মরুযাত্রা ১০ম পর্ব : আসওয়ানের পথে কল্পনার রথে

মন মাঝি এর ছবি
লিখেছেন মন মাঝি [অতিথি] (তারিখ: বিষ্যুদ, ০৮/০৩/২০১২ - ২:২৯অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

“I soon realized that no journey carries one far unless, as it extends into the world around us, it goes an equal distance into the world within.” Lillian Smith

“All journeys have secret destinations of which the traveler is unaware.” Martin Buber


" প্রতিটি নতুন শহরে হাজির হওয়ার পর মুসাফির আবারও নিজের এমন এক অতীত খুঁজে পায় যা তার ধারণারও বাইরে ছিলঃ সে এখন আর যা নয় বা যা আর তার মাঝে নেই তার বিস্মৃতপ্রায়-অচেনাসুদূরতা তার জন্য এক সুদূর, অচেনা দেশে অপেক্ষা করে থাকে।

মার্কো একটি নতুন শহরে ঢুকেন; চোখে পড়ে শহরের মাঝে কোন চত্বরে কারও একটি জীবন বা মুহূর্ত যাপন যা তারও হতে পারত; ঐ লোকটির জায়গায় তিনি নিজেও থাকতে পারতেন আজ, কালের স্রোতে তিনি যদি থেমে যেতেন অনেকদিন আগে; অথবা, অনেকদিন আগে, যদি সময়ের চৌমাথায় তিনি একটি রাস্তায় যাওয়ার বদলে উল্টোটি দিয়ে যেতেন আর তারপর দীর্ঘকাল ঘোরাঘুরি শেষে চত্বরের ঐ লোকটির জায়গায় পৌঁছে যেতেন। কিন্তু এতদিনে, নিজের ঐ বাস্তব অথবা অনুমিত অতীত থেকে, তিনি বহিষ্কৃত; তাঁর থামার উপায় নেই; তাঁকে পরবর্তী শহরে যেতেই হবে, যেখানে তাঁর আরেকটি অতীত তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে আছে, অথবা এমন কিছু যা হয়তো তাঁর একটা সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ছিল কিন্তু এখন অন্য কারও বর্তমান হয়ে গেছে। অনর্জিত ভবিষ্যৎ কেবলই অতীতের প্রশাখামাত্র : মৃত প্রশাখা।

"অতীতকে পূণর্যাপন করার জন্যেই কি আপনার ভ্রমন?" এই পর্যায়ে (কুবলাই) খানের প্রশ্ন ছিল, যে প্রশ্নটা কিনা এভাবেও করা যেতঃ "ভবিষ্যতকে পুনরুদ্ধারের জন্যে তাহলে আপনার ভ্রমন? "
[ইটালো ক্যালভিনোর 'ইন্‌ভিজিবল সিটিজ' থেকে]

আমারও এখন মনে হয় যে চেনা বন্দর থেকে রওনা দিয়েছিলাম একদিন, নিজের অনুমিত বা বাস্তব অতীত আর ভিন্ন বর্তমানে পর্যবসিত সম্ভাব্য ভবিষ্যতের ঘাটে ঘাটে ভিড়তে ভিড়তে কবে যেন সেই অতি চেনা বন্দর কেমন অচেনা হয়ে গেছে এরই মধ্যে। বদলে যাচ্ছে ভীষণ। আর তাই এই নতুন অচেনা বন্দর বা শহরগুলিতে আমারই যেন অনর্জিত সম্ভাব্য ভবিষ্যতগুলি আর তাদের অতীত আমার সেই বাস্তব অথবা অনুমিত আদি বন্দরকে বদলে দিতে দিতে ভবিষ্যতের পাথেয় হয়ে অপেক্ষা করে আছে। এটা নতুন কোন ভবিষ্যতের পানে নাকি কোন পরিবর্তনশীল অতীতমুখী যাত্রা এখনো পরিষ্কার না।

