মহীশুরের বাঘ, পর্ব-সাত

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
লিখেছেন সবুজ পাহাড়ের রাজা (তারিখ: বুধ, ২১/০৩/২০১২ - ৯:৩৮পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মহীশুরের বাঘ (আগের পর্বগুলো)

আগের পর্বের সূত্র ধরে.....
১৭৮৩ সালের জুন মাসে ব্রিটিশ গোলন্দাজদের প্রচন্ড আক্রমনে কোড্ডালোর দূর্গে কোনঠাসা হয়ে পড়ে মহীশুর-ফ্রেঞ্চ যৌথ বাহিনী। কোড্ডালোর দূর্গ অবরোধে ব্রিটিশদের রসদ আসছিল সমুদ্রপথে ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল এডওয়ার্ড হিউ-এর নেতৃত্বে। ব্রিটিশ গোলন্দাজদের প্রচন্ড আক্রমনে হতাশ হয়ে পড়েন কোড্ডালোর দূর্গের দায়িত্বে থাকা ফ্রেঞ্চ অফিসার মারকুইস ডি ব্যাসি ক্যাস্টেলন্যুঁ। ঠিক এসময় এলো এক মহা সুসংবাদ। ফ্রেঞ্চ অ্যাডমিরাল সাঁফ্রেন রসদ ও সৈন্যসহ পনেরোটি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে কোড্ডালোরের দিকে এগিয়ে আসছেন। ফ্রেঞ্চ রণতরীর খবর মাদ্রাজের ব্রিটিশ কুঠিতে পৌঁছুলে ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল এডওয়ার্ড হিউ আঠারোটি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে রওনা দেন ফ্রেঞ্চদের বিরুদ্ধে।

১৭৮৩ সালের ২০ জুন বঙ্গপোসাগরে মুখোমুখি হল ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চ রণতরী।


কোড্ডালোরের নৌযুদ্ধ, ২০ জুন, ১৭৮৩। (ছবি: Auguste Jugelet)

প্রচন্ড যুদ্ধ হল। নৌশক্তিতে সেসময় অনন্য হলেও কোড্ডালোরের নৌযুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশরা পরাজিত হয়। ব্রিটিশ অ্যাডমিরাল এডওয়ার্ড হিউ রণতরী নিয়ে মাদ্রাজের দিকে পিছু হটে যান।

২৩ জুন, ফ্রেঞ্চ অ্যাডমিরাল সাঁফ্রেন ২,৪০০ সৈন্য ও বিপুল পরিমাণ রসদসহ কোড্ডালোরের তীরে অবতরণ করেন। এতে, কোড্ডালোর দূর্গে অবরুদ্ধ মহীশুর-ফ্রেঞ্চ যৌথবাহিনী প্রাণশক্তি ফিরে পায়। প্রচুর নতুন সৈন্য ও রসদ পেয়ে মহীশুর-ফ্রেঞ্চ যৌথবাহিনীর প্রধান মারকুইস ডি ব্যাসি ক্যাস্টেলন্যুঁ ব্রিটিশদের উপর অর্তকিত এক আক্রমন পরিচালনার পরিকল্পনা করেন।


ফ্রেঞ্চ অফিসার মারকুইস ডি ব্যাসি ক্যাস্টেলন্যুঁ। (ছবি: উইকিপিডিয়া)

২৫ জুন, মহীশুর বাহিনীর প্রধান সাইয়িদ সাহিব, ফ্রেঞ্চ অফিসার মারকুইস ডি ব্যাসি ক্যাস্টেলন্যুঁ ও ফ্রেঞ্চ অ্যাডমিরাল সাঁফ্রেনের যৌথ বাহিনী মে.জে. জেমস স্টুয়ার্টের ব্রিটিশ বাহিনীকে আক্রমন করে। কিন্তু ফ্রেঞ্চ-মহীশুর যৌথবাহিনী ব্রিটিশদের কাছে পরাজিত হয়; প্রায় চার শতাধিক যৌথবাহিনীর সৈন্য মারা যায়। ব্রিটিশরা পুনরায় কোড্ডালোর দূর্গ অবরোধ করে। কিন্তু নতুন করে কোন রসদ না আসায় ব্রিটিশ বাহিনী দুর্বল হয়ে পড়ে।

