হাওয়াই মিঠাই ২

কনফুসিয়াস এর ছবি
লিখেছেন কনফুসিয়াস (তারিখ: শুক্র, ১৫/০২/২০০৮ - ৬:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অস্ট্রেলিয়ার প্রধান মন্ত্রী কেভিন রাড একটা ইতিহাস তৈরি করে ফেললেন।

ব্যাপারটার বর্ণনা আরও অনেক সুন্দর ভাবে দেয়া যায় নিশ্চয়- পত্রিকায় যেমন লিখেছে- অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসে একটি সোনালী পাতা যোগ হলো- বা এরকম কিছু। কিন্তু আমি এত কিছু বুঝি না, আমার কাছে মনে হয়েছে- আলাদা পাতা-টাতা নয়, এই ব্যপারটা নিজেই একটা ইতিহাস।

পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে কেভিন রাড- এই দেশের আদিবাসীদের উপর গত ২২০ বছর ধরে যে অন্যায় ও অত্যাচার হয়েছে, তার জন্যে সোজাসুজি দুঃখ প্রকাশ করেছেন, এবং ক্ষমা চেয়েছেন। বিশেষ করে তাদের কাছে, যাদেরকে বহু বছর আগে নিজেদের বাবা-মা-পরিবারের কাছ থেকে জোর করে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিলো, এ দেশে যাদেরকে 'স্টোলেন জেনারেশান' নামে ডাকা হয়।
আদিবাসীদের ইতিহাস বোধকরি পৃথিবীর কোথাওই আলাদা কিছু নয়। হোক সেটা আমেরিকা, ভারত, বাংলাদেশ অথবা অস্ট্রেলিয়া!

সাদা মানুষেরা এই দেশে বসতি বানাবার জন্যে নির্মূ্লের কাছাকাছি নিয়ে গেছে এখানকার এবঅরিজিনদের। মাল্টিকালচারাল দেশগুলোতে যা হয়, এখানেও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের শিশুরা তাই বড় হয় সাদা এবং এবঅরিজিন হিসেবেই। কেভিন রাডের ক্ষমা প্রার্থনা- হয়ত তাদের সাদা-কালো না হয়ে- শুধু অস্ট্রেলিয়ান হিসেবে বড় হবার একটা সুযোগ করে দিবে।

বড় শহরগুলোর রাস্তায়, রেস্তোরায় আর খেলার মাঠে বিগ স্ক্রীণে সরাসরি সম্প্রচার হয়েছে কেভিনের বক্তৃতা। ক্যানবেরায় পার্লামেন্ট হাউজের বাইরে অপেক্ষায় ছিলেন শত শত এবঅরিজিন, বক্তৃতার এক পর্যায়ে যখন কেভিন উচ্চারণ করলেন 'আই এপোলোজাইজ', অনেকেই আবেগে কেঁদে ফেলেন।
আদিবাসী নেতা প্যাট ডডসনের কথাটা চমৎকার লেগেছে আমার কাছে, " ক্ষমা চাইতে সাহস লাগে, ক্ষমা করতেও সাহসী হতে হয়, গন্তব্য জানা নেই, সেরকম স্বপ্নময় একটা যাত্রা শুরু করতেও অনেক বেশি সাহসের প্রয়োজন হয়।'

বেশ কিছুদিনের প্রস্তুতির পরে গত ১৩ তারিখে কেভিন পার্লামেন্টে তাঁর বক্তব্য রাখেন। ব্যপারটা খুব মসৃণ ছিল এমন নয়। নিজের দল, মানে লিবারেল পার্টির বেশ ক'জন সংসদ সদস্য কেভিনের পক্ষে ছিলেন না। শুরুতে একেবারেই সমর্থন পান নি বিরোধী দলের নেতা নেলসনের কাছ থেকেও। এই ভদ্রলোক বেশ গোঁয়ার আছেন বুঝা গেল, সেদিনের অনুষ্ঠানেও উনি 'যা কিছু হয়েছিলো ভালোর জন্যেই' জাতীয় কিছু মন্তব্য করে বসেছিলেন স্টোলেন জেনারেশানের মানুষদের নিয়ে। তার ফলও মিলেছে সাথে সাথেই, সবাই দুয়ো ধ্বনি ছুঁড়েছে তার উদ্দেশ্যে। তবে শেষমেষ কেভিনের আহবানে সাড়া দিয়েছেন ভদ্রলোক।
প্রাক্তন চারজন প্রধানমন্ত্রী এসেছিলেন সেদিন পার্লামেন্টে। তাঁদের মধ্যে ছিলেন না..., কে বলুনতো?- জনাব জন হাওয়ার্ড।
দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা চাইবার পুরো ব্যাপারটাকে ভেটো দিয়েছেন তিনি।

রাডের একটা কথা খুব ভাল লেগেছে। বলেছেন, আবেগ কখনো ইতিহাস তৈরি করে না, আমাদের কাজের মাধ্যমেই সেই ইতিহাস তৈরি হয়।
তা যে হয়, সেটা অন্তত ক্ষমা চাওয়ার উদ্যোগ নিয়ে ও তা বাস্তবায়ন করে রাড বুঝিয়ে দিয়েছেন।
এবার দেখা যাক, যাদের জন্যে এত আয়োজন, সত্যি সত্যিই তারা এর ফলে উপকৃত হতে পারে কি না!


