ভালো ছাত্র বনাম রাজনীতি

মাসকাওয়াথ আহসান এর ছবি
লিখেছেন মাসকাওয়াথ আহসান (তারিখ: বুধ, ২১/০৫/২০০৮ - ১:২৬পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

ছোটবেলা থেকেই লক্ষ্য করেছি আমাদের চারপাশ সাফল্যের একটা মানদন্ড তৈরি করে দেয়। আর সেই মানদণ্ডের চাহিদাপূরণ করতে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়াদের নিজেদের ‘ভালছাত্র’ হিসেবে সুচিহ্নিত করতে মরিয়া হয়ে উঠতে হয়।

এইসব ভালছাত্রদের কাছে আমাদের প্রত্যাশা তারা সুশীল হবে, মেধাবী হবে, পড়ুয়া হবে, ভালো রেজাল্ট করবে, ভালো বিতর্ক করবে, ভালো একটা ক্যারিয়ারের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করবে।

সমাজ, অভিভাবক এবং শিক্ষক চাইবেন ওইসব ভালো ছাত্র অত্যন্ত সুবোধ আচরণ করবে। ছাত্র রাজনীতিতে অংশগ্রহণ তাদের জন্য গর্হিত অপরাধ এবং একরকম নিষিদ্ধ। সমাজের ধারণা ভালো ছাত্ররা খারাপ ছেলেদের সঙ্গে মিশবে না। খারাপ ছাত্ররা রাজনীতি করবে এবং তারা ভাল ছাত্রদের টেনে হিঁচড়ে মিছিলে নিয়ে যেতে চাইলে শুভরা লুকিয়ে থাকবে।

নব্বুই এর দশকের শুরুতে মেধার ভিত্তিতে হলের সিট বণ্টনের উদ্যোগের সূত্র ধরে জহুরুল হক হলে আমি একটি সিঙ্গেল রুম পেয়েছিলাম। কক্ষ বরাদ্দের চিঠি নিয়ে হলের সেই কক্ষ দেখতে গিয়ে এক নয়নাভিরাম দৃশ্য চোখে পড়লো।

দরজার মৃদু নক শুনে বিরক্ত একজন ক্যাডার বেরিয়ে এলো লাল চোখ, ফেড জিন্সের ট্রাউজার, শীর্ণ শরীর আর পায়ের চেয়ে বড় মাপের বেইলী কেডস পরে। সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত থাকায় সম্ভবত জুতো পরে ঘুমাতে হতো ক্যাডারদের। বরিশালের লোকায়ত ভাষায় সে বুঝিয়ে দিলো সিট বরাদ্দ হওয়া মানেই দখল পাওয়া নয়। কারণ সিঙ্গেল ওই রুমটি বংশানুক্রমিকভাবে ক্যাডারদের হাওয়াখানা।

প্রায় কাপুরুষের মত সমাজের মনপছন্দ একজন ভাল ছাত্র সেদিন হল থেকে মাথা নীচু করে বেরিয়ে এসেছিল। জাতীয় টেলিভিশন বিতর্কে জহুরুল হক হলের জন্য চ্যাম্পিয়নশীপ এনে দেওয়ার পর আবার মাথা উঁচু করে হলে ঢুকেছিলাম। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরী হয়ে গেছে।

আমাদের বন্ধুদের মধ্যে কেউ কেউ ভালছাত্রের মীথ ভেঙ্গে দিয়ে মিছিলে নেমেছে, সক্রিয় রাজনীতি করেছে। কিন্তু ততদিনে আরও একটা মীথ চালু হয়ে গেছে। ভালো ছাত্র রাজনীতি করলেও তার জন্য বরাদ্দ সামাজিক আপ্যায়ন কিংবা সাহিত্য সম্পাদকের মতো অপেক্ষাকৃত কোমল পদগুলো।

সমাজকে খুশী রাখতে গেলে ভাল ছাত্রদের কম্পিটিটিভ পরীক্ষায় অবতীর্ণ হতে হয়। সিভিল সার্ভেন্ট হতে না পারলে কুল রক্ষা হয় না। সুশীল সেবকের পৈতে পরে সরকারী চাকরীতে যোগ দেওয়ার পর একজন মন্ত্রীর সমভিব্যহারে খাগড়াছড়ি সার্কিট হাউজে গিয়ে ভিআইপি রুমে দেখলাম আরেক নয়নাভিরাম দৃশ্য। কক্ষের সোফাগুলো আলো করে বসে আছে একদল ক্যাডার। তারা জেলা কমিটি তৈরি করতে ঢাকা থেকে পাহাড়ে এসেছে।

