নগরী ঢাকা ৩

অতিথি লেখক এর ছবি
লিখেছেন অতিথি লেখক (তারিখ: রবি, ২৬/০৭/২০২০ - ৩:৪০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ইউএন হ্যাবিটেট বা জাতিসংঘ বসতি টেকসই প্রতিবেশ পরিকল্পনার (sustainable neighbourhood planning) উদ্দেশ্যে নতুন যে কৌশলপত্র প্রকাশ করেছে সেখানে নিচের পাঁচটি নীতিকে গুরুত্বপূর্ণ ব’লে ঘোষণা করছে-
১. রাস্তা আর রাস্তার নেটওয়ার্কের জন্য পর্যাপ্ত জায়গা : রাস্তার নেটওয়ার্কের জন্য মোট জমির অন্তত ৩০ শতাংশ থাকা দরকার। সেই সাথে প্রতি বর্গকিলোমিটারের জন্য কমপক্ষে ১৮ কিলোমিটার লম্বা রাস্তা থাকতে হবে।
২. অধিক জনঘনত্ব: প্রতি বর্গকিলোমিটারে অন্তত ১৫,০০০ মানুষ। সেই হিসাবে প্রতি হেক্টরে ১৫০ জন বা প্রতি একরে ৬১ জন।
৩. জমির মিশ্র-ব্যবহার: যে কোনো প্রতিবেশে মেঝের (floor area) মোট পরিমাণের অন্তত ৪০ শতাংশ অর্থকরী কাজে ব্যবহারের জন্য রাখা উচিৎ।
৪. সামাজিক সংমিশ্রণ (মিক্সের বাংলা হিসেবে সংযোগও হ’তে পারে এক্ষেত্রে): প্রতিটা প্রতিবেশে বিভিন্ন দাম আর মেয়াদের বাসার সংস্থান থাকতে হবে যেন তা নানা আয়সীমার মানুষকে আবাসন সুবিধার আওতায় আনতে পারে। আবাসনের জন্য থাকা মোট মেঝের অন্তত ২০ থেকে ৫০ শতাংশ নিম্ন-আয়ের মনুষের আবাসনের জন্য (লো-কস্ট হাউজিং) রাখা উচিত। আর বিশেষ কোনো মেয়াদী-নমুনাই (টাইপ) পুরো প্রকল্পের অর্ধেক হওয়া বাঞ্ছনীয় নয়।
৫. জমির নির্দিষ্ট ব্যবহারের সীমা: একটা জায়গা বা প্রতিবেশকে একটি নির্দিষ্ট ব্যবহারের জন্য গ’ড়ে না তোলার জন্য; কোনো একটা উদ্দেশ্য (ফাংশন) সমাধার জন্য তৈরী করা ব্লক যেন কোনো প্রতিবেশের মোট জায়গার ১০ শতাংশের বেশি জায়গা নিয়ে না নেয়।

