ডাম্পিং : যদি সুখী হতে চান-

কনফুসিয়াস এর ছবি
লিখেছেন কনফুসিয়াস (তারিখ: রবি, ২৩/০৯/২০০৭ - ১:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ডাম্প অথবা ডাম্পিং শব্দটা আগেও জানা ছিল বটে, তবে ঠিকঠাক চেনা ছিলো না।
পুরোনো কাপড় চোপড় জমে গেলে বাসা থেকে খানিকদুরে সরকারের বেঁধে দেয়া জায়গায় গিয়ে ফেলে দিয়ে আসি। এই দেশে ইহাকেই ডাম্পিং বলে। তালিকায় আরো থাকে পুরোনো টেলিভিশান, ফ্রীজ, মাইক্রোওয়েভ, বাইসাইকেল থেকে শুরু করে আরো নানান হাবিজাবি। মোটের ওপর, যে কোন অবাঞ্চিত যন্ত্রণা থেকে সহজেই মুক্তি দেয় এই ডাম্পিং।

এই তালিকার সর্বশেষ সংযোজন দেখে অনেকটা চমকে উঠেছিলাম অল্প কিছুদিন আগে। ঘটনা বেশ গুরুতর।
মা দিবসের ভোরবেলায় মেলবোর্ণ হাসপাতালের বাইরে কোন এক মা তার সদ্যোজাত শিশুকে বাক্সের ভেতরে কাপড়ে মুড়ে ফেলে রেখে চলে যান। বাংলাদেশের সুনাগরিক হিসেবে এই সব সহজলভ্য খবরে চমকানোটা আমাদের জন্যে রীতিমতন লজ্জার বিষয়। তবু যে চমকালাম, তার কারণ পত্রিকার ভাষা। সরল ইংরেজীতে তারা হেডলাইন করেছে, " বেবী ডাম্পড অন মাদার্স ডে"।
ও হরি, জলজ্যান্ত মানুষের বাচ্চাও যে 'ডাম্প' করা যায়, এটা জানা ছিলো না!

এই লেখাটা এখন পর্যন্ত হাল্কা চালে লিখে যেতে পারছি, তার কারণ, এই ঘটনার শেষটা মধুরেণ সমাপয়েত।
নিজের আগ্রহেই পরের কিছুদিন পত্রিকা ঘেঁটেছি, ক্যাথেরিন নামের এই ছোট্ট মেয়েটার কপালে কি আছে দেখবার জন্যে। দেখেছি আর অবাক হয়েছি, এবং খুশীও। সবাইই খোঁজ রাখছিলো বাচ্চাটার। পত্রিকা রেডিও টিভি সবখানেই নিয়মিত ক্যাথেরিনের অজানা মা-কে অনুরোধ করা হচ্ছিলো যেন তার মেয়েকে ফিরিয়ে নেন তিনি।
কোন একজন মাল্টিমিলিওনিয়ার ক্যাথেরিনের আঠারো বছর বয়েস পর্যন্ত সব খরচ দিবেন বলে অঙ্গীকার করলেন। আরেকজন বললেন, ফিরিয়ে নিলে শান্তিতে বসবাসের জন্যে মা আর মেয়েকে একটা বাড়ি কিনে দিবেন তিনি।
এইসবের গুণেই কিনা জানি না, তবে শেষমেষ ক্যাথেরিনের আসল মা আড়াল থেকে যোগাযোগ করেছিলো। পত্রিকায় এলো গোপন অবস্থান থেকে কন্সালটেন্টের সাথে সদ্য-মা হওয়া মেয়েটির কথোপকথন। পড়লাম, এক ফাঁকে কনসাল্টেন্ট জিজ্ঞেস করলেন, ''তুমি নিজে ভালো আছো তো? মাত্রই বাচ্চার জন্ম দিয়েছ, তোমার নিজেরও তো মেডিক্যাল কেয়ারে থাকা প্রয়োজন।'' এই পড়ে আমি ভীষণ অবাক হলাম। ভাগ্যিস, এই মহিলা আমাদের দেশে জন্মায় নি!
ডাম্পড হওয়া বাচ্চাটি মায়ের কাছেই ফিরেছে কিনা জানি না, তবে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে পেয়েছিল শেষ মেষ, দেখে আমারও ভাল লেগেছিলো।
-----------------