তারা আমাকে চিনতে পেরে মন্ত্রীর সামনে সার্টিফিকেট দিল, উনি ভাল ছাত্র ছিলেন, ভাল ডিবেটর ছিলেন। আমি কৃতজ্ঞ তাহাদের কাছে। এমন সার্টিফিকেট আমার জীবনে এমন ব্রাত্য মুহূর্তে নিশ্চয়ই জরুরী ছিল।

মন্ত্রী বনাম সচিব টম অ্যান্ড জেরী খেলায় একজন সিভিল সার্ভেন্ট হয়েও মন্ত্রীর পক্ষ নিতে হলো। সচিব সিএসপি হওয়ায় তার ভাল ছাত্রত্ব প্রশ্নাতীত। আর মন্ত্রীর ছাত্রত্ব নিয়ে কথা বলার সাহস আমার নেই। কিন্তু ততক্ষনে বুঝে গেছি আমার সর্বোচ্চ অর্জন হতে পারে পদে পদে খারাপ ছাত্রদের হাতে অপদস্থ হওয়া।

সিভিল সার্ভিসের বুনিয়াদি প্রশিক্ষণের শেষে আমরা শপথ নিলাম দেশের জন্য সততা ও নিরপেক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করবো। অথচ সরকারী দপ্তরে দাম্ভিক ক্ষমতাধর ক্যাডারেরা এসে আমাকে প্রশ্ন করেছে আপনি কী আওয়ামী লীগ নাকি বিএনপি। আমি তাৎক্ষনিকভাবে সে উত্তর না দিলেও মনে মনে বলতাম একদিন নিশ্চয়ই সে কথা স্পষ্ট করে বলতে পারবো।

তীব্র রাজনৈতিক মেরুকরণের মাঝে চরম নৈরাশ্য নিয়ে দেশান্তরী হলাম। সিভিল সার্ভিসের পাট চুকিয়ে ‘সাংবাদিকতা’কে পেশা হিসেবে নিলাম। কারণ বিতর্ক যে ধরনের মুক্তির আগ্রহ তৈরি করে তা আমাকে অপেক্ষাকৃত মুক্ত একটা পেশা খুঁজতে বাধ্য করেছে।

জার্মানীতে বছর পাঁচেক সাংবাদিকতার সূত্রে ইউরোপের নানা দেশে রিপোর্টিং-এর জন্য যেতে হয়েছে। আমি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেশে দেশে যে রাজনৈতিক সংস্কৃতি প্রচলিত তা পর্যবেক্ষণ করতে চেষ্টা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশেষতঃ ডিবেটিং ক্লাবগুলোতে গিয়ে ছাত্রদের সঙ্গে সময় কাটিয়েছি।

ভালো ছাত্র এবং বিতার্কিকদের দেশের ভবিষ্যত রাজনৈতিক নেতৃত্বে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি দেখে মুগ্ধ হয়েছি। ওখানে মাঝারি আর খারাপ ছাত্ররা সিভিল সার্ভিস কিংবা কর্পোরেট সার্ভিসের বামন নিরাপত্তা খোঁজে। আর ছাল ছাত্ররা স্বপ্ন দেখে পৃথিবী বদলে দেবার। ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে মোমবাতি মিছিল, জি-এইট কিংবা দাভোস সম্মেলনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ, শোষণের বিরুদ্ধে, অনিয়মের বিরুদ্ধে নিরন্তর ব্লগ বিতর্কে সক্রিয় এমনকি গোলাপ কিংবা মখমল বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের স্বপ্ন দেখে পশ্চিমের ভালছাত্ররা। রাজনীতি সচেতনতা মেধা, পড়াশোনা, নেতৃত্বের গুণের সঙ্গে সম্পর্কিত সেটা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর স্টুডেন্ট ফোরামে গেলে টের পাওয়া যায়।

বিশ্বায়নের অভিঘাতে বাংলাদেশের ভালছাত্রদের মনোভঙ্গি বদলে ফেলার সময় অতিক্রান্ত হয়েছে তবে দেরী হয়ে যায়নি।

