কিছু গভীর অস্থিরতা আর একটা বই

মাশীদ এর ছবি
লিখেছেন মাশীদ (তারিখ: বুধ, ২৫/০৭/২০০৭ - ৪:০৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

জন্মদিনের এই মাসে খুব ইচ্ছা ছিল জন্মদিন নিয়ে একটা পোস্ট দেব। অপ্রত্যাশিতভাবে খুব সুন্দর এবারের জন্মদিন নিয়ে হয়তো লিখব এরপর কোনদিন, কিন্তু এখন নয়। কারণ আমার এই জন্মদিনের মাসটার আকাশটা খুব মেঘলা শুরু থেকেই। এই মাসে আমি হারিয়েছি আমার খুব কাছের হয়েও দূরে থাকা একজনকে আর খুব দূরে থেকেও অনেক কাছের আরেকজনকে। কিন্তু আজকের পোস্টটা ঠিক তাদের নিয়েও নয়, আজকের লেখাটা একটা বই নিয়ে।

প্রথম যাকে হারিয়েছি সে আমার মেজমামা। মেজমামাকে নিয়ে তেমন কিছু আজকে লিখব না। কারণ মেজমামাকে নিয়ে লিখতে গেলে সেটা আর একটা পোস্ট থাকবে না, একটা বিশাল বই হয়ে যাবে। শুধু বলতে চাই, মেজমামা আমার খুব কাছের একজন হয়েও অনেক দূরেই ছিল অনেকদিন। সেই যে ১৯৯৭ না ১৯৯৮-এর দিকে অ্যামেরিকা চলে গেল, এরপর আর কোনদিন দেখা হল না। অথচ এর আগের প্রায় প্রতি শুক্রবার আমাদের বাড়ি চলে এসে আমি সে সপ্তাহে ছায়ানটে নতুন কি গান শিখেছি সেটা শোনা ছিল মামার রুটিন। ভীষণ ইমোশোনাল আর পাগলাটে ছিল। আমার সাথে ঝগড়া হলেই মামার ওয়ালেটে যত্ন করে রাখা আমার ছবিটা আমার পড়ার টেবিলে পড়ে থাকাও ছিল আরেকটা রুটিন। সবসময় খুব লাইট মুডে থাকত আর সেন্স অফ হিউমার ছিল দুর্দান্ত। একবার বেসুরো গান গেয়েছিলাম ভাঙা গলায়, চড়ায় গিয়ে গলা দিয়ে একেক রকম সুর বের হল, মামা বলল,'তুই দেখি একাই কোরাস গাস!' খুব মারদাঙ্গা, always jolly, অসম্ভব প্রাণবন্ত, যাকে ডিস্ক্রাইব করতে গেলে 'full of life' কথাটাই প্রথমে মনে আসে - মামা ছিল সেরকমই একজন। মামা 'ছিল' লিখতেও তাই আমার এখন অবাক লাগে। মামা নেই? এটা কেমন করে হয়? চমৎকার স্বাস্থের এই মেজমামাই ক্যান্সারে শেষ কদিন হাড্ডিসার হয়ে পড়েছিল একটা হসপিসে? হতেই পারে না! গতবছর যখন শরীর ভাল ছিল আর কিসের জন্য জানি একবার মালয়েশিয়া আসল, আমি তখন সিঙ্গাপুরে আর অপু ক্যানাডায়, আমি রিসার্চের চাপে তখন একটা দিনের জন্যও আসতে পারলাম না মালয়েশিয়ায় মামাকে দেখতে? এটা কিভাবে হল? আমি কেন বুঝলাম না সেটাই আমার শেষ সুযোগ হবে? গত ২ বছরে যেখানে আমি মালয়েশিয়া এসেছি ৩৬ বার, ঐ একবারই আমার কেন মিস্ হল? এসব প্রশ্নের এখন বোধহয় আর কোন উত্তর নেই। মেজমামা চলে গেছে ৯ তারিখে।

