হাসিনা' কে ঘিরে কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিময়তা ।। পর্ব ৩

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: বুধ, ১৮/০৭/২০০৭ - ৬:২৭পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

১৯ বছর আগের সেইদিনগুলোতে ই-মেইল,মোবাইল ফোন আমাদের কল্পনাতেও ছিলোনা ।ল্যান্ডফোন ও বিরল ছিলো ছোট্ট মফস্বলে ।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের বেডে শুয়ে বোন আমাকে চিঠি লিখে। 'জলদস্যুর দ্বীপ পড়া শেষ,মুসা আমানটা ভীষন পাজি, বেশীক্ষন পড়তে পারিনা-বুকে খুব ধড়ফড় করে,মাঝে মাঝে শ্বাস আটকে যায়'

আমি ও চিঠি লিখি-'এমিলের গোয়েন্দাবাহিনী পড়েছি । বড় মামা তোকে দেখতে গেলে বইটা পাঠাবো । আমার বৃত্তি পরীক্ষা সামনে ।পড়তে ভাল্লাগেনা'

বোন এবার ফিরতি চিঠিতে লিখে-'মেজোমামার সাথে বংগবন্ধুর বাড়ি গিয়েছিলাম । থোকা থোকা রক্ত দেয়ালে লেগে আছে । ইস, একটুর জন্য হাসিনার সাথে দেখা হলোনা '

এবার আমার ইর্ষা হয় । ইস! বোন ও বাড়ী ঘুরে এলো , আমার যাওয়া হলোনা । বড় মামা ঢাকা যাবেন ওকে দেখতে । আমি বায়না ধরি । আমাকে ও নিতে হবে সাথে ।

যাওয়া হয় । সেই প্রথম মফস্বলে জন্ম নেয়া আর বড় হয়ে উঠতে থাকা আমার প্রথম নগর যাত্রা ।
এখন শুনি বিলাসবহুল বাসে ঘন্টা চারেকে রাজধানী পৌঁছে যাওয়া যায় । মেঘনা ব্রীজ হয়ে গেছে ।

১৯৮৮তে প্রায় দশবারো ঘন্টার বাসযাত্রা । আমি জানালার পাশে বসেছিলাম । শহর সিলেট পেরিয়েই বদলে যায় আমার পৃথিবী । এই পৃথিবী আমার চোখে ধরা দেয়নি তার আগে । সম্ভবতঃ বর্ষাকাল ছিলো । সিলেট-ঢাকা মহাসড়কের দু পাশে বিশাল বিশাল হাওর । আদিগন্ত জল । জল ছুঁয়ে আছে মহাসড়কের বুক । হাওরের বুক জেলে নৌকা । দ্রুত সরে যায় । আমি বিস্মৃত হই, মৃত্যু নিশ্চিত প্রায় সহোদরার কথা । দৃষ্টিসীমানা থেকে হাওর সরে গেলে পর সহসা প্রবেশ করে বিস্তীর্ন সবুজ । ছোট ছোট টিলা, চা বাগান । মহাসড়ক সরু হয়ে আসে আর বাড়তে থাকে চা-বাগানের সীমানা । দূরে,আরো দূরে উঁকি দেয় নীল পাহাড়ের রেখা । সেইসব রহস্যময়তা আমাকে গ্রাস করে ।

মেঘনা ফেরী ঘাটে এসে বাস থামলে পর আমরা নামি । ফেরীতে উঠি । এই মেঘনা! বিশাল মেঘনা। আমি কালনী পাড়ের ছেলে । মেঘনার গল্প শুনেছি শৈশব থেকে । আমাদের কালনী গিয়ে মিশেছে মেঘনাতে । নদী মিশে যায় যে নদীতে কতো বিশাল সে আদতে? কল্পনার ঐ বিশালতাকে এবার স্পর্শ করি দৃষ্টিতে । গল্প শুনেছিলাম মেঘনার চরে নাকি কুমীর রোদ পোহায় । সেই বর্ষার দিনে রোদ ছিলোনা কিনা আজ আর মনে করতে পারিনা । তবে একটা কিশোরের ছবি চোখে ভাসে এখনো-খুব কৌতুহলে সে তাকিয়ে আছে মেঘনার জলে । কোথাও হয়তো ঘাঁই দিল একটা শুশুক কিংবা পানকৌড়ি!