এসময় ফ্রেঞ্চ অফিসার মারকুইস ডি ব্যাসি পুনরায় ব্রিটিশদের আক্রমনের সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক এসময়, ২৯ বা, ৩০ জুন, কোড্ডালোরের তীরে একটি ব্রিটিশ জাহাজ এসে ভীড়ে। জাহাজে ছিল একদল ব্রিটিশ দূত; ওরা কিছু জরুরী খবর নিয়ে এসেছিল। খবরটা শোনামাত্র ফ্রেঞ্চরা মহীশুরের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে এবং যুদ্ধবিরতি ঘোষনা করে।

০২ জুলাই ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চদের মধ্যে শান্তিচুক্তি হয়। চুক্তি অনুসারে, ফ্রেঞ্চরা দ্বিতীয় মহীশুর-ব্রিটিশ যুদ্ধ হতে নিজেদের সরিয়ে নিবে এবং কোড্ডালোর দূর্গ ব্রিটিশদের কাছে হস্তান্তর করবে, বিনিময়ে ব্রিটিশরা মাহী ও পন্ডিচেরী ফ্রেঞ্চদের নিকট প্রত্যার্পণ করবে।

দ্বিতীয় মহীশুর-ব্রিটিশ যুদ্ধে মহীশুরের পক্ষ হতে ফেঞ্চদের হঠাৎ সরে যাওয়াটা এটাই প্রমাণ করে, ইউরোপীয়রা ভারত উপমহাদেশের আভ্যন্তরীণ কোন্দলে জড়িয়েছিল শুধুমাত্র ফায়দা লুটবার জন্য। ভারত উপমহাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে ইউরোপীয়রা এদেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যাগুলোকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগিয়েছিল।

এখানে, পিছনের কিছু কথা বলে রাখা ভাল। ব্রিটিশ আর ফ্রেঞ্চরা সেসময় চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। ভারত উপমহাদেশে ব্যবসায় ও প্রভাব বিস্তার নিয়ে স্বভাবিকভাবেই ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চদের মাঝে ঝামেলা শুরু হয়। মহীশুর সালতানাত প্রতিষ্টার প্রথম হতেই নিজাম আর মারাঠাদের সাথে শত্রুতা ছিল মহীশুরের। এদিকে, নিজামের সাথে ব্রিটিশদের ছিল খুব দহরম মহরম। অপরদিকে, ফ্রেঞ্চদের সাথে সুসম্পর্ক ছিল মহীশুরের। পরবর্তীতে নানা কারনে মহীশুর ও ব্রিটিশরা সরাসরি সংঘাতে জড়িয়ে পরলে ফ্রেঞ্চরা মহীশুরের পক্ষ অবলম্বন করে। এদিকে, ১৭৭৫ সালে আমেরিকায় স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ফ্রেঞ্চরা ব্রিটিশদের বিপক্ষে আমেরিকাকে সাহায্য করে। এ বিষয়টি ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ সম্পর্কের তিক্ততা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দেয়। ১৭৭৯ সালে দ্বিতীয় ব্রিটিশ-মহীশুর যুদ্ধে ফ্রেঞ্চরা মহীশুরের পক্ষ নেয়। ১৭৮৩ সালের জানুয়ারীর দিকে ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে সকল ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ সংঘর্ষে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ যুদ্ধবিরতির খবর এসে পৌঁছুলে ফ্রেঞ্চরা দ্বিতীয় ব্রিটিশ-মহীশুর যুদ্ধ হতে নিজেদের সরিয়ে নেয়। ফ্রেঞ্চদের এই হঠাৎ পক্ষ ত্যাগ টিপু সুলতান ভালো চোখে দেখলেন না।

