বর্ডার লাইনের গল্প

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৯/১১/২০১২ - ৪:৫৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমি গল্প লিখছিনা দুবছরের অধিক কাল। শেষ গল্প বোধ হয় লিখেছিলাম যে বছর দেশে ফিরে আসি সে বছরের শেষের দিকে, বিদেশ বিভুঁয়ে বসে- দেশের গল্পই। দেশে ফিরে আর দেশের গল্প হয়নি, বিদেশের ও না।
তবে দেশে ফিরে ঘুরাঘুরি হয়েছে বেশ। আমি যে শহরে থাকি তাকে উত্তর পূর্ব থেকে উত্তর পশ্চিম দিকে ঘিরে রেখেছে বেশ দীর্ঘ এক পাহাড় শ্রেনী। একেবারে উত্তর-পুর্বে শুরু জৈন্তিয়া পাহাড়, এটি এসে মিশেছে পূর্ব খাসিয়া পাহাড়, পূর্ব এসে মিশেছে পশ্চিম পাহাড়ে, সেই পশ্চিম শেষ হতে হতে গারো পাহাড়ের শুরু। বিচ্ছিন্নভাবে পশ্চিম খাসিয়া পাহাড়ের নীচ থেকে গারো পাহাড়ের দিকে ঘুরেছি কিন্তু অবিচ্ছিন্নভাবে জৈন্তিয়া পাহাড়ের নীচ থেকে পাশ্চিম খাসিয়া পাহাড়ের শুরু পর্যন্ত পুরোটাই ঘুরা হয়েছে পায়ে হেঁটে।

এই হাঁটাহাঁটির মধ্যে গল্প আছে, গল্প হয়েছে। মানুষের গল্প, প্রকৃতির গল্প, নদীর গল্প। কমলার বাগান বদলে গিয়ে কী করে পাথরের কোয়ারী হয়ে গেলো, কী করে বসত ভিটার নিকোনো উঠোন হয়ে গেলো ৭০ ফুট গভীর হা, কী করে আদি মানুষেরা নাই হয়ে গেলো আর শূন্য ভরলো এসে শেকড়হীন মানুষের দল, কী করে মানুষের ক্ষিধে আর লোভের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ করছে ভবিষ্যতের চিন্তা। এইসব গল্প ফিকশনের মোড়কে ঢুকানো যায়না অথবা যায়, আমি পারিনা। বরং এইসব গল্প আমি শুনি, লেখনী না হক শ্রুতি তো ঋদ্ধ হলো।

