আজাজিল

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি
লিখেছেন মাসুদা ভাট্টি (তারিখ: শুক্র, ১৯/০৯/২০০৮ - ২:৪৫অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

মাস খানেক শান্ত ছিল সে, কিন্তু কাল রাত থেকে আবার তার হাবভাবে পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে।অবশ্য এই পরিবর্তন শুধু জামাল সাহেবই বুঝতে পারেন, আর কেউ ধরতেই পারে না। কম দিন তো হলো না, সে জামাল সাহেবের সঙ্গে আছে; এই এতোটুকু এসেছিল, এখন সে প্রায় ছয় হাত লম্বা, হৃষ্টপুষ্টু, চকরা-বকরা শরীরটা নাদুস-নুদুস; ওর ঠান্ডা শরীরটায় হাত বুলিয়ে জামাল সাহেব যেনো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ আনন্দ পান।

জামাল সাহেবের মনে আছে ওকে যেদিন তিনি নিয়ে আসেন সেদিন বাড়ির সবাই কেমন আঁতকে উঠেছিল, বিশেষ করে জামাল সাহেবের স্ত্রী শাহিদা আখতার তো রীতিমতো কেঁদে-কেটে একসা। তখনতো জামাল সাহেবের মা বেঁচে আছেন, কিন্তু তিনি তার ছেলের কোনো কাজ নিয়ে কোনও দিনই কথা বলেননি, সেদিনও চুপ ছিলেন। একমাত্র শাহিদা আখতারই রাগ মেশানো গলায় বলেছিল, “ওই অজগর সাপের সঙ্গে এক ঘরে আমি থাকতে পারবো না। হয় তুমি ওই অজগর রাখবে, নয় আমি”।

জামাল সাহেব যতোই বোঝানোর চেষ্টা করেন ততোই শাহিদা আখতার ক্ষেপে ওঠে। শেষ পর্যন্ত জামাল সাহেবও স্বমূর্তিতে ফিরে এসেছিলেন। গলার স্বর পরিবর্তন করে বলেছিলেন, “তোমার ইচ্ছা হইলে থাকবা নইলে থাকবা না, এই অজগর এই ঘরে থাকবে, আমার বিছানায় ঘুমাবে, আমি এরে পাইলা-পুইষা বড় করবো – এর পরে আর একটা কথা কইলে তোমারে টুকরা টুকরা কইরা কাইটা এরে খাওয়াইয়া দিবো”।

জামাল সাহেবের গলায় কি ছিল কে জানে, শাহিদা আখতার এর পরে আর কোনো কথা বলেনি। তখনও তাদের প্রথম সন্তানের বয়স মাত্র সাড়ে চার বছর। মানুষটিকে খুব বেশি ঘাটায় না শাহিদা আখতার, বিয়েটা দিয়ে তার চাচা একরকম বেঁচে গিয়েছেন ধরে নিয়ে শাহিদা আখতার জামাল সাহেবের সব কথা, সব আদেশ মেনে নিয়েই সংসার শুরু করেছে। দু’একবার অবশ্য কথা কাটাকাটি হয়েছে কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই জামাল সাহেবের কথার সুর যায় বদলে এবং সেই সুর শুনে শাহিদা আখতারের মনে হয়, তার সামনে একটা খরিস সাপ ফোঁস ফোঁস করছে।

তার মনে আছে, একবার তাদের পাশের বাড়ির ময়না দাদির মুরগির খোপে একটা খরিস ঢুকেছিল।ময়না দাদির খোপে শাহিদা আখতারদেরও দু’তিনটা মুরগি থাকতো, যে কারণে প্রতিদিন সকালে শাহিদা গিয়েই মুরগির খোপ খুলতো। একদিন সকালে মুরগির খোপ খুলতে গিয়ে শাহিদা দেখে খোপ থেকে মুরগি বের হচ্ছে না, অন্য দিন খোপ খুলে দেওয়ার আগেই কার আগে কে বেরুবে তার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় মুরগিগুলোর মধ্যে।

কিন্তু সেদিন সেগুলো বেরুচ্ছে না দেখে শাহিদা খোপের সামনে মাটিতে বসে ভেতরে হাত ঢুকিয়ে দেখে দরোজার সামনেই মরে পড়ে আছে একটা মুরগি। টেনে বের করে আবার হাত ঢুকিয়ে আরেকটি মুরগি হাতে লাগে, সেটিও মৃত। শীতের সকালের তীর্যক রোদ এসে পড়েছে খোপের ভেতর। আর সেই রোদেই ঝিকমিক করছে কী যেনো একটা খোপের ঠিক মাঝখানে। শাহিদা ওই ঝিকিমিকি দেখে ভয় পেয়ে যায় আর সঙ্গে সঙ্গে ফোঁস ফোঁস ফোঁস শব্দে শাহিদার বুঝতে বাকি থাকে না যে মুরগির খোপের ভেতর সাপ ঢুকেছে। ততোক্ষণে অনেকেই এসে গেছে এবং মাটির খোপের ছাদ শাবল দিয়ে ভেঙে ফেলেছে কেউ। ভেতরে তিন চারটে মুরগি গিলে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে একটা খরিস সাপ। হলুদের ওপর সাদা ফোঁটা ফোঁটা চিহ্ন, যেহেতু মুরগি পেটে নিয়ে নড়তে পারছে না খুব একটা তাই ফোঁস ফোঁস করছে খুব। শাহিদার ভেতরটা তখনো কাঁপছে, ওর মনে হচ্ছিলো, এই মাত্র ও খোপের ভেতর হাত দিয়ে টেনে টেনে মুরগি বের করছিলো, যদি কোনো ভাবে সাপটির মুখের সামনে ওর হাত পড়ে যেতো তাহলে?

