ঈশ্বরের রংধনু দেশেঃ ১

কনফুসিয়াস এর ছবি
লিখেছেন কনফুসিয়াস (তারিখ: বিষ্যুদ, ২৬/০৭/২০০৭ - ৯:৫২অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

শূন্য।

'কোন দেশ থেকে এসেছ তুমি?'
'বাংলাদেশ।'
প্রশ্নকর্তার নাম প্যাট্রিক ম্যান্ডেলা কাও। আমার ক্লাশমেট। উত্তর শুনে একটু অসহায় দেখালো, খানিকটা দোনোমনা করে জিজ্ঞেস করলো, কোথায় যেন দেশটা?
এই প্রশ্নটা পছন্দ হলো না আমার। বাংলাদেশ কোথায় এটা জানবেনা কেন? তবু ভালো করে অবস্থানটা বোঝালাম তাকে। আমার কণ্ঠে মনে হয় উষ্মা প্রকাশ পেয়েছিলো, কাও হেসে বলল, " তুমি রাগ করেছ? কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তুমিও আমার দেশের নাম শুনোনি কখনো। আমার দেশের নাম লিসোথো , শুনেছ আগে?''
সত্যিই, আগে শুনিনি এর নাম। কেনিয়া , জিম্বাবুয়ে, নামিবিয়া এবং আরো কিছু আফ্রিকান দেশের নাম শোনা থাকলেও লিসোথোর নাম শুনিনি কখনো। মাথা নেড়ে জানালাম সেটা। ও এইবার দন্ত বিকশিত একটা হাসি দিল, যার অর্থ 'হু হু, দেখলে!''
লিসোথোর ম্যাপ দেখেছিলাম পরে, সাউথ আফ্রিকার ঠিক মাঝখানে দেশটা। ঠিক করে বলি আরো, বাংলাদেশের ম্যাপে ঢাকার অবস্থান যেখানে, সাউথ আফ্রিকার ম্যাপে লিসোথোর অবস্থান ঠিক সেখানেই। অথচ পুরো আলাদা একটা স্বাধীন দেশ! আমি কখনো ভাবিইনি এভাবে কোন দেশের মধ্যিখানে আলাদা একটা দেশ থাকতে পারে।

এক।

আরো অনেকের কাছেই আমাকে বলতে হয়েছে পরে বাংলাদেশ কোথায়। কিছুদিন পরে বুঝলাম, যারা ক্রিকেট দেখে তারাই শুধু জানে বাংলাদেশের নাম। জনপ্রিয়তার হিসেবে ক্রিকেটের অবস্থান এখানে রাগবি বা ফুটবলের অনেক অনেক পেছনে। তাই বাংলাদেশকে চিনে বা জানে এমন লোকের সংখ্যাও আসলে অনেক কম। তবু যে চিনে, তার পুরোটা কৃতিত্ব চোখ বুজে আমাদের ক্রিকেট টিমকে দিয়ে দেয়া যায়।
ধন্যবাদ হাবিবুল বাশার এন্ড কোং!

দুই।

পুরো ক্যামপাসে আর কোন বাংগালি নেই। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের বেশির ভাগই আশপাশের আফ্রিকান দেশগুলোর। চীনের আছে কিছু, কয়েকজন জাপানের, আর কিছু ইউএসএ আর কানাডার।
জাপানি দুজনের সাথে বেশ খাতির আমার। একজনের নাম তাকাশ, আরেকজনের নাম হিশা। তাকাশ আমাকে দেখলেই বলে ওঠে- হ্যাল্লো এশিয়ান ব্রাদার। এমনিতে দুজনেই বেশ ঠান্ডা মানুষ, শুধু উইক-এন্ডগুলোয় দু'জনেই বেশ কয়েক বোতল বিয়ার খেয়ে হল্লা করে শুধু। তাকাশ কেন খায় জানি না, শুধু শুধুই বোধহয়, তবে হিশারটা জানি। কিছুদিন আগেই গার্লফ্রেন্ডের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেছে ওর।
অল্প কিছুদিন আগেই হঠাৎ করেই মালদ্বীপের একজনের সাথে পরিচয় হলো। সুমাইস নাম। ঐ সময় মালদ্বীপ শুনেই মনে হলো কত কাছের একজন। আমি জানতাম না, মালদ্বীপ থেকে প্রতি বছরই বেশ কিছু ছেলে মেয়ে পড়তে আসে এখানে। এই ভার্সিটিতে আছে তিনজন। কাছাকাছি টাইপের চেহারা হওয়ায় বেশ আপন আপন লাগে ওদের।
অবশ্য প্রচুর ইন্ডিয়ানও আছে এখানে। পুরো সাউথ আফ্রিকায় ডারবানেই বোধহয় ইন্ডিয়ানদের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ইন্ডিয়ান মানেই যে এরা সবাই ইন্ডিয়া থেকে পড়তে এসেছে এরকম নয়। মানে হলো এরা ইন্ডিয়ান বংশোদ্ভূত।
মোট চার রকমের বর্ণ আছে এখানে। সাদা, কালো, ইন্ডিয়ান আর সাদা কালোর মিশেল যারা, মানে 'কালারড"।
এত রকম বর্ণের জন্যেই এদের 'রেইনবো নেশন' বলে বোধহয়।

