অপরা।। এক

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: সোম, ১৮/০২/২০০৮ - ১:১০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

(অমিত আহমেদ তার গন্ধমের রঙিন জগত থেকে নওরীনকে ফেলে গিয়েছিলেন বড়ো অবহেলায়। তারপর থেকে নওরীন এখানে)

হাড্ডি কখনও হয় না গোস্ত
কলিগ কখনও হয় না দোস্ত

অ্যালার্মে ঘুম ভাঙতেই কথাটা মনে পড়ল নওরীনের। কথাটা বিচ্ছু বাবুর। ব্যাচের মধ্যে সেই সবার আগে চাকরিতে জয়েন করে। এক মাসের ফাউন্ডেশন ট্রেনিং শেষে ফিরে আসার পরে চাকরির খবর বলতে গিয়ে এটা ছিল বিচ্ছু বাবুর প্রথম উত্তর

আজ থেকে আর অফিস নেই। কিন্তু অফিসের জন্য রেডি হতে হবে। না হলে বাসার প্রশ্নগুলো সামলানো যাবে না

প্রতিদিন যখন অফিসে বের হবার সময় থেকে দশ মিনিট দেরি হলো আজ বেরোতে। নেই অফিসে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলে সব কিছুই একটু স্লোলি হলো। এই স্লোনেস কারো চোখে পড়ার কথা নয়

আজ বিষুদবার। বিকেল চারটা পর্যন্ত আজ তার অফিসে থাকার কথা। সেই সময়টা কোথায় থাকবে আজ?

কারো বাসায় গেলে প্রশ্নের মুখোমুখি পড়তে হবে। চাকরি ছেড়ে দিয়েছি বলা যাবে না। মানুষ চাকরি ছাড়লে অনেক আগে থেকেই আশেপাশে আওয়াজ দেয়। গ্যাঞ্জাম না হলে হঠাৎ কেউ চাকরি ছাড়ে না। হঠাৎ করে ছেড়ে দেবার কথা বললে সাবই ধরে নেবে কোনো ঝামেলায় চাকরি চলে গেছে

চাকরিটাতো চলেই গেছে। যদিও কাগজে কলমে রেজিগনেশন। আর প্রাকটিক্যালি ফোর্সড রেজিগনেশন। এখন অবশ্য সব অফিসই সংসদের নিয়ম মানে। সংসদে কোনো মন্ত্রীকে যেমন বরখাস্ত করতে হলে প্রধানমন্ত্রী ডেকে নিয়ে তাকে পদত্যাগ করতে বলেন। অফিসগুলোতেও তাই। ডেকে নিয়ে বলা হয় রিজাইন করো। ফোর্স রেজিগনেশন টার্মটা কোনো ডিকশনারিতে না থাকলেও এটা এখন একটা পরিচিত জার্গন

নওরীন হাসে- মানুষ দিনদিন যত প্রাতিষ্ঠানিক হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানগুলোও আচরণে তত মানবিক হচ্ছে
এটাও বিচ্ছু বাবুর চাকরি সংক্রান্ত আরেকটা ফিলসফি

কিন্তু কোথাও যেতে হবে। বিকেল পর্যন্ত থাকতে হবে

ক্যাম্পাসের কথা মনে পড়ে নওরীনের। তার নেই হওয়া অফিসে সে ছাড়া বাকি সবাই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটির। তাদের সাথে দূরত্বের এটাও কি একটা কারণ?

প্রতি বছর হাজার হাজার সাইবেরিয়ার পাখি এসে ঠাঁই পায় তার ক্যাম্পাসে। সেই ক্যাম্পাস কি তাকে একদিন কয়েকটা ঘণ্টা থাকতে দেবে না? অবশ্যই দেবে। সে তো আর ইটের গর্তে বসে এসির ছিদ্র দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস চালাতে চালাতে ভার্সিটি পার করেনি; যে ইটের গরাদের ভেতর মোজাইকের মাঝে একটা বাড়তি পিঁপড়া হাঁটলেও দূর থেকে দেখা যায়। তার ভার্সিটিতে একরম কয়েকশ নওরীন কয়েক শ বছর অফিস আওয়ার পার করে দিতে পারে প্রশ্নহীন

ভার্সিটির সেই বাস। গাদাগাদি। কেউ কেউ কাউকে কাউকে চেনে। অনেককে চেনেও না। আর কেউই জানে না কে কে কার সাথে পরিচিত আর কে কে একেবারে একা। এরা সবাই-ই তার জুনিয়র হবার কথা। কিন্তু সিনিয়র স্টুডেন্টরা আবার স্টুডেন্ট বয়েসি কাউকে না চিনলে ধরে নেয় সে হয়তো নতুন। আর নতুন মানেই জুনিয়র
- বসো বসো তুমি এখানে বসো
মুরব্বি টাইপ একটা ছেলে। সত্যি সত্যি হয়তো নওরীনকে নতুন এবং জুনিয়র ভেবে বসেছে। তা ভাবুক। এই ভিড়ের মধ্যে তাকে বসার একটা সিট করে দিয়েছে
- থ্যাংক ইউ ভাইয়া

জুনিয়রশিপ বজায় রেখেই নওরীন উত্তর দিলো। বড়ো ভাইদের কাছ থেকে নোট-টোট নিলে তারা এরকম থ্যাংকস দিতো। যদিও ছেলেটা কমপক্ষে তার তিন বছরে জুনিয়র হবে। হোক না। অন্তত তাকে স্টুডেন্টদের থেকে আলাদা মনে হচ্ছে না সেটাই শান্তির

