কাঠঠোকরার বিবর্তন কিংবা বৃত্তায়ন

মাহবুব লীলেন এর ছবি
লিখেছেন মাহবুব লীলেন (তারিখ: বিষ্যুদ, ১৩/১২/২০০৭ - ২:৩৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

০১
আনাড়িপর্ব

৮৯ এর শুরুতে আমার লেখা ছাপা হয়ে গেলো। লেখার সাথে ছাপার অক্ষরে আমার নাম। একটা কাটুসকুটুস টাইপের ছড়া। সিলেটের একটা দৈনিক; সিলেটের ডাক-এ। আমি দশটা কপি কিনে একটা কপি থেকে আমার লেখার অংশটি দশটা ফটোকপি করে বাসায় এনে আলাদা আলাদা বিশটা জায়গায় বিশটা ফাইলে রেখে দিলাম। যদি কোনো কারণে হারিয়ে যায় তাহলে আমার লেখা যে ছাপা হয়েছে তার প্রমাণ দেবো কী করে? প্রতিটা পত্রিকার পাতায় আমার লেখা যেখানে ছাপা হয়েছে তার চারপাশে স্কেল ধরে কলম দিয়ে বক্স করে ইনসেট করলাম। যাতে যে কেউ জিজ্ঞেস করলে খুব সহজেই লেখাটি আমি খুঁজে বের করতে পারি। আর প্রতিটি ফটোকপি কেটে আলাদা আলাদা ফুলস্কেপ কাগজে আঠা দিয়ে লাগিয়ে নিচে পত্রিকার নাম- তারিখ- বার সব লিখে দলিল একেবারে পাকাপোক্ত করে রাখলাম। আমার লেখা যে ছাপা হয়েছে এখন আর সেটা অস্বীকার করার সুযোগ থাকবে না কারো

ছাপার অক্ষরে বের হওয়া এই লেখাটি নিয়ে যখন আমি এভাবে মগ্ন হয়ে অনেকগুলো দিন কাটাচ্ছি তখন কি আমি জানতাম যে সেই লেখাটির কাহিনী বয়ান করে একদিন আমি লোক হাসানোর খোরাক দেবো? কিংবা সেই কাহিনী মনে করে বহুবার নিজে নিজে হাসব? অথবা আমি কি জানতাম যে কী কী লিখতে হয়? কেন লিখতে হয়? কোথায় লিখতে হয়? অথবা কোথায়- কেন এবং কী লিখতে হয় না?

জানতাম না। জানতে যে হবে সেটাও জানতাম না। কিন্তু আমার লেখা কেউ ছাপায় না। ব্যাগের মধ্যে সব সময় আট দশটা কপি নিয়ে ঘুরে বেড়াই। কেউই আমার কাছে লেখা চায় না। আবার কেউ লেখা নিলেও যখন পত্রিকা ছাপা হয় তখন সেখানে আমার লেখা থাকে না। কিন্তু তখনকার সার্বক্ষণিক ফ্রেন্ড রেজুয়ান মারুফের লেখা দেদারসে ছাপা হয় সব জায়গায়। রাস্তাঘাটে সবাই তার লেখা চায়। তার লেখার প্রশংসা করে আমার সামনে। আমি কিছু বলতে পারি না। আমার ভেতরে খালি জ্বলে। আর বাসায় এসে একটার পর একটা লিখি। আর দিনে লুকিয়ে লুকিয়ে সম্পাদকদের কাছে দিয়ে আসি....