রাগের মুহূর্তে জামাল সাহেবের কথা বলার সুরটি অবিকল সেই খরিস সাপের মতো, আর তার মুখের সামনে দাড়িয়ে শাহিদা তখন সত্যিকার অর্থেই কাঁপতে থাকে, নারকেলের লম্বা পাতায় শয়তান ভর করলে যেমন অনবরত কাঁপতে থাকে, ঠিক তেমনই। শাহিদাদের নারকেল গাছের আর সব পাতাগুলো যখন নিথর থাকে, শুধু একটি মাত্র পাতা যখন অনবরত কাঁপতে থাকে তখন ওর দাদি বলেন, “শয়তানের ভর হইছে, একখান কাচি পোড়া দিয়া থো” – শাহিদা তখন একটা কাচি চুলোর ভেতর গুজে দিতো। সেসব দিন শাহিদা আখতার ভুলে যাচ্ছে আস্তে আস্তে, আজকাল তো সে আর শুধু শাহিদা নয়, শাহিদা আখতার। জামাল সাহেব কখনওই তাকে শুধু শাহিদা ডাকেন না, ডাকেন শাহিদা আখতার বলে।

তারপর থেকেই অজগরটা জামাল সাহেবের কাছে আছে। প্রথম প্রথম ওর জন্য ইঁদুর ধরে আনতেন জামাল সাহেব, তারপর একটু বড় হতেই আর ইঁদুরে হয় না, মুরগি কিংবা হাঁস কিনে আনতে হয়। নিজেদের বাজার করার সময় জামাল সাহেবের হাতের ফাঁক গলে পয়সা বের হয় না, প্রায়ই শাহিদা যখন দ্বিতীয়বার অন্তঃসত্ত্বা তখনও ওর জন্য মাছ কিংবা মাংস কিছুই আসেনি ঘরে, কিন্তু অজগরটির জন্য প্রতি সপ্তাহে মুরগি কিংবা হাঁস এসেছে নিয়মিত, দিনে দিনে ও গায়ে-গতরে বেড়েছে, সেই সঙ্গে বেড়েছে তার চাহিদা। ক্ষিদে পেলেই ও বিচিত্র ভাবে মোচড়া-মুচড়ি শুরু করে, ওর চেরা-জিহ্বাটা তখন এমন ভাবে বের হয় আর ভেতরে ঢোকে যে মনে হয়, ও যা কিছু দেখছে তাই-ই খেতে চাইছে। শাহিদা শুনেছে, সাপ নাকি জিহ্বা দিয়ে স্বাদ, গন্ধ, শব্দ টের পায়। তার মানে ওর সামনে দিয়ে তখন যে কেউ হেঁটে গেলে তাকেই ও খাবার মনে করে কিনা কে জানে? নইলে ওভাবে জিহ্বাটা বের করবে আর ঢোকাবে কেন?

আর তখন জামাল সাহেব যে ভাষায় অজগরটির সঙ্গে কথা বলেন তা আসলেই দেখার মতো। তখন তাকে কেউ দেখলে বিশ্বাসই করতে পারবে না যে, এই মানুষই যখন শাহিদার সঙ্গে কথা বলেন তখন কতোটা বদলে যান। সাপটিকে তখন পাশে নিয়ে অনবরত ওর শরীরে হাত বুলিয়ে দিতে থাকেন জামাল সাহেব আর মুখে বলেন, “এইতো, এক্ষণি নিয়া আসতাছি, একটু সবুর করো।আহারে শরীরটা শুকাইয়া কেমন দড়ি দড়ি হইয়া গেছে” – মুখে চুক চুক শব্দ করতে করতে জামাল সাহেব বেরিয়ে যান বাজারের উদ্দেশ্যে।
এরকমই একদিন জামাল সাহেব তখন বাসায় ছিলেন না, হঠাৎ করেই শাহিদার বড় ছেলে বনি আমিনের চিৎকারে আশেপাশের বাসা থেকেও মানুষ ছুটে এসে হাজির। শাহিদা তখন কোলের মেয়েটিকে রান্না ঘরের মেঝেতে বিছানা পেতে শুইয়ে রেখে রান্না করছিলো। ছেলের চিৎকার শুনে শাহিদা ছুটে এসে দেখে সবাই ওদের ঘরের মেঝের দিকে বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে। আর সেখানে বনি আমিনের চামড়ার বলটিকে আমূল গিলে ফেলেছে অজগরটি। অতোবড় বলটিকে কি করে সে পুরোপুরি মুখের ভেতর নিয়ে নিয়েছে তা নিয়ে সবাই বিস্ময় প্রকাশ করছে। গলার কাছটা পুরোপুরি ফুলে আছে, সাদা-কালো রঙের বলটি যেনো হলুদ-কালো ডোরা রঙের হয়ে গেছে। শাহিদা ছোঁ মেরে তার ছেলেকে ওখান থেকে টেনে বের করে এনে সবাইকে সেখান থেকে সরিয়ে দিয়ে দরোজাটা বন্ধ করে দেয়। কিন্তু তাতে কি? ওর ভেতর থেকে চিন্তাটা কখনওই যায় না, সারাক্ষণ একটা ভয়ের মধ্যে থাকে, ছেলেটা যখন যেখানে ইচ্ছে সেখানে ঘুমিয়ে যায়, মেয়েটাকেও মাঝে মাঝেই মেঝেতে শুইয়ে রাখে। নিজেও গরমের দিনে মেঝেটা মুছে নিয়ে তারপর একটা মাদুর বিছিয়ে দুপুরে একটু জিরিয়ে নেয়। কিন্তু এর পর কি আর এভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা যাবে?

সেদিন অবশ্য জামাল সাহেব বাড়ি ফিরে পশু ডাক্তার ডেকে এনে তারপর অপারেশন করিয়ে সেই চামড়ার বল বের করিয়েছিলেন অজগরের পেট থেকে। বল বের করে ছেলের দিকে ছুড়ে দিয়ে বলেছিলেন, “এই নে তোর বল, আর যদি কখনও এই বল মাটিতে পইড়া থাকে আর সে যদি আবার এইটা গিল্লা ফালায় তাইলে বলটা বাইর কইরা তরে ওর সামনে ধরুম, বুঝলি?” তারপর থেকে ছেলেটা আর সেই বল নিয়ে খেলা তো দূরের কথা, সারাদিন ঘরেই ঢোকে না, বাইরে বাইরে থাকে, সন্ধ্যের পর ঘরে ফিরে এসে ভাতটা খেয়েই বিছানায় চলে যায়, আর বার বার মাকে ডাকতে থাকে। যতোক্ষণ পর্যন্ত না শাহিদা বিছানায় আসে ততোক্ষণ পর্যন্ত ঘুমায় না, জেগে থাকে। পাশে শুয়ে থাকা বোনটিকে জড়িয়ে ধরে রাখে।