যেহেতু সারা পৃথিবী জুড়েই নগরীর চৌহদ্দি বাড়ছে, বলা হচ্ছে ২০৫০ সাল নাগাদ পৃথিবীর মোট মনুষ্য জনসংখ্যার অর্থেকই নগরে বাস করবে, সেই হেতু ভবিষ্যতের নগরীকে কিভাবে টেকসই হিসেবে গ’ড়ে তোলা যায় সেটা এই সময়ের একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। জাতিসংঘ বসতি এই ব্যাপারটা নিয়ে অনেক দিন ধরেই কাজ করছে। বিভিন্ন সময়ে তারা এই বিষয়ে অনেক ধরণের গবেষণা-পত্র প্রকাশ করেছে। টেকসই প্রতিবেশ বা পাড়া নিয়ে তাদের কিছু আলোচনার সাথে ঢাকার বর্তমান আর ভবিষ্যতের বেড়ে ওঠার ধরণ/ধরণগুলোকে মিলিয়ে দেখার একটা চেষ্টা এই লেখাটা।
নেইবারহুড ব’লতে পাড়া, মহল্লা বা প্রতিবেশ যা-ই বলি না কেন নগরের চরিত্র তৈরীতে এটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একটা সময় নারিন্দা আর গ্যান্ডারিয়া মহল্লাগুলোর চরিত্র বেশ আলাদা ক’রেই সনাক্ত করতে পারতেন এর অধিবাসীরা। এখনো হয়তো মিরপুর আর ধানমন্ডির বৈশিষ্ট্যগুলোও বেশ মোটাদাগেই সনাক্ত করা যায়। এই মোটাদাগের একটা বিষয় হ’লো এই জায়গাগুলোর রাস্তাগুলো। তুলনামূলকভাবে যেমন ধানমন্ডির রাস্তাকে প্রশস্ত বলা যায়, ফলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সেখানকার রাস্তাগুলোতে ফুটপাথের উপস্থিতি আছে, কোনো কোনো জায়গাতে রাস্তার সাথেই বড় বড় গাছের সমাবেশ আছে। আর মিরপুরের আবাসিক প্লটগুলোর সংলগ্ন রাস্তার প্রশস্ততা ২০ ফুট থেকে ২৫ ফুটের ভেতরেই সীমাবদ্ধ। ফলে সেসব রাস্তাতে ফুটপাথ করার সুযোগ নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নেইও। অথচ মিরপুরের রাস্তাতেই পায়ে হাঁটা মানুষের ভিড় থাকে বেশি।
আবাসিক এলাকার ধরণের সাথে তাই এর রাস্তার প্রকৃতি অনেকটাই নির্ভরশীল। আবাসিক প্লটের আকার আর সেখানে বাস করা অধিকাংশ মানুষের আয়সীমার উপর নির্ভর করে কোনো এলাকার আবাসনের ধরণ। যাদের আয়ের সীমা উপরের দিকে তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের প্রবণতা বেশি থাকে। নিম্ন-আয়ের মানুষের প্রবণতা থাকে গন-পরিবহন (পাবলিক ট্রান্সপোর্ট) ব্যবহারের দিকে। ফলে ভিন্ন ভিন্ন আয়-সীমার মানুষের বসতি নিয়ে গ’ড়ে তোলা পাড়াগুলোর রাস্তার ধরণে আর পরিমাণে ভিন্নতা থাকাবেই। জাতিসংঘ বসতি যে অন্তত ৩০ শতাংশ জমি রাস্তার নেটওয়ার্কের জন্য বরাদ্দ রাখতে বলছে তা ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের কথা মাথায় রেখেই। কিছু পরিসংখ্যান থেকে জানা যাচ্ছে যে বর্তমানে ঢাকা শহরের মোট জমির ৯ শতাংশ জায়গা রাস্তার জন্য আর ৬ শতাংশ জায়গা পাকা বা পেভমেন্টের (চিপা-গলিগুলো এর অন্তর্ভুক্ত) জন্য আছে।(১) জাপানের টোকিওতে শহরের মোট জমির ১৬ শতাংশ জায়গা রাস্তার জন্য আছে। মোটামুটি ভাবে বলা হয় বেশ কিছু উন্নত শহরে রাস্তার পরিমাণ শহরের মোটা জমির ২৫ শতাংশের কাছাকাছি।
অর্থাৎ জাতিসংঘ বসতি রাস্তার পরিমাণ আরো বাড়িয়ে নিতে পরামর্শ দিচ্ছে। ঢাকার মতো একটা পুরোনো শহরে সেটা করা সম্ভব হবে কিনা সেটা ভেবে দেখার মতো। তবে শহরের প্রবৃদ্ধি হচ্ছে যে দিকগুলোতে সেখানে রাস্তার পরিমাণ বৃদ্ধির একটা চেষ্টা করা যেতে পারে। উত্তরা থার্ড-ফেইজ বা পূর্বাচলে রাস্তার পরিমাণ ২৫ শতাংশের কাছাকাছি ব’লেই দাবি করা হয়। রাজউক ব’লছে পূর্বাচলের মোট জমির ২৫.৯ শতাংশ রাস্তার জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে।(২) এটা থেকে ধ’রে নেওয়া যায় এই এলাকাগুলো মোটামুটিভাবে উঠতি মধ্যবিত্ত্ব আর উচ্চবিত্ত্বের মানুষের আবাসন আর কাজের জায়গার প্রয়োজনকে মাথায় রেখেই করা হয়েছে।
শহরের জন-ঘনত্বের ব্যাপারে জাতিসংঘ বসতি যে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ১৫০০০ মানুষের থাকার কথা বলছে সেটাও হয়তো ঢাকাতে নিশ্চিত করা যাবে না। এখনই ঢাকাতে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩০০০ এর উপরে মানুষ বাস করছে। দিন দিন সেই ঘনত্ব আরো বাড়ছে। আর বাড়ছে ব’লেই কমছে পড়ে থাকা জমির পরিমাণ। যেমন বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা বা আফতাব নগরের ফাঁকা প্লটগুলোতে প্রতিদিনই তৈরী হচ্ছে নতুন নতুন ভবন। আবার গুলশান বা ধানমন্ডির দোতলা আর ছয়তলা ভবনগুলোর বেশির ভাগ এরই ভেতরে ১৪ তলা হ’তে শুরু করেছে। যে গতিতে এই ভবনগুলোর সংখ্যা বাড়ছে তার সাথে আনুপাতিক হারে বাড়ছে ঢাকার জন-ঘনত্ব। ঢাকার এই ক্রমবর্ধমান জন-ঘনত্ব নিকট ভবিষ্যতে ঠিক কতটা টেকসই কিমবা বাসযোগ্য হবে সেটা এই মুহূর্তে বলা শক্ত। তবে ঢাকার জন-ঘনত্বের সাপেক্ষে এর ভবনগুলোর গড়পড়তা উচ্চতা যে বেশ কম, পৃথিবীর অন্য বড় শহরগুলোর অনুপাতে, তা নিশ্চিত ক’রেই বলা যায়। এ থেকে বলা যায় ঢাকার মানুষের জনপ্রতি ব্যবহৃত জায়গা বা বর্গফুটের পরিমান খুবই কম। দ্বিতীয়ত ভবনগুলো যেহেতু উচ্চতায় বেশি নয় সেহেতু তারা বেশ গায়ে গা লাগিয়ে দাড়িয়ে আছে। দুই কারণেই ঢাকার বাতাসের গুণগত মান কমছে। আবাসিক ভবনগুলোতে পর্যাপ্ত সূর্যের আলো ঢুকতে পারছে না। সব মিলিয়ে ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলো, সে এর উচ্চবিত্ত্বের আবাসিক এলাকাগুলোও, বসবাসের পক্ষে যথেষ্ট স্বাস্থকর থাকছে না। রেম কুলহাস কিছুদিন আগে মানুষের এত ঘন-বসতিপূর্ণ শহর তৈরীর আগ্রহকে সমালোচনা করেছেন, এই করোনা-মহামারিকে বিবেচনাতে নিয়ে। পৃথিবীর অর্ধেক মানুষকে শহরে বসবাসের কথা ব’লে তাদেরকে একধরণের অস্বাস্থকর পরিবেশে টেনে আনা হচ্ছে ব’লে মনে করছেন তিনি।
আবার পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে নগরের সংখ্যা আর আয়তন বৃদ্ধি করা ছাড়া এত মানুষের থাকার ব্যবস্থা করা যাবে ব’লেও মনে হয় না। মনে রাখা দরকার এখন মূলত বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বাড়তির দিকে। আর বয়স্ক মানুষের জন্য প্রয়োজন বাড়তি চিকিৎসা ব্যবস্থা। যার সংস্থান শহর ছাড়া করা সম্ভব নয়। ফলে শহর বা নগরের সংখ্যা বৃদ্ধিও একটি বাস্তবতা। এই অবস্থাতে শুধুমাত্র ঢাকাকে আয়তনে বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা নিয়ে আগালে খুব কার্যকর ফল পাওয়া নাও যেতে পারে। ২০/২৫ বছর পরও ঢাকাকে টেকসই একটা শহর হিসেবে দেখতে চাইলে প্রয়োজন এখনই বেশ কিছু মাঝারি আকারের শহরকে বড় শহরে পরিণত করার পরিকল্পনা হাতে নেওয়া। আমরা সুযোগ পেলেই বিকেন্দ্রীকরণের কথা বলি। সেটা সম্ভবত সঠিক সমাধান নয় এই ক্ষেত্রে। ১৬ থেকে ২০ কোটির দিকে যেতে থাকা জনগোষ্ঠির নিরাপদ জীবন যাপনের জন্য প্রয়োজন বহু-কেন্দ্রীকরণ। অর্থাৎ অনেকগুলো গুরুত্বপূর্ণ নগর বা কেন্দ্র তৈরী করা। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে ঠিক কতগুলো বড় নগর তৈরী করা প্রয়োজন তা নিয়ে সমীক্ষা হওয়া উচিত। সচেতন ভাবে না হ’লেও সরকার হয়তো সেই দিকে যাচ্ছে ব’লে মনে হচ্ছে যদিও খানিকটা। যেমন চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট আর খুলনাতে চিকিৎসা বিশ্ববিদ্যালয় তৈরীর উদ্যোগ। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে দেখেছি নতুন এমবিবিএস করা ডাক্তাররা শুধুমাত্র উচ্চতর লেখাপড়ার জন্য ঢাকাতে থাকতে বাধ্য হন। কারণ ঢাকার বাইরে এ ধরণের কোনো সুযোগ নেই।
ঘূর্ণিঘড় সিডর আর আয়লার পর উপকূলীয় এলাকা থেকে অনেক মানুষকে কাজের খোঁজে ঢাকাতে চ’লে আসতে দেখেছি। ঢাকা এই মানুষগুলোর জন্য তখন কতটা প্রস্তুত ছিলো বলা কঠিন। কিন্তু আমাদের যদি আরো কিছু বড় শহর থাকতো তবে হয়তো দুর্যোগ পরবর্তী সময়ে ঢাকার উপরে জন-ঘনত্ব বৃদ্ধির চাপটা একটু কম পড়তো। দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির সাথেও এর সম্পর্ক আছে।
এবার আসি জমির মিশ্র ব্যবহার প্রসঙ্গে। ঐতিহ্যগত ভাবেই আমাদের বাঙালিদের জীবনাচরণে মিশ্র-ব্যবহারের প্রবণতা আছে। এবং তা বেশ বেশি ভাবেই আছে। গ্রামের চাষী-বাড়িতে, কুমার-বাড়িতে একটা উঠান আগে থাকতই। পানাম নগর কিমবা পুরানো ঢাকার আগের বাড়িগুলোর অনেকগুলোই উঠানের উপকারিতা মেনেই তৈরী হয়েছিলো। রূপলাল হাউজে এখনো কিছু উঠান দেখা যায়। এই উঠান মিশ্র-ব্যবহারের সংস্কৃতির উদাহরণ। আমাদের পুরোনো বাড়িগুলোতে, সে গ্রামের দোচালা বা চারচালা ঘরগুলোতেও, প্রশস্ত বারান্দা থাকতো। এই বারান্দাগুলোতে দিনের নানা সময়ে নানা ধরণের কাজ করা হ’তো। ফলে ভারী আর জড়োয়া ফার্নিচার সেখানে রাখা হ’তো না বললেই চলে। তাতে সহজেই প্রয়োজন অনুযায়ী পরিসরের চরিত্রকে পাল্টে নেওয়া যেতো। দুপুরে যেখানে বসে বাড়ির লোকজন পাটি পেতে খেয়ে নিতে পারে সেখানেই হয়তো বিকালে আড্ডা বসে। বা বর্ষার সময় কাঁথা পাতা আর সেলাই করার আয়োজন হয়। ফসলের মাড়াই আর প্রক্রিয়াকরণের নানা কাজ উঠানে করা হতো। ফলে আমাদের ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির সাথে মিশ্র-ব্যবহারের পরিচয় আছেই। এখন এটাকে শহরের সাথে সম্পৃক্ত ক’রে নেওয়া যায় কিভাবে সেটা ভেবে দেখতে হবে।
আবাসন, নাগরিক সুবিধা (সার্ভিস) আর পেশাগত কাজের জায়গাগুলোকে কিভাবে বিন্যস্ত করা যায় সেটা নিয়ে নতুন ক’রে ভাবার সময় এসেছে। ১৯২০ থেকে ১৯৭০ সময় কালে পৃথিবীব্যাপী শহরের বৃদ্ধি আর পরিকল্পনাতে যে ভাবনাগুলো ব্যবহার করা হয়েছে তাতে মিশ্র-ব্যবহারকে এড়ানোর প্রবণতা ছিলো প্রচণ্ডভাবে। তখনকার নতুন প্রযুক্তিগুলো একরকম বাধ্য করেছিলো সেটা করতে। ফলে অফিস পাড়া, কারখানা এলাকা, পার্ক, বাজার, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান আর আবাসনের জন্য আলাদা আলাদা জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে এতদিন। তাতে ব্যবহার অনুযায়ী গ’ড়ে ওঠা এক ধরণের জায়গা থেকে আর এক ধরণের জায়গাতে মানুষের যাতায়াতের প্রয়োজন বেড়েছে। তাতে বেড়েছে রাস্তা আর গাড়ির প্রয়োজনীয়তাও। ফলস্বরূপ অটো-মোবাইল কারখানার চাহিদা বেড়েছে। অর্থনীতি সমৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে মানুষের ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারের প্রবণাতাও বেড়েছে। সেই সাথে দূষণ আর যানজটের যন্ত্রণা দিন দিন যেন বেড়েই চলেছে। শহর পরিকল্পনা নিয়ে যারা কাজ করছেন তারা অনেকেই তাই এখন মনে করছেন অফিস পাড়া, কারখানা কেন্দ্র, আবাসিক এলাকা এমনতরো স্পষ্ট ভাগ না ক’রে মিশ্র-উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষের যাতায়াতের পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়। তাতে মানুষের সময় আর অর্থেরও সাশ্রয় করা সম্ভব।
পুরোনো ঢাকাতে এখনো অনেক ভবন আছে যার নিচতলাতে ব্যবসার জয়গা আর উপরে মানুষের আবাস। কোথাও কোথাও হয়তো কারখানাও আছে। তবে সেই কারখানাগুলো নিরাপত্তার প্রশ্নে কতটা যুক্তিসংগত সেটা বিশ্লেষণ করে দেখার সময় এসেছে। মিরপুর আর মোহম্মদপুরের অনেক আবাসিক ভবনের নিচের তলাতে এ্যাম্ব্রয়ডারির ম্যাশিন দেখা যায়। এটা কতটা ঝঁকিপূর্ণ জানি না, তবে মিশ্র-ব্যবহার হিসেবে বেশ কর্যকর ব’লে মনে হয়েছে। জমির মিশ্র-ব্যবহার ভবন কেন্দ্রিক হ’তে হবে এমনও নয়। একটা বড় জমি বা ব্লক কেন্দ্রিকও হ’তে পারে। একটা বড়সড় ব্লকের জন্য প্রয়োজনীয় হাসপাতাল সুবিধা, স্কুল, বাজার আর খানিকটা অফিস এরিয়া সমন্বিত ক’রে গ’ড়ে তোলা গেলে সামগ্রিক হিসাবে শহরের মানুষের যাতায়াতের পরিমাণ কমিয়ে আনা যাবে। সোভিয়েত ইউনিয়নে হাউজিং বা আবাসন পরিকল্পনার তৃতীয় ফেইজে সুপার-ব্লক কেন্দ্রিক এই ধরণের মিশ্র-ব্যবহারের কিছু চেষ্টা নেওয়া হয়েছিলো, যেগুলো নাগরিক সুবিধার বিচারে খুব উপযোগী হয়েছিলো। ফলে জমির মিশ্র-ব্যবহার যে শহর পরিকল্পনাতে উপকার দিতে পারে সেটা এখন মোটামুটি জানা। কিন্তু প্রশ্ন হ’লো ঢাকা তথা বাংলাদেশে আমরা সেটা বিবেচনা করছি বা করেছি কিনা।
ধানমন্ডি, মিরপুর, গুলশান বা উত্তরার পরিকল্পনাতে জমির মিশ্র ব্যবহারকে বিবেচনা করা হয়নি ব’ললেই চলে। কিন্তু সময়ের সাপেক্ষে প্রশস্ত রাস্তাগুলোর পাশে মিশ্র-ব্যবহারের চাহিদা তৈরী হয়েছে। মানুষ নিজের প্রয়োজনেই তা গ’ড়ে নিয়েছে। রাজউক বা নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান এসব ক্ষেত্রে কখনো নিরব থেকেছে, কখনো অসুবিধার সৃষ্টি করেছে আবার কখনো প্লটের ব্যবহার পরিবর্তনের জন্য বিধি তৈরী করেছে, আবার সেই বিধি ব্যবহার করে নানা ধরণের সুযোগ নিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ঢাকার প্রায় সমস্ত এলাকাতেই জমির মিশ্র-ব্যবহার গ’ড়ে উঠেছে। এমনকি ডিওএইচএসগুলোও এখন আবাসিক আর অফিস এলাকার মিশ্রণ।
প্রয়োজন এই মিশ্রণের প্রকৃতির অভিজ্ঞতা নিয়ে আগামী দিনের শহর পরিকল্পনা করা, সে যেমন ঢাকার বর্ধিত অংশে তেমনই অন্য গুরুত্বপূর্ণ শহরগুলোও যে গুলোর নতুন কেন্দ্র হওয়ার সম্ভাবনা আছে, সেই সাথে বর্তমানের শহরের যে নিত্য-পরিবর্তন তাতে দিক-নির্দেশনা দেওয়া।
সামাজিক সংমিশ্রণ ছাড়া কোনো শহরই সাস্টেইনেবল বা টেকসই হতে পারে না। করাইল আর মহাখালির বস্তি ছাড়া গুলশানের আবাসিক এলাকা এখন যেভাবে চলছে সেভাবে চলতে পারবে না। এই বস্তিগুলো তুলে দিলে শুগশানের আবাসিক ভবনগুলোর পরিচালন ব্যায় অনেক বেড়ে যাবে। আবার কাছের বাড্ডা আর রামপুরার মতো মধ্যবিত্ত্বের এলাকাগুলো না থাকলে গুলশানের অফিস পাড়াতে পরিণত হওয়ার সুযোগও যেতো কমে। শহরের কোনো এলাকার চরিত্র গঠন আর পরিবর্তনে এরকম নানা স্তরের মানুষের অংশগ্রহণের ভূমিকা এড়াবার নয়। আর যে শহর পরিবর্তিত হ’তে থাকে না তা এক সময় গুরুত্ব হারাতে থাকে।
শেষ যে কথাটা বলা হয়েছে সেটা হ’লো ব্যবহার মিশ্র করতে গিয়ে আবার যেত কোনো একটা বিশেষ ফাংশনকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে না ফেলা হয়, যেমনটা ঢাকার গুলশানের ক্ষেত্রে হয়েছে। আবাসিক এলাকা হিসেবে গ’ড়ে তোলা গুলশান-বনানীকে এখন ঢাকার নতুন বিজনেস-ডিস্ট্রিক্ট বা বড়বাজার হিসেবেই মনে করেন অনেকে। একসময় মতিঝিলকে যা মনে করা হ’তো।
প্রতিবেশ বা পাড়া তৈরীতে তাই অন্য ব্যবহারগুলো যেন মূল ব্যবহারের ১০ শতাংশকে পেরিয়ে না যায় সেদিকে নজর দিতে ব’লছে জাতিসংঘ বসতি।
সূত্র :
১) http://article.sciencepublishinggroup.com/html/10.11648.j.ijtet.20160201.11.html
২) http://www.rajukdhaka.gov.bd/rajuk/projectsHome?type=purbachal
নোট: বাঁক হরফের লেখা গুলো ইংরেজি থেকে অনুবাদকৃত।
(রাজীব রহমান)