ফ্রেঞ্চদের সাথে যুদ্ধবিরতি ও শান্তিচুক্তি হবার পর, মে.জে. জেমস স্টুয়ার্টের ব্রিটিশ বাহিনী কর্নেল ফুলার্টনের সাথে একত্রিত হয়ে নভেম্বর, ১৭৮৩-তে মহীশুর সালতানাতের পালাক্কাড দূর্গ দখল করে নেয়। এর কিছুদিন পর, ১৪ ডিসেম্বর, ১৭৮৩-তে ব্রিটিশরা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ম্যাকলিয়ডের নেতৃত্বে কান্নুর দখল করে। মহীশুর সালতানাতের পূর্বাঞ্চলে ব্রিটিশরা কয়েকটি সাফল্য পেলেও পশ্চিমাঞ্চলে ব্রিটিশরা পুরোপুরি কোনঠাসা হয়ে পরেছিল, যা দ্বিতীয় এ্যংলো-মহীশুর যুদ্ধের চুড়ান্ত ফলাফল ও ব্রিটিশদের পরাজয় নির্ধারন করে দেয়।

আগের পর্বে বলা হয়েছে, ২৮ এপ্রিল, ১৭৮৩-তে টিপু ব্রিটিশদের নিকট হতে মহীশুরের পশ্চিমাঞ্চলের বেদনুর পুনরুদ্ধার করেন। বেদনুর পুনরুদ্ধার করার কিছুদিন পর পশ্চিমঘাটের নিরাপত্তার জন্য টিপু তাঁর বিশ্বস্ত সেনাপতি হুসেন আলী খানের নেতৃত্বে সৈন্য পাঠান। পশ্চিমঘাটের চার মাইল দূরে ম্যাঙ্গালোর; সেখানে ব্রিটিশ কর্নেল জন ক্যাম্পাবেল সৈন্যবাহিনী নিয়ে অবস্থান করছিলেন। পশ্চিমঘাটে মহীশুর বাহিনীর অবস্থানের কথা জানার পর কর্নেল ক্যাম্পাবেল ০৬ মে রাতে মহীশুর বাহিনীর উপর অর্তকিত আক্রমন করেন। ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারেনি অপ্রস্তুত মহীশুর বাহিনী; দ্রুত পিছু হটে যায় তারা। এ ঘটনার পর ব্রিটিশ দমনে টিপু নিজেই সৈন্য নিয়ে এগিয়ে এলেন। তিনি মহীশুরের পশ্চিমাঞ্চলের মালাবার উপকূলী ধরে এগুতে থাকেন। ১৯ মে, টিপু তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে ম্যাঙ্গালোরের কাছেই কোড্ডারীতে সৈন্য সমাবেশ করেন। এসময় মহীশুর বাহিনীর সাথে ফ্রেঞ্চ সৈন্যরা যোগ দেয়। পরদিন, ২০ মে, টিপুর বাহিনী ম্যাঙ্গালোরের চারপাশের তিন-চার মাইল এলাকা অধিকার করে নেয়। ম্যাঙ্গালোর দূর্গের ভিতর আটকে পড়ে কর্নেল জন ক্যাম্পাবেলের ব্রিটিশ বাহিনী।

ভারত উপমহাদেশে তখন ব্রিটিশদের তিনটি প্রধান কুঠি ছিল; বোম্বে (বর্তমানের মুম্বাই), কোলকাতা, মাদ্রাজ। ব্রিটিশদের অধীন ম্যাঙ্গালোর দূর্গ বোম্বে কুঠি হতে পরিচালিত হত। টিপু মে মাসের শেষের দিকে ম্যাঙ্গালোর দূর্গ অবরোধ করেন। অপরদিকে, জুন মাসে, মাদ্রাজ ও বাংলা কুঠি যৌথভাবে তামিলনাড়ুর কোড্ডালোর দূর্গ অবরোধ করে। দু'ফ্রন্টে মহীশুর-ফ্রেঞ্চ যৌথ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা তখন বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ায় ব্রিটিশদের জন্য।