সন্ধ্যা পেরুবার পর আমরা নামি নগর ঢাকাতে । ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের রাজধানী শহর আমার আতংক হয়ে যায় প্রথম দর্শনেই । তীব্র হর্ন দিয়ে ছুটে যাচ্ছে পুলিশ ভ্যান । মেশিনগান উঁচিয়ে আর্মির ট্রাক । আমার মনে পড়ে,বছর পেরোয়নি নুর হোসেনকে গুলী করে হত্যা করা হয়েছে এই ঢাকার রাস্তায় । ছোট্ট মফস্বলের সরকারী স্কুল থেকে আমরা রাস্তায় বেরিয়ে এসেছিলাম প্রতিবাদ মিছিলে ।
এইসব মনে পড়ে যায়,আমি বড় মামার হাত ধরি আরো শক্ত করে ।

আমরা যাই সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ।
হৃদরোগ বিভাগে সারি সারি বেড । একটা বেডে বসে আছে প্রায় হাড্ডিসার কোমল কিশোরী । আমার বোন । প্রায় ছয় মাস পর দেখা । অনেক বদলে গেছে । আমার চিনতে কষ্ট হয় । এই আমার বোন তো?
বোন হাসে । আমার হাত ধরে । আমার ঘ্রান নেয় । চুলে হাত বুলায় । পাশের বেড থেকে উঁকি দেয় প্রায় একই বয়সের আরেক কিশোরী ।
বোন আমাকে বলে-'আয় আমার বান্ধবীর সাথে পরিচয় করিয়ে দেই'

পরিচয় হয় । ওর নাম রীনা । রীনা এসেছে আংগুরপোতা দহগ্রাম থেকে । ওর ও হার্টের অসুখ । ওর দুটো ভাল্বই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । তবু কি অদ্ভূত হাসিমুখ মেয়েটার । কোঁকড়ানো কালো চুল সারা মাথা জুড়ে । চোখের নীচে একটা কালো তিল । এই ছবিটা আটকে ছিলো আমার স্মৃতিতে দীর্ঘ অনেকদিন ।
রীনার গল্প শুনি । সেই প্রথম আমি শুনি ছিটমহলের কথা ।ওখান থেকে নাকি যখন খুশি আসা যায়না দেশের অন্য অংশে । রীনাকে আমার গল্পের রহস্যময় রাজকুমারীর মনে হয় ।
রীনা বলতে থাকে-রাষ্ট্রপতি গিয়েছিলো সেই দহগ্রাম আগুরপোতায় হেলিকপ্টারে চড়ে । সেখানকার লোকজন রাষ্ট্রের পতিকে শুনেয়েছিল এক অসুস্থ কিশোরীর কথা যার চিকিৎসা অসম্ভব সেই ছিট্মহলে । সেই রাষ্ট্রপতির মন ভীষন কোমল । মেয়েটার কথা শুনে তিনি কেঁদে ফেলেন । জনসভায় ঘোষনা দেন মেয়েটির চিকিৎসার সমস্ত দায়িত্ব তাঁর ।
তারপর কয়েক হাজার মানুষের হর্ষধ্বনিকে ছাপিয়ে রাষ্ট্রপতির হেলিকপ্টার রাজধানী ফিরে সেই মেয়েটিকে সাথে নিয়ে ।

(আরো কিছু গল্প বাকী রয়ে গেছে)
--------
--------

[
রীনার সাথে আমাদের যোগাযোগ ছিলো আরো বছর দুয়েক । ওর অপারেশন হয়েছিলো রাষ্ট্রপতির বিশেষ নির্দেশে । ফিরে গিয়েছিলো দহগ্রামে । কিন্তু প্রতি মাসে ওকে ঢাকায় আসতে হতো চেকআপের জন্য । রাষ্ট্রপতির হেলিকপ্টার নিয়ে আসতো ওকে,চেকআপ শেষে ফিরিয়ে দিয়ে আসতো সেই যোগাযোগ বিবর্জিত ছিটমহলে ।
রীনার শেষ চিঠি পাই নব্বুই এর ডিসেম্বর কিংবা একানব্বুই এর জানুয়ারীতে । গনআন্দোলনের বিজয়ী সৈনিক তখন,পৃথিবীটাই যেনো চাইলে জয় করে ফেলা যায় । রীনা চিঠি লিখে,দয়ালু রাষ্ট্রপতির পতনে তার সমবেদনা আর নিজের জীবনহানীর আশংকা জানিয়ে । চিকিৎসার কিছুটা বাকী রয়ে গেছে এখনো । কিন্তু নতুন রাষ্ট্রপতি কি হেলিকপ্টার পাঠাবেন আংগুরপোতা দহগ্রামে,খুব সাধারন একটা মেয়ের চিকিৎসা পর্ব শেষ করার জন্য?
চিঠির উত্তর দেয়া হয়না । চিঠি হারিয়ে যায় । হারিয়ে যায় কোনো এক ছিটমহলে বন্দীনি দুঃখিনী রাজকন্যা
]