তিন।

প্রথমদিকে আমার নাম নিয়ে খুব ঝামেলা হচ্ছিলো। কোন এক অদ্ভূত কারনে আমার 'তারেক' নামটার মত সহজ একটা শব্দ ওরা কিছুতেই উচ্চারণ করতে পারে না। আমি কিছুতেই এর সঠিক কারন আজো ভেবে পাই নি। দুজনের নাম জানি আমি, Nski Umangjao আর Sthebain Npuma । এরকম কঠিন সব নাম ওরা অবলীলায় উচ্চারণ করে, কিন্তু তারেক বলতে গিয়ে সবার যেন শ্বাস আটকে যায়!! ডেরেক, টারাক, ঠারিক এরকম নানা কিম্ভূত শব্দ পার হয়েও ওরা কেউ তারেক পর্যন্ত পৌছাতে পারে নি। শেষ মেষ আমি ক্ষেপে গিয়ে বললাম, হয় ঠিক করে ডাকতে হবে, নতুবা কিছুই ডাকা চলবে না। অবশষে ওরা নিজেরাই একটা সমাধান বের করে ফেলল, আমাকে বাংলাদেশ বলে ডাকা শুরু করলো। আমি প্রথমত থতমত খেয়ে গেছিলাম। বাংলাদেশ তো শুধুই একটা শব্দ নয় আমাদের কাছে। তবে ওদের জোরাজুরিতে অবশেষে রাজি হয়েছি, যখন অবাক হয়ে মনের মধ্যে একরাশ আনন্দ নিয়ে দেখি, আমার দেশের নামটা ঠিকমতই উচ্চারন করছে সবাই।

চার।

একজন আমাকে একদিন জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, তোমাদের দেশে নাকি চুরি করলে চোরদের ধরে হাত কেটে দেয়?
ততদিনে আমি আরো অনেক উদ্ভট প্রশ্ন শুনে ফেলেছি। তবু এটা শুনে অবাক হয়ে পালটা জিজ্ঞেস করলাম, কক্ষনোই না! এরকম আজব কথা কে বলেছে তোমাকে?
ছেলেটা একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আমি দেখলাম কি যেন ভাবছে সে। খানিক পর মাথা দোলাতে দোলাতে গম্ভীর স্বরে বলে, আমি বাজি ধরে বলতে পারি, এখানে আসবার আগে তুমি ভেবেছ, এলে নিশ্চয় দেখতে পাবে এখনো এখানে রাস্তা ঘাটে বাঘ-সিংহ ঘুরে বেড়াচ্ছে!
আমি শুনে হা হা করে হেসে ফেলি। কথা তো ঠিকই। আফ্রিকা শুনলে আজো আমার প্রথম জংগলের কথাই মনে পড়ে। এখানে না এলে আমি কারো মুখে শুনে কিছুতেই বিশ্বাস করতাম না যে এরা এত উন্নত হয়ে গেছে!