মন্তব্য

সুমন চৌধুরী এর ছবি

ভালো লাগলো।
তবে এইটাও একটা পেজগী হইতে পারে। সফেদ রামুদের খাই পড়ি বটে। কিন্তু বিশ্বাস করি না।



ঋণম্ কৃত্বাহ ঘৃতম্ পীবেৎ যাবৎ জীবেৎ সুখম্ জীবেৎ

বিপ্লব রহমান এর ছবি

উদ্ধৃতি

আদিবাসীদের ইতিহাস বোধকরি পৃথিবীর কোথাওই আলাদা কিছু নয়। হোক সেটা আমেরিকা, ভারত, বাংলাদেশ অথবা অস্ট্রেলিয়া!

একমত। ।

মেইলবোর্নের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী আমার ভাগ্নি মুনার কাছে খবরটি শুনে ইন্টারনেট আর এদেশের পত্র- পত্রিকায় ছোট করে প্রকাশিত খবরটি আগেই পড়েছিলাম। এখন আপনার লেখায় আরেকটু বিস্তারিত জেনে ভালো লাগলো।

মুনার কাছে শুনেছি, অস্ট্রেলিয়ান সরকার নাকি আদিবাসী সংস্কৃতি, কুটির শিল্প, ঐতিহ্য রক্ষায় অনেক উদার, এমন কি সহযোগি। প্রমান হিসেবে মুনা আমাকে আদিবাসীদের তৈরি কিছু বুমেরাং আর নকশা করা টি শার্ট এনে দিয়েছে।

তবে এ - ও শুনেছি, সেখানের আদিবাসীরা নাকি সরকারি পুনর্বাসনে (?) মোটেই রাজী নন। তারা নাকি জনবিচ্ছিন্ন আদিম বুনো জীবনই পছন্দ করেন।...ইত্যাদি।

শেষোক্ত ঘটনাটি যদি সত্যি হয়, তাহলে আমি কিন্তু আদিবাসীদেরই সমর্থন করবো। প্রত্যেকেরই নিজ নিজ রীতিনীতির, তথা পছন্দের জীবন যাপন করার অধিকার আছে, যেমন একজন সৈনিকের রীতি হচ্ছে ব্যারাক জীবন, তাই না?

কনফুদার কাছে আগামীতে এ নিয়ে ছবিসহ সরেজমিন কোনো লেখা আশা করবো। ধন্যবাদ।


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

পরিবর্তনশীল এর ছবি

পৃথিবীর সব দেশের প্রধানমন্ত্রীরা যদি এমন হত!
---------------------------------
চোখের পাতায় হাত রেখে ওরা আমাকে স্বপ্ন দেখার যন্ত্রণা দেয়।

দ্রোহী এর ছবি

এবার আসার সময় আমার বউ আমার জন্য আদিবাসীদের তৈরি কয়েকটা টি-শার্ট এনেছে। টি-শার্টগুলো দেখলে হঠাৎ করে মনে হয় বুকে নকশীকাঁথার কাজ করা।

দেখা যাক কেভিন রাড সাহেব কথা অনুযায়ী কদ্দুর কি করেন। রাজনীতি বড়ই ঘোলাটে ব্যাপার বাপু!


কি মাঝি? ডরাইলা?

হিমু এর ছবি

মেরেধরে শেষ করে নকশী-কাঁথা পুষে রেখে দরদ দেখানোকে "ইয়ে মেরে টিস্যু দান" ছাড়া আর কিছু বলা যায় না।