শেষবার গিয়েছিলাম ভোলাগঞ্জ। ভোলাগঞ্জ থেকে পূর্ব দিকে দয়ার বাজার থেকে হাঁটা শুরু করেছিলাম- সাথে ছিলো দুই বন্ধু , ছোটভাই। ভোলাগঞ্জ থেকেই চিহ্ন পেতে থাকি বোমা মেশিনের ছড়ানো ছিটানো যন্ত্রাংশের। আর কয়দিন পরই এগুলো জোরা লাগবে, মাটির ৭০ ফুট গভীর থেকে তুলে নিয়ে আসবে পাথর, বালির স্তুপ হতে থাকবে দুই পাশে, গভীর গর্ত। ভোলাগঞ্জ থেকে জাফলং পর্যন্ত দীর্ঘ লাইন এরকম বিশাল বিশাল গর্ত তৈরী হবে। আগামী বর্ষায় ঢল নামবে, মানুষের তৈরী করা গভীর গর্তে পাহাড়ী ঢলের স্বাভাবিক গতিপথ বাধা পাবে, জনপদ ভেঙ্গে নিয়ে যাবে।
উথমার পাহাড়ী নদীতে তখন পানি নেই। বিশাল সব পাথর ছড়ানো নদীর বিস্তৃতিতে , এই মৃতপাথরগুলোর এখনো অর্থমূল্য নেই এখনো, তাই উচ্ছেদ ও নেই আপাততঃ। বিজিবি ক্যাম্প পেরিয়ে সালমা বেগমের সাথে দেখা হয়, সালমা কথা বলছিলেন তাঁর ছেলের সাথে ‘সিলেটি’তে। সিলেটের বর্ডার লাইন জুড়ে ‘ সিলেটি’ সংখ্যালঘুদের ভাষা। সালমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী হই।
সালমা ও হয়তো আমার ‘সিলেটি মাত’ শুনে স্বচ্ছন্দ্য হন।
সালমা ছিলেন সালুটিকরের মেয়ে। স্বাধীনের পর বিয়ে হয়ে আসেন এই অঞ্চলে। সালমা বলেন- এই পুরো এলাকায় ছিলো ‘খাসিয়া’ রা। আর ছিলো তাদের কমলা বাগান। সালমার শ্বশুড়ের পরিবার সহ কয়েক ঘর ছিলেন সিলেটি বাঙ্গালী। তারা ও খাসিয়াদের পাশাপাশি কমলার চাষ করতেন। আর কোন ‘মানু’ ছিলোনা এখানে।
তো এই মানুষেরা গেলো কই? এই ‘খাসিয়া’রা, এই ‘সিলেটী’রা? কই গেলো ‘কমলার বাগান? যারা আছে এখন, তারা এলো কোত্থেকে?
সালমা বেগম তার মতো করে বলেন- তিনি আসার পাঁচ ছয় বছর থেকেই খাসিয়ারা নাই হতে থাকে, নাই মানে পিছনের পাহাড়ের দিকে তারা সরে যেতে থাকে।
আর কারা আসে?

কুমিল্লা, ময়মনসিংহ, নোয়াখালী থেকে ‘মানু’ রা আসতে থাকে। আমি হিসেব মেলাই - সময়টা তাহলে ‘৭৬-‘৭৭?
সামরিক শাসনামলের প্রথম পর্বে যখন পার্বত্য চট্রগ্রামে পাহাড়ীদের হটিয়ে দিয়ে ট্রাক ভরে ভরে সমতলের মানুষ নিয়ে বসতি গড়ে দেয়া হয়েছে- একই সময়ে কী সিলেটের দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে ও তাই করা হয়েছে? পরিকল্পিত ভাবেই?
লোভাছড়া থেকে লালাখাল, তামাবিল, জাফলং, পাংথুমাই, কুলুমছড়া, বিছনাকান্দি, উথমা, ভোলাগঞ্জ, বাঁশতলা, ডলুরা হয়ে বারিক টিলা, বড়ছড়া, টেকেরঘাট পর্যন্ত ঘুরাঘুরি করতে করতে এই সন্দেহ আমার মাঝে প্রবল হয়ে উঠে?
এই দীর্ঘ সীমান্ত লাইনের জনমিতি বদলে গেলো কেনো?

যদি এই জনমিতি বদলে না যেতো তাহলে কী সীমান্ত লাইন জুড়ে পাথর, বালু, কয়লা উত্তোলনের নামে নদী ও ভূমিকে ক্ষতবিক্ষত করার যে ভয়ংকর চর্চা চলছে, সেটী হতোনা? হয়তো হতো, হয়তো না। সালমা বেগম বাধ্য হয়েছেন তাদের বসত ভিটা পাথরখেকোদের কাছে বিক্রী করে দিতে কারন এর নীচে অনেক ‘ট্যকার মাল’