মন্তব্য

হিমু এর ছবি

খেলার মাঠ বা আচ্ছাদিত স্থান দরকার। ভলিবল, ব্যাডমিন্টন, পিংপং এমন খেলাগুলোর সুযোগ বাড়াতে হবে (এ খেলাগুলো অল্প জায়গার মধ্যে প্রচুর ছুটোছুটির সুযোগ দেয়, আর খেলা শেষে কোর্ট বা চারপাই তুলে জায়গাটা অন্য কাজে ব্যবহারের জন্যে ছেড়ে দেওয়া যায়)। শুধু ছোটদেরই নয়, মাঝবয়সী মানুষের জন্যেও দলগত খেলার সুযোগ থাকা প্রয়োজন।

অতিথি লেখক এর ছবি

পাড়া তৈরীর জন্য কমিউনিটি (বাংলা কি হবে ব'লতে পারছি না। সমাজ বলা যায় কি?) তৈরী করাটা পূর্বশর্ত। ঢাকাতে নতুন নতুন যে হাউজিং প্রকল্পগুলো হচ্ছে তাতে প্রচুর মানুষ হয়তো থাকছে, কিন্তু সেই মানুষগুলোর সমন্বয়ে সমাজ বা কমিউনিটি হয়তো হচ্ছে না। না হওয়ার একটা বড় কারণ কমন কিছু ফ্যাসিলিটি তৈরীর দিকে একেবারেই নজর না দেওয়া। খেলার মাঠ, পাঠাগার, সিনেমা বা কনসার্ট হল এই ধরণের কিছু কমন ফ্যাসিলিটি। যে শহরে বংশানুক্রমিক ভাবে বেশির ভাগ মানুষ বাস করে সেখানে কমিউনিটি তৈরীর জন্য বাড়তি আয়োজন কম থাকলেও চলে। কিন্তু নগরে কমিউনিটি তৈরীর কাজটা খুব সচেতন ভাবে করতে হয়, কারণ নগরের বেশির ভাগ মানুষ নগরের স্থায়ী/পুরোনো বাসিন্দা নন। মানুষের সাথে মানুষের যোগাযোগ করার বাসনাটা একেবারেই আদিম একটা প্রবৃত্তি। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোও নানা ভাবে কমিউনিটি গ'ড়ে তুলতে সাহায্য করে।
ঢাকাতে এখন ওয়ার্কিং কমিউনিটির বাইরে ভিন্ন কোনো ধরণের কমিউনিটি তৈরী হয় কিনা তা সার্ভে বা সমীক্ষা ছাড়া বলা কঠিন। অন্তত আমরা অনেকেই যে ওয়ার্কিং কমিউনিটি আর পারিবারিক বলয়ের ভেতরে আটকে গেছি সেটা নিশ্চিত। খেলাধুলা কেন্দ্রিক কিছু আয়োজন শীত কালে চোখে পড়ে যদিও ঢাকার কিছু কিছু এলাকাতে। তাতে সব বয়সের মানুষের অংশগ্রহন থাকে না। নারীদের তো থাকেই না।
ইনডোর গেইমসের (আবারো বাংলার জন্য হাতড়ানো!) পরিকাঠামো পাড়ার স্কুলগুলোতে সহজেই করা যায়। স্কুল চলাকালীন সময়ে যেটা শিক্ষার্থীরা ব্যবহার করলো। আর বিকাল বা রাতে ব্যবহার করলো পাড়ার অন্যরা, যারা হ'তে পারে সব বয়সের, নারী পুরুষ উভয়ই।
(রাজীব)