ঘরের মধ্যে আজাজিল ছাড়াই থাকে সব সময়। এ ঘর-ওঘর করে, আর তখন সারা ঘরে যেনো হিম ছড়ানো থাকে, যেনো ঘরটা অস্বাভাবিক রকমের ঠান্ডা। বনি আমিনতো বটেই শাহিদা নিজেও পারতো পক্ষে ঘরে ঢুকতে চায় না। বিশেষ করে সেই সময়গুলোতে যখন ওর ক্ষিদে পায়, দিন-রাত এঘর থেকে ওঘরে, কখনও বাইরেও চলে আসে। আশেপাশের কারো বাড়ির মুরগি উঠোনে ঢুকলে তাদের ধরার জন্য এগিয়ে যায়, মুরগিগুলো তখন ভয়ে দৌড়ে পালায় কিংবা পারলে উড়াল দিয়ে ওই উঠান থেকে চলে যায়।
পাশের ঘরে শাহিদা তার ছেলেমেয়ে নিয়ে ঘুমুতে পারে না। মনে হয় এই বুঝি খাটে উঠে আসছে আজাজিল, তারপর গিলে খেয়ে ফেলবে বনি আমিন বা ছোট্ট আসমাকে। প্রায় রাতেই মেঝেতে ফোঁস ফোসঁ শব্দ শোনা যায়, ঘষটে ঘষটে চলার শব্দও কানে আসে। জামাল সাহেব গভীর রাতে সাপ নিয়ে বাইরে যান, কোথায় যান কে জানে? শাহিদা কখনওই এসব নিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করে না। যেখানে ইচ্ছে সেখানে যাক, সাপটা চিরদিনের জন্য বিদায় হলে বাঁচা যায়। ঘরের মধ্যে, মেঝেতে, দরোজার ওপাশে এরকম সাক্ষাত মৃত্যু নিয়ে কি বেঁচে থাকা যায়?

শাহিদা মাঝে মাঝেই ভাবে, বনি আমিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কিন্তু ছেলের লেখাপড়া নিয়ে জামাল সাহেবের কোনো ভাবনা-চিন্তা নেই, বরং বল গিলে ফেলার ঘটনার পর ঘরের মেঝেতে কিছু ফেলে রাখলে কিংবা অজগরটির জন্য এনে রাখা ডিম কখনও সখনও ছেলেমেয়েদের ভেজে-টেজে দিলে জামাল সাহেব কুরুক্ষেত্র বাঁধান। মাঝে মাঝে এমন ভয়ঙ্কর আচরন করেন যে শাহিদার মনে হয়, হয়তো কোনওদিন শাহিদাকে কিংবা ছেলেমেয়েদের সত্যি সত্যিই সাপটির মুখের সামনে দিয়ে দেবেন।

একদিন শাহিদা বারান্দায় বসে বসে চাল বাছছিলো, কাঁকর আর মরা চাল ভর্তি, আর পানি গরম হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই চাল থেকে বের হয় দুর্গন্ধ, সেই চাল একটু না বেছে চুলোয় দেওয়া যায় নাকি। মনে মনে ভাবছে আর তখনই ভেতরে জামাল সাহেবের গলা।

“এই দ্যাখেন আজাজিল আপনার জন্য সরকারি সার্টিফিকেট নিয়ে এসেছি। এখন আর আপনাকে পালার জন্য আমাকে কেউ কিছু কইতে পারবে না। আপনার জন্য আমি এখন বৈধ ভাবেই খাবারের ব্যবস্থা করতে পারবো, দরকার হইলে আপনারে আমি একদিন আসল খাবার নিয়ে আসবো। কেউ জানতে পারবে না, বুঝতেও পারবে না, আপনি শুধু গিলা ফেলবেন, আপনার পেটের মইদ্যে কি আছে তা কি কেউ জানবে? জানবে না। আর বেশি দেরি নাই, একটু অপেক্ষা করেন আজাজিল, আপনারে আমি আসল খাবার শিগ্‌গিরই আইন্যা দিমু। আইজ থিক্যা আপনার নাম দিলাম আজাজিল, আপনার স্বজাতিইতো শয়তানেরে মুখের মইদ্যে বেহেশ্‌তে লইয়া গেছিলো, তাই ওই নামই আপনেরে মানায় খুব, কী বলেন?”

কুলোর ভেতর চাল নিয়ে শাহিদা বাছছিলো, বিকেলের আলো ম্লাণ হয়ে এসে পড়েছিল মফস্বল শহরে ওদের বাড়িটির এক চিলতে উঠোনে। ঘরের ভেতর জামাল সাহেবের কথা শুনে চালের ভেতর শাহিদার আঙুল থেমে যায়। শাহিদা ভুলে যায় ও কি করছিলো, বুকের ভেতর ওর সেই ভয়ঙ্কর কাঁপুনিটা শুরু হয় তীব্র ভাবে। ও বুঝতে পারে না কি করবে। ‘আসল খাবার’ বলতে জামাল সাহেব কী বোঝাচ্ছেন, তা যেনো আর কেউ না বুঝুক শাহিদা বুঝেছে। কিন্তু ওর তো কিছুই করার নেই, কী ই বা করতে পারে ও, ঘরের ভেতর বসে দ্যাখা ছাড়া। বিকেলের আলো আরো ম্লাণ হতে থাকে, শাহিদা চাল বাছা আর হয় না। সন্ধ্যের মুখে ছেলে ফিরে এলে ছেলেকে জড়িয়ে ধরে আরও কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকে।ছেলেও যেনো কিছু একটা বুঝতে পেরে মায়ের বুকের সঙ্গে লেপ্টে দাড়িয়ে থাকে। দূরে মসজিদে আজান হয়, একসঙ্গে অনেকগুলো মসজিদে। কিন্তু শাহিদার কানে আজানের শব্দের বদলে ফোঁস ফোঁস শব্দই কেবল বাজতে থাকে, যে শব্দ শাহিদাকে তার ছেলেমেয়ে শুদ্দু পাকে পাকে বেঁধে ফেলে। শাহিদার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে থাকে খুব, কিন্তু তখনই জামাল সাহেব চা দেওয়ার জন্য হাক দেন। শাহিদা অনেক কষ্ঠে নিজেকে মুক্ত করে ছেলের কোলে মেয়েকে দিয়ে উঠোনেই একটা কাঠের জলচৌকি পেতে বসিয়ে রেখে চা বানাতে রান্নাঘরে ঢুকে যায় কিন্তু ওর শ্বাসকষ্ট যেনো বাড়তেই থাকে, বাড়তেই থাকে। সে রাতে শুতে গিয়েও ছেলেমেয়েকে জড়িয়ে ধরে থাকে অনেক রাত অবধি, ঘুম আসে না ওর।

