বৈশাখে শুভেচ্ছার সাথে এক ফোঁটা প্যাঁচাল

মাহবুবুল হক এর ছবি
লিখেছেন মাহবুবুল হক (তারিখ: মঙ্গল, ১৪/০৪/২০১৫ - ১২:৫৫পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

সবাইকে পহেলা বৈশাখে ১৪২২ নববর্ষের শুভেচ্ছা। আরও একবার বৈশাখ আমাদেরকে বাঙালির সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন সামাজিক অনুষ্ঠানে একত্রিত হওয়ার সু্যোগ দিয়েছে। এই শুভ ক্ষণেও মৌলবাদীদের একদল পহেলা বৈশাখকে অমুসলিম বা হিন্দুদের বা বিধর্মীদের উৎসব সুতরাং ‘নাজায়েজ’ বলে বন্ধ করার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। যার প্রমাণ আমরা বোমা হামলা থেকে শুরু করে আরো অনেক লেখালেখি বা অনলাইন প্রচারণায় প্রতিনিয়ত দেখছি। মৌলবাদীদের অপেক্ষাকৃত উদার অপর দলটি ইদানিং পহেলা বৈশাখকে ইসলামী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার প্রমাণ করার চেষ্টায় আছে। তাদের লক্ষ্য পহেলা বৈশাখের গায়েও সাম্প্রদায়িকতার ছাপ বসিয়ে দেয়া এবং এটি কেবল মুসলমানের উৎসব বলে প্রচার করা ।

দুদলই যে আসল সত্যটি এড়িয়ে যায় সেটা হল, এই উৎসবটি প্রায় ৪৫০ বছর ধরে বঙ্গের সবচেয়ে বড় অসাম্প্রদায়িক সার্বজনীন উৎসব হিসেবে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের মনে স্থান করে নিয়েছে। কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন যে, বখতিয়ার খলজির সময় থেকে হিজরি সন চালু ছিল বাংলায় তাই এই ভূখণ্ডে হিজরি সন গণনার বয়স ১২০১ সাল থেকে শুরু। কথাটা অর্ধ সত্য, পুরো সত্য হল বাংলায় বা বৃহত্তরভাবে উপমহাদেশে তিথি-বাসর-কাল-যুগ-রাশি-পক্ষ-প্রহরভিত্তিক কাল গণনার রেওয়াজ খ্রিষ্ট জন্মের আগে থেকে। এ সম্পর্কে প্রাচীন ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান শাস্ত্র 'সূর্যাবর্ত' (?'সৌরসিদ্ধান্ত') -এ বিশদ বর্ণনা আছে। আগে পঞ্জিকা প্রকাশিত হত এই হিসাবেই। মুসলিম শাসনামলে রাজাদেশে হিজরি সন চালু হলেও তা সামাজিকভাবে কতটা ব্যবহৃত হত বা হতে কত শ বছর সময় লেগেছিল এটা অনুমান করতে বা প্রমাণ করতে কষ্ট হওয়ার কথা নয়। তাছাড়া যারা চান্দ্র মাস চালু করেছিলেন তারা এই অঞ্চলের জলবায়ু ও ভৌগোলিক অবস্থান জেনে বা না-জেনে সম্পূর্ণ অবহেলা করেছিলেন এতে কোন সন্দেহ নেই। সূর্যাবর্তে চান্দ্র ও সূর্য মাসের হিসাবের সমন্বয় আছে, প্রাচীন চীনেও চান্দ্র-সূর্য-সমন্বিত বছর গণনার রেওয়াজ ছিল। পক্ষান্তরে মরুভূমির প্রখর সূর্য ও উত্তাপ সেখানে সৌর মাস গণনার উপযোগী ছিল না। ভৌগোলিক ও জলবায়ুগত কারণেই সেখানে চান্দ্র মাসের হিসাব অথবা রাতের আকাশকেন্দ্রিক কালগণনা সহজ ছিল। আরবে জ্যোতির্বিজ্ঞান বিকশিত হওয়ার অন্যতম কারণও এটি। সে ভিন্ন প্রসঙ্গ।

বাঙালি মুসলমান তাঁর ঐতিহাসিক দীনতা ও মুর্খতার কারণে তাঁর স্বসমাজ-সৃজিত, স্ব-উদ্ভাবিত অনেক সার্বজনীন সামাজিক উৎসব আয়োজনকে সাম্প্রদায়িকতার তকমা দিয়ে বর্জন করেছে এবং দিনে দিনে অসংস্কৃত হচ্ছে । উদাহরণ হিসেবে চৈত্র-সংক্রান্তি, শিশুর হাত-খড়ি, অন্নপ্রাশন, জামাই ষষ্ঠী ইত্যাদি অনুষ্ঠানের নাম করা যায় । বাঙালি মুসলমানের এই দৈন্য ও ক্ষুদ্রতা নতুন নয় । সে ২০০ বছর আগেও বাঙালি পরিচয় লুকিয়ে মোগল, পাঠান, বোগদাদি, সৈয়দ পরিচয় দিতে গর্ব বোধ করত । নিজের দেশের কোমল মাটির বদলে মরুভূমির শুষ্ক বালুতে কবরস্থ হওয়ার জন্য তাঁর প্রাণ আকুল হত, এখনো হয়।

