বিছা

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি
লিখেছেন ইশতিয়াক রউফ (তারিখ: রবি, ১৫/০৩/২০০৯ - ৮:৩১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

‘বললাম তো যাবো না, তবু এত গুঁতানোর কী হল?’ বয়সভারে ন্যুব্জ বিছরুখের গরম জবাব। বিছনাজ তাই বলে ছেড়ে দেওয়ার পাত্রী না। এই লেজভোঁতা সঙ্গীটার আস্ফালন দেখছে বহু বছর ধরে। বছরে কিছুদিন থাকে এমন। এই দিনগুলোয় বুড়োকে একা ছেড়ে দেওয়া যায় না। আকাজ করে বসে কিছু না কিছু একটা।

গেলবার এই দিনে রাগের মাথায় জামার বুকের কাছটা খেয়ে ফেলেছিল বিছরুখ। পাশের বাড়ির বিচ্ছুকে বিশেষ ভাবে খুশি করে সে-কেলেংকারি সামাল দিয়েছিল বিছনাজ। দুর্বল মুহূর্তে কামড়ে ওর জামার কিছু অংশ ছিড়ে নিয়েছিল। বলেছিল, ‘আমার জান্টু একটু অন্যরকম না হলে হয়? আজ থেকে এটাই নতুন ধারা।’ শুনে বিচ্ছুও খুশি। ষণ্ডাটার দেখাদেখি আশপাশের দু’কলোনিতে সেই রীতি চালু হয়ে গেল। লোকেও আর বিছরুখের ছেঁড়া জামা আর আলুথালু চোখ-মুখ নিয়ে কোন কথা বললো না।

তার আগের বছর চলছিল বিছরুখের আধ্যাত্মিক সময়। তখনও বিচ্ছুটা আসেনি পাশের বাড়িতে, বিছনাজের মনেও বসন্তের পৌনঃপুনিকতা শুরু হয়নি। উত্তরপাড়ার খটখটঞ্জ থেকে বিছা ভাই বেড়াতে এসেছিলেন ওদের বাড়ি। যেমন তাঁর সফেদ আলখাল্লা, তেমন তাঁর নুরানি লেজের আগা। একহারা গড়নের পুষ্ট, নধর দেহটা দেখেই বিছনাজ বিশ্বাসী হয়ে গিয়েছিল। অতিলৌকিক কোন সত্বা না থাকলে এক দেহে এত আশীর্বাদ জমা হতে পারে না বলে তার বদ্ধমূল ধারনা হল। ধরে-বেঁধে বিছরুখকেও সে বিছা ভাইয়ের আন্তরিক মুরিদ করে দিল। বিছনাজের মত অতটা না, তবে বেশ অনেকটাই আন্তরিক।

বিছা ভাইয়ের একাগ্র ছাত্র-ছাত্রী হয়ে গেল ওরা দু’জন। দুপুর হলে বিছা ভাই বিছরুখকে স্নেহের সাথে কাছে ডেকে নিতেন। বিভিন্ন রকম তালিম দিতেন।

‘বিছার বিষ থাকে লেজের আগায়, বুঝলা? এই লেজ সুরসুর করে বলেই আমরা বিছা। তা লেজের যথাযথ ব্যবহার নিয়ে আমার ছোট্ট একটা ম্যানুয়েল আছে। তোর বাড়ি আসার আসমানি নির্দেশ পাওয়ার আগে আমি খটখটগঞ্জের মেম্বারের বাড়িতে ছিলাম কিছুদিন। তখন কিছু তরিকা শিখেছিলাম; সেগুলোর লেখ্য রূপ। হাদিয়া মাত্র ১০ টাকা।’