গভীর রাতে যখন জামাল সাহেব ওঘর থেকে ডাকেন তখন শাহিদা অনেকক্ষণ তার ডাকে সাড়া দেয় না। মড়ার মতো পড়ে থাকে। তারপর একসময় উঠে গিয়ে জামাল সাহেবের বিছানায় বসে, পাশে শুয়েও পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জামাল সাহেবের হাত শাহিদার শরীর খুলতে শুরু করে, শাহিদার মনে হয় ওর শরীর বেয়ে ওঠানামা করছে সাপের মতো শীতল কিছু একটা, দঁাতে দঁাত চেপে শুয়ে থাকে শাহিদা, ও জানে, এই বিছানারই এক কোণে বিড়া পাকিয়ে শুয়ে আছে জামাল সাহেবের আজাজিল। অথবা সেই মুহূর্তে জামাল সাহেব নয়, আজাজিলই – শাহিদা অবশ্য কিছু ভাবতে পারে না, চায়ও না, চুপচাপ শুয়ে থেকে সহ্য করে, তারপর অজগর নেমে গেলে ও নিজেও উঠে কলতলায় গিয়ে বালতির পর বালতি ঠান্ডা পাটি ঢালে শরীরে। যতোক্ষণ না ওর মনে হয় ও শান্ত হয়েছে, ততোক্ষণ পানি ঢালতেই থাকে। গভীর রাতে বিছানায় ফিরে এসে আবার ছেলেমেয়েদের বুকের ভেতর টেনে নেয়, ওদের শরীরের উষ্ণতায় ওম্ খোজে শাহিদা।

সকালে উঠে জামাল সাহেব আজাজিলকে প্রথমে টেনে নিয়ে আসেন বাইরে, বারান্দায় এক চিলতে রোদ এসে পড়ে, সেখানেই টান টান শুইয়ে রাখেন। আজকাল আর তাকে উঁচু করে তুলে আনতে পারেন না জামাল সাহেব, ঘাড়ের সঙ্গে পেঁচিয়ে তারপর বারান্দায় এনে একটা একটা করে প্যাঁচ খোলেন তিনি। তারপর রোদে নামিয়ে রেখে নিজে যান অফিসের জন্য তৈরি হতে। গোসল করে, খেয়েদেয়ে, অফিসের জামা-কাপড় পরে তারপর আবার কাধে জেনারেলকে পেঁচিয়ে ঘরের ভেতর নিয়ে গিয়ে একটা কাঠের তৈরি বাক্সের ভেতর তাকে রেখে অফিসে বেরিয়ে যান।

এর মাঝে একদিন বিকেলের দিকে আজাজিল ঘর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে প্রায় উঠোনে নেমে যাচ্ছিলো। বাড়িতে তখন কেউ নেই, শাহিদা একা, উঠোনে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে এগিয়ে এসে দ্যাখে ওই অবস্থা। আজাজিল নেমে এসেছে উঠোনের একেবারে মাঝখানে। শাহিদা কি করবে ভেবে পাচিছলো না, চিৎকার করে যে কাউকে ডাকবে তাও ভেবেচিন্তে ঠিক করতে পারছিলো না, যদি জামাল সাহেব এসে মনে করেন যে, আজাজিলকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার জন্যই শাহিদা চিৎকার করে লোকজন জড়ো করেছিল, তখন? সাত-পাঁচ ভেবে শাহিদা মোটা মোটা দু’টি চটের বস্তা ছুড়ে দেয় সাপটির ওপর, তারপর বারান্দায় বসে থাকে ঠায়। যতোক্ষণ না জামাল সাহেব ফিরে আসেন। ততোক্ষণ অবশ্য কুকুরটিও সমানে ঘেউ ঘেউ করে যাচ্ছিলো। বাড়ি ফিরে জামাল সাহেব কুকুরের ঘেউ ঘেউ শুনে প্রচণ্ড বিরক্ত হন প্রথমে তারপর উঠোনে চটের নীচ থেকে আজাজিলকে বের করে ঘরে নিয়ে আসেন। তার পরের দিনই অবশ্য এই কাঠের বাক্স বানিয়ে আনেন, সেদিন থেকেই অফিসে যাওয়ার আগে ওই বাক্সের মধ্যেই আজাজিলকে রেখে যান।

কিন্তু সেদিনের সেই ঘটনার দু’একদিন পরের ঘটনার কথা শাহিদা ভাবলে ওর শরীরের সব রোম একসঙ্গে দাড়িয়ে যায়, বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে। রাত তখন ক’টা হবে কে জানে, মফস্বল শহরের রাত, ন’টা সাড়ে ন’টাতেই মনে হয় অনেক রাত। হঠাৎ বারান্দায় কুকুরের কুঁই কুঁই শুনে শাহিদা বাইরে এসে দ্যাখে, জামাল সাহেব সকালের সেই কুকুরটিকে কি যেনো খেতে দিচ্ছেন আর তার খুব কাছেই অজগরটি ওঁত পেতে আছে, আবছা আলো-আঁধারিতে দেখা যাচ্ছে ওর চেরা জিহ্বা মুখের ভেতর ঢুকছে বেরুচ্ছে। এই ভঙ্গিটি শাহিদার খুব পরিচিত, যখনই অজগরের সামনে কোনও খাবার ধরেন জামাল সাহেব তখনই এরকম তেরচা হয়ে কিছুক্ষণ খাবারের দিকে তাকিয়ে থেকে তারপর ছোবল দেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত শরীর দিয়ে খাবারকে পেঁচিয়ে ধরে। তারপর আস্তে আস্তে গিলে ফ্যালে।