পাঁচ।

আমার জানালা দিয়ে একটুখানি আকাশ দেখা যায় ....., ঘুম থেকে উঠেই তাই জানালা দিয়ে একবার আকাশ দেখে নিই।
ভীষন সুন্দর এই ক্যাম্পাসটা। শহরের একপাশে পাহাড়ের উপর ইউনিভার্সিটি। শহর থেকে খুব সহজেই দেখা যায় পাহাড়ের উপর মাথা উঁচু করে থাকা বিলডিংগুলো। দারুন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন। প্রথম এসে সত্যিকার অর্থেই এখানকার সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হয়ে গেছিলাম। ক্লাশ শেষে হেঁটে বেড়াতাম পুরো ক্যাম্পাস। আর যখন ট্যাক্সিতে করে ভার্সিটি থেকে শহরে যাই, উঁচু-নিচু রাস্তাগুলো যাওয়ার সময় বুকের ভেতর কাঁপন ধরে যায়।অনেক উপর থেকে একেবারে ঝপ করে নীচে নেমে আসে। যেন বা রোলার কোষ্টার!
আমার 'হল'টাও তাই। পাহাড় কেটে এমন করে বানানো যে মজার একটা ব্যাপার হয়। হলের যে দু'টো গেট, তার একটা দিয়ে ঢুকলে সোজা দোতলায়, আরেকটা দিয়ে একতলায় যাওয়া যায়। অর্থাৎ, একতলা দোতলা যেদিক দিয়েই বের হই না কেন সামনে রাস্তা পড়বে। আর আমার রুমটা ঠিক মাঝামাঝি। মানে দেড় তলায়।
হলের ঠিক সামনেই বিশাল একটা গাছে কিছুদিন ধরেই নীল রঙের ফুল ফুটছে। সকালে ক্লাসে যাবার সময় দেখি, সামনের রাস্তায় ফুলগুলো এমনভাবে ঝরে পড়ে থাকে, যেন মনে হয় খুব সুন্দর নীল রঙের একটা কার্পেট বিছানো।
আমার সবচেয়ে ভালো লাগে লাইব্রেরির সামনে বসে থাকতে। ওখান থেকে পুরো শহরটা দেখা যায়।
তারচেয়ে বড় কথা, সমুদ্্র দেখা যায় ওখান থেকে!

ছয়।

বন্ধুদের বলেছি, দেশের বাইরে পড়তে আসতে চাইলে টোফেল করার আগে যেন রান্না শিখে নেয়। ওরা হাসে। কিন্তু এটা যে কি পরিমান সত্যি কথা, তা ভূক্তভোগিরাই জানেন। প্রতিদিন পেঁয়াজের ঝাঁজের সাথে নাকের জল আর চোখের জল এক করে ফেলি। অনেক কষ্টে হাত খানিকটা কেটে আর অনেকটা পুড়িয়ে যখন রান্না করি, দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার থাকেনা আসলে। রান্না শেসে পাতিলের ভেতরের বস্তুটার দিকে তাকিয়ে প্রায়শ:ই দ্্বিধায় পড়ে যাই, এটা আসলে কি?মুরগির মাংস না চিংড়ি মাছের চচ্চড়ি? নাকি শবে বরাতের হালুয়া?
দু:খের ব্যাপার, এতগুলো নাম মনে এলেও শেষমেষ কোন কিছুর সাথেই আর মেলাতে পারি না। সেই নাম না জানা বস্তুটি খেয়েই পেট ভরাই প্রতিদিন। তারপর বিছানায় শুয়ে ভরা পেটে হাত বুলোতে বুলোতে ভাবি, যাক বাবা, বিয়ের পরে বউ রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেলে অন্তত: না খেয়ে থাকতে হবে না!

সাত।

ক্লাস, প্রোজেক্ট আর ল্যাব মিলিয়ে ব্যস্ততায় কেটে যায় সময়। দম ফেলবার ফুরসত নেই। নেই মন খারাপ করার সময়ও। তবু মনের কি আর আগামাথা থাকে? হুট করে আবিষ্কার করি, আম্মুকে মনে পড়ছে ভীষন, বাসার সবার কথা- নানুর কথা। ছোট ভাইটার লেখা চিঠি পড়ে হাসতে হাসতে লুটিয়ে পড়ি আর অবাক হয়ে ভাবি, এত সুন্দর চিঠি লেখা কে শেখালো ওকে?
এত সুন্দর ক্যাম্পাস, তবু কার্জন হলকে মনে পড়ে খুব। ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের অতি পুরনো লাল দালানটাকে যতটা কাছের মনে হয় এখনো, এখানকার অত্যাধুনিক বিলডিংগুলোকে ততটা আপন মনে হয় না কেন জানি!
কোথায় পাবো সেই প্রাণ প্রিয় বন্ধুদের এখানে, যাদের হাতে হাত রেখে দু:খ ভুলে যেতাম? অথবা অমর একুশে হলের রাতজাগা সেইসব ক্ষণ! সুন্দর নীল ফুলগুলোও কিছুতেই ভুলাতে পারে না ঢা.বি.-র সেই আগুনরঙা কৃষঞচূড়ার স্মৃতি!
লাইব্রেরিতে পড়া শেষ করে রাত করে হলে ফিরবার পথে তাই মাঝে মাঝে থমকে দাঁড়াই ওখানটায়, যেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায়। রেলিংয়ে ভর দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকি সত্যি, তবে সমুদ্রটাকেই দেখি কি না, তা আমি নিজেও আসলে ঠিক করে বলতে পারবো না।


