সিরাজী, জাফর ও শওকত সাহেবদের কথা...

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
লিখেছেন সবুজ পাহাড়ের রাজা (তারিখ: শুক্র, ১২/১০/২০১২ - ১:৫৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

খবর-১:

সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা শাখা (সাবেক শেরাটন) থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে ২০১০-১২ সময়ে ২৬৬৭ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে হলমার্ক গ্রুপ। [০১]

খবর-২:

হলমার্ক গ্রুপের এই অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি এই বছরের জানুয়ারিতে টের পেয়ে যান তৎকালীন সোনালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আ.ন.ম. মাশরুরুল হুদা সিরাজী। নিজে উদ্যোগী হয়ে তিনি হলমার্কের বিষয়ে নিরীক্ষা শুরু করেন। এতে তাঁর প্রতি ওপর মহল থেকে প্রচণ্ড চাপ আসা শুরু করে। ওইসব চাপের কাছে নতি স্বীকার না করে তিনি অডিট কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকেন। বিভাগীয় নিরীক্ষার উদ্যোগ নেন কিন্তু ব্যবস্থা নেয়ার একদিন আগেই তাকে বদলি করে কুমিল্লায় পাঠিয়ে দেয়া হয়। এরপর তাঁকে সিলেটে ও পরে রংপুরে বদলি করা হয়। সিরাজী সাহেবের বক্তব্যে, সরকার ও ব্যাংক কর্মকর্তাদের হলমার্ক কেলেঙ্কারীতে জড়িত থাকার কথা জানা যায়।
সিরাজী সাহেবের সাথে আরো যেকজন কর্মকর্তা সাহসী ভূমিকা নিয়ে হলমার্ক-সোনালী ব্যাংকের অর্থ-লোপাটের বিষয়টির নিরীক্ষায় অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন, তারা হলেন-উপমহাব্যবস্থাপক এস.এইচ.এস.আবু জাফর ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক শওকত আলী। [০২, ০৩]

খবর-৩:

রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংকের রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে ভুয়া ঋণপত্র বা এলসির মাধ্যমে অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় দুদকের ছয় সদস্যের তদন্ত দল বাদী হয়ে রমনা মডেল থানায় হলমার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তানভীর মাহমুদসহ হলমার্কের সাতজন ও সোনালী ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক হুমায়ুন কবিরসহ সোনালী ব্যাংকের বিশ জন, সর্বমোট সাতাশ জনকে আসামি করে প্রতারণা, জাল-জালিয়াতি, অর্থ আত্মসাৎ, পরস্পরের যোগসাজশ,ক্ষমতার অপব্যবহার ও অর্থের সব অপব্যবহার-সংক্রান্ত মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ এনে গত বৃহস্পতিবার (০৪/১০/২০১২) এগারোটি মামলা করেছে।
দুদকের এই দায়ের করা মামলার আসামী হয়েছেন সোনালী ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আ.ন.ম. মাশরুরুল হুদা সিরাজী, উপমহাব্যবস্থাপক এস.এইচ.এস.আবু জাফর ও সহকারী মহাব্যবস্থাপক শওকত আলী। [০৪]

সিরাজী, জাফর ও শওকত সাহেবদের কথা:

হলমার্ক গ্রুপ যখন সরকার ও সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহায়তায় ব্যাংক থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যাংক থেকে লোপাট করছিল, তখন ব্যাংকের ভিতরের থেকে প্রতিকূল পরিবেশে সাহস নিয়ে এগিয়ে এসে হলমার্কের এই দুর্নীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন ব্যাংকের মহাব্যবস্থাপক আ .ন.ম. মাশরুরুল হুদা সিরাজী, উপমহাব্যবস্থাপক এস.এইচ.এস.আবু জাফর এবং সহকারী মহাব্যবস্থাপক শওকত আলী।