শাহিদা চোখ ফেরাতে পারছিলো না, জামাল সাহেব শাহিদাকে দেখতে পাননি, ওর দিকে পেছন ফিরে কুকুরটিকে কি যেনো খাওয়াচ্ছিলেন। চোখের পলকে অজগরটি কুকুরটিকে ছোবল দিলো, এবং মুহূর্তের মধ্যেই কুকুরটির গোটা শরীরটা পেঁচিয়ে ফেললো। কুকুরটি প্রথমে একটি চিৎকার দিয়েছিল কিন্তু তারপর ওর গলার স্বর ক্ষীণ শোনালো, মনে হলো ওর গলা চেপে ধরেছে কেউ। ওই দৃশ্য দ্যাখার পর কেউ সেখানে দাড়িয়ে থাকতে পারবে না হয়তো, কিন্তু শাহিদার পা নড়ছিলো না, যেনো শক্ত কোনও আঁঠা দিয়ে কেউ ওর পা আঁটকে দিয়েছে।

কিন্তু শাহিদার মনের ভেতর প্রচণ্ড ভয়ও ছট্‌ফট্ করছিলো, এই বুঝি জামাল সাহেব ঘুরে তাকান, তারপর? তারপর কি হবে? ভাবতে ভাবতে শাহিদা তাড়াতাড়ি পেছন থেকে সরে এসে বিছানায় ছেলেমেয়েদের পাশে শুয়ে পড়লো।

তারপর অনেকক্ষণ কোনো সাড়া শব্দ নেই। একসয় জামাল সাহেব ঘরে ঢুকলেন, টের পেলো শাহিদা, সে তখনও ঘুমোয়নি, এমনকি সেদিন সারাটি রাতই শাহিদা ঘুমুতে পারেনি। সকালে উঠে বারান্দায় পেট ফোলা অজগরটিকে দেখে ওর গা গুলিয়ে উঠছিলো শুধু। দিন নেই রাত নেই যে কুকুরটি ওদের উঠোনে শুয়ে থাকতো, কারণে অকারণে ঘেউ ঘেউ করতো, কখনও কখনও বনি আমিনের পেছন পেছন দৌড়ে বাইরে যেনো আবার আসতো, সে রাতের পরে তাকে আর কেউ দেখেনি। বনি আমিন অনেকবার প্রশ্ন করেছে শাহিদাকে, শাহিদা উত্তর দেয়নি, দিতে পারেনি। কী বলবে ও? প্রায় দিন পনেরো মতো ওই বারান্দায় শুইয়ে রাখার পর যখন আজাজিলের মোটা পেট আবার চিকন হয়ে গিয়েছিল তারপর তাকে বারান্দা থেকে ঘরে নিয়ে এসেছিলেন জামাল সাহেব। কিন্তু বারান্দায় এ ক’দিন প্রায়ই সাপটির বিষ্ঠা পড়ে থাকতো, শাহিদা লক্ষ্য করে দেখেছে সেগুলোর মধ্যে শেয়াল রঙের লোম। শাহিদার চিৎকার করতে ইচ্ছে করতো খুব, কিন্তু ওর গলায় যেনো কোনো জোর নেই, নেই শরীরেও কোনো শক্তি। ও যেনো প্রতিদিন দুর্বল থেকে দুর্বলতর হয়ে যাচ্ছিলো।

কারো সঙ্গে কথা যে বলবে সেরকমও কাউকে পাচ্ছিলো না, এই বাড়িতে অজগর আছে জেনে কেউই আর এ বাড়ির ছায়া মাড়ায় না। এমনকি স্কুলে বনি আমিনের সঙ্গে অন্য বাচ্চারা খেলাধুলাও করে না। ছেলেটা মাঝে মাঝে এসে মাকে বলে কিন্তু এতেও শাহিদার কি-ই বা করার আছে? কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই জামাল সাহেব একটি তের চৌদ্দ বছরের মেয়েকে নিয়ে হাজির। “এই যে শাহিদা আখতার, তোমার জন্য নিয়া আইলাম। একা একা কাজ-কাম করো, ছেলেমেয়ে নিয়ে তোমার খুব অসুবিধা হয়, তাই ভাবলাম গ্রাম থিক্যা এরেই নিয়া যাই। আমার দূর সম্পর্কের ভাগনি হয়। বাপটা মইরা গেছে। মা এর ওর বাড়ি কাম কইরা খায়। গ্রামে খাবার-দাবার কিছুই পায় না, তাই ভাবলাম তোমার কামে আইবো। খাইবো-দাইবো কাম করবো”। তারপর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে বললেন, “এই যে মালেকা, তুই তোর মামিরে সাহায্য করবি, ছেলেমেয়ে দুইটারে দ্যাহাশুনা করবি, আর কি, থাকবি, খাবি, বুঝলি?” মেয়েটি মাথা নাড়ে শুধু, কথা বলে না।

লিকলিকে শরীরের মালেকার দিকে তাকিয়ে থাকে শাহিদা, ওকে আগে কখনও দ্যাখেনি, নামও শোনেনি, তারপরও ওর মনে হয়, যাক এতোদিনে কাউকে একজন পাওয়া যাবে কথা বলার।কাজ কতোটা কি করবে সেটা শাহিদা জানে না কিন্তু সারাদিন ওর এই যে একা একা একটা আজদাহা সাপের সঙ্গে কাটানোর ভয়াবহতাতো কাটবে, কেউ না কেউ তো আশেপাশে থাকবে ওর, এই চিন্তাতেই খুশী হয়ে শাহিদা। এক থালা উঁচু করে ভাত বেড়ে, অনেক করে তরকারি বেড়ে দিয়ে খেতে দেয় মেয়েটিকে। জামাল সাহেবও দেখে বলেন, “আহারে গ্রামে কয়দিন না খাইয়া ছিল কে জানে? শাহিদা আখতার মাইয়াডারে বেশি কইরা কয়দিন খাইতে দিও। শরীরডা শুকাইয়া বষ্টি লাইগ্যা রইছে। কয়দিন ভালোমতো খাওয়া-দাওয়া করলে ঝাড়া দিয়া উঠবো দ্যাখবা”।

