।। যাপিত জীবন ও এইসব বিবমিষা-২ ।।

হাসান মোরশেদ এর ছবি
লিখেছেন হাসান মোরশেদ (তারিখ: শনি, ২৯/০৯/২০০৭ - ৭:১৬অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সেই সন্ধ্যা কেটে যায় প্রবল স্নেহ ও স্মৃতিচারিতায় ।
নানীকে জড়িয়ে ধরে থাকি অনেকক্ষন । বুড়ি আমার মাথায়,শরীরে হাত বুলান । টেবিল ভর্তি খাবার । ইফতারীর বিশাল আয়োজন । বুড়ি তবু খুশী নন যেনো । 'কি খাবি ভাই বল । পিঠা বানাই?'
আমি হাসি । 'নানু,বুগনী খাওয়াতে পারো?'

বুড়ী বড়ো বেদনাকাতর হন । খুব ছোটবেলায় প্রায় দু'যুগ আগে তখনো গ্রামের সাথে আমাদের চিরস্থায়ী সম্পর্কহীনতা ঘটেনি,তখনো গ্রাম পর্যন্ত পাকা সড়ক যায়নি,নদীতে ইঞ্জিনের নৌকা নামেনি,বিদ্যুৎবাতির ঝলক পৌঁছায়নি । তখনো গ্রামে যাওয়া হতো অন্ততঃ বৈশাখে । নতুন ধানের চারা দিয়ে এক অদ্ভুত ঘ্রানময় ক্ষীরের মতো কিছু একটা বানানো হতো । 'বুগনি' তার নাম । সেই শৈশবে আমি তার রঙ দেখতাম গোলাপী ।

অন্ততঃ দু যুগ,সেই নতুন ধানের চারার ঘ্রান নেয়া হয়নি আমার । সে দু যুগ আগে এই বুড়ী তখনো ফুরিয়ে যাননি । আমার স্মৃতিতে ভাসে,বাড়ীর কোন এক মেয়ের বিয়ে হচ্ছে । বিয়ের অনুষ্ঠানে মেয়েরা গোল হয়ে 'দামাইল' নাচছেন, রাধারমনের গান সহযোগে । নতুন ধানের ঘ্রানের মতোই কেবলই স্মৃতি,কেবলই দীর্ঘশ্বাস সেইসব সংস্কৃতি । পাকা দালান উঠেছে গ্রামের বাড়িতে,ধর্মের দেয়াল আরো বেশী চেপে বসেছে জীবনযাপনে ।

আরো পরে এক বন্ধুর ফোন আসে । লন্ডনে এক বাংলা টিভি চ্যানেলে কাজ করে । সেই টিভি চ্যানেলের স্টুডিও ছিলো সিলেটে । বন্ধু আসলে কাজ করতো ওখানে । প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতি আর গ্রুপ থিয়েটারে অসম্ভব ডেডিকেটেড ছিলো । একটা দীর্ঘসময়ের প্রায় পুরোটাই কাটিয়েছে মঞ্চনাটকের পিছনে । সিলেটে 'প্রান্তিক' নামের যে নাটক পাড়া ছিলো,সেখানেই ছিলো তার ঘরদোর । টিভি চ্যানলের ওয়ার্কপারমিট নিয়েই এসেছে লন্ডনে, গেলো বছর ।
জানালো দুদিন পর দেশে ফিরে যাচ্ছে । হয়তো আর না ও ফিরতে পারে । আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি ' কেনো? তোর তো ভিসা আরো এক বছর ।এখনই যাবি কেনো?'
ওর কন্ঠ কেমোন ফ্যাসফেসে শুনায়-'এইখানে সবাই আরো বেশী কম্যুনাল ।বাংলাদেশের চেয়ে ও বেশী । বাংলাদেশীর চেয়ে ও বড় পরিচয়-আমি হিন্দু । এমন কি লন্ডনের সংস্কৃতি করা মানুষ গুলোর কাছে ও '
ওহ তাই তো । ও বলার পর আমারো মনে পড়ে-এই ব্যাটা তো হিন্দু ! সেই ১৯৯২ থেকে এমসি কলেজ ক্যাম্পাস,প্রান্তিক,শিল্পকলায় ঘন্টার পর ঘন্টা একসাথে কাটিয়েছি । ঝগড়া করেছি,মারামারি করেছি,মদ খেয়ে মাতাল হয়েছি,লাক্কাতুরা বাগানে গিয়ে হাড়িয়ার বদলে জ্যোছনা গিলেছি একবার ও তো মনে হয়নি আমার এই বন্ধু হিন্দু,আমি অন্য কিছু!