তখন আমি বাসদ এর অ্যাকটিভ মেম্বার- বিপ্লবী নাট্যকর্মী- সর্বক্ষণ পায়ে মিলিটারি বুট এবং মাথায় চেগুয়েভারা ক্যাপ। ক্ষমতায় তখন স্বৈরাচার আর সারা বাংলাদেশ জুড়ে গোলাম আজম- মাওলানা মান্নান এবং শিবির ইস্যু। সুতরাং কলম দিয়ে লেখা নয় আগুন জ্বালানোর টার্গেট আমার। প্রতিটা বিজয় দিবস-স্বাধীনতা দিবস- একুশে ফেব্রুয়ারিতে সিলেটে বিশ- ত্রিশটা করে ম্যাগাজিন বের হয় তখন। ... একটা দুটো করে লেখা ছাপা হয় আর আমি ডজন ডজন করে নতুন লিখি- সাথে নিয়ে ঘুরি- লেখার সাথে সম্পাদক বরাবর লেখা ছাপানোর অনুরোধসহ চিঠি লিখে টেবিলে রেখে আসিÑ ডাকে ঢাকার পত্রিকায় পাঠাই আর পত্রিকার পাতায় লেখা আহ্বান জাতীয় বিজ্ঞাপন কিংবা প্রেস রিলিজ খুঁজতে থাকি এবং সাহিত্য পাতায় নিজের নাম দেখার জন্য পাগল হয়ে থাকি। ...এবার মারুফ একটু একটু ধরিয়ে দেয়- শ্লোগান আর ছড়ার পার্থক্য বুঝিয়ে দেয়। কবিতা আর বক্তৃতার ফারাক টেনে দেয়। ছন্দ আর মাত্রা চিনিয়ে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা বিস্ময়কর কথা শুনিয়ে দেয়- সবাইকে লেখা দিতে নেই। সবখানে লিখতে নেই...

ততদিনে আমি একেবারে সাহিত্যপণ্ডিত হয়ে গেছি। সপ্তায় কমপক্ষে আট নয়টা সাহিত্য আসরে গিয়ে ছড়া কিংবা কবিতা পড়ি আর অন্যদের পড়া কবিতা কিংবা ছড়া কীভাবে লিখলে আরো ভালো হতো তার প্রেসক্রিপশন দেই

কিন্তু তখনও আমি জানি না জামাত-শিবির আর স্বৈরাচারের লোকজন ছাড়া আর কাকে কাকে লেখা দিতে নেই। কিংবা কোথায় লিখতে হয়...

অনেক লেখা ছাপানোর ব্যাপারে দৈনিক পত্রিকাগুলোর কিছু লিমিটেশন আছে। কিন্তু নিজেদের উদ্যোগে মাঝে মাঝে যারা ছোট ছোট ম্যাগাজিন বের করে সেগুলোতে যা ইচ্ছা তা লেখা যায়। বলা যায় সকল কথা। স্বৈরাচার কিংবা স্বাধীনতা বিরোধীদেরকে গালি দেয়া যায় মুখ খুলে। সুতরাং... এই প্রথম আমার লেখাগুলোকে আমি দুভাগ করতে শিখলাম নিজের অভিজ্ঞতায়

তখন থেকে যে লেখাগুলো আমি-তুমি-সে মার্কা সেগুলো পাঠাতাম দৈনিকে আর যেগুলো জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো টাইপের সেগুলো দিতাম ছোট ছোট ম্যাগাজিনগুলোতে। ম্যাগাজিনগুলো ছোট এবং আক্ষরিক অর্থেই ছোট। এক-কালার প্রচ্ছদসহ এক থেকে দুই ফর্মা। প্রতিটার প্রথম পাতায় শামসুর রাহমানের একটা কবিতা- দ্বিতীয় পাতায় দিলওয়ারের একটি কবিতা এবং তৃতীয় পাতায় নির্মলেন্দু গুণের একটা কবিতা প্রায় বাধ্যতামূলক। এই তিনজনই সেইসব ম্যাগাজিনে একা একটা করে পাতা বরাদ্দ পেতেন। বাকি পাতাগুলোর প্রতি পাতায় চারজন- পাঁচজন এমনকি আট-দশজনের ঠাসাঠাসির ভেতর মাঝেমধ্যে নিজের নামটাও চোখে পড়তো। কোনো কোনো সময় নিজের নামের সাথে পাওয়া যেতো লেখার অর্ধেক অংশ আর বাকি অর্ধেক কোথায় আছে তা তীর চিহ্ন দিয়ে দেখিয়ে দেয়া হতো অন্য কোনো পাতার ফাঁকে। আবার মাঝে মাঝে পাতায় জায়গা না হলে সম্পাদক শেষ দিক থেকে লাইনগুলো ফেলে দিয়ে পাতার আকারে লেখাকে সাইজ করে নিতেন...