দ্বিতীয়জন যাকে হারিয়েছি, তাকে আমি ঠিক কতটা চিনি আমি নিজেও জানিনা। আমার জার্মান এক আন্টি। ওনার হাজবেন্ড আমার বাবার বন্ধু একজন জার্মান প্রোফেসর। আমার বাবার মতই যার কাজ মেডিক্যাল ফিজিক্স নিয়ে। সেই সুবাদে ছোটকাল থেকেই দেখি প্রায় বছরই সেমিনারে আর কেউ আসুক আর না আসুক, হুওয়েফার আংকল্ ঝটপট ঢাকা চলে আসেন। ২০০৪-এ লাস্ট যেবার আসলেন, সেটা ছিল ওনার ৯ম ঢাকা সফর। খুব অদ্ভুত কোন কারণে আমার বাবার থেকেও আমার সাথে ওনার বেশি খাতির। আমার বাবা ইমেইলের ধারে-কাছে নেই, তাই আমার সাথেই ওনার নিয়মিত যোগাযোগ চলে। আমি আমার বাবাকে যা বলি না, ওনার সাথে সেসবও শেয়ার করে ফেলি অবলীলায়। উনিও আমার সাথে শেয়ার করেন অনেক কিছু, তার সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে আন্টির জন্য ভালবাসা। আন্টি ক্যান্সারে ভুগছেন অনেকদিন ধরে, নানা এক্সপেরিমেন্টাল চিকিৎসার কারণে মাঝেমাঝে ভালও হয়ে ওঠেন। আংকলের ভাষায়, '‌‌if you believe in it, you can move mountains'. আমি ২০০১-এ যেবার লন্ডন গেলাম একটা সায়েন্স ফোরামে, সেবার হুওয়েফার আংকল্ গভীর উৎসাহে আন্টিকে নিয়ে এক উইকেন্ডে জার্মানী থেকে চলে আসলেন আমার সাথে দেখা করতে। স্বাস্থের কারণে বাংলাদেশে যেতে পারেন না কোনদিন, তাই বলে আমি এত কাছে আসব আর তারপরেও দেখা হবে না, সেটা কি করে হয়? তো, সেবারই আন্টির সাথে আমার প্রথম ও শেষ দেখা। জার্মান ভাষা ছাড়া অন্যকিছু বলতে পারতেন না দেখে হয়তো কথা হয়নি তেমন, কিন্তু আন্তরিক ভালবাসাটুকু অনুভব করতে ভুল হয়নি সেসময়। কেমন যেন কোন কারণ ছাড়াই একটা ভালবাসা। ক্লাসমেট বিয়ে করছি দেখে আমাদের বাসায় যখন তুমুল গ্যাঞ্জাম, সেসময় হুওয়েফার আংকল্ আমাকে সান্তনা দিতেন, 'tell your mother that your uncle has been married to the best wife in the world for 42 years and she's two years senior to him!' আন্টির খুব ইচ্ছা ছিল আমি কোন একদিন জার্মানী যাব ওনাদের কাছে। এই শেষ কয়েক মাসে কোন ইমেইল আসছিল না। আমি ভেবেছি ফোন করব, কিন্তু কেন যেন করা হয়নি। গতকাল একটা ছোট্ট ইমেইল আসল। little masheed, তোমার আন্টি আর নেই। আমি ফাইনালি ফোনটা করলাম, 3 days too late. আংকলের সাথে কথা হল। আমাকে বললেন, 'oh! it is so good to hear your voice'. আরো বললেন, আন্টি আমাকে কতটা ভালবাসতেন। আন্টির একটা ফাইল, যেখানে দরকারী পারিবারিক কাগজ-পত্র থাকত, সেটায় হুওয়েফার আংকল্ আমার দুইটা ইমেইল খুঁজে পেয়েছেন, যেগুলো উনি কোন একদিন ট্রান্সলেট করে দিয়েছিলেন। আমি হতবাক হয়ে যাই। আমার কাছে এটা একটা রহস্য, ভীষণ দুর্বোধ্য। কিভাবেই বা হুওয়েফার আংকলের সাথে আমার খাতির হল আর আন্টিও বা ঠিক কেন এত ভালবাসা জমিয়ে রাখতেন আমার জন্য? আর আমি কিনা, একটা ফোন সময় মতো করতে পারলাম না? এটা কিভাবে হল?