২১ মে, ১৭৮৩, টিপুর বাহিনী ম্যাঙ্গালোর দূর্গ অবরোধ করে। ২৩ মে, টিপুর গোলন্দাজ বাহিনীর তুমুল গোলাবর্ষনে ব্রিটিশ বাহিনী কোনঠাসা হয়ে পড়ে। ম্যাঙ্গালোর দূর্গের বর্হিভাগে থাকা ব্রিটিশ বাহিনী দ্রুত দূর্গের ভিতরে পিছু হটতে বাধ্য হয়। অবস্থা বেগতিক দেখে কর্নেল ক্যাম্পাবেল সাহায্যের জন্য আবেদন করলেন বোম্বেতে কিন্তু ম্যাঙ্গালোর দূর্গে প্রবেশের সব পথে টিপুর গোলন্দাজ ও অশ্বারোহী সৈন্যদের অবস্থানের কারনে সাহায্য পৌঁছুতে পারল না।

অবরুদ্ধ ম্যাঙ্গালোর দূর্গে ধীরে ধীরে শেষ হয়ে আসতে থাকে ব্রিটিশ রসদ। বেকায়দায় পড়ে যায় ব্রিটিশরা। কোন উপায় না দেখে কর্নেল ক্যাম্পাবেল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেন; দূর্গের বাইরে এসে মহীশুর বাহিনীকে আক্রমন করে ছত্রভঙ্গ করে দেয়ার পরিকল্পনা করেন। পরিকল্পনা অনুসারে ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড নুজেন্ট ম্যাঙ্গালোর দূর্গের বাইরে পূর্বদিকে অবস্থান নেয় কিন্তু ব্রিটিশ বাহিনী বেশিক্ষণ টিক থাকতে পারল না। মহীশুর গোলন্দাজ বাহিনীর প্রচন্ড গোলাবর্ষনের মুখে পিছু হটতে বাধ্য হয় ক্যাপ্টেন এডওয়ার্ড নুজেন্ট।

০৪ জুন, ১৭৮৩, মহীশুর বাহিনীর ব্যাপক গোলাবর্ষনে ম্যাঙ্গালোর দূর্গের দেয়ালে ফাটল ধরে। মহীশুরের অশ্বারোহী ও পদাতিক সৈন্যরা ফ্রেঞ্চ সৈন্যসহ এসময় বেশ কবার দূর্গের ভিতরে ঢুকবার চেষ্টা করে কিন্তু পাল্টা ব্রিটিশ গোলন্দাজদের গোলাবষর্নে সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। এভাবে, অগাস্ট, ১৭৮৩ পর্যন্ত অবরোধ দীর্ঘায়িত হয়।

এরমাঝে, কিছু কথা বলে নেয়া ভাল। উপরে বলা হয়েছে, ১৭৮৩ সালের জানুয়ারীতে ইউরোপে ফ্রেঞ্চ-ব্রিটিশ শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এরপ্রেক্ষিতে, ০২ জুলাই, ১৭৮৩, কোড্ডালোর দূর্গের যুদ্ধে ব্রিটিশরা ও ফ্রেঞ্চরা শান্তিচুক্তি করে এবং ফ্রেঞ্চরা দ্বিতীয় দ্বিতীয় ব্রিটিশ-মহীশুর যুদ্ধ হতে নিজেদের সরিয়ে নেয়।