সিরাজী, জাফর, শওকত সাহেবরা পারতেন চুপ করে সবকিছু সহ্য করতে। যেখানে আড়াই হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি হয়েছে, সেখানে ব্যাংকের পরিচালক পদে কর্মরত এই তিনজন পারতেন দশ-বারো কোটি টাকা ঘুষ খেয়ে চোখ, কান, মুখ বন্ধ করে চুপ থাকতে। পারতেন বিশাল অংকের ঘুষের টাকায় আয়েশী জীবন যাপন করতে।

কিন্তু মানুষগুলো বড় বোকা। অঢেল টাকা আর আয়েশী জীবনের লোভ ত্যাগ করে এই মানুষগুলো সোনালী ব্যাংকের অর্থ-দুর্নীতির বিষয়ে নীরিক্ষার কাজে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা রাখেন। ফলস্বরূপ জুটেছিল অপমান আর বদলির কষ্ট।

কিন্তু তাদের কষ্ট বৃথা যায়নি। হলমার্কের অর্থ-আত্মসাতের বিষয়টি প্রকাশ্যে চলে আসে। এরপর, আমরা দেখতে পাই মন্ত্রীদের প্রলাপ। মিডিয়ার কল্যাণে বেরিয়ে আসে গর্তের অনেক গোপন খবর। সরকার নড়ে চড়ে বসে। মন্ত্রীরা মুখে লাগাম লাগাতে শুরু করে। মিডিয়ার অনুসন্ধানী রিপোর্টে বেরিয়ে আসে,হলমার্কের দুর্নীতিতে ব্যাংকের ভিতরের চোরগুলোর সাথে সরকারের অনেকেই তো জড়িত।

তারপরও আশাবাদী ছিলাম, দোষীদের বিচার হবে। সরকারও আশ্বাস দেয় এব্যাপারে। কিন্তু আমরা আমজনতা বড়ই বোকা। সরকারের মিষ্টি কথায় গলে গেলাম।

অবশেষে, দুদক দোষীদের বিরুদ্ধে মামলা করল। আর সেই মামলায় চোরদের কাতারে শামিল করা হল সিরাজী, জাফর, শওকত সাহেবদের।

সেলুকাস! যে মানুষগুলো কোটি টাকার লোভ না করে হলমার্ক-দুনীর্তির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিল, ব্যাংক কর্তৃপক্ষের করা অপমান আর কষ্ট সহ্য করলেন, সেই মানুষগুলোকেই কি-না চোরদের কাতারে শামিল করে দেয়া হল।

এই হল আমাদের দেশের ভাল মানুষদের পরিণতি। লজ্জায় মাথা নুঁয়ে রাখি। যারা দেশের জন্য এতকিছু করলেন। কোটি টাকার লোভ ঠেলে দূরে ফেলে দিলেন। তাদের আমরা মাথায় করে রাখার বদলে চোরদের কাতারে ফেলে দিলাম?

দিন দিন আমাদের এই সুন্দর দেশটা বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে না কি? 'সময় গেলে সাধন হবে না'-লালন ফকিরের গানের এই লাইনটা বড় বেশি মনে পড়ে যাচ্ছে।

.


মন্তব্য

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

এই দেশের ভবিষ্যৎ কি হবে তবে?
ভালো মানুষেরা দেশ ছাড়া -
আর খারাপ মানুসে দেশ ভরা ???
মন খারাপ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যত অন্ধকার।
তবে, আমি-আপনি-আমরা চেষ্টা করলে সব অন্ধকার দূর হবেই।

অতিথি লেখক এর ছবি

আচ্ছা ভাইয়া,
এরকম হতে পারে না, ভাগে টাকা কম পড়াতে সিরাজী সাহেব হলমার্কের বিরুদ্ধে লেগেছেন।
আমি শুধু সম্ভাবনার কথা বলছি।

(ফুটোন্বেষী)

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

আপনার সন্দেহ তো এখনও প্রমানিত হয়নি। তাই, ওই সন্দেহ নিয়ে আপাতত: কথা না বলাই ভাল।
সত্য প্রকাশিত হোক।