হাদিয়ার কথা শুনেই বিছরুখ হাউ-মাউ করে উঠলো। জীবনের পদে পদে বঞ্চনার শিকার হয়ে কত কষ্টে সাজানো সংসার তার। এক বিছনাজ ছাড়া তার ফুটো কড়িটুকুও নেই। কেঁদে-কেটে সে-কষ্টের কথা বলা শুরু করতেই বিছা ভাই কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘তোকে কিছু দিতে হবে না, তোর জন্য বিনামূল্যে সব। তোকে আজ নতুন কিছু শেখাবো, তুই শুধু রাত-ভোর এই তরিকা কাজে লাগাবি।’

খুশির বদলে আরো বিপর্যস্ত হয়ে ওঠে বিছরুখ। আবারও কেঁদে বলে, ‘পুরনো তরিকা শেখার টাকাই নেই, বেশি দামী নতুন তরিকা কীভাবে নেবো?’

বিছরুখের কান্না উপেক্ষা করে বিছা ভাই বলে চলে, ‘এই তরিকার জন্য শহর থেকেও লোক এসেছে। কত বড় বড় লোক আমার পায়ের কাছে সব ক্ষমতা সঁপে দিয়েছে। বলে কিনা আমাকে নশ্বর দেহে দেখবার সাহসও নেই। আমি নাকি দেবতা, শুধু বিনয় করে দেহে ঠাঁই নিয়েছি।’

বলা বাহুল্য, বিছরুখের কান্না বেড়েই চলে। এ-সময়ই স্মিত হেসে তাকে উদ্ধার করে বিছা ভাই।

‘যাক সে-কথা, এদের এই বিষ ছাড়ানো খুব জরুরী। আমি কালরাতে স্বপ্নে নতুন এক সমাধান পেয়েছি। উলটা করে ঝুলিয়ে রাখলে অবিশ্বাস ও অতিপ্রশ্নের রোগ ভাল হয়ে যায়। এক রাত ঝুলিয়ে রাখলেই সব বিষ মুখ দিয়ে বের হয়ে আসবে। তুই যা, এই তরিকা কাজে লাগা। তোকে কিছু দিতে হবে না।’

আনন্দে ডগমগ করতে করতে বিছরুখ চলে গেল নিজের কাজে। সাঁঝের আঁধারে ঘরে থাকা উত্তম বিধায় বিছা ভাই ধীরে ধীরে হাঁটা দিলেন অন্দরমহলের দিকে। হঠাৎ চমকে দিয়ে গলায় কে যেন ফাঁস পরিয়ে দিল। বিছনাজ খ্যানখ্যান করে হেসে বলে, ‘আজ আর গামছা না, দড়ি দিয়ে বাঁধবো। আপনাকে উলটা করে বেঁধে তাংফাং করার মজাই অন্যরকম। আজকে দুগনা মজা হবে!’ বিছাভাই অবোধ্য কী সব যেন বিড়বিড় করতে লাগলেন।

ভালই চলছিল এভাবে। অপারেশন দড়িবান্ধা শেষ হয়ে গেল অল্পদিনের মধ্যেই। নতুন তরিকার খোঁজে অস্থির বিছরুখকে কিছু একটা বলে শান্ত করা দরকার। কোন কুক্ষণে বিছা ভাই মুখে এনেছিলেন সহজে মাকড়সা মারার তরিকা। মাকড়সার নাম শুনেই ক্ষেপে উঠলো বিছরুখ। অবাক বিছা ভাই কিছু বোঝার আগেই বিছরুখ তাঁর দাঁড়ির একাংশ খাবলে ছিড়ে ফেললো। আরেক দফা আক্রমণ করতে উদ্যত হতেই বিছনাজ এসে তাকে নিবৃত্ত করলো।

‘আপনাকে না কাল রাতেই বললাম, বিছরুখের সামনে মাকড়সার নাম নেবেন না? এই নাম শুনলেই ও আর স্থির থাকতে পারে না।’