হিমু এর ছবি

ইনডোরকে অন্দরি আর আউটডোরকে বাহিরি বলা যায় বোধহয়। অন্দরি খেলা আর বাহিরি খেলা বললে লেখা আর বলা দুটোই সহজ হয়।

মন মাঝি এর ছবি

আপনি অন্য কোনো একটা পোস্টে আমার প্রশ্নের জবাবে Interchangeable-এর একটা বাংলা প্রস্তাব করেছিলেন যা আমার খুব পছন্দ হয়েছিল সে সময়ে কিন্তু এখন ভুলে গিয়েছি। সেটা কি ছিল মনে আছে??

****************************************

হিমু এর ছবি

ইন্টারচেইঞ্জেবলি বোধহয় পরস্পরবিকল্পে বলেছিলাম। দুটো জিনিস ইন্টারচেইঞ্জেবল হলে তারা পরস্পরবিকল্প

অতিথি লেখক এর ছবি

অন্দরি আর বাহিরি শব্দ দুটোই পছন্দ হ'য়েছে। খেলার সাথে যোগ করে অন্দরি/বাহিরি খেলা বা ক্রিড়া কোনোটাই কানে বাজছেও না। ধন্যবাদ।
ইনডোর, আউটডোর আর সেমি আউটডোর স্পেস শব্দবন্ধগুলো স্থাপত্যে বারবার ব্যবহার করতে হয়। স্পেস ব'লতে পরিসর একরকম গৃহীত শব্দই বলা যায়। ইনডোর-স্পেসের জন্য অন্তঃপরিসরের ব্যবহার মন্দ লাগে না। এটাকে অন্দরি-পরিসরও হয়তো বলা যাবে। তবে আউটডোর-স্পেসের জন্য বহি-পরিসর ব্যবহৃত হলেও আমার মন ঠিক সাই দেয় না। বাহিরি পরিসরেও মন ভরছে না পুরো। আবার সেমিআউটডোর তো সেমিইনডোরও। আধাবহি-পরিসর হয়তো বলা যায়। তবে এগুলোকে আরো ছোট আকারে আনতে পারলে বোধ হয় আরো ভালো হ'তো।
(রাজীব)

হিমু এর ছবি

স্থাপত্যের ভাষা যেহেতু সচরাচর গম্ভীর, অন্তঃপরিসর (ইনডোর স্পেস), বহিষ্পরিসর (আউটডোর স্পেস) আর আঙ্গণিক পরিসর (সেমি-আউটডোর স্পেস) বলা যায় কি? আমি বিসর্গ সন্ধির নিয়ম অনুসরণের পক্ষে।

আরেকটু আটপৌরে ঢঙে বলতে গেলে অন্দরি, বাহিরি, অঙ্গনি বলা যায় হয়তো (মানে, 'পরিসর' তখন না বললেও চলে)।

কিংবা অন্তরাল (ইন্টারমিডিয়েট স্পেস)-এর আদলে অন্দরাল, বহিরাল আর অঙ্গণাল বলা যায়।

অতিথি লেখক এর ছবি

ভালো প্রস্তাবনা। পরবর্তী কিছু লেখাতে ব্যবহার করার চেষ্টা করবোখন। দেখি অন্যরা কেমন ভাবে নেয়।

অতিথি লেখক এর ছবি

বাংলায় নতুন শব্দ ব্যাবহারে প্রথম খটকা লাগতে পারে। যেমন অন্দরি বা বাহিরি বললে একটু থমকে যেতে হয়। কিন্তু ব্যবহারে ক্লিশে হয়ে গেলে সবাই স্বাভাবিকতায় অভ্যস্ত হয়ে যাবে। তাই আমরা সবাই মিলে এইশব শব্দ প্রয়োগ করে জনপ্রিয় করে তুলতে পারি।

আবরার এর ছবি

'পুরোনো ঢাকা' বললে কানে বাজে। পুরান-ঢাকা শুনলে মনে যে ছবি ভেসে ওঠে, সেটা 'পুরোনো ঢাকা'য় অনুপস্থিত। এর লিখিত রূপ পুরান-ঢাকাই থাকুক (ইংরেজিতেও Puraan Dhaka-র পক্ষপাতী আমি)।

অতিথি লেখক এর ছবি

আসলে ভাষায় তো ডায়ালেক্ট থাকেই। একই শব্দ একেক মানুষ একেক ভাবে উচ্চারণ করেই। পুরোনো ঢাকার লোকজনকে পুরান-ঢাকা বলতে শুনেছি। আবার বেশির ভাগ সময় পুরোনো পল্টনের উচ্চারণ শুনেছি পুরানা পল্টন। আমার কোনোটাতেই আপত্তি নেই। আবার কোনোটার প্রতি বাড়তি ঝোঁকও নেই। যত দূর মনে করতে পারছি জীবনানন্দ দাশের 'কয়েকটি লাইন' কবিতাতে তিনি 'পুরানো' আর 'পুরোনো' দুটো বানানই ব্যবহার করেছিলেন। এটা হয়তো বাংলা ভাষার এক ধরণের সৌন্দর্য।
(রাজীব)

মন মাঝি এর ছবি

আমি সম্পূর্ণ একমত। পুরোনো দিনের কথা, পুরনো বা পুরোনো গাড়ি/বাড়ি/কাঁথা/কম্বল - এইগুলির কোনোটাতেই আমার আপত্তি নাই - ইন ফ্যাক্ট আমি সেটাই বলি। কিন্তু "পুরান-ঢাকা" বা "পুরানা পল্টন" কিভাবে যেন ঢাকার অবিচ্ছেদ্য নাগরিক কালচারাল হেরিটেজ এবং সে বিষয়ে আমাদের কালেক্টিভ স্মৃতির সাথে জড়িত ও সিক্ত একটা অবিকল্প চিত্রকল্প হয়ে উঠেছে! এই শব্দ (হুবহু) বা চিত্রকল্পটা হারিয়ে ফেললে সেই হেরিটেজ ও তার ইউনিক আমেজ-মেদুর স্মৃতিটাও বোধহয় আমরা হারিয়ে ফেলব। তাই এই শব্দ/চিত্রকল্পটা স্রেফ যে কোনো একটা শব্দ নয় - বা অন্য কোনো শব্দ বা অন্য কোনো বানান বা উচ্চারণের সাথে ইন্টারচেঞ্জেবলও নয়, এই বানান ও উচ্চারণেই শব্দদু'টি নিজেরাই আমাদের একটা অবিস্মরণীয় অ-বর্জনীয় ঐতিহ্য!

****************************************

অতিথি লেখক এর ছবি

একটা সম্পূরক প্রশ্ন: যে কোনো ঐতিহ্যকে কি হেরিটেজ বলা যায়? সাধারণ অভিধান যদিও বলে উত্তরাধিকার হিসেবে পাওয়া যে কোনো কিছুই একধরণের হরিটেজ। তবে স্থাপত্য পাঠের একাডেমিতে হেরিটেজ ব'লতে ঐতিহ্যের শ্রেষ্ঠ বা উৎকৃষ্ট উদাহরণগুলোকে বোঝানো হয় সাধারণত। ভাষা বা কালচারের জন্যও কি তেমনটা নয়?
(রাজীব)

মন মাঝি এর ছবি

দৌড়ের উপর আছি তাই মনোমত বিস্তারিত উত্তর দিতে পারছি না বলে দুঃখিত।

আপনার প্রশ্নের সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে (আমার মতামত!) - না!