মন্তব্য

কনফুসিয়াস এর ছবি

এই লেখাটা লম্বা সময় ধরে সিরিজ আকারে বাংলালাইভেবের হয়েছিলো। এইটারে বলা যায়, সাহস করে প্রথম একটা বড় লেখা। সেই সূত্রে খুব প্রিয়। সচলদের জন্যে এইখানে তুলে দিলাম আবার। বিরক্ত হলে পরের পর্ব আর তুলবো না।
-যা দেখি তা-ই বলি...

-----------------------------------
বই,আর্ট, নানা কিছু এবং বইদ্বীপ

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

সৈয়দ মুজতবার 'দেশে বিদেশে'র একটা লাইন এখনো মনে পড়ে। ট্রেনে অন্য যাত্রী তাঁকে জিজ্ঞেস করছেন, "Going far?" প্রশ্নটা সরাসরি "কোথায় যাচ্ছেন" টাইপের না হওয়ায় প্রশ্নের উত্তরেই অনেক প্রশ্নের জবাব মিলেছে। আর লেখক তা নোট করতে ভুলেননি।

তাই বলছি, পুরানো হলেও একজায়গায় লেখাগুলো থাকলে আমাদের মত পাঠকের বড়ই সুবিধা। বিশ্বভূবন দেখব আমি দেশবিদেশের কাহিনীতে।

আরশাদ রহমান এর ছবি

অনেক দিন বাদে ব্লগে ঢুকলাম। লেখাটা পড়ে পুরোনো দিনের কথা মনে হলো। বাংলাদেশ কোথায় বিদেশে তা অনেকেই জানেনা তবে তাতে অবাক হবা কিছু নেই কারণ বাংলাদেশকে বিদেশে পরিচিত আমাদেরই করতে হবে। কিন্তু তা আমরা করি কই। বাইরে পড়ার সুবাদে রান্নাটা আমারও রপ্ত হয়ে গেছে। শুধু রান্না কেন সবিতো নিজের করতে হয়েছে। সব বাঙালি ছেলেদের কিছুদিন প্রবাসে থাকা উচিত, পর নির্ভরশীলতা কমে যাবে।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

নাহ, খুব পঁচা। যাচ্ছেতাই। জঞ্জাল। উফ, গন্ধ! কী, বন্ধ করে দেবেন লেখা? দেঁতো হাসি তাড়াতাড়ি বাকিগুলোও এনে ফেলেন, ভাই। আমি বাকিটুকু বাংলালাইভে পড়ে নিলাম। ধন্যবাদ।

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

না না ভালৈ। SWI পড়ছিলাম যদিও।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

দ্রোহী এর ছবি

আমি লেখাটা প্রথম পড়েছিলাম ব্লগস্পটে।


কি মাঝি? ডরাইলা?

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

আমি সম্ভবত: এ সিরিজের মাধ্যমে আপনার লেখার সাথে পরিচিত হয়েছিলাম।
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

তারেক এর ছবি

আমি এইটা আগে পড়ি নাই। আপনার নামও তাইলে তারেক? সাধু!
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

কিংকর্তব্যবিমূঢ় এর ছবি

আগে পড়ছিলাম ... কিন্তু আবার পইড়া আগের মতই ভাল্লাগছে ...

ঝরাপাতা এর ছবি

কি ব্যাপার! হাওয়া হয়ে গেলেন নাকি? মাঝে মধ্যে আওয়াজ দিয়েন। নতুন লেখার সময় না থাকলে পুরানা দিয়েন।


রোদ্দুরেই শুধু জন্মাবে বিদ্রোহ, যুক্তিতে নির্মিত হবে সমকাল।


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

রায়হান আবীর এর ছবি

ঝটিল মামু...
---------------------------------
এভাবেই কেটে যাক কিছু সময়, যাক না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।