মেধার সঙ্গে সাহসের যোগসূত্র, সাফল্যের সঙ্গে নিঃস্বার্থ মনোভাবের মিশেল, স্বপ্নের সঙ্গে দেশপ্রেমের যূথবদ্ধতা, বিতর্কের সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গীকার-- বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।


মন্তব্য

দ্রোহী এর ছবি

মেধার সঙ্গে সাহসের যোগসূত্র, সাফল্যের সঙ্গে নিঃস্বার্থ মনোভাবের মিশেল, স্বপ্নের সঙ্গে দেশপ্রেমের যূথবদ্ধতা, বিতর্কের সঙ্গে নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতির অঙ্গীকার-- বাংলাদেশ অপেক্ষা করছে তাদের জন্য।


আমীন!


কি মাঝি? ডরাইলা?

অতিথি লেখক এর ছবি

শেষ দু'টি অনুচ্ছেদে বর্ণিত আবেদনের প্রেক্ষিতে সুধাতে চাই বিষয়টা আসলে আমাদের রাজনীতিক সংস্কৃতিতে কতটা সম্ভব। ভাল ছাত্র হিসেবে একজন ছাত্রকে বেশ কিছুটা সময় পড়াশুনার জন্য বরাদ্দ রাখতে হবে। আমাদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রকৃতি কীরূপ? বাঙলাদেশে ভাল ছাত্রদের রাজনীতিতে আসা দরকার দেশের স্বার্থে। কিন্তু রাজনীতিতে তাদের সমান পদচারণায় সফলতা নিয়ে আমি দ্বিধান্বিত। উন্নত দেশগুলোর রাজনৈতিক সংস্কৃতির আমূল বৈপরীত্যে, আমাদের দেশের সাপেক্ষে ভাল ছাত্রদের রাজনীতিক নেতৃত্বে আসার ব্যপারে আমি কোন উৎসাহ পাইনা। সবার আগে রাজনীতিকেই উদ্যোগী হতে হবে। অর্থাৎ রাজনীতিকেই নির্ধারণ করে দিতে হবে ওখানে ভাল ছাত্ররা যেতে পারবে কি না। তখনই ভাল ছাত্ররা সেখানে স্থান পাবে এবং দেশের চিত্র বদলে দিতে পারবে। তবে একটা প্রশ্ন কিন্তু আমি রাখব। সিএসপি, আইসিএস বা বিসিএসদের ভাল ছাত্রত্বের ব্যাপারে সার্টিফিকেট থাকা সত্তেও তারা কতটা পরিবর্তনে ভূমিকা রাখতে পারছে। তারা কেন গত সাঁইত্রিশ বছরেও তাদের প্রশাসনিক কার্যক্রমের ধীরগতিতে আজও গতি সঞ্চার করতে ব্যর্থ হয়েছে। তারা কেন বিচার বিভাগ পৃথককরণের মতো ভালো উদ্যোগকে ব্যারিকেড দিয়ে বসেছিল এতদিন যাবৎ শুধুমাত্র নিজেদের প্রশাসনিক ক্ষমতার স্বার্থে? কেন কোন সরকারি কার্যক্রমেই সমন্বয় নেই? কেন পুরোনোকে বদলে দিয়ে নিজেদের ক্ষেত্রটাকেই গতিশীল করতে ব্যর্থ হন তারা? কেন একটা সাধারণ কাজ সম্পাদন করতেও সত্তরটা প্যাজগোঁজ না দিয়ে সরাসরি সম্পাদন (execute) করতে পারেন না আজও? কেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রাজনীতি করার কারণেই একজন সাধারণ শিক্ষককে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত হতে হয়। সর্বোচ্চ জ্ঞানচর্চার আখরায় রাজনীতি কিছু দিতে পারছে না; কেড়ে নেয়া ছাড়া। সেজন্য রাজনীতিক সংস্কৃতির প্রকৃতি যতদিন না পরিবর্তন হচ্ছে ততদিন ভাল ছাত্ররা রাজনীতির পেছনে ছুটতে গিয়ে নিজেরা দলছুট হয়ে যাবে - নীরু অভিদের মতো এমন আশঙ্কা আমার।
আপনার আশাবাদি লেখা আমার নৈরাশ্যবাদি মন্তব্যের চেয়ে বেশি সত্য হবে এই কামনায় ধন্যবাদ।