যারা সংস্কৃতি বলতে শুধু ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে চলাকে বোঝেন তারা বাংলাদেশের মুসলমান আর ইন্দোনেশিয়া বা মালয়েশিয়ার মুসলমানের মধ্যে পার্থক্য বোঝেন না। সুদানের মুসলমান আর কাজাখস্তানের মুসলমানের সংস্কৃতি একই মনে করেন। একই ধর্মের হওয়া সত্ত্বেও দুই দেশের মানুষের ধর্মচর্চার ভিন্নতা তাদের চোখে পড়ে না। নামের আগে শ্রী বললে বা সংস্কৃত শব্দে নাম রাখলে ওসব দেশে কেউ ভ্রূ কুঁচকায় না। তারা আরবের উলুধ্বনির মধ্যে পৌত্তলিকতা দেখেন না। কিন্তু বাঙালি মুসলমান শিশুর নামে বাংলা শব্দ থাকলে তাতে হিন্দুয়ানীর গন্দ শুঁকতে শুঁকতে নাক লম্বা করে ফেলেন। সংস্কৃতি গড়ে ওঠে মাটির সাথে মানুষের সম্পর্ক থেকে, চাঁদ-সূর্য-আলো-বাতাসের সাথে মাটির সন্তানের বোঝাপড়া থেকে। শস্যদানা, দূর্বা-ধান্য, মঙ্গলঘট-আলিপন, প্রসাধন, পরিচ্ছদ, বাদ্য-ধ্বনি, সজ্জা, অভ্যাস, আচরণ ইত্যাদি গড়ে ওঠে মাটির সাথে মিল রেখে। সৃষ্টিকর্তাই সেই ছাপ মেরে মানুষ পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। অথচ আমাদের কারো প্রাণ মাদিনী, কারো আজমিরি, কারো বা তুর্কি-পাঠান হওয়ার জন্য ওষ্ঠাগত । যা হোক এসব ভিন্ন প্রসঙ্গ, পরে এক সময় লেখা যাবে। আসল কথায় আসি।

সম্রাট আকবর যে বর্ষপঞ্জি চালু করেছিলেন, যার ভিত্তি হিজরি সন বলে ক্ষীণস্বরে দাবি করা যায়, তার প্রথম দিনটি ৪৫০ বছর ধরে, খাজনার বাজনা ভুলে গিয়ে বাঙালির প্রাণের বাজনা বাজাচ্ছে এটাই তো বাঙালি মুসলমানের জন্য বড় অর্জন, সেটাকেও ওয়াহাবিরা নানাভাবে বাদ দেয়ার মাধ্যমে ইসলামের অবমাননাই করছে না কি? পহেলা বৈশাখ পাহড়িদের সবচেয়ে বড় সামাজিক অনুষ্ঠান, তাদের সংস্কৃতির অন্যতম ট্রেডমার্ক, বাঙালি হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খৃষ্টান সকলের অনুষ্ঠান, পাঞ্জাবসহ ভারত ও এশিয়ার বেশ কয়েকটি এলাকায়ও বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে উৎসবের মধ্য দিয়ে পালিত হয় এই দিনটি। এই অনন্য উৎসবটিকে সাম্প্রদায়িকতার লেবেল লাগানোর জন্য একটি গোষ্ঠী উঠেপড়ে লেগেছে। তাদের সবচেয়ে বড় অস্ত্র মানুষের ধর্মীয় গোঁড়ামি ও অজ্ঞতা। আসুন পহেলা বৈশাখ নিয়ে সকল ষড়যন্ত্র প্রতিহত করি।


মন্তব্য

মাসুদ সজীব এর ছবি

বাঙালি মুসলমান তাঁর ঐতিহাসিক দীনতা ও মুর্খতার কারণে তাঁর স্বসমাজ-সৃজিত, স্ব-উদ্ভাবিত অনেক সার্বজনীন সামাজিক উৎসব আয়োজনকে সাম্প্রদায়িকতার তকমা দিয়ে বর্জন করেছে এবং দিনে দিনে অসংস্কৃত হচ্ছে ।

শতভাগ সহমত।

সংস্কৃতি গড়ে ওঠে মাটির সাথে মানুষের সম্পর্ক থেকে, চাঁদ-সূর্য-আলো-বাতাসের সাথে মাটির সন্তানের বোঝাপড়া থেকে। শস্যদানা, দূর্বা-ধান্য, মঙ্গলঘট-আলিপন, প্রসাধন, পরিচ্ছদ, বাদ্য-ধ্বনি, সজ্জা, অভ্যাস, আচরণ ইত্যাদি গড়ে ওঠে মাটির সাথে মিল রেখে।