০২ আগস্ট, ১৭৮৩, ফ্রেঞ্চ দূত পিভিরণ দ্যা মোরল্যে ফ্রেঞ্চ-ব্রিটিশদের শান্তিচুক্তির খবর ম্যাঙ্গালোরে টিপুকে জানান। ফ্রেঞ্চদের হঠাৎ এভাবে পক্ষ ত্যাগে টিপু রেগে যান কিন্তু তখন ফ্রেঞ্চদের শায়েস্তা করার উপযুক্ত সময় ছিল না। কারন, এতে, ব্রিটিশ-ফ্রেঞ্চ একজোট হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া, নতুন শত্রু সৃষ্টি করার অবস্থা ও এর মোকাবিলা করা সেসময় টিপুর পক্ষে সম্ভব ছিল না। ফ্রেঞ্চরা পক্ষ ত্যাগ করে চলে যাবার পর টিপু একাই ম্যাঙ্গালোর দূর্গ অবরোধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।

২৪ নভেম্বর, ১৭৮৩, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ম্যাকলিয়ডের নেতৃত্বে নৌপথে ম্যাঙ্গালোরে ব্রিটিশ বাহিনী এসে পৌঁছায় কিন্তু সমুদ্রতীরে মহীশুরের গোলন্দাজ, অশ্বারোহী ও পদাতিক বাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারনে ব্রিটিশ সৈন্যরা ম্যাঙ্গালোরে অবতরণ করতে ব্যর্থ হয়। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ম্যাকলিয়ড সৈন্যবাহিনী নিয়ে অবতরণ করতে ব্যর্থ হয়ে ডিসেম্বরে ব্রিটিশ অধীন তেলীচ্চরী বন্দরে চলে যান। এই ঘটনায় ক্যাম্পাবেল আরো হতাশ হয়ে পড়েন। ম্যাঙ্গালোর দূর্গে ব্রিটিশদের রসদ ক্রমশ শেষ হয়ে যাচ্ছে, বিপুল পরিমাণ সৈন্য ইতিমধ্যে মারা গেছে, জীবিতদের একটি বড় অংশ আহত ও অসুস্থ, দূর্গের বাইরে যেয়ে মহীশুর বাহিনীর মুখোমুখি হওয়া মানে আত্মহত্যা করা। এসব চিন্তা করে অবশেষে কর্নেল ক্যাম্পাবেল আত্মসমর্পন করার সিদ্ধান্ত নেন।

৩০ জানুয়ারী, ১৭৮৪, টিপু সুলতান ম্যাঙ্গালোর দূর্গে প্রবেশ করেন। ম্যাঙ্গালোর দূর্গ অবরোধ শুরুর সময় ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় ৪,০০০। পরাজিত হয়ে দূর্গ ছেড়ে যাবার সময় এই সংখ্যা দাঁড়ায় মাত্র ৭০০। এই যুদ্ধে প্রায় তিন শতাধিক ইংলিশ সৈন্য মারা যায়। ম্যাঙ্গালোর দূর্গে ব্রিটিশদের পরাজয় ও প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি খোদ ইংল্যান্ডে ব্যাপক সমালোচিত হয় এবং টিপু সুলতানের সাথে শান্তিচুক্তি করার জন্য কোম্পানীকে চাপ দেয়া হয়। এরপ্রেক্ষিতে, ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী যুদ্ধবিরতি ঘোষনা করে ও টিপু সুলতানকে শান্তি প্রস্তাব দেয়।

অবশেষে, ১১ মার্চ, ১৭৮৪, ম্যাঙ্গালোর দূর্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ও টিপু সুলতান শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন। এর মাধ্যমে শেষ হয় দ্বিতীয় এ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধ।