অস্ট্রেলিয়ায় আদিবাসীদের হটানোর সবচেয়ে নির্মম উদাহরণ আছে তাসমানিয়ায়। তাসমানিয়া এক কালে বৃহত্তর মহাদেশ সাহুল এর অংশ ছিলো (পাপুয়া নিউগিনি, অস্ট্রেলিয়া আর তাসমানিয়া নিয়ে বৃহত্তর মহাদেশ, পরবর্তীতে সাগর সমতলের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে এর নিচু অংশগুলো সমুদ্রের নিচে চলে গিয়ে তিনটি বিচ্ছিন্ন ভূ-খন্ড তৈরি হয়), সাহুলের আদিবাসীদের যে অংশ তাসমানিয়াতে আটকা পড়েছিলো, তারা শ্বেতাঙ্গদের আগমনের আগ পর্যন্ত বিচ্ছিন্নই ছিলো। বৃটিশ বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ানরা এদের মানুষ আর বানরের মাঝামাঝি জীব বলে মনে করতো। প্রায় ৫,০০০ তাসমানিয়ানের প্রত্যেককে (আমি আবারও বলছি, প্রত্যেককে) মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছিলো। শুরুতে তাদের গুলি করে আর বিষ দিয়ে মারা হতো, শেষ যে ক'জন জীবিত ছিলো, তাদের জোর করে খ্রিষ্টান বানিয়ে একটি ছোট দ্বীপে পাঠিয়ে দেয়া হয়, যেখানে প্রায় সবাই রোগে আর শোকে ভুগে মারা যায়। শেষ জীবিত পুরুষ কিং বিলির মৃতদেহ কবর থেকে তুলে "গবেষণা" করা হয়েছিলো মিসিং লিঙ্ক হিসেবে চালানোর জন্য, দুই ডাক্তার তার শরীরের বিভিন্ন টুকরো নিয়মিত একজন আরেকজনের কাছ থেকে চুরি করতো। কিং বিলির অন্ডকোষ পরিষ্কার করে সেটা দিয়ে তামাকের ব্যাগ বানিয়েছিলো এক ডাক্তার। তার স্ত্রী, শেষ আদিবাসী তাসমানিয়ানের ইচ্ছা ছিলো মৃত্যুর পর তার শরীরটা যাতে কেটে টুকরো না করে সাগরে ফেলে দেয়া হয়। তার কঙ্কাল ১৯৫৯ সাল পর্যন্ত তাসমানিয়ায় হোবার্ট জাদুঘরে নিদর্শন হিসেবে দেখানো হয়েছিলো। অস্ট্রেলিয়ায় তাসমানিয়ার উদাহরণ ১০০% না হলেও প্রায় ৮০% অনুসরণ করা হয়েছিলো।

তথ্যসূত্র জানিয়ে দিই, রিচার্ড ডকিন্সের দ্য অ্যানসেস্টরস টেল আর জ্যারেড ডায়মন্ডের দ্য রাইজ অ্যান্ড ফল অব দ্য থার্ড শিম্পাঞ্জি।

কোন বৃটিশ যদি সভ্যতার বড়াই করে, কানের ওপর একটা চটকানা মারতে মন চায়। এই চুদির ভাইয়েরা দক্ষিণ আফ্রিকায় ব্যোর যুদ্ধের সময় কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বানিয়ে মহিলা আর শিশুদের খুন করেছে, একটা গোটা জাতিকে একটা ভূখন্ড থেকে মেরে শেষ করেছে, এখন একটা দেশের নিরীহ মানুষদের খুন করছে তাদের মাটির নিচ থেকে তেল চুরির জন্য। নিজের দেশে বৃটিশদের ইতিহাস নিয়ে অভিযোগ নাহয় করলাম না।


হাঁটুপানির জলদস্যু

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- কোন অস্ট্রেলিয়ান রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের জন্য এটা ইতিহাসই বটে!
_________________________________
<সযতনে বেখেয়াল>

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

হুমম

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

বিষয়টিকে অনেক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যেতে পারে। বিতর্কও হতে পারে এ নিয়ে, তবে পূর্বপুরুষদের কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা চাইবার বিষয়টি আমার কাছে ভালো লেগেছে। সব শ্বেতাঙ্গই কালোদের নিগ্রহ করতে মুখিয়ে আছে, এমনটি ভাবা, আমার মনে হয়, উচিত নয়।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

কনফুসিয়াস এর ছবি

আমিও সন্ন্যাসীর মত করে ভাবছি।
যে সব অত্যাচার করা হয়েছে আদিবাসীদের সাথে, তার ক্ষতিপূরণ কোনভাবেই সম্ভব নয়, সেটা দেয়ার চেষ্টা করাটাও হাস্যকরই হবে। কিন্তু পূর্ব-পূরুষদের কৃতকর্মের জন্যে ক্ষমা চেয়েছে- একেবারে অফিসিয়ালি- পার্লামেন্টে বসে- একটা জাতির কাছে তাদের প্রধানমন্ত্রী- এই ব্যাপারটাতেই আমি অভিনবত্ব পেয়েছি।
তারচেয়ে বড় কথা, আমি খুশি বা অখুশি নই, আমার দৃঢ় কোন মতামতও নেই পুরো ব্যাপারটাতে, কিন্তু এখানকার আদিবাসীরা কিন্তু ভয়ানক খুশি! আমার মনে হয় ব্যাপারটার গুরুত্ব এ জন্যেই অন্যরকম।
-----------------------------------
যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

" ক্ষমা চাইতে সাহস লাগে, ক্ষমা করতেও সাহসী হতে হয়, গন্তব্য জানা নেই, সেরকম স্বপ্নময় একটা যাত্রা শুরু করতেও অনেক বেশি সাহসের প্রয়োজন হয়।'

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

অমিত আহমেদ এর ছবি

ব্যাপারটা আমারও ভালো লেগেছে। ক্ষমা চাওয়াই উচিত ছিলো। কেভিন রাড একজন যোগ্য মানুষের মত কাজ করেছেন।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।