স্থাপত্যের ক্ষেত্রে কি হয় জানি না, কিন্তু ভাষার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই এবং ক্ষেত্রেই এইসব শ্রেষ্ঠ/অশ্রেষ্ঠ মনস্তত্ত্বের গভীরে আসলে লুকিয়ে থাকে সমাজের / রাজনীতির ক্ষমতা-কাঠামোর অসম বিন্যাস, ভুয়া এলিটিজম, হেজিমনি ও শ্রেণিবাদ, মান্ধাতার আমলের রেইসিজম ও ফিউডালিজম এবং প্রাক-বিংশ শতাব্দীর কলোনিয়ালিস্ট মনোবৃত্তি। পৃথিবীতে সব ভাষাই ইকুয়ালি সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ, সব ভাষার সব ডায়ালেক্ট ও ভ্যারাইটিই ইকুয়ালি সুন্দর ও শ্রেষ্ঠ। এবং এই সৌন্দর্য্য ও মূল্য-বিচার বেশির ভাগটাই আসলে শেষ পর্যন্ত সাব্জেক্টিভ - আর তাই শ্রেষ্ঠ/অশেষ্ঠ নির্ধারণ করা অর্থহীণ। সব ভাষা এবং ভাষার সব ভ্যারাইটিই নিজস্ব উপায়ে ইউনিক জীবনাভিজ্ঞতা, পার্স্পেক্টিভ, অনুভূতি, উপলব্ধি ও সৌন্দর্য্যের আধার যা অন্য কোনো ভাষা বা ভ্যারাইটি দিয়ে পূরণ করা যায় না। এই দিক থেকে দেখলে সব ভাষা ও ডায়ালেক্টই ইনডিস্পেন্সিবল! রেইসিস্ট, ফিউডাল, কলোনিয়ালিস্ট, এলিটিস্ট ইত্যাদি ধরণের চর্চা ও মানসিকতার স্বভাবই হচ্ছে নিজেদের বৈষয়িক ও অবৈষয়িক (ট্ঞ্জিবল ও ইনট্যাঞ্জিবল) আধিপত্য জারি রাখা এবং সেটা করতে গিয়ে নিজের শ্রেনী/জাতি/গোষ্ঠী বা সংশ্লিষ্ট সাংস্কৃতিক বলয়ের বাইরের সবকিছুকে ডিলেজিটিমাইজ করা, ক্যান্সেল করা, খাটো করা, অবমূল্যায়ণ করা, ছোট করা, "অশ্রেষ্ঠ" তক্‌মা দাগিয়ে উপযুক্ত মূল্যায়ণের অধিকার থেকে অবনমিত বা অবদমিত বা পদদলিত করা। ভাষার ক্ষেত্রে এটা সম্ভবত হাজার-হাজার বছর ধরে হয়ে আসছে, এবং আমার আনএডূকেটেড অনুমান "স্থাপত্য"-ও বোধহয় এর থেকে পুরোপুরি হয়তো মুক্ত নয়। এমনকি আমাদের বাংলা ভাষায় (এবং পৃথিবীর অন্যান্য অনেক ভাষাতেই) যে প্রমিত ভাষা - আঞ্চলিক ভাষা -ডায়ালেক্ট / সোশিওলেক্টের যে দ্বন্দ্ব প্রবল ভাবে বিদ্যমান ছিল এবং সাধারণ জনমানসে এখনও অনেকখানিই আছে - সেসবও অনেকাংশেই এই রেইসিস্ট/কলোনিয়ালিস্ট/এলিটিস্ট রাজনীতি ও মানসিকতার বাই-প্রোডাক্ট। ভাষা / ডায়ালেক্ট ও অন্য সংস্কৃতিকে ডিলেজিটিমাইজ (নাকি কথাটা "ইনভ্যালিডট"?) / অবনমন / অবদমন / অশ্রেষ্ঠ করার মাধ্যমে আসলে শেষ বিচারে মানুষকেই ডিহিউম্যানাইজ করা হয় - যে দৃষ্টিভঙ্গি এই একবিংশ শতাব্দীতে আমার কাছে নিখাদ বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই নয়!! তবে যারা বর্তমানে এমনটা করেন, তাদের পক্ষে এইটুকু বলা যায় -- এই কাজ বর্তমানে আমরা সবাই যে খুব বুঝেশুনে করি সবসময় তা হয়তো নয় - আমরা সেই অতীতের সামন্তবাদী দৃষ্টিভঙ্গিটাকেই হয়তো অনেক সময় উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়ে না বুঝেই বিনা বিচারে নিজেদের মধ্যেও ধারণ করে ফেলি। যাইহোক, এই বিষয় আমি কোনো এক্সপার্ট না তাই এর চেয়ে বেশি খুব বেশি কিছু বলতে পারব না বা বলতে হলে নতুন করে আবারও পড়াশোনা করতে হবে। এই মুহূর্তে সেই সময় বা এনার্জি নাই। তবে আপনি নিজেই ইচ্ছা করলে সোশিওলিঙ্গুস্টিক্স এবং ভাষা-রাজনীতি নিয়ে একটু পড়াশোনা করলে হয়তো অনেক কিছু আবিষ্কার করতে পারবেন।

মূল কথা হচ্ছে -- ভাষার ইতিহাস অপ-রাজনীতিতে ভর্তি - আর এইসব শ্রেষ্ঠ/অশ্রেষ্ঠর প্রশ্ন একেবারেই তার কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত!!! কিন্তু আমার মতে সব ভাষা ও তার সব ভ্যারাইটিই সমান মূল্যবান, আদরনীয়, শ্রেষ্ঠ - এবং সে কারনে সমমূল্যেই সংরক্ষনযোগ্য -- এমনকি যেসব ভাষা বা ডায়ালেক্ট পৃথিবীর বুক থেকে এক্সটিংক্ট হয়ে গেছে - সেগুলিও!!! পৃথিবীর অনেক জায়গাতেই এখন এনডেঞ্জার্ড বা এক্সটিংক্ট ভাষাকে সংরক্ষণ বা পুনর্জাগরণের চেষ্টা চলছে।

অঃটঃ-১ ॥ প্রমিত / অপ্রমিত ভাষার দ্বন্দ্ব নিয়ে এখানে আমার একটা পুরনো লেখা আছে। আগ্রহ থাকলে দেখতে পারেন। আসলে আমার স্বল্পজ্ঞান-প্রসূত মূল লেখাটার চেয়ে নীচে মন্তব্যঘরে হিমু এবং আরও দু-একজ্নের সাথে মন্তব্য-বিনিময়ের অংশটাই আমার কাছে স্মরণীয় ও শিক্ষনীয় হয়ে আছে।
অঃটঃ-২ ॥ বাইরে বেরুবো বলে তাড়াহুড়ার মাথায় তেমন চিন্তা-ভাবনা না করেই ঝড়ের গতিতে আঙুলের মাথায় যা এসেছে তা-ই কী-বোর্ডে টাইপ করে গেছি। উল্টা-পাল্টা ভুলভাল কিছু বলে ফেললে নিজগুণে আশা করি ক্ষমা করে দিবেন!

****************************************

শারমিন এর ছবি

বাংলাদেশে ফিউডালদের ভাষা দুইচারটা ইংরেজি শব্দে ঠেকা দেওয়া বাংলা। পুরাপুরি ফিউডাল হওয়া তো আর সম্ভব না, কারণ বেশিরভাগ রইস লোকই বড়জোর জোতদার পরিবার থেকে আসা। এরা মনে মনে ডাউনটন এবিতে বাস করে আর দুই-চারটা ফুটফাট ইংরেজি বলে তৈলাক্ত বাঁশের বানরটার মতো সামন্ত পরিচয় বেয়ে এক ফুট উঠে আর তের ইঞ্চি নামে। ইংরেজিতে এরা এত সরেস হলে এতদিনে দেশ ইংরেজিতে শিল্প-সাহিত্যের গলাপানিতে ডুবে থাকত।

অতিথি লেখক এর ছবি

এই ব্যাপারটা নিয়ে রবীন্দনাথকেও ভাবতে হয়েছে ব'লে জানি। সংস্কৃতির সবকিছু ভালো কিনা সেটা নিয়ে প্রশ্নও করেছেন। যেমন পান খেয়ে যেখানে সেখানে পিক ফেলাটা বাঙালি সংস্কৃতির অংশ। তবে সেটা ভালো কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন করা যায়। অল্প কিছু দিন আগেও আমি সরকারী বেশিরভাগ ভবনের সিড়ির দেয়ালে যত্রতত্র পানের পিকের দাড় দেখেছি। ইদানিং অবস্থার খানিকটা উন্নতি চোখে পড়ছে। এই বিচারেই হেরিটেজ শব্দটা নিয়ে ভাবনা।
পুরোনো কোনো সভ্যতাতে তো অনেক ধরণের অনেকগুলো বিল্ডিং থাকেই। অনেক মন্দির বা প্রাসাদ থাকে। সবগুলো তো টিকে না। হয়তো এক পর্যায়ে সবগুলোই হারিয়ে যায়। যেমন ধরুন পিরিমিডগুলো। সাদা চোখেই শ্রেষ্টগুলোকে আলাদা করা যায়। অনেকগুলো গ্রিক মন্দিরকেও সেভাবেই আলাদা করা যায়। হ্যাঁ এই আলাদা করার পেছনে নানা ধরণের ভাবনার প্রভাব থাকেই। আলাদা করাটার পদ্ধতি আর উদ্দেশ্য নিয়ে সব সময়ই প্রশ্ন করা যায় ব'লে মনে করি। তবে একাডেমিক কিছু উদ্দেশ্য আলাদা করা বা বিশেষায়নের প্রয়োজন পড়েই। এমনকি মাইকেল এ্যাঞ্জেলোর সব কাজকেও সমান গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয় না। শিক্ষার্থীদেরকে সম্পূর্ণতর প্রকল্পগুলো কমপক্ষে শিখতে বলা হয়। আর এইগুলোকেই হেরিটেজ ব'লে বলার একটা চল আছে। আমি নিজে এটার সমর্থক কিনা তা ভেবে দেখিনি। তবে এর উপযোগীতা যে আছে তা বুঝি।
মূল মন্তব্যের 'ঢাকার অবিচ্ছেদ্য নাগরিক কালচারাল হেরিটেজ' প্রসঙ্গে আমার মাথায় এটা এসেছে। ঢাকার কালচার যে তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কালচারাল হেরিটেজ কিনা তা নিয়েই ভাবনা।
(রাজীবন)