চলুক চলুক

সব সংকীর্ণমনা প্রলেপ দূর হোক, বৈশাখ থাকুক প্রতিটি বাঙালির প্রাণের স্পন্দনে আর উৎসবে। নববর্ষের শুভেচ্ছা হাসি

-------------------------------------------
আমার কোন অতীত নেই, আমার কোন ভবিষ্যত নেই, আমি জন্ম হতেই বর্তমান।
আমি অতীত হবো মৃত্যুতে, আমি ভবিষ্যত হবো আমার রক্তকোষের দ্বি-বিভাজনে।

সাক্ষী সত্যানন্দ এর ছবি

পাকিস্তান থেকে আলাদা হবার যে কয়টা "সাংস্কৃতিক অনুষঙ্গ" ছিল তার মাঝে এটি অন্যতম। সেজন্যই বুঝি বারংবার এ দিনটি নানা পক্ষের আক্রমণের শিকার হয়ে চলেছে। আরও তীব্রভাবে দিনটি পালন করা ছাড়া গতি নেই। শুভ হোক নতুন বছর। হাসি

____________________________________
যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো,
তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?

অতিথি লেখক এর ছবি

সংস্কৃতি গড়ে ওঠে মাটির সাথে মানুষের সম্পর্ক থেকে, চাঁদ-সূর্য-আলো-বাতাসের সাথে মাটির সন্তানের বোঝাপড়া থেকে।

এই কথাটাই মাথায় ঢুকে না কারও। ধর্মটা বাঙালি মুসলমানের (ভুল হলো মুসলমান বাঙালি, যারা ক’দিন পরে পুরোপুরি মুসলমান বনে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে) এমন এক রোগ যা দিয়ে আমাদের গর্ব করার মতো সকল কিছু সংক্রমিত হচ্ছে।

আমাদের মেলা, আমাদের গান, আমাদের সংক্রান্তির উৎসবগুলো এইসব রোগের বিপরীতে একেকটি ধারালো অস্ত্র, একেকটি এন্টিবায়োটিক। এসবকে যত জোর দেব, রোগ তত পালাবে। আমাদের কাজ কেবল নিজেদের নাওয়ের হালটা ধরে পালটা জোরসে মেলে দেয়া।

তবুও মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক যাক জরা---
শুভ হোক, সুন্দর হোক

স্বয়ম

বন্দনা এর ছবি

চমৎকার একটা লিখা।

মৌলবাদীদের অপেক্ষাকৃত উদার অপর দলটি ইদানিং পহেলা বৈশাখকে ইসলামী ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার প্রমাণ করার চেষ্টায় আছে। তাদের লক্ষ্য পহেলা বৈশাখের গায়েও সাম্প্রদায়িকতার ছাপ বসিয়ে দেয়া এবং এটি কেবল মুসলমানের উৎসব বলে প্রচার করা ।

পুরাই এক মত। তবে অন্যদল হিন্দুয়ানি উতসব, র‍্যালিতে বিভিন্ন মুখোসের ব্যবহার, দেয়ালের চিত্রাঙ্কন এর দোহাই দিয়ে এই উৎসবকে বন্ধ করে দেয়ার চেষ্টা ও চালাচ্ছে বইকি।

অতিথি লেখক এর ছবি

চলুক । দিনকয়েক আগে মিষ্টির দোকানে গেছি; দুই তরুণ খুবই উদভ্রান্ত-পহেলা বৈশাখ নাকি পালন করা যাবে না এ বিষয়টা নিয়ে। তারা শুনেছে এবং এ নিয়ে রীতিমত সমস্যায়ও পড়েছে। দেখলেই বোঝা যায়-কোনরকম তথ্য যাচাই-বাছাইয়ের মত আর্থ-সামাজিক অবস্থা তাদের নয়, নিজেদের বিশ্বাসের ভিতটা বাইরের দমকা বাতাসে সহজেই নড়ে যায়। এ সরল মানুষগুলোর মন আর কিছু মানুষ কত সহজেই বিষিয়ে দিচ্ছে! মন খারাপ

দেবদ্যুতি

এক লহমা এর ছবি

সকল ষড়যন্ত্র- ব্যর্থ করে পহেলা বৈশাখ-এর উৎসব চলতে থাকুক বছর থেকে আর বছরে।

নববর্ষের শুভেচ্ছা জানাই।

--------------------------------------------------------

এক লহমা / আস্ত জীবন, / এক আঁচলে / ঢাকল ভুবন।
এক ফোঁটা জল / উথাল-পাতাল, / একটি চুমায় / অনন্ত কাল।।

এক লহমার... টুকিটাকি

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।