জিজ্ঞাসু

অতিথি লেখক এর ছবি

অপেক্ষা তো ভাই কম করা হয় নাই । আমার মনে হয় যাদের আসার কথা ছিল তাদের 'ডেলিভারি ডেট' পার হয়ে গেছে । এখন যারা 'ডেলিভারড' অবস্থায় আছে তাদেরি কিছু করতে হবে । কারো জন্য বসে থেকে লাভ নাই ।

- এনকিদু

অতিথি লেখক এর ছবি

ঢাবি তে যেমন ছাত্র রাজনীতিতে অস্ত্রের ঝনঝনানি আছে, বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিশ্চয়ই তেমনটি নেই। তাই ভাল ছাত্ররা গঠনমূলক কিছু করার সাহস ও প্রেরণা পায়। এখানে তেমন কিছু করতে গেলেই তো পা ভেঙ্গে হাতে ধরিয়ে দেবে ক্যাডাররা। সেই ঝুঁকি নিতে রাজি কজন?

- ফেরারী ফেরদৌস

sahoshi এর ছবি

কিছু মনে করবেন না, আপনার লেখা পড়ে মনে হল আমি এমন একজন ভলো ছাত্রের জীবনী পড়ছি যে স্বদেশে পদে পদে বন্চনার শিকার হয়ে আজ নিজের জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে।

আমিও খানিকটা আপনারই মতো। আমি আরো অনেককে চিনি আপনার মতোই জীবন থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। যখন বয়স কম ছিল তখন দেশ থেকে পালিয়ে এসে ভেবেছি, যাক ভবিষ্যতে সুন্দর জীবনের নিশ্চয়তা পাওয়া গেল। কত বোকা ছিলাম, একবারের জন্যেও মনে হয় নি, যত দূর গেলে নিজের জীবন থকে পালিয়ে যাওয়া যায়, ততদূরে যেতে পারে না কেউ।

আমাদের এই পলাতক জীবনের সমাপ্তি কোথায়?
-সাহোশি

অতিথি লেখক এর ছবি

বুয়েটে ঢুকার সময় আমরা দুজন বন্ধু ঠিক করেছিলাম রাজনীতি করব। কেন করব সেটা আজ আর মনে নেই। কিন্তু কবেই ভুলে গেলাম সেই কথা। দেশ থেকেও পালিয়ে এসেছি বাইরে। এখন শুধু চায়ের আড্ডায় দেশকে নিয়ে ভাবি আর রাজনীতিবিদদের গালিগালাজ করি।
-উলুম্বুশ

শামীম এর ছবি

আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় ভাল ছাত্র মানেই যে মেধাবী সেটা সত্য নয়। বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ভাল ছাত্র মানেই স্বার্থপর, ক্ষুদ্র মানসিকতা সম্পন্ন একজন ব্যক্তি যে কিনা শুধু নিজের স্বার্থে (গাড়ি-বাড়ি-নারী পাওয়ার জন্য) ভাল ফলাফল করতে চায়। স্বার্থপর এজন্য যে, তাঁর নোট অন্যকে দেয় না (!) .... ক্ষেত্রবিশেষে শিক্ষকের আনুকূল্যের জন্য যা নয় তা-ই করে।

মেধা নিয়ে প্রশ্ন তোলার কারণ হল আমাদের মুখস্থ নির্ভর পরীক্ষা ব্যবস্থা .... মুখস্থ করার ক্ষমতাটাই শুধু মেধার উপস্থাপক নয় বলেই মনে করি।

আর এই ধরণের বিশেষ প্রজাতির ছাত্ররাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভাল ছাত্র বলে পরিচিতি পায় বলেই আমাদের দেশের তথাকথিত ভাল ছাত্রদের বাইরের দেশের ভাল ছাত্রদের মত অগ্রগামী মানসিকতার অগ্রদূত হয়ে ওঠা হয় না।
________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

