণ্ড সহ স্কান্ডেনেভিয়াতে তো বটেই, এমনকি বাল্টিক দেশগুলোতেও অনেক জনপ্রিয়। এই সিরিজের মোট নয়টা বইসহ কমিক্স এমনকি টিভি সিরিজও আছে।

এটুকু পড়ে একটা কথাই মনে আসল- কস্কি মমিন!

দেশান্তরের নতুন গল্প শুরু হোক। পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

রকি এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ। হাসি

তিথীডোর এর ছবি

আপনার আরো লেখা পড়তে চাই। হাসি

________________________________________
"আষাঢ় সজলঘন আঁধারে, ভাবে বসি দুরাশার ধেয়ানে--
আমি কেন তিথিডোরে বাঁধা রে, ফাগুনেরে মোর পাশে কে আনে"

রকি এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ। হাসি

জিপসি এর ছবি

অনেকদিন পর একটানে কিছু একটা পড়ে শেষ করলাম। বেশ লেগেছে। কিছু কিছু লাইন তো মারাত্মক রকমের ধাক্কা দিয়ে গেল মাথার নিউরনে।

------------------------------------------------------------------------------
জিপসিরা ঘর বাঁধে না,
ভালবাসে নীল আকাশ

রকি এর ছবি

পড়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ জিপসি।

নৈ ছৈ এর ছবি

খুব ভাল লাগলো পড়ে। দুই জায়গায় “মেয়েমানুষ” শব্দের ব্যবহার কি ইচ্ছাকৃত?

সুমন চৌধুরী এর ছবি

খুবই ভালো লাগলো।

অর্ণব এর ছবি

অনেক ভালো লাগলো। আপনার আরো লেখা চাই।

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকদিন পর সচলায়তনে ঢুক্লাম,আর ঢুকেই আপনার লেখাটা পড়ে খুব খুব ভালো লাগলো, কেন জানি খুব রিলেট করতে পারলাম, স্নিগ্ধ একটা বিষন্নতার ব্যাপার আছে, বোঝাতে পারছি না
অনন্যা

অতিথি লেখক এর ছবি

অনেকদিন পরে সচলায়তনে ঢুঁকে একটা ভালো লেখা পড়লাম। আপনার কাছ থেকে আরও সুন্দর সুন্দর লেখা কামনা করছি।

রিফাত জাহান

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।