মানুষের গল্পের পাশে শুয়ে থাকে নদীর ও গল্প। যে নদীর গল্প আছে হাজার বছরের, ইবনে বতুতার চক্করে, যে নদী নীল। সেই নদীর জন্য অভিশাপ তার উৎসের পাহাড় থেকে ভেসে আসা কয়লার গুঁড়ো আর চকচকে বালি। দুটোরই অর্থ মুল্য আছে, অতএব নদীর বুক আর দুই তীর খুঁড়ে খুঁড়ে কয়লা উঠছে, নদীর নীলে কয়লা ধুঁয়া চলছে, আমদানী হয়েছে তিন শতাধিক বিশেষজ্ঞ শ্রমিকের যারা নেত্রকোনার সোমেশ্বরী নদীতে একই কাজে অভিজ্ঞ।
আদালত আছে, আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি আছে, গনতন্ত্র ও আছে। গনতন্ত্রের নামে মানুষের উচ্ছেদ আছে, নদীর হত্যা আছে। এই বহুবর্ণের বিচিত্র থাকার যুগে মানুষের ক্ষুধা, লোভ ও গোগ্রাসের বাইরে তেমন কোন মৌলিক গল্প শ্রুত কিংবা লিখিত হয়না।


মন্তব্য

স্যাম এর ছবি

ভূমিকা হিসেবে নিলাম গল্পের -- আরো গল্প চলুক - ফিকশনের মোড়ক দরকার নেই, এমনিই জানার আগ্রহ বাড়িয়েছে, অপেক্ষায় থাকলাম।

রণদীপম বসু এর ছবি

এই বহুবর্ণের বিচিত্র থাকার যুগে মানুষের ক্ষুধা, লোভ ও গোগ্রাসের বাইরে তেমন কোন মৌলিক গল্প শ্রুত কিংবা লিখিত হয়না।

আসলে সব গল্পের চুম্বক-কষ্ট তো এটাই ! গল্প গল্পের মতোই থেকে যায় শেষ পর্যন্ত, কেবল বাকি সব ঠিকই বদলে যেতে থাকে তার নির্মম ক্ষুধা আর নির্লজ্জ লোভের বলী হতে হতে।।।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আজকের দেখা দৃশ্য, সালমা কথন - একদিন গল্প হয়ে উঠবে; আমি নিশ্চিত।
খানিক দূর থেকে যেমন অনেক জিনিস স্পষ্ট দেখা যায় সেরকম।

"ভ্রমণ আনন্দময় হয়েছিল" হয়তো একটা উপন্যাসের শিরোনাম হবে। হাসি

তানিম এহসান এর ছবি

স্বোমেশ্বরী নদী’তেও মনে হয়না বন্ধ হয়েছে এই কাজ, কোথাও না। লুটপাটের চোটে দগদগে ঘা এর মত হয়ে গেছে সব নদী। আপনি আমরা যেভাবে আমাদের নদীগুলো হত্যা করছি [ পর্ব ১] এই লেখাটিতে ভিন্ন আঙ্গিকে হলেও আলোকপাত করেছিলেন, যোগ করে দিলাম।

আরেক বিষয় যোগ করতে চাই: নদী’তে নদী’র জেলেরা মাছ ধরতে পারে না, মাছের ইজারা নিয়ে নদী থেকে শুরু করে দীর্ঘ জলাশয়গুলোতে বিদেশী মাছের ভিড়ে হারিয়ে গেছে সব দেশি প্রজাতি, নদী’র তীর দেশি গাছ নেই, এমনকি বর্ষা মওসুমে প্রচুর নদী থকথকে কাদার গহ্বরের ভেতর শুয়ে থাকে, বালি উঠিয়ে ব্রীজের তলা খালি। লুটপাট সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে এই দেশে বহু আগেই।

পোস্টে পাঁচতারা।

কাজি মামুন এর ছবি

ট্যাকার মাল, জনপ্রতিনিধি, আদালত, সামরিকতন্ত্র এসবই যেন এক সূত্রে গাঁথা। আর তাই হারিয়ে যায় খাসিয়ারা, কমলার বাগান, ইবনে বতুতার নীল নদী। অবশিষ্ট থাকে শুধু গভীর গর্ত, বালু, কয়লা, আর পাথর। সবুজ দেহ ভরে উঠছে পাথরে, একদিন হয়ত পরিচিত হবে পাথুরে দেশ হিসেবে। যদি না আমাদের খিদে আর হা গুলোকে কষে ধরা না যায়!
অসাধারণ, সময়োপযোগী, আর মর্মস্পর্শী একটা লেখা, হাসান ভাই।
এই গল্পগুলো আরো লিখতে হবে, আমাদের জন্যই। আমরা যে পাথর আর কয়লা হয়ে যাচ্ছি সবাই!