________________________________
সমস্যা জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ; পালিয়ে লাভ নাই।

নুশেরা তাজরীন এর ছবি

মাসকাওয়াথ, আপনার লেখা যথারীতি ভাল লাগল। ভাল ছাত্রও বাংলাদেশে রাজনীতি করে। কিসের আশায় করে আর কীসে পরিণত হয়, সেটা অভি থেকে এম কে আনোয়ার, এ এস এইচ কে সাদেক, মাহবুব উল্লাহ থেকে এরশাদুল বারী কি আফতাব আহমেদ- যে কারো উদাহরণে টের পাওয়া যায়।
আপনার খাগড়াছড়ির অভিজ্ঞতা আমারও আছে অন্য কোনো জেলায়; অবশ্য দেশের সর্বত্রই অভিন্ন চিত্র। এসএসসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র যথাস্থানে বুঝিয়ে দিতে গেছি, প্রথম কেন্দ্রের কাজ চুকিয়ে বেরিয়ে দেখি গাড়ি উধাও। শিক্ষার পূর্ণ ও অর্ধমন্ত্রী পরীক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে এসেছেন, তাদের কোনো কর্ষিকা হয়তো বাহনশূণ্য ছিলেন। খুঁটিনাটি আবশ্যকতা বাদ দিয়ে শহরের তিন প্রান্তের তিনটি কেন্দ্রে বাকী প্রশ্নগুলো শুধু ছুঁড়ে দিয়ে আসাও তখন অসম্ভব। নিরাপত্তা তো আল্লার হাওলা...
এসব ছেড়ে অনেক ভাল আছি। নার্ভের ক্ষয় কমেছে। বিশ্বাস করি আপনিও ভাল আছেন।

সুবিনয় মুস্তফী এর ছবি

কিছু মন্তব্য -

১) মাস্তানী, চান্দাবাজি আর ক্যাডারবাজির রাজনীতিতে যাওয়ার দায়-দায়িত্ব কোন ছাত্রেরই নাই, সেইটা ভালো ছাত্র কি খারাপ ছাত্র। যেইদিন বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতি অস্ত্রের রাজনীতি না হয়ে আদর্শের রাজনীতি হবে, সেইদিন এই বিতর্কে যাওয়া যাবে। তার আগে পর্যন্ত একটা ছাত্রকে judge করার অধিকার আপনার বা আমার নাই।

২) পশ্চিমের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক তথা সর্ববৃহৎ বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলা কোথা থেকে তাদের ট্রেইনিদের নেয়, খোঁজ নিয়ে দেখবেন। "ওখানে মাঝারি আর খারাপ ছাত্ররা সিভিল সার্ভিস কিংবা কর্পোরেট সার্ভিসের বামন নিরাপত্তা খোঁজে।" এই কথাটা একদমই ভূল। কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানই বেতন দিয়ে খারাপ ছাত্রকে চাকরি দিতে চাইবে না - না বাংলাদেশে, না ভারত-চীনে, না আমেরিকা-ইউরোপে। বরং টাকা খরচ করে সবচেয়ে তুখোড় ছাত্রদের নিয়ে আসা বড় কর্পোরেটদের রীতি। আপনি স্টুডেন্ট ফোরামে ডিবেট পর্যন্ত দেখেছেন। ডিগ্রির পর চাকরির বাজার চেক করলে প্রকৃত সত্য পেয়ে যেতেন।

আমার অভিজ্ঞতায় তাই ভালো ছাত্ররা সব জায়গায় স্থান পায় - সেটা কর্পোরেট, সিভিল বা রাজনীতি হোক। উদাহরণ স্বরূপ বৃটেনে ব্যবসা বাণিজ্যের অনেক পুরোধাই আসে এলিট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, যেমন অক্সফোর্ড ক্যাম্ব্রিজ। যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসা দৌঁড়ায় আইভি লীগ গ্র্যাজুয়েটদের পেছনে - হার্ভার্ড-ইয়েল থেকে। এমন কি ফ্রান্সেও সবচেয়ে দামী গ্র্যাজুয়েটরা আসে grandes ecoles থেকে - সেখানে তুখোড় মেধাবী ছাত্র বাদে কেউ চান্স পায় না। আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন হয়ে তো মজা আরো বেড়েছে ইউরোপের সেরা ছাত্রদের। কত বড় আমলা শ্রেণী তৈরী হয়েছে জনগণের ট্যাক্সের টাকায়, তা ব্রাসেলসে গিয়ে বোঝা যায়। সেই ইউরোপিয়ান কমিশন একটা ক্যান্ডিডেট-এর ডিগ্রির মান দশবার যাচাই না করে সহজ়ে চাকরি দেয় না।

পক্ষান্তরে 'খারাপ' ছাত্রদের জায়গা হয়তো হয় নন-প্রফিটে নাইলে কর্পোরেটের নীচের সারিতে।

৩) "বামন নিরাপত্তা"-র মতো একটা খেলো স্লোগান দেওয়ার কারন বুঝলাম না। যেন চাকরি করতে চাওয়াটা একটা অপরাধ। আর এত ভালো ছাত্রই যদি পশ্চিমা রাজনীতি সয়লাব করে দিচ্ছে, তাইলে পশ্চিমা নীতির এই বেহাল অবস্থা আর নীতি-নির্ধারকদের এত নীতিহীন চেহারা কিভাবে হলো? গতকাল যেই তুখোড় ছাত্র ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে মিছিল করেছিল, আজকে সেই কিনা ইরাকে আর আফগানে সৈন্য পাঠায়...