সিলেটে আরেক ধরনের ম্যাগাজিন আছে। সেগুলো হলো বিয়ের ম্যাগাজিন। বিয়ে উপলক্ষে প্রায়ই অনেক বড়ো বড়ো ম্যাগাজিন বের হয়। সেগুলোতে মা-বাবা এবং শালা শালির বাণী এবং টিপ্পনির কয়েকটা পাতা বাদ দিয়ে বাকি সব পাতাতেই ছড়া- কবিতা কিংবা গল্প ছাপা হয়। আমি সেখানেও আছি। চেনা হোক অচেনা হোক। ছাপা তো হয়?

আমি খুশি। দারুণ খুশি। সব সময়ই সম্পাদক এবং সম্ভাব্য সম্পাদকদের হাতে ভবিষ্যত সংখ্যার জন্য আগাম কবিতার বান্ডিল জমা দিয়ে রাখতাম। আর মনে মনে হিসেব করতাম কোন বিজয় দিবসে মারুফের থেকে আমার বেশি লেখা ছাপা হয়েছে। ঈদ সংখ্যায় আমার থেকে বেশি কারো লেখা দৈনিকগুলোতে গেছে কি না। ...এবং এক সময় এক ডাক্তারের কাছে গিয়ে প্রেসক্রিপশনে লেখার জন্য নিজের নাম বলার সাথে সাথে নিপাট ভদ্রলোক এই ডাক্তার বলে উঠলেন- সিলেটের পত্রিকাগুলোতে ঠিকাদাররা যদি টেন্ডার নোটিশ খোঁজার জন্যও পাতা ওল্টায় তাহলেও নাকি কোনো না কোনো ফাঁকে আমার নাম আর দু-চারটা লাইন প্রতিদিন তাদের চোখে পড়বেই...

ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখলে আর উত্তেজিত হই না তখন। সম্পাদকরা পত্রিকার কপি দিলে প্রায়ই সেগুলো এখানে সেখানে ফেলে রেখে যাই...। কিন্তু লিখি। প্রতিদিন লিখি। কাঠ কাটতে কাটতে কাঠুরিয়া আর লিখতে লিখতে লেখক; মরে যাওয়া এক ফ্রেন্ড লোপার এই কথায় ভিত্তি করে লিখি। ...লেখা একটা টেকনলজি আর ক্রমাগত চর্চার বিষয়; সিলেট ছেড়ে চলে যাওয়া রেজুয়ান মারুফের এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে লিখি। ...লেখা একটা গার্ভেজ। হাত পা ছড়িয়ে নিজেকে আনলোড করার একমাত্র ডাস্টবিন এই লেখা; নিজের এই বিশ্বাস থেকে লিখি। কিন্তু আর ছাপতে দেই না। প্রায় একেবারেই না। কেমন যেন পোষায় না। কী যেন অন্য একটা কিছু চাই। দৈনিকের পাতা কিংবা দিবসকেন্দ্রিক ছোট ছোট ম্যাগাজিনগুলোতে কী যেন নেই...

তখন আমাদের বন্ধুরাও ম্যাগাজিন সম্পাদনা কিংবা ছাপানো শুরু করে দিয়েছে। এই প্রথম কোনো ম্যাগাজিনের পরিকল্পনা থেকে ছাপানো পর্যন্ত থাকার সুযোগ পেতে থাকলাম। শুধু লেখা দিয়ে শেষ নয়। কী ছাপাবে- কেন ছাপাবে আর কী ছাপাবে না কিংবা কেন ছাপাবে না সেসব বিষয়ে তর্ক এবং কাজ করাও এসে যুক্ত হলো লেখার পাশাপাশি...

ইয়েস। নিজের লেখাটি ঠিক যে জায়গাটাতে ছাপাতে চাই এই ম্যাগাজিনগুলো অনেকটা সেরকম হয়ে উঠছে আস্তে আস্তে। শুধু লেখক নয়। লেখার কর্মী। লেখা এবং লেখার প্রকাশনা পরিকল্পনাকারী... সম্পূর্ণ ম্যাগাজিনের উপরই তৈরি হতে থাকল মালিকানাবোধ। ইয়েস...আমি এবং আমরা মনে করি এইসব এইভাবেই হওয়া উচিত...