মাকড়সা শব্দটি আরেকবার উচ্চারিত হতে শুনেই বিছরুখ ক্ষেপে উঠলো। সেই সংহারমূর্তি দেখেই বিছা ভাই দৌঁড়ে ভাগলেন। ক’দিন পর দেখা গেল আশে-পাশের চার গ্রাম ধরে সবাই ছিলা দাঁড়ি নিয়ে ঘুরছে। সবারটা দেখেই মনে হচ্ছে যেন কেউ সামনে থেকে খাবলে নিয়েছে। বিছনাজের বুঝতে দেরি হল না, এটা বিছা ভাইয়ের মুখরক্ষার ফিকির।

পরপর দুই ঝক্কির পর বিছরুখকে নিয়ে আর ভরসা পায় না বিছনাজ। তাই এখন এই দিনটা এলেই ওকে ঘরে বাইরে নিয়ে যায়। এ-বছর ওদের শাহী হওয়ার একটা সুযোগ আছে। ক’দিন আগেই বিছাগঞ্জ থেকে শাহী এক ভদ্রলোক এসেছেন। বিছনাজ প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে দুই শাহী রক্তের মিলন ঘটিয়ে জাতে উঠতে। বিছরুখকে নিত্য তালিম দেওয়া হচ্ছে শাহী কায়দায় কথাবার্তা বলার। মেলবন্ধনের বাকি দায়িত্ব বিছনাজ নিজের উপর নিয়েছে। ভয় একটাই, এই শাহী বংশের আবার মাকড়সাদের সাথে উঠা-বসা। কিছু হলেই বিশাল একটা আঁঠালো জাল বানিয়ে কাচ্চা-বাচ্চা সহ সেখানে আড্ডা জমিয়ে দেয়।

যত রাগারাগিই করুক না কেন, আজকে ওকে ঘর থেকে বের করতেই হবে; প্রয়োজনে বিছিলার নাচের টোপ দিয়ে হলেও। বেকুবটা যে আজও কেন ভুলতে পারে না সেই মাকড়ানির কথা। খান্দানি মাকড়ানির সাথে ফস্টি-নস্টির এক ফাঁকে কামড়টা বিছরুখই দিয়েছিল, কিন্তু বেকুব পিটার পার্কারটা ঘুরে তাকিয়ে দেখলো মাকড়ানিকে। সেই থেকে বিছম্যান না হয়ে স্পাইডারম্যান হয়ে গেল ব্যাটা।

বিছনাজ কত কষ্ট করে উপরে ওঠার সিড়িটা নিজের দখলে আনে প্রতিবার। প্রতিবারই বিছরুখটার এই খেয়ালের জন্য সব ভেস্তে যায়। আর কতকাল এভাবে চলে?


মন্তব্য

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

"বিছনাজ" নামটা বেশ মনে ধরল।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

"বিছনূর" নিয়েও চিন্তা করছিলাম কিছুক্ষণ... খাইছে

সুহান রিজওয়ান এর ছবি

আমার ভুল ও হতে পারে...
না হলে, গল্পের মর্মার্থ মারাত্বক।
চালিয়ে যান গুরু।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

তাহলে যেচে পড়েই বেনিফিট অফ ডাউট নিলাম একটা। আশা করি বুঝতে পেরেছেন। নাহয়... মন খারাপ

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

রূপকটা একটু বেশি জটিল হয়ে গেল। বেশির ভাগ জিনিষ মাথার উপর দিয়ে চলে গেছে।

আচ্ছা, বৃশ্চিক, মাকড়সা এরা কি পশু?



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ঝামেলা আছে, ভাইয়া। বিছা ভাইয়ের সাগরেদরা বড় জাঁদরেল মানুষ। এঁরা আক্ষরিক অর্থেই বুঝে ও পালন করে অভ্যস্ত। অতএব, অধমের গর্দান রক্ষার্থেই একটু জটিল করে বলা আর কি! বোঝেনই তো, এখনও বিয়ে-শাদি করি নাই। ধরতে পারলে কী থেকে কী করে বসে!