জামাল সাহেব বলুন বা না বলুন, শাহিদা কিন্তু মালেকাকে এমনিতেই বেশি করে খেতে দেয়। আর মেয়েটিরও না নেই, পাতের ভাত শেষ হলে আরও ভাত ঢেলে দিলে ও কখনওই না বলবে না। শাহিদার মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে মেয়েটি কতো খেতে পারে সেটা পরীক্ষা করে দেখে, কিন্তু ইচ্ছে করেই করে না। মানুষের বাচ্চা নিয়ে এরকম তামাশা করাটা ঠিক হবে না। তবে সত্যি সত্যিই অল্প কয়েক দিনেই মেয়েটার সেই লিকলিকে ভাবটা চলে গেলো, লক লকে পুঁই ডগার মতো মালেকার শরীরও যেনো মাচা ছাড়িয়ে যেতে চায়, ঝলমল করছে স্বাস্থ্য।ইদানিং শাহিদার সঙ্গে দু’একটা কথাও বলে মালেকা। সবচেয়ে বড় কথা হলো, মালেকার চোখের সামনে থেকে এক চুলও নড়ে না সে। জমের মতো ভয় পায় সাপটিকে। কিন্তু এই বাড়ির ভাতের থালা রেখে চলে যাওয়ারও সাহস ওর নেই। তাই সারাক্ষণ শাহিদার পায়ে পায়ে ঘোরে, শাহিদার মেয়েটিকে কোলেও রাখে সারাদিন। শুধু দুপুর বেলা ভাত খাওয়া হলে শাহিদা ছেলেমেয়েদের নিয়ে চৌকিতে আর মালেকা মাদুর বিছিয়ে নীচে ঘন্টাখানেক ঘুমিয়ে নেয়।

ছুটির দিনে পাশের ঘরে তখন জামাল সাহেবের মৃদু নাক ডাকার শব্দ শোনা যায়।কিন্তু একদিন হঠাৎ এরকমই এক ছুটির দিনের দুপুরে শাহিদার ঘুম ভেঙে গেলে মেঝেতে চোখ পড়ে গেলে যে দৃশ্য ওর চোখের সামনে ফ্রেমের মতো আঁটকে থাকে তা দেখার পর ওর ভেতর আবার সেই কষ্টের দাপাদাপি শুরু হয়।

ঘুমের মধ্যে মেয়েটা হঠাৎ কেঁদে ওঠায় শাহিদা চেয়েছিল মালেকাকে পাঠিয়ে মেয়ের জন্য একটু দুধ গরম করিয়ে আনাবেন। সবেমাত্র দুধ ছেড়ে মেয়েটি একটু একটু ভাত খেতে শুরু করেছে। কিন্তু তখনও মাঝে মাঝেই বিশেষ করে ঘুমুতে যাওয়ার আগে কিংবা ঘুমের ভেতর বোতলে দুধ ভরে দিলে খেয়ে নেয়। কিন্তু মালেকা ডাক দিতে গিয়ে মেঝের দিকে তাকাতেই শাহিদার চোখে পড়লো যেখানে মালেকা শুয়ে থাকতো সেখানে মালেকার বদলে অজগরটি শুয়ে আছে, তার হা করা মুখের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে মালেকার দু’টি পা।

শাহিদা কি করবে ভেবে পায় না, চিৎকার করে কাউকে ডাকতে ইচ্ছে করে খুব কিন্তু ওর মুখ দিয়ে কোনও কথা বের হয় না। তারপরও ওর গলা দিয়ে কোনো স্বর বেরিয়ে থাকবে, আর তখনই পাশের ঘর থেকে জামাল সাহেব বেরিয়ে আসেন। শাহিদা আর মালেকাকে ধমকে ওঠেন, “এতো চিল্লাচিল্লি কিসের? দুইফরে এট্টু যে ঘুমামু, তারও জো নাই। আরে আজাজিলরেও আমি আইজ ছাইড়া দিচ্ছি, বেচারা সারাদিন বাক্সের মইদ্যে বন্দী হইয়া থাকে, আইজ ছুটির দিন, আমি ঘরেই আছি, এট্টু ঘুইরা-ঘাইরা বেড়াক না হয়” – বলতে বলতে আজাজিলকে ওই অবস্থায় দেখে শাহিদার দিকে চোখ ফেরান। তারপর তার সেই ভয়ংকর ফোঁস ফোঁস শব্দ করা খরিস গলায় চিবিয়ে চিবিয়ে বলেন, “এই কথা যেনো কেউ না জানে, কাউরে কইলে আমি সবাইরে এর খাবার বানাইয়া দিমু কইয়া দিলাম। খালি পশু-পাক্ষি খাইয়া তার জিহ্বার স্বাদ নষ্ট হইয়া গেছিলো। আমারে সে স্বপ্নে কইয়া দিছে, সে মানুষ খাইতে চায়। এ্যাহন থিকা সে খালি মানুষ খাইবো।তোমারে সাবধান কইরা দিতাছি, এই কথা যেনো কেউ না জানে, কেউ না। এই চাইর দেওয়ালের বাইরে এই কথা গেলে তোমার খবর আছে, প্রথমে তোমার ছেলে, তারপর তোমার মেয়ে আর সবশেষে তুমি, মনে রাইখো কইলাম”।

শাহিদার চিৎকারে বনি আমিন জেগে উঠেছিল, ও হয়তো জামাল সাহেবের কথা শুনে থাকবে, শাহিদা টের পায় বনি আমিনের একটি হাত তার হাতকে শক্ত করে ধরে আছে। মনে হচ্ছে বনি আমিনের আঙুল শাহিদার শরীরের ভেতর ঢুকে যাবে। শাহিদা তাই আর কোনও কথা না বলে বনি আমিনের পাশে শুয়ে পড়ে, মেয়েটার কান্নাও কখন যেনো থেমে গিয়েছিল। জামাল সাহেবও ধীরে ধীরে ঘর থেকে বেরিয়ে যান।শুধু মেঝেতে তখনও হিঁস হিঁস একটা শব্দ হচ্ছিলো।