আর সব জায়গার মত পশ্চিমের রাজনীতিও শ্রেফ স্বার্থের খেলা - সেখানে ভালো ছাত্র ঢুকালেও তার পরিবর্তন হয় না।
-------------------------
হাজার বছর ব্লগর ব্লগর

অছ্যুৎ বলাই এর ছবি

প্রয়োজনীয় একটি বিষয় নিয়ে লিখেছেন। আমার বক্তব্যের প্রথম অংশ ওপরে শামীম ভাই বলে দিয়েছেন। ভালো ছাত্রের যে সংজ্ঞা বাংলাদেশে, তাতে ভালো ছাত্র নয়; বরং ভালো মানুষদের রাজনীতিতে আসা দরকার। সার্টিফিকেটধারী ভালো ছাত্রদের একটা অংশ ছাত্রজীবনের পরে হলেও রাজনীতিতে আসে। দুর্ণীতিতে তারাও সিদ্ধহস্ত। ডঃ ইউনুস রাজনীতিতে আসার খবরে দেশে বিদেশে এইসব হেবিওয়েট সার্টিফিকেটধারীদের যে তৎপরতা দেখেছি, তাতে সত্যিই আতঙ্কিত। ফখরুর জোর করে ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার আমলে এই এককালীন ভালোছাত্ররাই আজ সুশিল সমাজ!

হাই জিপিএমার্কা ভালো ছাত্র দরকার নেই, মানুষ হিসেবে ডেভেলাপড বুদ্ধিমান মানুষগুলো আসুক রাজনীতিতে। আর ক্ষেত্র নিয়ে কথা তুলে লাভ নেই। ক্ষেত্র তৈরি করে নেয়াটাও একটা যোগ্যতা।

---------
চাবি থাকনই শেষ কথা নয়; তালার হদিস রাখতে হইবো

তীরন্দাজ এর ছবি

জার্মানীর ভার্সিটিতে পাঁচ বছর নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পড়াশোনা করেছি। অনেকের সাথেই মিশেছি। এখানে অন্ততপক্ষে পড়াশোনার সময়কালীন ভাল ছাত্র, বা মন্দ ছাত্রকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করার প্রবণতা দেখিনি কখনো। চিহ্নিত করা হয় চাকুরী জীবনে।

রাজনৈতিক কর্মকান্ডে ছাত্রদের ভুমিকা খুবই কম। রুডি ডুচকের সময়ে আটষট্টির জেনারেশানে ছাত্রদের ভেতরে যে রাজনৈতিক জোয়ার এসেছিল, তা এখন পুরো স্তিমিত বললেই চলে। এখনকার বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন আন্দোলনে (বিদেশী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, তৃতীয় বিশ্বে শোসনের বিরুদ্ধে...ইত্যাদি) ছাত্ররা যায় বটে। তবে সেখানে তাদের ভূমিকা ছাত্র হিসেবে আলাদা কিছু নয়।
**********************************
কৌনিক দুরত্ব মাপে পৌরাণিক ঘোড়া!

**********************************
যাহা বলিব, সত্য বলিব

বিপ্লব রহমান এর ছবি

হুমম...এই শিক্ষা ব্যবস্থাই একেবারে শিশু বয়সে আমাদের শিখিয়েছে:

পড়াশুনা করে যে
গাড়ি-ঘোড়া চড়ে সে!

আর ভালো ছাত্রদের রাজনীতিতে আসার বোধহয় একেকটি মাহেন্দ্রক্ষণ থাকে। যেমন, কল্লোল যুগ, ৭০ এর দশক। সেই সময় ভালো ছাত্রদের আইকন ছিলো নেতাজী সুভাষ বসু, চে গুয়েভারা। কিন্তু এখন?


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

আনোয়ার সাদাত শিমুল এর ছবি

খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো... ।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।