নিজের লেখার পাশাপাশি মহা উৎসাহে সারারাত জেগে শামীম শাহানের গ্রন্থীর জন্য সাহিত্যের নীতিমালা লিখছি। কবিতা কাকে বলা যাবে আর কাকে বলা যাবে না তার মানদণ্ড নির্ধারণ করছি। শুদ্ধস্বরের জন্য কিশওয়ারের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি- গীতিগল্প নামে আলাদা এক ধরনের গল্পের ধারা তৈরি করছি...

সব নিজের মতো। যা করা গেছে তার খুশির মালিকানা যেমন সম্পাদকের সাথে সম্পূর্ণ আমারও তেমনি যা করা যায়নি তার দুঃখও আমার

লেখালেখি শুরু করার বহু বছর পার করে এসে এই যে লেখা ও প্রত্যাশিত প্রকাশনার মিশ্র শ্রম আর অনুভূতি। এটাকেই আমি লিটল ম্যাগাজিন বলে জানি- মানি এবং বলি

০২
বিরোধপর্ব

কিন্তু আমি এর কোনো সংজ্ঞা দাঁড় করাতে চাই না। অন্য যারা সংজ্ঞা দেন তাদের সেই সংজ্ঞাগুলোও আমি কানে তুলতে চাই না। লিটল ম্যাগাজিনের পরিচয় আমার কাছে কেউ জিজ্ঞেস করলে আমি আমি আমার এই ইতিহাসটাই বারবার শোনাতে চাই। লিটল ম্যাগাজিনকে আমি দেখতে চাই অনেকগুলো ডাইমেনশনে। তার প্রথমটাই হলো- হাত পা ছড়িয়ে নিজেকে ছড়ানোর মতো জায়গা হিসেবে। জনতার ভিড়ে তীর চিহ্ন দিয়ে নিজের নাম চিহ্নিত করা সংকলন কিংবা বিচিত্রা হিসেবে নয়। লিটল ম্যাগাজিনের লেখাগুলো সব ক্ষেত্রেই মানোত্তীর্ণ হতেই হবে এই সূত্রে আমি বিশ্বাস করি না। মানোত্তীর্ণ লেখা ছাপানোর দায় লিটল ম্যাগাজিনের নয়। লিটল ম্যাগাজিনকে আমি পার্টি কিংবা কোনো আইডলজির ভ্যানগার্ড হিসেবেও দেখি না। আমি লিটল ম্যাগাজিনকে দেখি লেখাশ্রমিকদের কিছু করার তাড়ায় ক্রমাগত ভুল করা আর ভুল অতিক্রম করার বিবর্তন ইতিহাস হিসেবে। কিছু লেখকের গুঁটি পোকা থেকে মথে পরিণত হবার পুরো পথপরিক্রমার ধারককে আমি লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই। একেবারে কাঁচা তরুণদের হাজার হাজার ভুল- লক্ষ লক্ষ আনাড়িপনার মধ্যে প্রকাশিত একপাতার স্বপ্নময় প্রকাশনাকেও আমি চিহ্নিত করি একটি লিটল ম্যাগাজিনের সূচনাবিন্দু হিসেবে। কারণ এই সূচনাবিন্দু থেকেই নিজেদেরকে নিজেদের মতো করে ছড়িয়ে দেবে অন্তত কয়েকজন লেখক। যা অন্য কোথাও সম্ভব নয়। লিটল ম্যাগাজিন