ম্যাঙ্গালোর চুক্তির বিষয়বস্তু:
০১। ব্রিটিশ ও মহীশুর বাহিনী অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি ঘোষনা করবে।
০২। ব্রিটিশ ও মহীশুর ভবিষ্যতে পরস্পরের বিরুদ্ধে কোনরূপ শত্রুতা করবে না।
০৩। ব্রিটিশরা মহীশুর ও এর মিত্রদের বিরুদ্ধে কোনরূপ সংঘর্ষে জড়াবে না এবং মহীশুরের শত্রুদের কোন সাহায্য করবে না।
০৪। আন্নুড়, কারওয়ার, সদাসিওয়াগুড়, কান্নুর, পালাক্কাড দূর্গ, আভারাচ্চরী, দারাপুরাম, দিন্দীগুলসহ ব্রিটিশরা দখলকৃত সব দূর্গ ও এলাকা মহীশুরকে ফেরত দিবে।
০৫। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী মহীশুরের আভ্যন্তরীণ কোন ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না।
০৬। ব্রিটিশরা তাদের আশ্রয়ে থাকা সুলতানের শত্রুদের তাঁর নিকট হস্তান্তর করবে।
০৭। ব্রিটিশরা মহীশুরে ব্যবসায় ব্যতীত অন্যকোন বিষয়ে নিজেদের জড়াবে না।
০৮। মহীশুর সীমানার ভিতরে অথবা, বাইরে সুলতানের কোন কাজে ব্রিটিশরা বাঁধা দেবে না বা, হস্তক্ষেপ করবে না।
০৯। দক্ষিন ভারতের আভ্যন্তরীন রাজনৈতিক বিষয়গুলো হতে ব্রিটিশরা নিজেদের আলাদা রাখবে।
১০। মহীশুর ও ব্রিটিশরা পরস্পরের যুদ্ধবন্দীদের মুক্তি দিবে।
১১। আম্বুরগড় ও সাতগড়ের দূর্গ ব্যাতীত কর্নাটকে মহীশুরের অধিকারকৃত অন্যান্য ব্রিটিশ দূর্গগুলো ব্রিটিশদের ফেরত দেয়া হবে।

ম্যাঙ্গালোরের শান্তিচুক্তি অনেক ঐতিহাসিক গুরুত্ব বহন করে। এটি ভারত উপমহাদেশে কোন ভারতীয়র সাথে ব্রিটিশদের করা শেষ চুক্তি, যাতে, ভারতীয় পক্ষ চুক্তিতে প্রাধান্য বিস্তার করে। দ্বিতীয় এ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধে টিপুর সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে- এই যুদ্ধের কারনে আল্টিমেটলি দক্ষিন ভারতে ব্রিটিশ আধিপত্য "কিছু সময়ের" জন্য স্থিমিত হয়ে যায়।

ম্যাঙ্গালোর চুক্তি এমন সময় হয়, যখন ব্রিটিশরা আমেরিকায় তাদের অধীন তেরটি কলোনীর(আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র) স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। ম্যাঙ্গালোর চুক্তির পরে লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর শেয়ারের মূল্য লাফিয়ে লাফিয়ে কমে যায়। সেসময় ব্রিটিশ জাতীয় আয়ের এক পঞ্চমাংশ আসত ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী হতে। দ্বিতীয় এ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধে ব্রিটিশদের পরাজয় সারা ইংল্যান্ডে ব্যাপক সমালোচনার ঝড় তুলে। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে এরপ্রেক্ষিতে পাস হয় পিট'স ইন্ডিয়া এ্যাক্ট, যার মাধ্যমে ভারতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কার্যক্রমে সরাসরি ব্রিটিশ সরকার হস্তক্ষেপ করা শুরু করে।

ব্রিটিশরা কখনোই দ্বিতীয় এ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধে পরাজয় ও ম্যাঙ্গালোর চুক্তির কথা ভুলতে পারেনি, যার প্রমান আমরা ১৭৯৯ সালে দেখতে পাই।

(চলবে)

*ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশ বাহিনীর সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করা হয় দেশীয়, ইউরোপীয়, ইংলিশ ও আফ্রিকানদের নিয়ে।