অন্য ভাবেও হয়তো বলা যায়। দেশ ভ্রমণ অনেকটা সমান্তরাল-বিশ্বে ছিটকে পড়ার মত। ম্যাক্রো-পর্যায়ে বাহ্যিক পার্থক্য থাকলেও মাইক্রো-পর্যায়ে... কোথায় যেন কিছু আশ্চর্য মৌলিক সাদৃশ্য চোখে পড়ে যায়। এ যেন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির একটা সমান্তরাল জগতে নিজেরই অনেকগুলি ভিন্ন চেহারার সম্ভাব্য ভিন্ন ভিন্ন সংস্করণের সাথে দেখা হয়ে যাওয়া - সমান্তরাল-পরিব্রাজকের চোখ দিয়ে। আর প্রাচীণ কোন সভ্যতার দেশ বা নিদর্শন দেখতে গেলে (বিশেষ করে এই তরুন বাংলাদেশ থেকে) সময়-ভ্রমণটাও হয়ে যায় সমান্তরালের সাথে সাথে। তখন নিজের সাথে নিজেরই যেন মোলাকাত হয়ে যায় কালের এস্ক্যালেটরে পা দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন পটভূমিতে। কে বলেছে সময়-ভ্রমণ বা সমান্তরাল-বিশ্বে মানুষ ভ্রমণ করতে পারে না? আমার তো মনে হয় আমরা হাজার বছর ধরেই করে আসছি সেটা। এই পৃথিবীতেই!

মার্সেল প্রুস্ত লিখেছিলেন, "প্রকৃত দেশভ্রমণ মানে নতুন নতুন প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখা নয়, বরং নতুন একটা দৃষ্টি অর্জন করাঃ ব্রহ্মাণ্ডকে অন্যের চোখ দিয়ে দেখতে পারা - শত শত অন্য মানুষের চোখে - শত শত ব্রহ্মাণ্ডকে দেখতে পারা যা তারা প্রত্যেকে আলাদা ভাবে দেখতে পায়।"

জানিনা সময় ও ভূগোলের কোন অজানা সঙ্গমে, কোন সমান্তরাল জগতের এক অচেনা কালবিন্দুতে বা অচেনা এক কালপর্বের সমান্তরাল বিন্দুতে পৌঁছে নিজেকে আবিষ্কার করছি এখন। কিন্তু দু'টিই কমবেশি আছে মনে হয় - তাও আবার দুই মাত্রায়। একটা বিন্দুর বয়স কমসে কম ৪-৫ হাজার বছর, আর আরেকটা ঠিক কোথায় এখনো স্পষ্ট ধরতে পারিনি যথেষ্ট মেলামেশার অভাবে।

এই দিগন্তপ্লাবী মরুবালুঝড়-সংকুল শহরগুলির প্রায় অতিপার্থিব মরুবিচ্ছিন্নতা। এর মধ্যযুগীয় প্যাঁচানো, সরু-গলিময় স্মৃতিভারাক্রান্ত প্রাচীণ মহল্লাগুলি আর তাদের নোনাধরা-স্বপ্নের স্মৃতি থেকে উঠে আসা প্রায় পরাবাস্তব বাড়িঘর। এর উপসড়কগুলির দু'পাশে সারি দেয়া কাবাব-কোফ্‌তা-কোশারি-টাগ্‌ন থেকে শুরু করে হাজারো পদের অচেনা খাবারের মনভোলানো সুবাস ভেসে আসা দোকানগুলি। নানা রকম অপরিচিত স্মারক, হস্তশিল্প, আর মনোহারির প্রাচীণ বাজার বা সূক। এর দৈনন্দিন আজিব শীষা/কফি শপ, আর সেসবের ভেতর জোব্বা-আবায়া ঢাকা ভিন্‌দর্শন অর্ধপ্রাচীণ মানুষ। এর টাঙা আর টাঙাওয়ালা। এরই মাঝে আবার হঠাৎ পথচলতি আজব ইন্টারনেট ক্যাফে, ভূঁইফোড় হোটেল আর বার। শহরের একপাশ দিয়ে স্মরণাতীত কাল থেকে কুলকুল বয়ে চলেছে নীলে নীল নীলনদ। তার বুকে এখনো পাল তুলে ভাসে সেই পাঁচ হাজার বছর আগের ফেলুক্কা। আবার তার মধ্যে কখনো-সখনো হঠাৎ করেই দড়াম করে ঢুকে পড়া আধুনিক টুরিস্ট-লঞ্চের উৎপাতও আছে।