তারপর ওর মোটা শরীরটা জামাল সাহেবের ঘরে যেখানে তার কাঠের বাক্স তার পাশেই লম্বালম্বি পড়ে ছিল মাস খানেক আর সেবার আজাজিলের ত্যাগ করা বিষ্ঠার সঙ্গে লেগে থাকা চুলের রঙও ছিল কালো – শাহিদা অবশ্য তা নিয়ে আর প্রশ্ন করেনি। প্রশ্ন করে কী হবে? প্রশ্ন করে কখন্ওই কিছু হয় না।

কিন্তু বছর খানেক পরে হঠাৎই একদিন শাহিদার ভেতর প্রচণ্ড ভালো লাগা ছড়িয়ে পড়ে, একটা দৃশ্য দেখে। গরমের দিনের দুপুর, কেমন ঝিমিয়ে পড়া সবকিছু। বনি আমিন স্কুলে, মেয়েটাও ঘুমিয়েছে। শুধু শাহিদাই ঘুমুতে পারে না, ওর ঘুম আসে না। ভয় লাগে খুব, যদি ঘুমিয়ে গেলেই অজগরটা ওর ছেলেমেয়েদের কিংবা ওকেই গিলে ফ্যালে, সেটা ভেবেই শাহিদার চোখ থেকে ঘুম চলে গিয়েছে একেবারেই। সেদিনও শাহিদা বারান্দায় একটা মোড়ায় বসে চাল বেছে নিচ্ছিলো। হঠাৎই চোখ পড়লো ঘরের দিকে, ও যেখনে বসেছিল সেখান থেকে জামাল সাহেবের খাট স্পষ্ট দেখা যায়। ছুটিরি দিনের দুপুর বলে জামাল সাহেব ঘুমিয়েছিলেন, তার নিঃশ্বাসের ওঠা-নামা দ্যাখা যাচ্ছে। আর তার পাশেই লম্বালম্বি শুয়ে আছে অজগরটি। ওর শরীর তখন ছিমছাম, চকরা-বকরা শরীর বিছানার সাদা চাদরের ওপর ফুটে আছে, শাহিদা শুধু ওর শরীরের একটা পাশ দেখতে পাচ্ছে, একটা চোখ জ্বলজ্বল করছে যেমন করে ওর ক্ষিদে পেলে, চেরা জিহ্বাটা ঘন ঘন বেরুচ্ছে আর ঢুকছে মুখের ভেতর। জামাল সাহেবের মাথা থেকে পা পর্যন্ত লম্বালম্বি শুয়ে আছে অজগরটি, লম্বায় জামাল সাহেবের চেয়েও কয়েক হাত বাড়তি, বোঝা যাচ্ছে।

দৃশ্যটি শাহিদার ভেতরে আনন্দের ঘুড়ি উড়িয়ে দিলো। এতোদিন হাতের কাছে যা পেয়েছে এমনকি পুরনো ঠোঙা পর্যন্ত তন্ন তন্ন করে খুজেঁ সাপ সম্পর্কে যা কিছু লেখা সবই পড়েছে। ওর আর দৌঁড় কতোদূর, তবু এই মাত্র কিছুদিন আগেই পুরনো কাগজে একটি খবর পড়েছিল শাহিদা। সেখানে লেখা ছিল, অজগর কোনও বড় শিকার করতে চাইলে আগে নিজের শরীরের সঙ্গে শিকারের শরীরের মাপ দিয়ে নিশ্চিত হয়ে নেয়, তারপরই আঘাত হানে।

অনেকক্ষণ ওই দৃশ্যের দিকে তাকিয়ে থেকে শাহিদা কুলোর ওপরে আবার দৃষ্টি টেনে আনে, ওর হাতের আঙুলে কুলোয় তোলা চাল অন্যরকম ঠেকে, খুবই অন্যরকম।


মন্তব্য

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

আমি লগ-আউট করলে, গল্পটা কেন যেনো প্রথম পাতায় থাকছে না। এটা কি নুতন কোনও নিয়ম? কেউ কি জানাবেন?

শুভেচ্ছা সবাইকে।

পরিবর্তনশীল এর ছবি

লগ আউট করার পর কিছুক্ষণ আগের পেইজ দেখায়। আসলে গল্পটা প্রথম পাতাতেই আছে।
---------------------------------
ছেঁড়া স্যান্ডেল

আলমগীর এর ছবি

লগআউট (মানে অতিথি) অবস্থায় সর্বোচ্চ ১০ মিনিটের পুরোনো জিনিশ দেখা যাবে। সার্ভারে ক্যাশিং ব্যবস্থা চালু আছে, লোড কমানোর জন্য। "সাম্প্রতিক কমেন্ট" আসতেও একটু আধটু দেরী হতে পারে।

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

অন্যরকম একটা গল্প।
কৌতূহল টেনে রাখলো শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

রানা মেহের এর ছবি

বেশ ভালো গল্প
ভয় পেয়েছি
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

হিমু এর ছবি

অজগর কি ছোবল দেয়? আমি জানতাম সাফোকেট করে মারে। অজগরের ত্বক খুবই সংবেদনশীল সেন্সর হিসেবে কাজ করে, সে শিকারের হৃৎপিন্ড আর ফুসফুস এলাকা প্রথমে পেঁচিয়ে ধরে, তারপর হৃৎস্পন্দন মেপে একটু একটু করে এই কুন্ডলী আঁট করতে থাকে। যখনই শিকার নিঃশ্বাস ফেলে, আঁটুনি আরো বজ্র হয়ে ওঠে। এভাবে একটা সময় গিয়ে ফুসফুসের সমস্ত বাতাস বের হয়ে যায়, কিন্তু ভেতরে বাতাস ঢোকানোর জন্যে ফুসফুসের প্রসারণের জায়গা আর থাকে না। ফলাফল, "দম আটকে মৃত্যু"। যখন হৃৎস্পন্দন বন্ধ হয়ে যায়, তখন সে শিকারকে ছাড়ে। তারপর গিলে ফেলে।

