তৃষ্ণা

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বুধ, ২২/১০/২০০৮ - ১২:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনীক

এই চিঠি তোকে পোস্ট করব না কিন্তু চিঠিটা তোকেই লিখছি আমি। এখানে যা বলতে চাই তা কোনোদিনও জানাতে চাই না তোকে

ডাক্তার বলেছে আমি বেঁচে আছি কিছুদিন পরে মারা যাবার জন্য। ...বুকে হাত দিয়ে বলতো- এই কথা শুনলে কি আমাকে তুই কথায় কথায় পেত্নি কিংবা কুত্তারাশি কিংবা কাউয়াকণ্ঠী বলতে পারতি? ...পারতি না। তুই ভাবতি- মেয়েটা মাত্র কয়েকটা দিন বাঁচবে; তাকে সব সময় প্রশংসা করা উচিত। আর জোর করে প্রশংসা করতে গিয়ে আমাকে বারবার মনে করিয়ে দিতি সেইসব কথা যা আমি মনে করতে চাই না মোটেও

হাসপাতালে সবাই আমার দিকে কেমন কেমন করে যেন তাকায়। আমার কী ইচ্ছে করে জানিস? ইচ্ছে করে সবাইকে চিৎকার করে বলি- ঔষধ নয়। তোমরা আমাকে মারো না হয় গালি দাও। তাহলে আমি রাগ করতে পারব। আর রাগ করতে পারলেই আমি ভুলে যাব যে আমার এই অসুখটা ভালো হবে না কোনোদিন

আমার মা বকাঝকা ভুলে গেছে। আমি ইচ্ছা করে জিনিসপত্র নষ্ট করি- ভাঙচুর করি। কিন্তু কিচ্ছু বলে না সে। বাবা তার পিত্তি জ্বালানো তাত্ত্বিক উপদেশগুলো এখন আর দেয় না। কেমন যেন ক্লাউনের মতো আচরণ করে। খামাখাই আমার সামনে হাসে আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখে আমি হাসছি কি না

কিন্তু আমি কী করি জানিস?
আমাকে গালাগালি করে লেখা তোর চিঠিগুলো পড়ি। সারাক্ষণ। মায়ের ওষুধ- ডাক্তার হয়তো আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। কিন্তু তোর গালিগুলো আমাকে ভুলিয়ে রাখে কেন মা আমাকে প্রতিদিন কয়েকশোবার উঁকি দিয়ে দেখে যায়। কেন বাবা আমার বেডে জোকসের বই রেখে যায়

তোর সবগুলো চিঠি আমার বালিশের নিচে রাখা। ঘুমের ভেতরেও ওগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে আমি রেগে উঠি- শুয়োরের বাচ্চা আমাকে কত্তো বড়ো গালি দিলো। এরপরে তাকে এমন গালি দেবো যে... আর তখনই ব্যস্ত হয়ে পড়ি তোকে দেবার জন্য গালি খুঁজতে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে গালাগাল খুঁজি...

হয়তো একদিন তুই জেনে যাবি কোন কথাগুলো তোকে জানাতে চাইনি আমি। যখন জানবি তখন কি তুই আমাকে একটা ক্যান্সারের রোগী হিসেবে মনে রাখবি? নাকি মনে রাখবি সারাক্ষণ হৈচৈ করা- গালাগালি করা- হাতাহাতি করা এক হাড্ডি জ্বালানো ড্রাকুলা হিসেবে?