চারপাশে হৈচৈ। চিৎকার করে কথা বলা। এক মুহূর্তেই নিজেকে আবার একেবারে সেই আগের মতো মনে হলো নওরীনের। যেন দুবছর পরে অন্যদের ফাঁকে বসে নওরীন ভার্সিটি যাচ্ছে না; দুবছর আগের সময়েই যাচ্ছে ক্লাস করতে। শুধু ঘটনাক্রমে গাড়িতে আজ তার কোনো বন্ধু ওঠেনি। সেই একই ভাষা। একই রকম বিষয়; সিরিয়াসরা কথা বলছে ক্লাস কিংবা নোট নিয়ে। ফাজিলরা ক্ষেপাচ্ছে অন্য কাউকে। জুটিগুলো বাকবাকুম করছে। আর গলাবাজরা হয় রাজনীতি না হয় কোনো টিচার না হয় কোনো স্টুডেন্টের সমালোচনা করছে হাত পা নাড়াতে নাড়াতে

থ্রি-সিটারে নওরীনের ভেতরের দিকে বসছে একটা বাকবাকুম। নিজেদের মাঝেই ব্যস্ত তারা। পুরো বাসে সবাই সবার মতো করে ব্যস্ত। সিট ছেড়ে দেয়া মুরব্বি ছেলেটা দুয়েকবার অবশ্য তাকিয়েছে। হয়তো কথা বলার চান্স খুঁজছিল। কিন্তু ভিড়ের ঠেলায় সে এখন নওরীন থেকে অনেকটা দূরে

নওরীন ফোন খুলে নম্বরগুলো খুঁজতে লাগল। কিছু নম্বর আর রাখার দরকার নেই। খুঁজে খুঁজে আটত্রিশটা ডিলিট করে দিলো। কিন্তু একটা নম্বর সে মুখস্থ করে রেখেছিল। কোনোদিন ফোন করেনি। কোনো একদিন সেই ফোন থেকে ফোন আসবে অথবা কোনো একদিন সেই ফোনে ফোন করতে হবে বলে একটা নম্বর মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। সেই নম্বরটা কী করবে?

বিচ্ছু বাবু বলছিল মানুষের মাথা থেকে যদি স্মৃতি নষ্ট করার কোনো পদ্ধতি আবিষ্কার করা যায় তাহলে প্রতিটা মানুষের আয়ু বেড়ে যাবে কমপক্ষে দশ বছর। যে স্মৃতিটা মানুষ মনে রাখতে চায় না। হাসপাতালে এসে সেই স্মৃতিগুলো ডিলিট করে মানুষ আবার মগজে স্পেস বের করে নেবে নতুন স্মৃতি স্টোর করার

কারা নাকি কোথায় এই বিষয়টা নিয়ে গবেষণা করছে। ডিলার্নিং। ইচ্ছা করে কি ডিলার্নিং সম্ভব? নাকি যেটাকে মানুষ বেশি ভুলতে চায় ভুলে ভুলে সেটাই বারবার মনে করে বলে সেটাই মনে থাকে সবচেয়ে বেশি?

ফোনে না রেখে মনে রাখা নম্বরটা মুছে ফেলার জন্যই বাকি নম্বরগুলো মুছে ফেলল। কিন্তু সেই নম্বরটা এখন যেন আরো জ্বলজ্বলে হয়ে মনে পড়ছে নওরীনের
২০০৮.০২.১২ মঙ্গলবার


মন্তব্য

হাসান মোরশেদ এর ছবি

উপন্যাস হবে নাকি?
----------------------------------------
শমন,শেকল,ডানা

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

আমি তে তিনি নামে বড়ো ধরনের একটা লেখা লিখছি অনেকদিন থেকে
তিন ধরনের তিনটা মেয়ে
তার মধ্যে দুটো নিয়ে অতদিন এগিয়েছি
হয়তো তৃতীয়জন নওরীন হলেও হয়ে যেতে পারে
দেখি কতদূর যায়

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

নওঋণ প্রভাব দেখছি মারাত্মক ! হাসি

মাহবুব লীলেন এর ছবি

অমিতের তৈরি করা সবচেয়ে দুর্ধষ কারেকটার
কিন্তু অমিত তাকে হয় ভুলে না হয় অবহেলায় রাস্তায় ফেলে চলে গেছে
দেখি তাকে কতদূর নেয়া যায়

অমিত আহমেদ এর ছবি

অসাধারণ!

মাহবুব লীলেন এর ছবি

তবে এই কাহিনীতে কোথাও না কোথাও অবশ্যই সরাসরি গন্দম এবং তার লেখকের কথা উল্লেখ থাকবে
বলা যায় না হয়তো ঘটনা হিসেবে গন্দম
এবং চরিত্র হিসেবে অমিত আহমেদ

অমিত আহমেদ এর ছবি

বলেন কি!

তাপস শর্মা এর ছবি

'গন্দম'টা পড়া হয়নি এখনো। সচলে তো দেখেছি বই-e'তে ১১টার মতো পর্ব আছে। নওরীনকে তাই অচেনা লাগল। কিন্তু নূতন করে এটাই একটা গল্পের মতো পড়ে নিলাম। বেশ ভালো লেগেছে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।