এই মাসটা তাই ভীষণ মেঘলা আমার।
i had been taking things for granted for so long that i had lost precious chances.
this month is ‌full of regrets.

একটা বই পড়ছিলাম বেশ কিছুদিন ধরেই। গতকাল অনুশোচনা আর আক্ষেপ আর সব শেষ হয়ে যাওয়ার হাহাকার নিয়ে বইটার শেষটুকু পড়া শুরু করলাম। বইটার নাম ‌'the five people you meet in heaven'. Mitch Albom-এর লেখা। আজ সকালে বইটা শেষ করে আমার অস্থিরতা কাটল অনেকটা। জীবন-মৃত্যু নিয়ে ভাবি মাঝেমাঝে খুব। যখন ভাবি জীবন কত fragile, তখন নিত্যদিনের জাগতিক টানাপোড়েন নিয়ে খুব হতাশ লাগে। খুব ইচ্ছা করে, তবু মৃত্যুর পরে আদৌ কিছু আছে কিনা সে বিষয়ে খুব গভীর কোন বিশ্বাসকেও লালন করতে পারিনা। আর খারাপ লাগে হারিয়ে যাওয়া সুযোগগুলো নিয়ে। এই বইটা পড়ে তার কিছুটা দূর হল আজকে। এখানে খুব সহজভাবে আরেকটা পয়েন্ট অফ ভিউ-এর কথা বলা হয়েছে। পুরোটাই ফিকশান, তারপরেও বেশ ইন্টারেস্টিং একটা ভিউ। লেখকের আংকলকে ডেডিকেশানের সময় বইটার শুরুতেই লেখা আছে, '‌‌everyone has an idea of heaven, as do most religions, and they should all be respected. the version represented here is only a guess, a wish, in some ways, that my uncle, and others like him - people who felt unimportant here on earth - realize, finally, how much they mattered and how they were loved.' ৮৩ বছর বয়সের একজন খুব সাধারণ মানুষের মৃত্যু আর তারপর বেহেশতে গিয়ে তার অভিজ্ঞতার কথা নিয়েই ঘটনাটা আবর্তিত। এডি নামের এই লোকটি নিতান্তই সাধারণ একজন, যুদ্ধের কালো কিছু অভিজ্ঞতা যাকে তাড়া করে ফেরে সবসময়। বেহেশতে গিয়ে তার দেখা হয় ৫জন মানুষের সাথে, যারা কোন না কোন ভাবে তার জীবনে এসেছিল। তার জীবনের ছোট কোন ঘটনাই হয়তো তাদের জীবনের বিশাল কিছু হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কারণ সবকিছুই সবকিছুকে এফেক্ট করে। লেখকের ভাষায়, '...that each affects the other and the other affects the next, and the world is full of stories, but the stories are all one.' বেহেশতের একেক ধাপে এই ৫জন তাকে ৫টি শিক্ষা দেয়। এই ৫টি শিক্ষা একে একে দূর করে দেয় তার জীবনের কিছু ক্ষোভ, মুছে দেয় খুব গভীরে বহন করা কিছু ক্ষতচিহ্ন, উত্তর দেয় কিছু বহুদিন তাড়া করে আসা প্রশ্নের আর above all, জীবনের নানা সীমাবদ্ধতায় আটকে পড়া হতাশ, বীতশ্রদ্ধ খুব সাধারণ এই লোকটাকে শেখায় তার জীবনের মূল্য কতটা ছিল তার পারিপার্শ্বিকের কাছে যেটা সে তার জীবদ্দশায় কোনদিন বোঝেনি।

খুব অস্থির একটা সময়ে এই বইটা পড়ে ভাল লাগল। মনে হল, এরকম যদি সত্যি হয়, তবে মন্দ হয় না। মেজমামা আর আন্টিকে হয়তো কেউ জানিয়ে দেবে how much they meant to me and others.


