অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুর

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
লিখেছেন সবুজ পাহাড়ের রাজা (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৭/০৯/২০১২ - ৩:২৯পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুর; হারিয়ে যাওয়া এক বিচিত্র প্রাণীর গল্প।


ছবি: উইকিপিডিয়া

ছবিতে ক্যাঙ্গারু ও ইঁদুরের মত দেখতে প্রাণীটির ইংরেজী নাম Australian Desert rat-kangaroo, বৈজ্ঞানিক নাম Caloprymnus campestris, বাংলায় নাম দেয়া যেতে পারে অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুর। মারসুপিয়াল গোত্রীয় এই বিলুপ্ত এই প্রাণীর আবাস ছিল মধ্য-অস্ট্রেলিয়ায়।


ছবি: উইকিপিডিয়া

১৮৪০ সালে প্রথম অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরের সন্ধান পাওয়া যায়। তৎকালীন দক্ষিন অস্ট্রেলিয়ার গর্ভনর জর্জ গ্রে তিনটি অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরের নমুনা লন্ডনের প্রাণীবিদ জন গোওল্ডের কাছে পাঠান। পরবর্তীতে, ১৮৪৩ সালে জন গোওল্ড সর্বপ্রথম অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরের কথা বিশ্বকে জানান।

মধ্য অস্ট্রেলিয়ার মরুঞ্চলের ঝোঁপ-ঝাড়ের অধিবাসী অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুর দেখতে ক্যাঙ্গারু ও ইঁদুরের মত। এদের পিঠের অংশ, পা ও লেজ দেখতে ফ্যাকাশে হলুদাভ বাদামী আর পেটের অংশ সাদাটে রঙের ছিল। এরা লম্বায় লেজ মিলিয়ে প্রায় আঠারো ইঞ্চির মত হত। এদের ক্ষুদ্রাকৃতির মাথা মারসুপিয়াল গোত্রের অন্যান্য প্রাণীদের থেকে এদের আলাদা করে দিয়েছে। এদের কান দুটো বেশ লম্বা, পশমে ঢাকা ও গোলাকৃতির। এদের সামনের বাহু জোড়া ছিল ছোট আর পা জোড়া বেশ লম্বা ও শক্তিশালী। অন্যান্য মারসুপিয়াল হতে অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরদের একটি বড় পার্থক্য ছিল, এরা বাম পায়ের সামনে ডান পা ফেলে চলে। আর এদের লেজ ছিল চিকন লম্বাটে।

অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুররা সাধারণত: তের থেকে পনেরো বছর পর্যন্ত বেঁচে থাকত। এরা একাকী বসবাস করত। এরা মরুভূমির তপ্ত-শুষ্ক-ঊষর পরিবেশে বসবাসযোগ্যতা খুব ভালভাবে রপ্ত করেছিল। এরা নিশাচর ছিল; দিনের বেলা ঘুমিয়ে ও বাসায় বসে কাটিয়ে দিত আর রাতে বের হত খাবারের সন্ধানে। এরা খুব দ্রুত ও অনেক সময় ধরে (এক নাগাড়ে প্রায় বিশ কিলোমিটার) দৌঁড়ুতে পারত।

অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুররা তৃণভোজী ছিল। তবে, এরা পোকা-মাকড়ও খেত। অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুররা কোন পানি না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারত। এদের পানির অধিকাংশ চাহিদা এরা খেয়ে থাকা ঘাস, লতা, পাতা ও গাছের শিকড় হতে মিটাতো।