বরাবরই জেনারেশন কেন্দ্রিক প্রকাশনা। গ্রুপ কেন্দ্রিক প্রকাশনা। একটি জেনারেশন কিংবা গ্রুপ নিজেরা কী করতে চায় তা প্রমাণিত হয়ে গেলে সেই ম্যাগাজিনকে আমি আর লিটল ম্যাগাজিন বলি না। ওটা তখন সংকলন হয়ে যায়। পরিচিত ও প্রমাণিত লেখকদের সংকলন। লিটল ম্যাগাজিনে প্রমাণিত লেখকদের কিছু করার নেই। অপ্রমাণিত লেখকদের প্রমাণিত করার জন্যই লিটল ম্যাগাজিন। একটা লিটল ম্যাগাজিন দুটো জেনারেশন কিংবা দুটো গ্রুপকে কোনো সময়ই ধারণ করতে পারে না। এতে সবাই সবার ভেতরে হারিয়ে যায়। লিটল ম্যাগাজিন নামে প্রকাশিত বর্তমানের অনেক ঢাউস ম্যাগাজিনের চরিত্র এখন ঠিক তাই। এগুলো বহু বছর থেকে বের হচ্ছে। বের হতে হবে বলেই বের হচ্ছে। যে কোনো দৈনিক পত্রিকার এক মাসের সাহিত্য পাতা একসঙ্গে বাঁধাই করলে যা দাঁড়াবে তার সাথে এইসব লিটল ম্যাগাজিনের বৈশিষ্ট্যের কোনো ফারাক চোখে পড়বে না। একেবারে এক। বিভিন্ন জায়গা থেকে বিভিন্ন লেখকের কিছু কবিতা-কিছু গল্প-পত্রিকার উপসম্পাদকীয় বা কলাম স্টাইলের কয়েকটা নিবন্ধ নিয়ে বের হচ্ছে এইসব। না আছে কোনো সম্মিলিত উদ্দেশ্য। না আছে স্বপ্ন না আছে কোনো অতিক্রমের ইচ্ছা। এগুলো মূলত সাহিত্য সংকলন। কিন্তু এই ম্যাগাজিনগুলোই হয়তো এক সময় দুর্দান্ত বৈশিষ্ট্যের লিটল ম্যাগাজিন ছিল। সেই বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলার মূল কারণই হলো; যাদের হাত ধরে এর সূচনা হয়েছে তারা হয় নিজেদেরকে প্রমাণ করে ফেলেছে না হয় মাঠ ছেড়ে চলে গেছে। উদ্দেশ্য হারিয়ে ফেলার পর কোনো লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশনা চালিয়ে যাবার কোনো মানে আছে বলে মনে করি না আমি। লিটল ম্যাগাজিন একটা জেনারেশন সিঁড়ি। অন্য কোনো জেনারেশনের কোনো সুযোগ কিংবা অধিকার নেই সেই সিঁড়ি বাইবার। তারা তাদের প্রয়োজনে নিজেদের সিঁড়ি নিজেরা বানিয়ে নেবে। আর সিঁড়ি বানানো জেনারেশন যদি মনে করে তাদের সিঁড়ি বাওয়া শেষ কিংবা সিঁড়ি বাইবার আর কোনো দরকার নেই। তবে সেই সিঁড়িটাও পরিত্যক্ত হওয়া উচিত। কোনোভাবেই তাকে অন্যদের ব্যবহারের জন্য খুলে দেয়ার দরকার নেই