মন্তব্য

ঝরাপাতা এর ছবি

আবারো এক বুক কষ্ট।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

দীর্ঘশ্বাস!

অমিত আহমেদ এর ছবি

আপনার এই সিরিজের কোন পোস্টে আমি আর মন্তব্য করবো না। এই সিরিজের লেখা গুলো পড়েই মনটা হু হু করে ওঠে। অন্য কিছুতে মন বসে না আর। কতটা ছুঁয়ে গেছে সেটা বোঝাবারও ভাষা পাইনা খুঁজে। শুধু জেনে নেন, প্রতিটা লাইনই গভীর মমতা নিয়ে পড়ছি।


আমার বেলা যে যায় সাঁঝ-বেলাতে
তোমার সুরে সুরে সুর মেলাতে

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

লেখাগুলো পড়ে মনে হয় কিছু লিখি। লেখার প্রতি সম্মান জানিয়ে, যাদের নিয়ে লেখা তাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে। কিন্তু লিখতে গেলে শূন্য হাতে বসে থাকতে হয় অনেক্ষণ।

??? এর ছবি

সবই ভাল, শিরোনামটার উপলক্ষ এখনো আসে নি। আসবে, আশা করছি।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

মোরশেদ,পড়ছি প্রতিটি পর্ব।
তোর লেখার সাথে পরিচিত প্রায় ১৪/১৫ বছর।তাই মনে হচ্ছে এ লেখাগুলো তুই লিখছিস না,লেখা হয়ে যাচ্ছে এমনিতেই।

একটা প্রস্তাব করতে চাই।
খুব দ্রুত কি লেখা হয়ে যেতে পারে না একটা ই-বুক?
একটু ধারাবাহিকতা রক্ষা করে গেলেই চলে।
মফস্বল শহরে বেড়ে ওঠা এক কিশোর,তার স্বপ্ন,তার সংগ্রাম,তার আটপৌরে জীবন।

জীবন সংগ্রামে পর্যুদস্ত বাবা,মৃত্যুর খুব কাছাকাছি বাস করা পিঠাপিঠি বোন,মফস্বল থেকে ঢাকা আসার পথে ধূ..ধূ জলরাশি......জীবনের এক অন্যরকম সত্য গল্প।
এ কালের এ যুগের অন্য এক পথের পাচালি।
দেখবি চিন্তা করে?

-----------------------------------
কিস্তিমাতের যুদ্ধ শেষে,সাদাকালো ঘুটিগুলো এক বাক্সেই ফেরত যাবে...

অতিথি এর ছবি

বর্ননা অসাধারন। পরের পর্বের অপেক্ষায়।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

কৃতজ্ঞতা আবারো সকলে ।

আরিফঃ
নারে বন্ধু,অতোটুকু হবেনা এবেলা ।

অতিথিঃ
সবিশেষ কৃতজ্ঞতা হে অচেনাজন
-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

নিঘাত তিথি এর ছবি

পড়ে যাচ্ছি।

--তিথি

----------------------------------------------------
আমার এই পথ চাওয়াতেই আনন্দ

তারেক এর ছবি

এই নিয়ে কতবার পড়লাম লেখাটা? জানি না। কি মন্তব্য করব? গলা বুঁজে আসছিল বারবার আমি কিছু ভাবতে পারছিলাম না কি বলব, কি লিখব। শেষ পর্বটা হঠাৎ শেষ হয়ে গেল। শুধু কষ্ট হয়, আমরা কীরকম ভাবে বেঁচে আছি।
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।