কোন কনস্ট্রিকটরই সম্ভবত বিষাক্ত না। আমার আগে ধারণা ছিলো অজগর প্যাঁচ দিয়ে পাঁজর ভেঙে হৃৎপিন্ড অকেজো করে দেয়, কিন্তু ডিসকভারি চ্যানেলের কল্যাণে অজগরের হননপন্থা নিয়ে ভুল ভেঙেছে। সামনাসামনি অজগর দেখেছি, কিন্তু শিকার মেরে খেতে দেখিনি। ডিসকভারিতে একটা অবিশ্বাস্য ক্লিপ দেখেছিলাম, অজগর একটা জাকান্দা (কুমির) মেরে খাচ্ছে, বেশ কয়েকদিন পর সেই কুমিরের নিখুঁত কঙ্কাল আবার উগড়ে ফেলে রেখে গেছে।

যাই হোক, গল্পটা ভালো লেগেছে।


হাঁটুপানির জলদস্যু

মাহবুব লীলেন এর ছবি

এই গল্পে বিজ্ঞান ঢোকানোর জন্য এখন হিমুকে আজাজিলের সামনে দিয়ে পরীক্ষা করা দরকার অজগর মানুষ কীভাবে খায়...

বিজ্ঞানের চেয়ে লোকচিন্তাই যেন এই গল্পে বেশ মাননসই

হিমু এর ছবি

বিজ্ঞানেও আছে শিক্ষণীয় অনেক কিছু ... খুব খিয়াল কইরা ... চোখ টিপি


হাঁটুপানির জলদস্যু

মাহবুব লীলেন এর ছবি

পুস্তকের বিজ্ঞান হইতে চলচিত্রের বিজ্ঞান উত্তম

থার্ড আই এর ছবি

গল্প পড়ে যতটানা ভয় লাগলো, হিমুর অজগর বিষয়ক বৈজ্ঞানিক মন্তব্য পড়ে যথারীতি গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে !! মনে হচ্ছে এই বুঝি ব্লগে অজগর বের হয়ে এসে শ্বাস বন্ধ করে মেরে ফেলবে!!
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

ঝরাপাতা এর ছবি

দারুন একটা গল্প পড়লাম। দেশের বর্তমান অবস্থার সাথে কেমন একটা সামঞ্জস্যও খুঁজে পেলাম। বুমেরাং।


যে রাতে গুঁজেছো চুলে বেগুনি রিবন বাঁধা ভাট,
সে রাতে নরকও ছিলো প্রেমের তল্লাট।
. . . . . . . . . . . . . . . . . . (আবু হাসান শাহরিয়ার)


বিকিয়ে যাওয়া মানুষ তুমি, আসল মানুষ চিনে নাও
আসল মানুষ ধরবে সে হাত, যদি হাত বাড়িয়ে দাও।

অনিন্দিতা এর ছবি

গল্পের প্লটটা চমৎকার।
ভীষণ উৎকন্ঠা নিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়েছি।

এলোমেলো ভাবনা এর ছবি

এক নিঃশ্বাষে পড়ে ফেললাম।
খুবি টানটান একটা গল্প।


হাত বাড়িয়ে ছুঁই না তোকে, মন বাড়িয়ে ছুঁই,

দুইকে আমি এক করি না এক কে করি দুই৷

থার্ড আই এর ছবি

ওরে বাপরে..!! বড় গল্প দেখে ভাবলাম রাতে পড়বো, এখন দেখি ভয় লাগছে....! গল্পের প্লট দারুণ,অসাধারণ লিখেছেন। তবে আপনার রাজনৈতিক কলামের চেয়ে গল্পতো আরো বেশী প্রানঞ্জল। আর পড়বার ইচ্ছা রইলো।
---------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

-------------------------------
স্বপ্নকে ছুঁতে চাই সৃষ্টির উল্লাসে

ধূসর মানব [অতিথি] এর ছবি

সর্ম্পূন অন্য রকম অনুভুতি হল পড়ার সময়। ভয়, ঘৃনা, সবমিলিয়ে অন্যধারার অনুভুতি।
একটানে পড়ে ফেলেছি। অসাধারন।

মাসুদা ভাট্টি এর ছবি

ধন্যবাদ সবাইকে, পড়ার জন্য।

অজগর ছোবল দেয় না ঠিকই কিন্তু শিকারকে পেচিয়ে ধরার আগে শিকারের শরীর কামড়ে ধরে এবং দাঁত থেকে নিঃসৃত এক ধরনের 'বিষ' জাতীয় তরলে শিকারকে অচল করে দিতে চায়। এর অর্থ হচ্ছে অজগর প্রথম আঘাতটি হানে মুখ দিয়েই, যা সর্পকুলের স্বভাবজাত।
যাহোক, গল্পটি ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। শুভেচ্ছা সবাইকে।

বজলুর রহমান এর ছবি

ভয়জাগানো গল্প, যদিও পরিনতিটা প্রত্যাশিত ছিল।

তিন সপ্তাহ আগে ভেনেজুয়েলায় এক বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রকে এক অজগর মেরে গলাধঃকরণ করার চেষ্টা করার সময় ধরা পড়ে। ছেলেটি রাতে চিড়িয়াখানায় কাজ করার সময় নিয়ম ভেঙ্গে একা একা সাপটিকে বাগে আনার চেষ্টা করছিল। এ গল্প হয়তো সেই ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত।

উইকি অবশ্য বলে যে বাংলাদেশের অজগর মানুষ খায় না। অজগর মানুষকে হিমুর বর্ণিত পদ্ধতিতে হত্যা করতে পারলেও মাথার পরে ঘাড়ে আটকে যায়।

এ গল্পের জুৎসই রাজনৈতিক ব্যাখ্যাও সম্ভব।

জুলিয়ান সিদ্দিকী এর ছবি

বেশ লাগলো। তবে পড়তে পড়তে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের কথাও মনে পড়ছিলো।
____________________________________
ব্যাকুল প্রত্যাশা উর্ধমুখী; হয়তো বা কেটে যাবে মেঘ।
দূর হবে শকুনের ছাঁয়া। কাটাবে আঁধার আমাদের ঘোলা চোখ
আলোকের উদ্ভাসনে; হবে পুন: পল্লবীত বিশুষ্ক বৃক্ষের ডাল।

___________________________
লাইগ্যা থাকিস, ছাড়িস না!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।