তুই প্রায়ই বলতি আমাকে নিয়ে স্ক্যান্ডাল লিখে পত্রিকায় ছাপিয়ে দিবি। প্লিজ লিখিস। এমনভাবে লিখিস যেন সেটা পড়ে সবাই আমাকে গালাগাল করে। লিখবি? পারবি এই চিঠি পড়ার পরও আমাকে গালি খাওয়ার ব্যবস্থা করে দিতে? ...তুই একটা হরর নাটক লেখার কথা বলতি। বলতি সেই হররে একটা মেয়ে ড্রাকুলা থাকবে। যার নাম হবে লোপা

সত্যি করে বলতো অনীক; কী লিখবি আমাকে নিয়ে? স্ক্যান্ডাল- হরর নাকি এলিজি? আমি জানি আমাকে নিয়ে এলিজিই লিখবি তুই। যার অক্ষরে অক্ষরে থাকবে করুণা- দয়া আর সহানুভূতি। থাক। লিখিস না। কিছুই লিখিস না আমাকে নিয়ে। এলিজিতে মানুষ মানুষকে বড়ো বেশি করুণা করে। আমাকে করুণা করিস না তুই। তোর থেকে অনেক বেশি ধুরন্ধর আর ফাজিল; যার হাতে তোকে সব সময় নাস্তানাবুদ হতে হয় সেরকম শত্রু ভেবে মরার পরেও আমাকে তুই জেলাস করিস প্লিজ। আর আমাকে শায়েস্তা করার জন্য মনে মনে কখনও স্ক্যান্ডাল- কখনও হরর- কখনও ব্ল্যাকমেইলিংয়ের প্লান করিস

আর যদি না পারিস। মনে করিস সিনেমা দেখতে গিয়ে সিনেমার পর্দাতেই কোনো একদিন আমাকে দেখেছিলি। যার নাম কিংবা চেহারা কিংবা ঘটনা কোনোটাই মনে নেই তোর

- তোর সেই লোপা

২০০৬.০৫.২০ শনিবার

***
এই লেখাটা সচলায়তন অণুগল্প সংকলনে প্রকাশিত হয়েছে আগে


মন্তব্য

অনিন্দিতা এর ছবি

এই চিঠিটা বোধ হয় আগে পড়েছি তাই না?
এখানে এর একট ভূমিকা দেয়া থাকলে বোধহয় ভাল হতো।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই চিঠিটার কয়েকটা ভার্সন আছে কয়েকবারে লেখা
কোনো সময় এটা অন্য কোনো গল্পের অংশ হিসেবে এসছে
কোনো সময় এসছে আলাদা গল্প হিসেবে
আমার একটা নাটকেও এই চিঠিটার একটা ভার্সন আছে

এটা আমার পুরোনো বদঅভ্যাসের একটা;
একই লেখাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিভিন্নভাবে লেখা

তবে এটা এর আগে প্রায় অবিকল প্রকাশিত হয়েছে সচলায়তন অণুগল্প সংকলনে

০২

ভূমিকা লিখতে পারি না তাই ফুটনোট যোগ করে দিলাম

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি

বস দেখি কোন প্যারার শেষেই ডান্ডা দেননি। এটা কি বিশেষ কোন ধরনের লেখা?

এখানে যা বলতে চাই তা কোনোদিনও জানাতে চাই না তোকে
অথবা
ডাক্তার বলেছে আমি বেঁচে আছি কিছুদিন পরে মারা যাবার জন্য।
বেশ দার্শনিক ধাঁচের লেখা।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

প্যারার শেষে আমি যে ডান্ডা ইউজ করি না স্যার
এক সময় এটার একটা ব্যাখ্যা ছিল আমার মুখে
এখন আছে খালি অভ্যাস

০২

দর্শন নাকি ইউরোপিয়ানরা খালি লেখে আর পড়ে
আর পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র ভারতীয়রাই দর্শন ইউজ করে দৈনন্দিন কাজে

ধুসর গোধূলি এর ছবি

- আমার কেমন জানি পরিচিত লাগলো লেখাটা। কোথায় পড়েছি? চিন্তিত

মজার ব্যাপার হলো অনেকটা কাছাকাছি থিইমে একটা লেখা মাথায় ঘুরছিলো কয়েকমাস যাবৎ। লেখা হয়ে ওঠেনি। এই লেখা পড়ার পর আসে সেটা জন্মাবার কোনো অধিকারই রাখে না।
___________
চাপা মারা চলিবে
কিন্তু চাপায় মারা বিপজ্জনক