মন্তব্য

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

অসাধারণ, অসাধারণ, অসাধারণ। তবে খুব বেশি মন খারাপ করা লেখাও। বইটা পড়তে হবে কোন এক ফাঁকে।

রেজওয়ান এর ছবি

সত্যি মজার মিচ এলবমের লেখাটি। আর আপনার কষ্টটুকুও ছুঁয়ে গেল।

আমাদের জীবনের ফাইনার থিঙসগুলিই আমাদেরকে একে অপর থেকে আলাদা করে। একই স্থাপত্য কারো কাছে একটি সাধারন মেমোরিয়াল, কারো কাছে হারিয়ে যাওয়া মানুষের কাছে বার বার ফিরে আসা বা কারও কাছে শুধুই কন্ক্রীট।

আর ভালবাসার মানুষগুলো জানতে পারে তাদের জানাতে হয়না।

*********************************
পৃথিবী কথা বলছে আপনি কি শুনছেন?

এস এম মাহবুব মুর্শেদ এর ছবি

তোর লেখাটা চিন্তার খোরাক দিলো।

আমাদের জীবনটাতো আসলে এই ভালোবাসার নুড়ি কুড়ানোতেই। ছোট্ট ছোট্ট ঘটনা কিন্তু সারাজীবন যাকে খুঁজেছি তাকেই হয়তো পেয়ে যাই দু মিনিটের সাক্ষাতে। মনে হয় কত আপন!

ভালো থাকিস। লাল গাড়িতে করে মজা করে ঘুরিস।

====
চিত্ত থাকুক সমুন্নত, উচ্চ থাকুক শির

শোহেইল মতাহির চৌধুরী এর ছবি

নান্টুর কথা মনে পড়লো।
মানুষকে অবহেলা আর নয়।

-----------------------------------------------
সচল থাকুন ---- সচল রাখুন

-----------------------------------------------
মানুষ যদি উভলিঙ্গ প্রাণী হতো, তবে তার কবিতা লেখবার দরকার হতো না

হাসান মোরশেদ এর ছবি

যে গেলো, সে আসলে গেলোই

-----------------------------------
'পড়ে রইলাম বিধির বামে,ভুল হলো মোর মুল সাধনে'

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

একই সঙ্গে মন-খারাপ-করা এবং মন-ভালো-করা লেখা খুব বেশি পাওয়া যায় না। আজ একটা পেলাম।

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

ফারুক হাসান এর ছবি

পড়লাম।
মন্তব্যের ভাষা নেই।

-----------------------
জানেনিতো, ইহা নিতান্তই নিজস্ব মতামত

মাশীদ এর ছবি

অনেক ধন্যবাদ সবাইকে।


ভাল আছি, ভাল থেকো।


ভাল আছি, ভাল থেকো।

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

যারা যায়, তারা কোথায় যায়!
ভীষণ আবেগী লেখা।
_________________________
'আজকে না হয় ভালোবাসো, আর কোন দিন নয়'

তারেক এর ছবি

ভাল থাকুন মাশীদাপু। মামা আর আন্টির জন্য শুভকামনা। আজ আমারও খুব মন খারাপ। যদিও খুব তুচ্ছ কারণে, তবু...
_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

_________________________________
ভরসা থাকুক টেলিগ্রাফের তারে বসা ফিঙের ল্যাজে

অপালা এর ছবি

নো কমেন্ট!

নজমুল আলবাব এর ছবি

কি বলা যায় এমন সময় গুলোতো? আসলে বলার কিছু থাকেনা। বলা যায়না। শুধু অনুভব করতে হয়।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।