অতিথি লেখক এর ছবি

চমতকার লেখা।
সিরাজীরা আছেন বলেই বাংলাদেশ এখনো বসবাস উপযোগী আছে। প্রাতিষ্ঠানিক কাজে উনাকে চিনি। মিতভাষী এবং বেশ ভাল মানুষ।

-শুভ আসাদ

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ভাল মানুষরা আছেন বলেই, দেশটা এখনো আছে, চলছে।
পোস্ট পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

অতিথি লেখক এর ছবি

সিরাজীরা দেশপ্রেমিক বা, ভাল মানুষ হলে সাধুবাদ জানাই কিন্তু গণিমত কম পাওয়ায় বা, একদমই না পাওয়ার আক্রোশ থেকে যদি হলামার্কের বিরুদ্ধে কাজ করে, তাহলে হলমার্ক আর সোনালী ব্যাংকের এসব কর্মকর্তাদের জন্য একদলা থু থু।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

সিরাজী, জাফর ও শওকত সাহেবরা নীতিবোধ থেকে হলমার্কের বিরুদ্ধে কাজ করেছেন বলেই এনাদের সমর্থনে আমার এই পোস্ট কিন্তু যদি এনারা অন্য উদ্দেশ্যে হলমার্কের বিরুদ্ধে কাজ করেন, তবে, এনাদের প্রতি আমার সহানুভূতি ঘৃণায় পরিণত হতে মুহূর্তকাল লাগবে না।

অতিথি লেখক এর ছবি

দেশের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করলে ভয় লাগে।
-ফিওনা।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

সত্যি বলতে, এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পতন সময়ের ব্যাপার মাত্র হয়ে দাঁড়াবে।

মাইনুল এইচ সিরাজী এর ছবি

জিএম সিরাজী প্রধান কার্যালয়ে যোগদান করেন এ বছরের ১ জানুয়ারি। যোগদান করেই তিনি দেখতে পান পূর্ববর্তী কয়েক মাসে রূপসী বাংলাসহ ৩টি শাখায় ঋণ কার্যক্রমে অনিয়ম হয়েছে। এবং তখনও হচ্ছে। তিনি অডিটের উদ্যোগ নেন। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ান এমডি ও ডিএমডি। তাঁরা সিরাজীকে অন্য দুটি শাখা অডিট করতে বলেন আগে (এই বাধা অন্য কোনো কারণে নয়, শুধু রূপসী বাংলা শাখা থেকে লুটপাটের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য)। অনেক নাটক শেষে ৪ এপ্রিল যখন রূপসী বাংলা শাখা অডিটের তারিখ নির্ধারিত হয়, তার দুদিন আগে ২ এপ্রিল জিএম সিরাজীকে বদলি করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সিলেটের দায়িত্বসহ কুমিল্লায়। পরে আবার রংপুরে। ডিজিএম আবু জাফরকে পাঠানো হয় ফেনীতে।
এখন যাঁরা এই কর্মকর্তাদের সততা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছেন, তাঁদের একটা অনুরোধ করি। দয়া করে একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন, সিরাজী জয়েন করার পরপরই অডিট টিম গঠন করেছেন, নাকি নিজের ভাগ পাওয়ার জন্য সময় ক্ষেপন করেছেন? আর যদি ভাগ পাওয়ার বিষয়-আশয় থাকত, তাহলে তাঁকে হয়রানিমূলক বদলি করা হলো কেন?
একটা কথা এখন ভাবছি। সিরাজীকে যে কোটি টাকা আর ফ্ল্যাটের অফার দেওয়া হয়েছিল, সে সব নিলেই তিনি ভালো করতেন। এখন নামকরা আইনজীবী নিয়োগ করে পার পেয়ে যেতেন। এখন তিনি কীভাবে পার পাবেন? তাঁর কাছে যে লাখ টাকাও নেই।
যা-ই হোক। সিরাজীদের এখন চোর-বাটপারের কাতারে নামিয়ে এনেছে দুদক। আর যাঁর অঙুলিহেলনে হাজার কোটি টাকা লোপাট হলো, তিনি রয়ে গেলেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। এটাই এখন বাস্তবতা। এটাই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ধন্যবাদ মাইনুল ভাই।
কয়েকজন মন্তব্যকারীর সন্দেহের জবাব দিতে সিরাজী পরিবারের ভিতরের একজনের বক্তব্যের খুব দরকার ছিল। আপনি তা ক্লিয়ার করে দিলেন।
থেংকস ম্যান।