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এটা পড়েছেন সচল অণুগল্প সংকলনে

০২

লেইকখ্যা ফালান
এই ধরনের পোস্ট না করা চিঠি প্রতিদিনই কেউ না কেউ লেখে
হোক প্রকাশ্যে
হোক মনে মনে

আবু রেজা এর ছবি

অদ্ভুত হৃদয় ছোঁয়া চিঠি!!!
-----------------------------------------
যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

যে জন বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গ বাণী
সে জন কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।

স্নিগ্ধা এর ছবি

কেন যেন, মেয়েটার অবস্থা আমি বুঝি - ক্যান্সারে আক্রান্ত না হয়েও।
সুন্দর লেখা, তবে নামকরণটা আরো!

কীর্তিনাশা এর ছবি

চোখের কোনে কখন পানি জমে উঠেছে টের পাইনি।

লীলেন ভাই আপনাকে সালাম।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

-------------------------------
আকালের স্রোতে ভেসে চলি নিশাচর।

মাহবুব লীলেন এর ছবি

বিষয়টা যাদি এমন হয় স্যার
যাকে চিঠিটা লেখা হয়েছে সে প্রেরকম মরে যাবার আট দশ বছর পরে তার পুরোনো কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ আবিষ্কার করে বসেছে এই চিঠি তাকেই লেখা?

তাহলে তার কী অবস্থা হবে বলেন তো?

পান্থ রহমান রেজা এর ছবি

হুমমমম।

অতিথি লেখক এর ছবি

আপনার লেখা দেখেও লেখার 'তৃষ্ণা' জাগে আরো বেশি- ক'দিন পরই ম'রে যাওয়ার জন্য বেঁচে থাকার সময়ও হঠাত্ কখনও যেমন প্রখর বাঁচার তৃষ্ণা বোধ হ'তে পারে।
কিন্তু সময় আর শক্তি-সামর্থ্য একসাথে আসেই না প্রায়।
লীলেন ভাই, খুব সুন্দর লাগলো চিঠিটা। আমার পড়া হয়নি এটা আগে। অনেক অনেক পূর্বাপর পাওয়া যায় জোরেশোরে- এটাই এই ধরনের লেখার সবচে' বড় শক্তি বোধ হয়। হাসি

_ সাইফুল আকবর খান

মুশফিকা মুমু এর ছবি

লেখাটা যখন সচলায়তন অণুগল্প সংকলনে পড়েছিলাম তখনই খুব ভাল লেগেছিল, আবারো লাগল।
------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

রণদীপম বসু এর ছবি

এমন একটা লেখা দিলেন যেখানে মন্তব্য করার কিচ্ছু নাই !

এটাই ঠিক যে, তৃষ্ণারা জন্মায় শুধু মরে যাবার জন্যেই। হয় নিজে মরে, নয়তো কেউ মারে। তবে মৃত্যু তার অনিবার্য।
এজন্যেই হয়তো এটা বলার কোন বিষয় না। পুরাটাই একটা হাবিজাবি বিষয়।

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই চিঠিটা যার চিঠির কনসেপ্ট থেকে নেয়া
আমার প্রাণশক্তির ১০০ভাগই তার উপচে পড়া প্রাণশক্তি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া স্যার....

রণদীপম বসু এর ছবি

তাহলে তাঁকে আমার স্যালুট ! যে অমন প্রাণশক্তি দান করে...

-------------------------------------------
‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই।’

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

স্যালুট জানাই আমিও...

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দিয়াশলাইতেই পড়েছিলাম, আবারও পড়লাম। ভালো লাগলো, আবারও।

মুজিব মেহদী এর ছবি

তৃষ্ণাটা বেশ জাগিয়ে তোলা গেছে।
..................................................................................
দেশ সমস্যা অনুসারে
ভিন্ন বিধান হতে পারে
লালন বলে তাই জানিলে
পাপ পুণ্যের নাই বালাই।

... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ... ...
কচুরিপানার নিচে জেগে থাকে ক্রন্দনশীলা সব নদী

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।