হিমু এর ছবি

"পুরান ঢাকা" নামটা ঐতিহ্যের সব মানদণ্ডেই উৎরাবে। মান শব্দটা 'পুরাতন'। পুরোনো, পুরানা, পুরান সবই নানা উপভাষার শব্দ। পুরান ঢাকা নামটায় উৎকর্ষের কোনো ঘাটতি নেই।

মান ভাষা আসলে আগিলা দিনের আংরেজ রাজাদের মতো, first among the equals। আর লেখ্য মান ভাষার উদ্দেশ্য কথ্য ভাষার প্রতিস্থাপন নয় (আমার কথা নয়, বহু আগে রাজশেখর বসু খুব প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন), শুধু্ই লেখ্য মাধ্যমে যোগাযোগ সহজ করা। পুরান ঢাকার নামটা লেখ্য ভাষার অবদান যেহেতু নয়, তাই ঐতিহ্যে ঠাঁই পেতেও বাধা নেই। একে অতিশোধন করা আর মাইনকার চিপাকে 'মানিকের সংকট' বলা কাছাকাছি ভুল হবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সহমত।
(রাজীব)

অতিথি লেখক এর ছবি

দাড় = পড়ুন দাগ, শ্রেষ্ট = পড়ুন শ্রেষ্ঠ। তড়িঘড়িতে টাইপো হ'য়ে গেছে। দুঃখিত। এমনকি নামটাতেও। হাহা।
(রাজীব)

মন মাঝি এর ছবি

টু দি পয়েন্ট জবাবটা হিমুই দিয়ে দিয়েছেন, তবে আমি আমার উপরের মন্তব্যের সাথে একটু (বা অনেকটু!) টিকা যোগ করতে চাইঃ উপরের কমেন্টটা লেখার সময় আমার মাথায় আসলে বিশেষ ভাবে বা বলা ভাল স্পেসিফিকালি - "ভাষা"-ই ছিল, ব্যপকতর অর্থে "সংস্কৃতি" নয়। সংস্কৃত আরো অনেক বড় জিনিস - ভাষার যার অন্যতম একটা উপাদান। আমি এই সংকীর্ণতর অর্থেই "কালচারাল হেরিটেজ" কথাটা লিখেছি। চাইলে আরও ন্যারো-ডাউন করতে পারি - পুরো ভাষাই নয়, আমার মাথায় উচ্চারণের প্রসঙ্গটাই বেশি করে ছিল। বৃহত্তর অর্থে "সংস্কৃতি" বলতে অনেক কিছুই বোঝায় যার সাথে সবসময় ভাষার কোনো অবধারিত সম্পর্ক নেই এবং সংস্কৃতির অন্যান্য অনেক উপাদানের ক্ষেত্রে যেসব মানদণ্ড প্রয়োগ করা যায় তার সবকিছু ভাষার ক্ষেত্রে করা যায় না বলেই মনে হয়। আমার মতে "দেয়ালে পানের পিকের দাগের" ভাল-মন্দ, শ্রেষ্ঠ-অশ্রেষ্ঠ, উপকারিতা-অপকারিতা, সৌন্দর্য্য-অসৌন্দর্য্য, প্রাসঙ্গিকতা-প্রয়োজন-গুরুত্ব-মূল্য বা সেসবকিছু বিচারের মাপকাঠি ইত্যাদির সাথে "পুরান-ঢাকা" বা অন্য কোনো ভাষিক কন্টেন্টের ভাল-মন্দ, শ্রেষ্ঠ-অশ্রেষ্ঠ, উপকারিতা-অপকারিতা, সৌন্দর্য্য-অসৌন্দর্য্য, প্রাসঙ্গিকতা-প্রয়োজন-গুরুত্ব-মূল্য বা সেসবকিছু বিচারের মাপকাঠি - এত সহজে তুলনীয় বা একটা আরেকটার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় কোনোমতেই। আমার মতে ভাষার "তাগিদটা" একেবারেই আলাদা। এখানে "তাগিদ" বলতে কি বুঝালাম সেটা বুঝে নেয়ার দায়িত্বটা আপনার উপরেই ছেড়ে দিলাম! আর হ্যাঁ, মহৎ স্থাপত্য বা বিভিন্ন একাডেমিক / উচ্চ-মার্গীয় বিষয় - যেখানে একাডেমিশিয়ান বা সীমিত-সংখ্যক বিশেষ শ্রেণীর সৃষ্টিশীল প্রতিভাবান মানুষ ছাড়া অবদান রাখা অতি দুরূহ (ভাষায় রচিত সাহিত্য-সহ) - সেসব ক্ষেত্রে একাডেমিকদের বিভিন্ন-রকম ক্লাসিফিকেশন বা মূল্য-বিচারের স্কোপ ও বিভিন্ন বিষয়ে বিভিন্ন মাত্রায় অধিকার তো থাকেই। কিন্তু আমি মনে করি (হ্যাঁ, এসবই আসলে শেষ বিচারে সমস্ত ভুলভ্রান্তির সম্ভাবণা সহ আমার ব্যক্তি-অভিমত মাত্র!) দৈনন্দিন ব্যবহার্য সামাজিক ভাষা মানব-সংস্কৃতিতে একটা অনন্য ফেনোমেনন - যেখানে ঐ সমাজের প্রতিটি সদস্য ঐ অধিকার সংরক্ষণ করেন। এই ভাষা কোনো একাডেমিশিয়ানের চৌদ্দ পুরুষও আবিষ্কার করেন নাই - করেছে আম জনতা (ফলে এটা একাডেমিকের সম্পত্তি না), এই ভাষা নিয়ন্ত্রণের অধিকার বা ক্ষমতাও তাদের নাই, এবং এই ভাষা প্রত্যহ যাপনও তারা নন - সমাজের প্রতিটি সদস্য করে থাকেন। সুতরাং এই ভাষার মালিক এবং "প্রাত্যহিক-সৃষ্টিকর্তা" সমাজের সবাই সমান ভাবেই - এবং এর মধ্যে শ্রেষ্ঠ-অশ্রেষ্ঠ বা বেশি-সুন্দর / কম-সুন্দর জাতীয় ক্লাসিফিকেশনের বিভেদ বপনের তাদের কোনো আলাদা (সমাজের সাধারণ সদস্যপদের বাইরে) কোনো প্রয়োজন, যোগ্যতা, অধিকার বা কর্তৃত্ব নাই। এইসব ক্ষেত্রে আমি যে কোনো কর্তৃত্ববাদী বা কর্তৃপক্ষবাদী মনোভাবের ঘোর বিরোধী।
এইখানে এসে একটু হার্ড-ব্রেক মারি!

ভাষার ব্যাপারে আপনার মতো আমারও এবং আরও অনেকেরই বিভিন্ন ধরণের রিজার্ভেশন বা মতামত আছে। যেমন ধরুন, ফারুকী-ডিজ্যুস স্টাইল,বা বর্তমানে বাংলাদেশে বা ঢাকায় (এবং সোশাল মিডিয়ার বিভিন্ন অংশে) যে একটা জগাখিচুড়ী অর্ধগ্রাম্য-অর্ধশহুরে কিম্ভুতাকিমাকার ডায়ালেক্ট ও উচ্চারণরীতি গড়ে উঠেছে যা শুনলেই আমার কানে-মনে চুলকাতে-না-পারা-চুলকানির মত তীব্র অস্বস্তিকর একটা অনুভূতির সৃষ্টি হয় - কোনো-না-কোনো শেইপ বা ফর্মে কর্তৃত্ববাদী বা কর্তৃপক্ষবাদী কোনো মনোভাব বা কার্যক্রম ছাড়া এর সুসমাধান হবে কি করে?? কর্তৃত্ববাদী বা কর্তৃপক্ষবাদী কাজ/আচরণ/সিদ্ধান্ত ছাড়া কি এর অন্য কোনো সমাধান আছে? নাকি এটা এভাবেই চলতে থাকবে বা চলতে দিতে হবে? এর উত্তর আমার এখনও জানা নাই। এ ধরণের প্রসঙ্গে যেহেতু হিমুর সাথে আগেও আলাপ হয়েছিল, তাই এখানেও তার মতামত পেলে ভাল হতো! হাসি তবে যাইই হোক, এই বিষয়টা (প্রাত্যহিক সামাজিক ভাষা্র সৌন্দর্য্য বা মর্যাদা বিচার বা স্ট্যাটাস নির্ধারণ) আমার মনে হয় "একাডেমিক"-দের এক্তিয়ারের বাইরে - এটা বৃহত্তর সামাজিক / সাংস্কৃতিক প্রয়াসের হাতে ছেড়ে দেয়াই উত্তম।

হেরিটেজ কি? উইলিয়াম এস লোগানের বরাতে উইকিপিডিয়া লিখছে, "Cultural heritage is the legacy of physical artifacts and intangible attributes of a group or society that is inherited from past generations. Not all legacies of past generations are "heritage", rather heritage is a product of selection by society."