মহীশুরের বাঘ, পর্ব-আট

পাদটীকা

  • ১. ম্যাঙ্গালোর সে সময় একটি ব্রিটিশ কুঠি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছিল।
  • ২. কোড্ডালোর সেসময় মহীশুরের অধীন ফ্রেঞ্চ কুঠি ছিল।
  • ৩. "কিছু সময়" বলার কারন হল, দক্ষিণ ভারতে দ্বিতীয় এ্যাংলো-মহীশুর যুদ্ধের পর যদি নিজাম, মারাঠা, টিপু একজোট হয়ে থাকতে পারত, তাহলে, কখনো ব্রিটিশরা দক্ষিন ভারতে পুনরায় তাদের লম্বা নাক ঢুকানোর সাহস করত না।

মন্তব্য

তারেক অণু এর ছবি

টিপুর সাথে শুনেছি নেপোলিয়নের পত্র যোগাযোগ ছিল। ব্যাপারটা নিয়ে লিইখেন সম্ভব হলে--- পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

সরাসরি ফ্রান্সের সাথে টিপুর যোগাযোগ হয় ১৭৮৭/১৭৮৮ সালে।
সামনের পর্বগুলোতে এই বিষয়টি থাকবে।

পড়ার জন্য ধন্যবাদ। হাসি

সত্যপীর এর ছবি

এক যুদ্ধজয় করে ইংরেজের ইনকাম কমায় দিসিল দেখে বড় খুশি হইলাম। ভাতে মারার মত বড় মারা আর নাই।

..................................................................
#Banshibir.

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ঠিক কইছো, ভাতে মারার চেয়ে বড় মারা আর নাই।
দ্বিতীয় মহীশুর-ব্রিটিশ যুদ্ধের পর মারাঠা-মুঘল-মহীশুর-নিজাম যদি একসাথে থাকত, তাহলে, ইংরেজরা কখনই ভারত উপমহাদেশে নিজেদের সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারত না।
এই বিষয়টা মনে হলে খারাপ লাগে।
রোম যখন আগুনে পুড়ছিল, নিরো তখন বাঁশী বাজাচ্ছিল। ঠিক তেমনি, ইউরোপীয় কুকুরগুলো যখন ভারত উপমহাদেশে লাদি ছড়াচ্ছিল, তখন, এই ভারতীয় রাজ্যগুলো পরস্পরের পোঁদে বাঁশ ঢুকাচ্ছিল।

দুর্দান্ত এর ছবি

"ইউরোপীয় কুকুরগুলো" - অতি সহসা পূরব আফ্রিকার কিছু দেশের মানুষ বলতে শুরু করবে, বাংগালী কুকুর।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

কাহিনী কি ভাই? ইয়ে, মানে...

দুর্দান্ত এর ছবি

এই হইল কাহিনী।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

খবরটা পড়লাম। এখনো চিন্তিত হবার মত কিছু হয়নি। হাসি আশা করি ভবিষ্যতেও হবে না।
এখন পর্যন্ত উদ্যোগটি আমাদের জন্য ভালই। উগান্ডায় ১,০০০ কিমি. জমি লীজ পেয়েছি বিনে পয়সায়। তান্জানিয়াতে চেষ্টা চলছে। আমাদের বর্ধিত খাদ্য চাহিদা পূরণে এই ধরণের উদ্যে্াগ দরকার ছিল।
তবে, এই কোম্পানীর কার্যক্রম ও পণ্যের মূল্য বৃত্তের ভিতর রাখতে হবে। তা না হলে, এই কোম্পানীর এখানে ও পূর্ব আফ্রিকায় "কুকুর" উপাধিতে(!) ভূষিত(!!) হতে বেশিদিন লাগবে না।