দিগন্ত এর ছবি

অনেক দিন ধরেই বাংলাদেশ সীমান্তের কথা পড়ার সময়ে মনে হয়েছিল দুপাশেই তো পাহাড়িদের থাকার কথা - এখানে সমস্যা আসছে কি ভাবে। সেইটা এবার পরিষ্কার হল, সীমান্তে আসলে দুইপারে দুই-জাতি - একপাশে বাঙালী অন্যপাশে পাহাড়ী।


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

হাসান মোরশেদ এর ছবি

আরেকটা হিসাব আছে দিগন্ত। আমাদের সীমান্ত লাইনে স্থানীয় বাঙ্গালীদের ও বিশ্বাস করা হয়নি। স্থানীয়দের সরিয়ে পরিকল্পিত ভাবে দূরের জেলাগুলো থেকে মানুষ এনে বসানো হয়েছে। এটাও নিশ্চয়ই জেনারেলদের তথাকথিত নিরাপত্তা পরিকল্পনার অংশ ছিলো।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

দিগন্ত এর ছবি

তাও তো ভাল, আপনি লিখেছেন, আমাদের পাড়ে কি ঘটে আমি জানিও না। মন খারাপ


পথের দেবতা প্রসন্ন হাসিয়া বলেন, মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি তোমাদের গ্রামের বাঁশের বনে । পথ আমার চলে গেছে সামনে, সামনে, শুধুই সামনে...।

অরফিয়াস এর ছবি

গনতন্ত্রের নামে মানুষের উচ্ছেদ আছে, নদীর হত্যা আছে। এই বহুবর্ণের বিচিত্র থাকার যুগে মানুষের ক্ষুধা, লোভ ও গোগ্রাসের বাইরে তেমন কোন মৌলিক গল্প শ্রুত কিংবা লিখিত হয়না।

শেষে এসে দারুন আঘাত লাগলো। গুরু গুরু

পাহাড়িদের যেভাবে তাদের বাস্তুভিটা থেকে পরিকল্পিতভাবে উচ্ছেদ করা হয়েছে তার গল্প আমাদের সমাজে নিষিদ্ধ গল্পের মতোই রয়ে গেছে। এ কথা কেউ বলেনা, কিংবা বলা হয়না।

----------------------------------------------------------------------------------------------

"একদিন ভোর হবেই"

রিক্তা এর ছবি

আমাদের শুধু দুঃখের গল্প। একটা দুঃখের গল্প শেষ না হতেই আরেকটা শুরু হয়। আমরাও আগের দুঃখ ভুলে নতুন গল্পে হামলে পরি। আপনার লেখাটা মনের অনেক গভীরে আঘাত করলো। এই গল্পটা মনেহয় এতো সহজের ভুলতে পারবো না।

--------------------------------
হে প্রগাঢ় পিতামহী, আজো চমৎকার?
আমিও তোমার মত বুড়ো হব – বুড়ি চাঁদটারে আমি করে দেব বেনোজলে পার
আমরা দুজনে মিলে শূন্য করে চলে যাব জীবনের প্রচুর ভাঁড়ার ।

সাবেকা  এর ছবি

লেখাটার শেষ লাইনগুলো গহীনে ছুঁয়ে গেল । আপনি চাইলে হয়ত আরো অনেক কিছু লিখতে পারতেন, হয়ত কোন একদিন লিখবেন,গল্প কিংবা গল্প নয় বাস্তব কাহিনীগুলোই শুনবার জন্য অপেক্ষায় থাকলাম ।
চলুক

তারেক অণু এর ছবি

অসাধারণ, পরবর্তী পর্বের অপেক্ষায়। খুব করুণ কাহিনী কিন্তু আমাদের জানা থাকা দরকার কী হয়েছে এবং কী হচ্ছে

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।