লিটল ম্যাগাজিনের সাথে অনেকেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার বিষয়টা জড়িয়ে ফেলেন। কিন্তু একেকটা লিটল ম্যাগাজিন নিজেইতো একেকটা প্রতিষ্ঠান। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো নিজের পারপাস ঠিকমতো সার্ভ করতে পারছে না কিংবা করছে না বলেইতো মনমতো ভিন্ন ভিন্ন প্রতিষ্ঠান খুলে বসা। কোনো প্রতিষ্ঠানই নিজের উদ্দেশ্যের বাইরে অন্য কারো উদ্দেশ্য হাসিল করে না। লিটল ম্যাগাজিনও তাই। সব লিটল ম্যাগাজিন সব লেখকের কিংবা সব ধরনের লেখা ছাপায় না। তার বৈশিষ্ট্য কিংবা নীতিমালার ভেতরে যা যা আছে তাই প্রকাশ করে। এটাওতো পুরোপুরি প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম। তাহলে অনেকের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কেন?

অনেকেই লিটল ম্যাগাজিনের লেখককে দৈনিকে লিখতে দেখলে হৈ হৈ করে উঠেন। লিটল ম্যাগাজিনের কর্মীকে দৈনিকে চাকরি করতে দেখলে রাম রাম করে উঠেন। এই দলের লোক লিটল ম্যাগাজিন বলতে কী বোঝেন সেই জিনিসটা নিয়ে আমার আগাগোড়া সন্দেহ আছে। লিটল ম্যাগাজিন একজন লেখকের একটি বিশেষ ধরনের প্লাটফর্ম এবং মিডিয়া। বিশেষ কিছু উদ্দেশ্য এবং বিশেষ ধরনের কিছু লেখার জন্য তিনি এই মিডিয়াতে যুক্ত থাকেন। তাই বলে তিনি একইসাথে অন্য কোনো মিডিয়াতে প্রকাশিত হতে পারবেন না এটা কোন ধরনের গোঁড়ামি? দৈনিক পত্রিকা- সাধারণ সাহিত্য পত্রিকা- সাহিত্য সংকলন কিংবা বই; সবগুলোই একজন লেখকের জন্য একেকটা মিডিয়া। প্রিন্ট মিডিয়ার বাইরে এখন ইন্টারনেট- টেলিভিশন- ফিল্ম এমনকি মোবাইল ফোনও সাহিত্যের শক্তিশালী মিডিয়া হয়ে উঠেছে। সবগুলো মিডিয়ার আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য যেমন আছে তেমনি আলাদা আলাদা পাঠক শ্রেণীও আছে। একজন লেখক অবশ্যই সবার কাছে পৌঁছাবেন কিংবা সবাই যাতে তার কাছে পৌঁছাতে পারে সেই দরোজাগুলো খোলা রাখবেন। তাহলে একজন লেখক কেন লিটল ম্যাগাজিনের বাইরে সেইসব মিডিয়ার সুযোগ নেবেন না? কেন তিনি শুধু একটা মিডিয়াতে নিজেকে বন্দী করে রাখবেন? বিশেষত যেই মিডিয়াটা বৈশিষ্ট্যের কারণেই খুব ক্ষুদ্র পরিসরে আবর্তিত?

০৩
আত্মপর্ব

লিটল ম্যাগাজিন শব্দটা উচ্চারিত হবার সাথে সাথে অনেকগুলো শ্লোগান আশেপাশে উচ্চারিত হতে শোনা যায়। আমি এগুলো থেকে দূরে থাকতে চাই। কারণ এগুলোর বেশিরভাগকেই আমার দেউলিয়া মৌলবাদ কিংবা গোঁড়ামি বলে মনে হয়। আর আমার হিসেবের লিটল ম্যাগাজিন যতগুলো প্রকাশিত হয় তার বেশিরভাগই হয় ঢাকার বাইরে দূর মফস্বলগুলো থেকে। ঢাকার চমৎকার প্রিন্ট আর ঢাউস ম্যাগাজিনগুলো থেকে আমি বেশি আকর্ষণ বোধ করি মফস্বলের তরুণদের আনাড়ি হাতের স্বপ্নময় প্রকাশনাগুলোর প্রতি। কারণ সেখানেই আমি পাই কিছু হয়ে উঠার এবং কিছু প্রমাণ করার চেষ্টা। সেখানেই আমি পরিচিত হই নতুন নতুন ভাবনা এবং নতুন লেখকদের সাথে। যারা একদিন নিজেকে প্রমাণ করে লিটল ম্যাগাজিন ছেড়ে যাবে। কিংবা যাদের এক সময় আর লিটল ম্যাগাজিনের দরকার পড়বে না। কারণ লিটল ম্যাগাজিন করা হয় লিটল ম্যাগাজিনকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য। একদিন আর লিটল ম্যাগাজিনে লিখব না বলেই আমি লিটল ম্যাগাজিনের সাথে যুক্ত হয়েছি। একদিন আমাকে আর লিটল ম্যাগাজিনে লিখতে হবে না বলেই আমি এখনও লিটল ম্যাগাজিনে লিখি


মন্তব্য

মাহবুব লীলেন এর ছবি

শুদ্ধস্বর এর প্রথম জাতীয় লিটল ম্যাগাজিন মেলা ২০০৭ এ এই লেখাটি প্রকাশিত

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

পরশুদিন হোয়াইট চ্যাপেলে মিডিয়া ফ্যাক্টরিতে গিয়ে মারুফের খোঁজ করলাম। জানলাম যে মাঝে মাঝে আসে।
কয়েকমাস আগে ওকে সচলায়তন দেখিয়ে নিয়মিত লিখতে বলেছিলাম।
দেখি আবার খুঁজে বের করতে হবে।

লেখাটা ভালো লাগলো। ধন্যবাদ।
-----------------------------------------------
খড়বিচালি জোগাড় করি, ঘর বানাবো আসমানে

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

মাহবুব লীলেন এর ছবি

যদি পান তবে ধরে নিয়ে আসবেন
হারামজাদা এমন বিলাতি যে ৮/৯ বছর বিলাতে থাকার পরে আমাকে ফোন করে বলে তার বিমানের টিকিট পাঠাতে
কারণ সে কাজ করে না তাই পয়সাও নাই