দুর্দান্ত এর ছবি

ইউরোপিয়ান কোম্পানিগুলোর কি এর চাইতে ভিন্ন কোন মোটিভ ছিল? ওরাও তো সেসময়ের স্থানীয় সরকারের কাছ থেকে জমি পত্তন নিয়ে তাতে বানিজ্য়িক ফসল ফলাতে চাচ্ছিল। ইউরোপের যতগুলো দেশের সরকার কোম্পানির লাইসেন্স (বা ডাকাতির লাইসেন্স) দিয়েছে, সেই দেশগুলোও কিন্তু সেই সময়ে কোন না কোন প্রকার আরথিক অনটনে ছিল।

আফ্রিকায় এখন বাতসরিক ১ মিলিয়্ন টনের মত চাল আমদানি হয় - তার পরেও রয়ে যায় অনেক ক্ষুধারত। উগান্ডাতেই বাতসরিক চালের ঘাটতি নাকি ৫০-৬০ হাজার টনের মত - তদুপরি সেখানে চাল মূল খাদ্য় নয়। সেখানের মানুষ মূলত ভূট্তার আটা খায়। আমি জানিনা, মতলুব সাহেবেরা উগান্ডায় কতটুকু চাল উতপাদন করবে, কিন্তু তাদের দেশে যেখানে আরো বেশী ভুট্তা গজাতো, সেখানে আমরা গিয়ে ধান চাষ করে দেশে নিয়ে আসবো ওদের চোখের সামনে দিয়ে।

উগান্ডার বাকশালি সরকার বাংলাদেশ থেকে কি পেল আর না পেল, সেই হিসাব তো আর পাবলিকের কাছে থাকবে না। তারা দেখবে তাদের মাটিতে গজানো বস্তায় বস্তায় চাল চলে যাচ্ছে বাংলাদেশে। আর তাদের দেশের ক্ষুধারতকে ভুটটার বদলে চাল খেতে বলা হচ্ছে। কোন এক জলপাই আমাদেরকে আলু খেতে বলায় আমাদের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছিল মনে আছে?

ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোকে আমরা গালাগাল করি, কিন্তু নাটকের চরিত্র বদলে গেলে আমরাই আবার ঔপনিবেশিক ব্য়াবস্থাতে কোন অসুবিধা দেখি না।

এইটাই বক্তব্য় ছিল।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

আপনার কথা বুঝতে পেরেছি। উদ্বেগের কারনটাও বুঝতে পারছি কিন্তু বানিজ্য এবং উৎপাদনও তো চলতে হবে। দেখাই যাক, নিটোল-নিলয় আরেকটি "ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী" হয় নাকি, "সাধারণ বানিজ্যিক কোম্পানী" হয়।
নব্য ঔপনিবেশবাদের অনেক চেহারা। হয়ত: আমার এই আশা একটি দুরাশা। তারপরও দেখি-না কি হয়।

পথের ক্লান্তি এর ছবি

ক্ষমতায় আরোহনের পূর্বে এবং পরে; টিপু মনেহয় একটা মুহুর্তও স্বস্তিতে পার করতে পারেনি বহিঃশত্রুর উৎপাতে। অবাক লাগে, এত কিছুর পরও কিভাবে ঘর সামলেছেন টিপু-হায়দার! সত্যিকারের প্রজাদরদী না হলে কেনই বা দু'শত বছর পর মানুষ তাদের স্মরণ করবে।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

টিপুর পুরো জীবনটাই যুদ্ধময়।
পৃথিবীর কোন শাসকই মনে হয় শতভাগ প্রজাদরদী না। টিপুর শক্তিশালী প্রশাসনিক কাঠামোর সুনাম আছে।
তবে, যুদ্ধের মাঠে টিপুর নৃশংসতার বর্ণনাও পাওয়া যায়।
তবে, ভারতের সমসাময়িক শাসকদের চেয়ে এই বাপ-বেটা চারিত্রিক দিক হতে অনেক ভাল।

যাযাবর এর ছবি

চলুক পপকর্ন লইয়া গ্যালারীতে বইলাম বাঘের বাচ্চা

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

কুমার এর ছবি

চলুক পড়ছি, চলুক।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।