সেই সন্ধ্যার শেষ লগ্নে আমি বিষন্ন হই ।

আমার জানতে আগ্রহ হয়- লন্ডন,নিউইয়র্ক,সিডনীতে থাকা অমুসলিম বাংলাদেশীরা দেশী কমিউনিটির সাথে ঠিক কতোটা সন্নিহিত হতে পারেন?


মন্তব্য

তারেক এর ছবি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাংচুরের কথা বলতে গিয়ে আমার আত্মীয় যিনি সেখানকার হল মসজিদের ইমাম কি বিচ্ছিরি ভাবেইনা সেদিন বললেন 'এইসবের জন্য দায়ী ফ্রন্টের ডান্ডিগুলা'। আমি খুব অবাক হয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার চেহারাটা জানোয়ারের মত হয়ে গ্যাছে। হায়রে, ধর্মের লেবাস !

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

শ্যাজা এর ছবি

আমিও একপাক ঘুরে এলাম শৈশব থেকে, এই লেখার সাথে সাথে...


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

আরিফ জেবতিক এর ছবি

এই হিন্দুটা দেশে ফিরে মুশকিলে পড়বে রে মোরশেদ।
আমাদের খুব খু-উ-ব আলোকিত একটা মানুষ খেদ ঝেড়েছিল, টিভি চ্যানেলের আমাদের প্রভাবশালী বন্ধুটি কেন এই "হিন্দু" বন্ধুটিকে ওয়ার্কপারমিট দেয়ার ব্যাপারে বাধা দিচ্ছে না।
আমি ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছিলাম।শুধু বলতে পেরেছিলাম,"এই ছেলেটার সাথে আমাদের বন্ধুত্ব প্রায় কুড়ি বছর।এই ছেলেটা যে হিন্দু বা মুসলমান, সেটা তো জানতাম না।"

খুব আশ্চর্যের বিষয়,তার ফ্লাইটের আগে তার ভিসা বাতিলের জন্য তার বিরুদ্ধে না না কমপ্লেন করে একটি ঝকঝকে চিঠি গিয়েছিল যথাস্থানে।
ঠিক জায়গায় একজন শূভার্থী ছিলেন,সেই শূভার্থী আবার আমাকে সাথে সাথে ফোন দিলেন,অত:পর কমপ্লেনের কাগজটি ফাইলে উঠতে দেরী হলো দুই দিন,আমি সেই ছেলেটিকে বললাম গেলে এই দুই দিনের মাঝেই চলে যা,এর বেশি আটকানো যাবে না কিছুই....।

মন খারাপ রে মোরশেদ,আসলেই মনটা খারাপ।
সব শালা বাঞ্চোত হয়ে গেছে।
আমরাই বেহুদা জীবনটা ভুল স্বপ্নে নষ্ট করে বসেছি খামোখাই।

সৌরভ এর ছবি

সব শালা বাঞ্চোত হয়ে গেছে।
আমরাই বেহুদা জীবনটা ভুল স্বপ্নে নষ্ট করে বসেছি খামোখাই।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

এইসব বিবমিষা। এইসব বিবমিষা। এইসব বিবমিষা।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।