ভাষার ক্ষেত্রে এই সিলেকশনটা বা এই ঐতিহ্যের উদযাপণটা পুরো সমাজ, গোষ্ঠী বা ব্যক্তি - যে কেউই করতে পারে তাদের ঐ সমাজে সদস্যপদের অবিচ্ছেদ্য অধিকারে - চাইলে প্রাত্যহিক চর্চাতেই সেটা করতে পারে। কেউ তাকে ঠেকাতে পারবে না এবং কারও সেই অধিকার, এক্তিয়ার বা যোগ্যতাও নেই।

তবে উইকিরই আরেক জায়গায় হেরিটেজের আরেকটা সংজ্ঞা দেখলাম যা আমার কাছে আরও বেশি যুৎসই মনে হচ্ছে এই আলোচনায় -

[ Heritage ] refers to events or processes that have a special meaning in group memory

"পুরান ঢাকা" তার সাধারণ শব্দার্থ বা বানান/উচ্চারণ/বৈয়াকরণিক যথাযথতার প্রশ্নের উর্ধ্বে উঠে গিয়ে আমাদের গ্রুপ মেমোরি বা সামষ্টিক স্মৃতিভাণ্ডারে একটা সদর্থক ট্রিগার-ওয়ার্ড বা চিত্রকল্প বা ট্রিগার-চিত্রকল্প বলে যদি কিছু থাকে তো সেইটার রূপ ধারণ করেছে - যা বর্তমানের বা অতীতের কোনো একটা বিশেষ স্থান-পরিবেশ-পরিস্থিতি-অবস্থা-আবহ-চিত্র-অভিজ্ঞতা ইত্যাদি সংশ্লিষ্ট দৃশ্য-স্পর্শ-গন্ধ-আবেগ-অনুভূতি-ভালোবাসার স্মৃতি তার সমস্ত অনুষঙ্গ সহ তাৎক্ষণিক ভাবে আমার মানসপটে জাগরূক করে যা কিনা "পুরোনো ঢাকা" পারে না কিছুতেই!!! "পুরোনো" ঢাকা ক্যালেণ্ডারের অর্থহীণ-অনুভূতিহীণ রোবটিক আবর্তনে খালি তার পৃষ্ঠা বদলই করতে পারে - আর কিছু পারে না। কালচক্রে কে জানে পুরোনো ঢাকাই হয়তো একদিন নতুন ঢাকা হয়ে উঠবে আবার - যেমন কিনা একদিন সে নতুনই ছিল। তখন সে আর পুরোনো থাকবে না ফিজিকালি এবং ফ্যাকচুয়ালি। কিন্তু স্মৃতিময় অনুষঙ্গসহ "পুরান ঢাকা" হয়তো চিরপুরাতনই থেকে যাবে চিরকাল আমাদের সামষ্টিক স্মৃতিভাণ্ডারে - এবং স্মৃতিময় চিরপুরাতনের ট্রিগার-ওয়ার্ড বা চিত্রকল্প হিসেবেই চিরনতুন থাকবে আমাদের প্রাত্যহিক চর্চায় ও প্রয়োগে। এটাই এর উপরোল্লিখিত "group memory" প্রদত্ত "special meaning"। "সামষ্টিক স্মৃতিস্থিত বিশেষ অর্থদ্যোতক" ফ্রেজ এবং চিত্রকল্প। এজন্যেই এটাকে আমাদের একরকম "ইনট্যাঞ্জিবল হেরিটেজ" বলা যায় হয়তো। এরকম সামষ্টিক স্মৃতিস্থিত বিশেষ অর্থ বা দ্যোতনাবোধক চিত্রকল্পের শ্রেষ্ঠ-অশ্রেষ্ঠ নির্ধারণে একাডেমিকদের কোনো একাডেমিকাল ভূমিকা নাই - আর সবার মত সমাজের সদস্য হিসেবে থাকলেও।

শেষ করি ছোট্ট একটা আত্ন-সংশয় দিয়েঃ আমার ছোট্ট একটা পয়েন্ট জাস্টিফাই করার জন্য অতিরিক্ত বাগাড়ম্বর করে ফেললাম কিনা বুঝতে পারছি না!!! হো হো হো হো হো হো হো হো হো

****************************************

হিমু এর ছবি

ফারুকী-ডিজ্যুস-কলকাতারটিভিরবাঙাল ভাষা (আবাল-বাংলা ১), কিংবা নিশ্চেষ্ট আর অর্ধশিক্ষিতের ইংরেজি পিজিন/ক্রিওল (আবাল-বাংলা ২) ভাষার গোড়াটা অভিন্ন। এর একদিকে আছে নিজের পরিচয় নিয়ে সংকোচ, অন্যদিকে আছে সে সংকোচের সাথে জড়ানো প্রত্যাখ্যান। সংকোচের কারণে এরা যে যার অনায়াসলব্ধ উপভাষাকে (সেটা নোয়াখাইল্যা হোক, বরিশাইল্যা হোক, মমিনসিঙ্গা হোক, সিলটি হোক, কুট্টি হোক, এমনকি 'কথ্য মানভাষা' হোক) পরিবারের বাইরে যে নাগরিক বুদ্বুদ, সেখানে ব্যবহার করতে লজ্জা পায়। আর প্রত্যাখ্যানের কারণে ঐ উপভাষার নিজস্ব সম্ভারও এরা আর কেউ অনুসন্ধান করে না। এতে করে একটা ভাষিক গহ্বর তৈরি হয়, যেটা হাতের কাছে স্বল্প আয়াসে যা কিছু থাকে সেটা দিয়ে ভর্তি হয়।

বিপরীতে রাষ্ট্রপতি হামিদ কিংবা বিএনপির তৈমুর খন্দকারকে সম্প্রচার মাধ্যমে যথাক্রমে কিশোরগঞ্জ আর নারায়ণগঞ্জের উপভাষায় গড়গড়িয়ে হেঁকে যেতে দেখেছি; এঁরা আমার অভিবাদন পাবেন কারণ নিজের কথ্য উপভাষা নিয়ে তাঁদের মনে কোনো সংকোচ বা সংশয় নেই। জার্মানে উপভাষার সীমানাগুলো বেশ স্পষ্ট, রাজনৈতিক নেতারা অনেকেই যুক্তসভায় (বুণ্ডেসটাগ) যে যার কথ্য উপভাষায় লেখ্য প্রমিত জার্মানে বকে যায়, এ নিয়ে কারো কোনো সমস্যার কথা জানি না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠসভায় (সিনেট) দক্ষিণাঞ্চলীয় উপভাষায় গণ্ডায় গণ্ডায় সিনেটর ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে, এ নিয়ে তাদের সমাজে কোনো হেলদোলের কথাও আমার জানা নেই। কিন্তু আমাদের দেশে রাষ্ট্রপতি হামিদ বা তৈমুর খন্দকারের বাচনভঙ্গি নিয়ে প্রচুর দুইদিনের বৈরাগী রাগারাগি বা হাসাহাসি করে। এরাই আবার আবাল-বাংলা ১ এবং/অথবা আবাল-বাংলা ২-এ বলে আর লেখে।