ধরে নিয়ে আসবেন। হয় সচলায়তনে না হয় বাংলাদেশে

বিপ্লব রহমান এর ছবি

আরে, দারুন তো! হাসি


আমাদের চিন্তাই আমাদের আগামী: গৌতম বুদ্ধ


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

আমার প্রথম লেখা ছাপা হয় আমার ছোটো শহরের একটি লিটল ম্যাগাজিনে। বলা বাহুল্য, সেটিই কাগজের প্রথম এবং অন্তিম সংখ্যা। লেখা ছাপা হওয়ার পর রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে ভাবি, সবাই দেখছে একজন লেখক যাচ্ছে! এই বুঝি কেউ এসে অভিনন্দন জানাবে। বলবে, দারুণ!

কিন্তু কিছুই ঘটলো না। কেউ বলেনি লেখাটা কেউ চোখের দেখা দেখেছে, এই কথাও কেউ বলতে এলো না! হায়, তবু কি লেখক হওয়ার সাধ যায়!

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

শেখ জলিল এর ছবি

একদিন আমাকে আর লিটল ম্যাগাজিনে লিখতে হবে না বলেই আমি এখনও লিটল ম্যাগাজিনে লিখি...সত্যভাষণ।

যতবার তাকে পাই মৃত্যুর শীতল ঢেউ এসে থামে বুকে
আমার জীবন নিয়ে সে থাকে আনন্দ ও স্পর্শের সুখে!

হাসান মোরশেদ এর ছবি

ছোটকাগজের প্রতিষ্ঠানবিরোধীতা বড় প্রহসন মনে হয় যখন পেছনের পাতায় নারকেল তেল কিংবা আকিজ বিড়ির বিজ্ঞাপন ঝুলে ( এটা ব্রিটিশ টোব্যাকো,নাইকো,গ্রামীন যে কোন কিছু হতে পারে)
বছর দুয়েক কাগজ প্রকাশনার সাথে ছিলাম । নিজেদের পকেটের টাকাতেই করেছি । জেদ ছিলো,কোনো বেনিয়ার কাছে হাত পাতবোনা ।
আমরা অবশ্য ছোট কাগজ বলতাম না । আমার কাগজ আমার কাছে অনেক বড় হাসি
----------------------------------------
পাখীটা উড়ে যেতেই চাঁদ উঠে পড়লো-
আজো সেই রক্তমাখা মুন্ডুটাই উঠলো ।।

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

অনিন্দিতা এর ছবি

লেখাটা পড়ে মুগ্ধ হলাম। লিটল ম্যাগাজিনের বিষয়ে অনেক কিছুই আমার অস্পষ্ট ছিল। এই লেখা থেকে সেগুলো অনেকটা স্পষ্ট হয়েছে।আপনার লেখা পড়ে মনে হচ্ছে শিগগীরই আপনি লিটল ম্যাগাজিনে লেখা ছেড়ে দেবেন। মানে আর এখানে লিখতে হবে না। বেশী দেরী নেই।

শ্যাজা এর ছবি

দারুণ লেখা।


---------
অনেক সময় নীরবতা
বলে দেয় অনেক কথা। (সুইস প্রবাদ)

তাপস শর্মা এর ছবি

সিম্পলি অসাধারণ একটা বিশ্লেষণ!!

সব কথা যেন বলা হয়ে যায় এখানেই -

আমি লিটল ম্যাগাজিনকে দেখি লেখাশ্রমিকদের কিছু করার তাড়ায় ক্রমাগত ভুল করা আর ভুল অতিক্রম করার বিবর্তন ইতিহাস হিসেবে।

লিটল ম্যাগ নিয়ে এত অনুভূতি আছে যে বলে শেষ করা যাবেনা, কিংবা সেই আবেগের কথাগুলি বলাই যাবেনা। কেননা সেই রাত জাগা, না খেয়ে থাকা, একটা কবিতার জন্য সংগ্রাম, একটা কালির অক্ষরের জন্য জিজ্ঞাসা -- ভাষায় বলা যায়না। পারিনা বলতে। আপনি পেরেছেন দাদা, আপনাকে স্যালুট!!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।