যেটা বুঝলাম, আমাদের আধুনিক জীবনে সুখী হওয়ার বেশ কার্যকরী ফর্মূলা এই ডাম্পিং।
পান-বিড়ি-তামুক কোনটাই এখন আর খাই না আমি, 'জীবন থেকে জটিলতা কমাই'- এমনটাই বলতাম আগে। এখন থেকে ভাবছি বলবো, ওগুলো কবেই ডাম্পড করে দিয়েছি!
চট্টগ্রামের ভূমিধ্বসে তিন অংকের মানুষ মারা গেলো, ছবি আর নিউজ দেখে নার্ভে চাপ পড়তো, সহ্য হতো না। পরে লম্বা সময় দেশের পত্রিকা পড়ি নি, ইচ্ছে করেই কদিনের জন্যে ডাম্প করে গেছিলাম সেসব খবর।
এই যে ডাম্পিং নিয়ে মজা করে এত এত বাক্য লিখলাম, পুরোটা সময় ভুলে থেকেছি আমাদের দেশের ডাস্টবিনগুলোতে ফেলে দেয়া মানব-শিশুদের কথা। বাবা মা'র কাছে অনাকাংক্ষিত তারা, তাই কপালে লেখা ছিলো ডাম্পড হওয়া।
মরে গিয়ে যারা বেঁচে যেত, সৌভাগ্যবান তারা, যারা বেঁচে থাকতো তারপরেও, তাদের কি হতো?
ভৈরবের সেই ক্লিনিকের কথাও ভুলে থেকেছি ইচ্ছে করেই, যেখানে মায়ের পেটের ভেতরে মেরে ফেলা হতো শিশুদের, গর্ভপাতের রেট বেশি ক্লিনিকে, সেই অল্প বেশী কিছু টাকা কামানোর লোভে। কি হবে এসব মনে রেখে?

বুঝতে পারছি আমার মন নিজে থেকেই সভ্য ও সুশীল হয়ে উঠছে দিন দিন। সুখী হবার ফর্মূলা জেনে গেছে সে। শিখে গেছে কেমন করে বেছে বেছে ভালো আর হ্যাপি-এণ্ডিং খবরগুলোকে মনে রাখতে হয়, আর আমাদের দেশের অসুখী খবরগুলোকে তলিয়ে দিতে হয় মনের অতল গহবরে।
অজি বাংলায় যাকে বলে কি না- ডাম্পিং!

------


মন্তব্য

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

একই সঙ্গে একটা রিলেটেড ইস্যু হল এবরশন। বাংলাদেশেতো খাবার অভাবে আর পশ্চিমে অবাধ স্বাধীনতা উপভোগ করার জন্য। ৬/৭ ফিটাসগুলোর ছবি দেখলে মায়া লাগে! আবার এইগুলো নিয়ে স্টীমসেল রিসার্চ করে দানবেরা।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

হিমু এর ছবি

অ্যাবরশন আর স্টেমসেল গবেষণা নিয়ে সচলে একটা বিতর্ক হতে পারে। সবচেয়ে ভালো হতো এগুলি সম্পর্কে বিভিন্ন সমাজে প্রচলিত ধারণাগুলি শেয়ার করতে পারলে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

সৌরভ এর ছবি

হ, সুশীল ও ভোগবাদী হইলে আমরা তাই করি।
হ্যাপি এন্ডিং খুঁজে বেড়াই।



আমি ও আমার স্বপ্নেরা লুকোচুরি খেলি


আবার লিখবো হয়তো কোন দিন

কারুবাসনা এর ছবি

মেল করসি।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।


----------------------
বিড়ালে ইঁদুরে হলে মিল, মুদির কিন্তু মুশকিল ।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

দীর্ঘশ্বাস।

মেহদী হাসান খান এর ছবি

ডাম্পিং? অনেক ভদ্র গোছের শব্দরে ভাই এটা। মেডিকেলে গাইনী ডিপার্টমেন্টের পেছনে বালতিতে ফেলে দিতে দেখেছি মরা বাচ্চাগুলোকে। কুকুরে খায়, ছেড়া মাথাটা পড়ে থাকে ফুটপাথে। অনেকবার রিপোর্ট করেও লাভ হয়নি। হিংস্র কুকুরগুলোর চেয়েও হিংস্র এই আমরা।

অনুভূতিগুলো মরে গ্যাছে কবেই...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।