প্রায় এক বছর বয়সে স্ত্রী অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুররা আর পুরুষরা প্রায় পনেরো মাস বয়সে যৌন সক্ষমতা লাভ করত। সারা বছর সংসর্গ করার সক্ষমতা থাকলেও এরা সাধারণত: জুন ও ডিসেম্বরের দিকে গর্ভধারণ করত। এদের গর্ভকাল ছিল সাধারণত: দুই মাস। এরা সাধারণত: একটিই শিশুর জন্ম দিত। শিশু অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুররা অন্যান্য মারসুপিয়ালদের শিশুদের মত অপরিপক্ক অবস্থায় জন্ম নিত। জন্মের পর শিশু অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুররা মায়ের থলিতে সাধারণত: তিন মাস থাকত। মায়ের থলি ছেড়ে স্থায়ীভাবে বের হয়ে আসার পর এক মাস পর্যন্ত শিশু অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুররা মায়ের সাথে থাকত। এরপর, মা-সন্তান দুজনেই নিজেদের একাকিত্বের জীবন যাপন করতে চলে যেত।


ছবি: যুক্তরাজ্যের প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘরে সংরক্ষিত নমুনা

১৮৪০ সালের পর অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরদের আর দেখা যাওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। প্রায় নব্বই বছর পর, হেডলি ফিনলেসন ১৯৩১ সালে মধ্য অস্ট্রেলিয়ার মরুঞ্চলে অস্ট্রেলিয়ার এদের একটি বসতি খুঁজে পান কিন্তু কয়েক বছরের মাঝে ওই বসতিটিতে আর অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরদের আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।
১৯৩৫ সালে উত্তর অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণাংশের লেক আইরের পূর্ব পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে শেষবারের মত অস্ট্রেলিয়ান মরুক্যাঙ্গারুঁদুরদের দেখতে পাওয়া যায়। এরপর, পঞ্চাশ, ষাট ও আশির বেশ কয়েকবার অস্ট্রেলিয়ার এদের দেখা যাবার খবর পাওয়া গেলেও সেগুলো গুজব ছাড়া আর কিছু ছিল না। অবশেষে, IUCN ১৯৯৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরদের বিলুপ্ত প্রাণী হিসেবে ঘোষণা করে।

অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুর হারিয়ে যাবার মূল কারণ কিন্তু সেই পুরনো দোষী, আধুনিক সভ্য মানুষ। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসী রাঙা শেয়াল ব্যাপক হারে বংশ বিস্তার করে। রাঙা শেয়াল অস্ট্রেলিয়ায় আমদানী হয় ইউরোপিয়ান সেটলারদের মাধ্যমে। ধারণা করা হয়, অধিকাংশ হতভাগা অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুর রাঙা শেয়ালের খাদ্যে পরিণত হয়।
অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরদের বিলুপ্তির মূল কারণগুলো হল:
• অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরদের বসতি অঞ্চলে আধুনিক মানুষের প্রাত্যাহিক যাতায়াত।
• বসবাস, চাষাবাদ ও গো-চারণভূমির জন্য নতুন ভূমি ব্যবহার।
• মধ্য অস্ট্রেলিয়ায় রাঙা শেয়ালের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া ও প্রচুর বংশবৃদ্ধি এবং অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরদের রাঙা শেয়ালের খাদ্যে পরিণত হওয়া।
• পরিবেশ দূষণ।

অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরের শেষ নমুনা সংগ্রহ করা হয় গত শতকের আশির দশকে। এই নমুনা থেকে এবং বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ব্যাক্তির অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুরের দেখা পাবার দাবীর ভিত্তিতে অনেকে মনে করেন মধ্য অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চলের কোন জায়গায় এখনো টিকে আছে অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুর। আমিও এই আশাবাদীদের মত আশা করি, একদিন আবারো মধ্য অস্ট্রেলিয়ার মরু অঞ্চলে ঘুরে বেড়াবে অস্ট্রেলিয়ার মরুক্যাঙ্গারুঁদুর।

মন চরম খারাপ। এরকম বিচিত্র প্রাণী এভাবে হারিয়ে গেল.......?