প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

আমরা ধীরে ধীরে মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলছি। কিন্তু না, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো চলবেনা। তাহলে আর আশার জায়গা থাকবে না। ভাল মানুষ, সৎ মানুষ, নিঃসার্থ পরপোকারী এখনও আছেন।
ধন্য বাদ, লেখাটির জন্য। সৎ মানুষের পক্ষে দাড়ানোর জন্য।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ঠিক বলেছেন, বিশ্বাস হারানো চলবে না। আমি-আপনি-আমরা চেষ্টা করলে সব অন্ধকার দূর হবেই।

মুস্তাফিজ এর ছবি

ব্যাপারনা।
একসময় সবমিলিয়ে আমার নামে ১৩৮টা (I mean that) মামলা ছিলো। মামলা থাকলেই যে দোষী এই কথাটা ঠিক না। আর আ .ন.ম. মাশরুরুল হুদা সিরাজী যা করেছেন (যতটুকু শুনেছি) তা উনার দায়িত্বের ভেতরই পরে।

...........................
Every Picture Tells a Story

স্যাম এর ছবি

???!!!!!১৩৮???!!!
খুব ঝামেলা না হলে এই গল্পটা কি আমাদের বলা যায় মুস্তাফিজ ভাই?

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

স্যাম দা'র সাথে একমত। সেই কাহিনী শুনতে চাই।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

ওবাবা! ১৩৮ টা!! বলেন কি!!!
স্যাম দা'র মত বলি, সমস্যা না বলে কাহিনী শেয়ার করেন।

শওকত, জাফর, সিরাজী সাহেবরা যা করেছেন, তার জন্য আমাদের উচিত উনাদের মাথায় তুলে রাখা। এরকম সাহসী-সৎ-কর্তব্যপরায়ণ মানুষ আজকাল পাওয়া যায় না।
কিন্তু আমরা দুর্ভাগা জাতি। সৎ-সাহসীদের মর্যাদা দিই না।

মুস্তাফিজ এর ছবি

এরকম সাহসী-সৎ-কর্তব্যপরায়ণ মানুষ আজকাল পাওয়া যায় না।

এ কথা সত্য ধরে নিয়েই বলছি উনি যা করেছে বলে বলা হচ্ছে সেটা তার দায়িত্বের ভেতরই ছিলো। এজন্য কাউকে মাথায় তুলে রাখাটা একটু বাড়াবাড়িই। ঐটা উনার চাকরি এবং এজন্যে উনি পয়সা নেন। উনি উনার কাজের প্রতি সৎ ছিলেন এবং সৎ থাকার জন্য প্রতিহিংসার কবলে পড়েছেন। আমাদের দেশে এরকম সাহসী-সৎ-কর্তব্যপরায়ণ মানুষ আজকাল পাওয়া যায় না আমি একথা মানতে পারছি না, এমন সৎ মানুষের খোঁজ আমাদের আশে পাশে অনেক পাবেন।

...........................
Every Picture Tells a Story

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

আমাদের দেশে আশেপাশে অনেক সৎ মানুষ আছেন ঠিকই কিন্তু জায়গামত সেই সৎ সাহস দেখানোর মানুষের অভাব আছে বই-কি।

ঠগ বাছতে গেলে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে।
দায়িত্ব পালন না করাটাই যেখানে নিয়ম হয়ে যায়, সেখানে ব্যাতিক্রমীদের বাহবা তো দিতেই হয়, কি বলেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।