আমরা যখন লিখি, তখন এমন একটা উপভাষাকে প্রমিত ঠাউরে লিখি, যেটা আমাদের রাজনৈতিক সীমানার সামান্য বাইরে। কিন্তু এটাও সবার বোঝা খুব প্রয়োজন, লিখিত ভাষায় যোগাযোগের কাজ লিপিতেই সীমাবদ্ধ। যিনি মমিনসিঙ্গা, তিনি রবীন্দ্রনাথকে হালকে দেওয়ার মতো সুললিত শান্তিপুরী বাংলা লিখেও অনায়াসে মুখে "লড়ছুইন তো মরছুইন" বলতে পারেন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু নিজের এই পরিচয়কে ধামাচাপা দিয়ে তিনি যখন ফারুকী-কলকাতারটিভিরবাঙালভাষার লুঙ্গির নিচে মাথা ঢুকিয়ে আবাল-বাংলা ১-এ কথা বলেন, তখন বুঝে নিতে হবে, তিনি একটা বিকল্প কথ্য মানভাষার সন্ধানে আছেন। আমরা লেখ্য মানভাষাকেই যে যার আঞ্চলিক টানসহ কথ্য মানভাষা হিসেবে চালিয়ে আসছি লম্বা সময় ধরে, যে কারণে এতে একটা মোটামুটি সম্ভারও (কর্পাস) দাঁড়িয়ে গেছে। হঠাৎ কী ঘটলো, যে নিজেদের উপভাষাগুলোর বুঙ্গি বাজিয়ে আমাদের আরেকটা কাইমেরা (সুকুমারের ছড়ায় 'আমি তবে কেউ নই' প্রাণীটা) দাঁড় করাতে হচ্ছে? আমরা কি ভাবছি, লেখ্য মানভাষায় কথা বললে আমরা তলে পড়ে যাচ্ছি? এটা কি কলকাতার সম্প্রচারমাধ্যমের ওপর ঢাকার সম্প্রচারমাধ্যমের মনকালাকালির ফল, যেটা আবালরা না জেনে বা না বুঝে বিপ্লব ভেবে গিলে নিচ্ছে?

এখন আপনার মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে, কর্তৃত্ববাদ দিয়ে আবলামি দমন করা যায় কি না। পৃথিবীর ইতিহাস আর বর্তমান বলে, যায় না। বিপ্লবের গোড়ায় আছে খাটনি, আর আবালবিপ্লবের গোড়ায় আছে আলস্য। এক লক্ষ লোক যদি হেগে শুচু না করে ঘুরে বেড়ায় আর ওটাকেই দ্রোহ/বিপ্লব ভাবে, একা কর্তৃত্ববাদ বদনা হাতে কয়দিকে দৌড়াবে? যদি স্বাভাবিক উপভাষাগুলো নিয়ে সরস, বুদ্ধিদীপ্ত, নতুন কাজ হয় (এই মুহূর্তে মনে পড়ছে হুমায়ূন আহমেদের বহুব্রীহিতে কাদেরের চিরায়ত সংলাপ, "ভালোবাসা হৈল গিয়া একটা শরমের ব্যাফার"), আবাল-বাংলার পালে হাওয়া এমনিতেই নেমে যাবে।

তপন রায়চৌধুরী মোটামুটি একা হাতে বরিশাইল্যা উপভাষার মাধুর্য আর সুষমাকে নবীন পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন (মিহির সেনগুপ্তও পরে পোঁ ধরেছেন)। আধেয় যদি ভালো হয়, আধার গতি পাবে, হয়তো টিকেও যাবে। যারা সর্বগ মাধ্যমগুলোতে কাজ করে, তাদের মধ্যে পড়ার অভ্যাস তৈরি হলে এসব উদাহরণের কথা তারা জানবে, হয়তো প্রত্যয়ও ফিরে পাবে।

অতিথি লেখক এর ছবি

সবই আসলে অভ্যস্ততার ব্যাপার। ধীরে ধীরে সবাই অভ্যস্ত হয়ে যাব। অভ্যস্ত হওয়ার জন্য প্রয়োজন প্রয়োগ/ব্যবহার। ক্লিশে ব্যবহারেই নতুন শব্দ স্বাভাবিকতায় রূপ নেবে বলেই আমার বিশ্বাস।

উদ্ধৃতি মৈনাক তান

পরাগ এর ছবি

রাজীব ভাই, আপনার এ ধারার লেখা অনেকদিন ধরে চলবে আশা করছি। শুধু নগরী ঢাকা নিয়ে চিন্তাই নয়, নগরী ঢাকা নিয়ে প্রাঞ্জল বাংলায় চিন্তার উদাহরণ হয়ে আপনার সঙ্গী স্থপতি ও নগরনবিসদেরও এ লেখামালা উদ্দীপ্ত করুক। (আপনাদের আলাপে আশকারা পেয়ে নগরনবিশ শব্দটা বানিয়ে ফেললাম। ফার্সি 'নবিশ' মানে যিনি রচনা করেন। নগর-পরিকল্পক বললে কথাটা বেশি বড় হয়ে যায় বলে বিকল্প খুঁজছিলাম, হঠাৎ মনে হল একজন পরিকল্পক তো রচনাই করেন। জানি না ঠিক বুঝলাম বা বোঝালাম কি না।)

মানুষের সাথে মানুষের যে হৃদয়রসে সিক্ত যোগাযোগ, সেটা ঘটানোর সামর্থ্য নগরী ঢাকা ক্রমশ হারিয়ে ফেলছে বলেই আমার উপলব্ধি। একজন রসিক, বুদ্ধিমান, সৃজনশীল মানুষ (নারী-পুরুষ-তৃতীয়লিঙ্গ সবাই) এ নগরীতে নিজের গুণ চর্চা করে এবং সে চর্চায় অংশী নাগরিকের পক্ষ থেকে সাড়া আর উৎসাহ পেয়ে নিজেকে কতটুকু বাড়াতে পারেন, সে ব্যাপারে এক বিষণ্ণ সংশয় মনে কাজ করে। সামাজিক যোগাযোগের কারণে যে অহম-চর্চার এক বিকার তুমুলভাবে চলছে, এটাও এক একজন মানুষকে যৌথকর্ম (collaboration) থেকে ক্রমশ দুর্বল ও করুণ আত্মমগ্নতার দিকে ঠেলছে। এর ছাপ প্রতিদিন বিকটভাবে আমাদের সামষ্টিক ইন্টেলিজেন্টসিয়াতে দেখি। স্থপতি আর নগরনবিশরা কি সমষ্টির সমস্যা সমাধানের চিন্তার অবসরে ব্যষ্টির এই ক্রমশ ক্ষয়কে ঠেকান নিয়ে কিছু ভাবেন? আমাদের কি সুযোগ আছে কোনও স্থাপনাকে ঘিরে সামাজিক Synergy সৃষ্টি করার?

অতিথি লেখক এর ছবি

সামাজিক যোগাযোগের কারণেই যে এই শহরে 'অহম-চর্চার এক বিকার' চলছে কিনা তা নিশ্চিত নই। আধুনিকতাবাদ বা মডার্নিজমকে সহজে ব্যাখ্যা করতে যে বাক্যগুলোর সাহায্য নেওয়া হয় তার একটা হ'লো, রাইজ অব দ্যা ইগো। আমার বরং খানিকটা মনে হয় আহম-চর্চার আকাঙ্ক্ষা আছে ব'লেই এতএত 'সোশ্যাল মিডিয়া'র বিস্তার। ভুললে চলবে না আমাদের এখনকার শহরগুলো গ'ড়ে তুলতে আধুনিকতাবাদের প্রবাদপ্রতিম ভূমিকাকে।
যা হোক, লেখা চালিয়ে যাওয়ার আগ্রহ আছে। আমার জায়গা থেকে ঢাকাকে জানানো তাকে নিয়ে আমার মূল্যায়ন। এক ধরণের নাগরিক দায়িত্বও বলা যায়। অবশ্য শেষ পর্যন্ত কতটা দায়িত্বই আর পালন করা হয় মানুষের !
(রাজীব)

হিমু এর ছবি

নগরনবিশ শব্দটা পছন্দ হয়েছে।

কাজী  এর ছবি

নবিশ প্রত্যয় যুক্ত বাংলা ভাষায় আরেকটা বেশী প্রচলিত শব্দ হচ্ছে নকলনবিশ। এদের কাজ হচ্ছে জমির দলিলের প্রতিলিপি হাতে লিখে তৈরি করা। অনলাইন বাংলা অভিধানে নবিশ প্রত্যয় যুক্ত আরেকটা শব্দ দেখলাম; হিসাবনবিশ। মানে একাউন্টান্ট বা হিসাবরক্ষক । নকলনবিশ আর হিসাবনবিশ - দুই জনের কাজের ধরন করণিক ধাঁচের । কিন্তু নগরপরিকল্পনাবিদ বা নগরপরিকল্পক কিন্তু শুধু করণিক কাজ করেনা; তাঁর কাজের মধ্যে সৃজনশীলতাই বেশী যেটা "নগরপরিকল্পনাবিদ" বা "নগরপরিকল্পক" ফুটিয়ে তোলে। নগরনবিশ শ্রুতিমধুর; কিন্তু বাংলাভাষায় যে অর্থে "নবিশ" প্রত্যয় যোগ হয় সে অর্থে নগরনবিশ মানানসই হবে কি?

সেলিম জাহাঙ্গীর এর ছবি

একাউন্টেন্ট কবে থেকে করনিক হল? আর সৃজন শীলতা সব কাজেই আছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।