পশু না, তবে "অমানুষ" অর্থে জাতভাই। দেঁতো হাসি

[বাঘিরা ও বাঘিরাতুন্নেসার গল্প লিখেছিলাম, দেখি ওটা পোস্ট হয়ে গেছে। অ্যানাকোন্ডা নিয়ে লিখতে গিয়েও লিখলাম না, দেখি ওটাও পোস্ট হয়ে গেল। বিছাই সই। :P]

কীর্তিনাশা এর ছবি

জম্পেস লিখেছেন.. হাসি
-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আমি বিছা আর অ্যানাকোন্ডা নিয়ে নিজের মনে তর্ক করছিলাম। আপনি অ্যানাকোন্ডা লিখলেন দেখে আফসোস কেটে গেল। দেঁতো হাসি

মুশফিকা মুমু এর ছবি

হাহাহা বিছম্যান হওয়ার কথা ছিল নাকি হো হো হো গল্পটা তেমন বুঝতে পারলাম না অবশ্য ইয়ে, মানে...

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

ইংলিশ আপাকে উল্টাও... বুঝে যাওয়া উচিত। চোখ টিপি

ফারুক হাসান এর ছবি

চলুক
*********************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

চলুক ... আপনাকে 'গরু' লেখার জন্য আবারও বিশেষ ধন্যবাদ। কী যে শুরু হল... এটাকে আপনার জন্মদিন উপলক্ষে ৩ দিনের পশুমেলা হিসেবেও দেখতে পারেন। চোখ টিপি

ফারুক হাসান এর ছবি

কস্কি মমিন!
*********************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

বিছনাজ কী নায়িকা শাবনাজের ছোডো বোন।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

বিছাগোত্রীয় ব্যতীত কেউ কোন চরিত্রের সাথে বাস্তবের মিল খুঁজিয়া পাইলে তাঁহার মর্ম- বা চর্মবেদনার জন্য ফায়ার ব্রিগেড দায়ী নহেন। চোখ টিপি

ফারুক হাসান এর ছবি

কিংবা, বিছানায় নাজ চোখ টিপি
*********************************
বলে এক আর করে আর এক যারা
তারাই প্রচণ্ড বাঁচা বেঁচে আছে দাপটে হরষে
এই প্রতারক কালে (মুজিব মেহদী)

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

বিছার বিছানা হিসেবেই 'বিছানা' ব্যবহারের চিন্তা করেছিলাম এক পর্যায়ে, কিন্তু ব্যাখ্যা করার ঝামেলা এড়াতে লিখিনি। খাইছে

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

এক পড়ায় বুঝলাম না। আমি আবার একটু মুখ্যসুখ্য মানুষ তো মন খারাপ

পরে আরেকবার পড়ব, দেখি তখন বুঝি নাকি...

না বুঝলেও, লেখা যে চমৎকার হইসে - এইটা বুঝতে পারসি হাসি

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

* স্পয়লার অ্যালার্ট *

একটু হেল্পাই তাহলে।

r.

ধুসর গোধূলি এর ছবি
ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আপনি ছিলেন অধমের শেষ ভরসা। এক একার আধা-খাইষ্টা কথাবার্তাগুলো তো আরেক একারই বোঝার কথা। চোখ টিপি

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

আরেকটা কথা - বিছরুখ, বিছনাজ নাম দুইটা দারুণ লাগলো দেঁতো হাসি

আসিফ আসগর এর ছবি

'দ্বিগুণ' এর কারণ জানা গেল, এতেই স্বস্তি! হাসি

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

মুহা-হা-হা-হা!! চোখ টিপি

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

হা হা হা
হি হি হি
হাসতে হাসতে মরে গেলাম, ইশতি...
বিছরুখ আর বিছনাজ নাম দুইটা অসম্ভব সুইট... চোখ টিপি

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

আপনারা উত্তরপাড়ার মানুষ বলে কথা! চোখ টিপি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।