তথ্য ও ছবি উৎস:
অ্যানিম্যাল ডাইভারসিটি ওয়েবে প্রকাশিত মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের লিন্ডসে দ্যুভ্যালের প্রবন্ধ।
উইকিপিডিয়া।


মন্তব্য

ফাহিম হাসান এর ছবি

হায় হায়! একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেল! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আরো যে কত প্রাণী এভাবেই হারিয়ে যাবে।

সিরিজটা ভালো হচ্ছে - চলুক চলুক

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

আর কোন প্রাণী যেন আর এভাবে হারিয়ে না যায়, এই উদ্যোগ নিতে হবে। সবাইকে সচেতন হতে হবে।

পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

তারেক অণু এর ছবি

এদের বাংলা নাম হিসেবে ক্যাঙ্গারু ইঁদুর কোথায় দেখেছি মনে পড়ছে।

দারুণ হচ্ছে, শুধু প্রাণীটা বিলুপ্ত হয়ে গেল এটাই খুব খারাপ হয়েছে।

একের পর এক পোস্ট দিন প্রাণীজগৎ নিয়ে-

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

মরুক্যাঙ্গারুঁদুর নামটি দেয়ার সময় সুকুমার রায়ের কথা মাথায় ছিল। দেঁতো হাসি

উৎসাহ দেবার জন্য ও পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

রু এর ছবি

আমিও মনে হয় ক্যাঙ্গারু ইঁদুর পড়েছি। কোনো প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে শুনলে খুব খারাপ লাগে, বিলুপ্তির পথে শুনলে খুব ভয় লাগে।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

কোনো প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে শুনলে খুব খারাপ লাগে, বিলুপ্তির পথে শুনলে খুব ভয় লাগে।

সব প্রাণীরা তাদের মত করে বেঁচে থাকুক।

পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

একদমই হারায় গেলো। পড়েই মন খারাপ। মন খারাপ

দেবা ভাই
-----------------------------------------
'দেবা ভাই' এর ব্লগ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

আমারো মন খারাপ। মন খারাপ

তানিম এহসান এর ছবি

রাঙা শেয়াল অস্ট্রেলিয়ায় আমদানী হয় ইউরোপিয়ান সেটলারদের মাধ্যমে। এই পৃথিবীর, প্রকৃতির কতকিছু যে এরা নষ্ট করেছে, ধ্বংস করেছে, করছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট করে দিতে পারলে আরকিছু করতে হয়না।

সবুজ বিপ্লবের নামে আমাদের কত পাখী-গাছ-মাছ-ধান আরও প্রাণী প্রজাতি চিরতরে হারিয়ে গেছে, আরও হারাবে। মন খারাপ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ঠিক বলেছেন তানিম দা।
মানুষের বর্বরতার শিকার হয়ে একের পর এক হাজারো প্রাণী হারিয়ে গেছে ও যাচ্ছে।

পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

যুমার এর ছবি

কত অদ্ভুত আর মজার প্রাণীর কথা যে জানছি! সিরিজ চলুক

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

প্রাণীজগৎ সম্পর্কে নতুন নতুন তথ্য জানা হচ্ছে। তবে বিলুপ্তির তথ্যে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
এ বিষয়ে লেখা জারি থাকুক।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

কড়িকাঠুরে এর ছবি

এরকম পশু-পাখিদের কথা শুনলে অপরাধবোধ প্রবল হয়ে যায়... মন খারাপ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

চলুক

পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মানুষ ছাড়া আর কোনো প্রাণী পৃথিবীতে বেঁচে থাকার দরকার কী?
শুধু কিছু ফার্মের মুরগী পয়দা হবে কেএফসিতে পুড়বে আমাদের খাদ্যচাহিদা মেটানোর জন্য
আর সব বিলুপ্ত হয়ে যাক...

[এটাই মনে হয় মানবজাতির চাওয়া মন খারাপ ]

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

একদিন মানবজাতিকে এসবের ফল ভোগ করতে হবে।
অবশ্য ইতিমধ্যে নানান প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাধ্যমে তা ভোগ করা শুরু করে দিয়েছে।

পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।