এ সমস্ত কিছুই আবার অনেকখানি চাপা পড়ে গেছে সভ্যতার ঊষালগ্নে মরীচিকাময় দূরবর্তীতায় মরুবালু ফুঁড়ে জেগে উঠা মূর্তিমান দানবের মত বিশাল সব পাথুরে মন্দির, মূর্তি, সিংহমানব, ওবেলিস্ক, ভূঃগর্ভস্থ মৃতনগরী, প্রাচীণতম মীথ-ইতিহাস আর সেসবের বর্ণনাসহ দেয়ালচিত্র আর নানা কিছুর নীচে। ভূগোল ও ইতিহাসের অচেনা এক সঙ্গমের সাথে এখানে আধুনিকের সেতু গড়তে চাইছে যেন আরেকটি অর্ধচেনা সঙ্গম, অচেনা অকল্প্যপ্রাচীণের সাথে আধুনিকের মধ্যস্থতা করছে এক প্রায় অর্ধচেনা-মধ্যপ্রাচীণ। প্রাচীণতরকে ঘিরেই সে আবর্তিত, মৃতকে ঘিরে জীবন্ত, অতীতকে ঘিরে বর্তমান। তারপরও সব মিলিয়ে দারুন জীবন্ত।

অদ্ভূত, অভিনব, এগজটিক এক কম্বিনেশন। পরতে পরতে তার অভিনবত্ব আর চেনা-অচেনার আলো-আঁধারি। কিন্তু আসলেই কি ততটা অভিনব বা অচেনা - নাকি সবই আমার অতীতের মৃত প্রশাখা, একই জায়গায় সমান্তরাল অতীত আর কালভিনোর ভাষায় অনর্জিত সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ ? সময়ের এস্ক্যালেটরে দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সময়ের পটভূমিতে নিজেরই অনেকগুলি সম্ভাব্য সংস্করণের দিকে তাকিয়ে আছি ? সুপ্রাচীণ মিশরীয় দেয়ালচিত্রে সভ্যতার নিদ্রাভঙ্গ-লগ্নের ঐ উদোম দেহের কৌপিন পরা মানুষগুলির জায়গায় কি এক সময় আমিই ছিলাম না, কিম্বা মুকুট আর রাজদণ্ড হাতে কিম্ভূত রাজার বেশে ? মন্দিরের ভিতর সারি দিয়ে দাঁড় করানো বা পর্বতের গা কুঁদে তৈরি বিশাল দানবীয় সব মূর্তিগুলি কি আমারই মেগালোম্যানিয়া, আত্নবিজ্ঞাপন আর অমরত্ব-বাসনার অভ্রভেদী মিনার হয়ে দাঁড়িয়ে আছে ? কিম্বা তার নীচে ভীতিভক্তিবিহবল পূজারীরা, ওরা কারা? আমিই না তো? বাদশাহি উপত্যকার মাটির নীচে যক্ষপূরীতে অপরিমেয় মণিমুক্তাকাঞ্চণের নীচে কি আমারই মমি চাপা পড়ে আছে এক অস্তিত্ত্বহীণ পরলোক-বাসনায়? কিম্বা রাজার লোভ, অহম, দর্প আর অমরত্বের বাসনা চরিতার্থ করতে প্রাণপাত করা প্রাচীণ শ্রমিকপল্লীতে পাওয়া প্রত্নচিহ্ণে, বা ছবির মধ্যে ঐ ভারবাহী শ্রমিক ও সৈনিকগুলির প্রাগৈতিহাসিক জীবনসংগ্রাম কি আসলে আমারই জীবনচিত্র?

কেমন ছিল সময়ের পাথুরে হৃদয়ে ফসিল হয়ে যাওয়া এই মূর্তি, মন্দির, মমি আর ছবির আড়ালে সেই রক্তমাংসের আদি মানুষগুলির একান্ত মানবীয় জীবন? ছবির মতই অচেনা আর কিম্ভূত, নাকি আমারই মত তাদেরও নাড়িতে আর শোনিতপ্রবাহে স্পন্দিত হত সেই একই আশা-আকাঙ্খা-ভয়ভীতি-আনন্দ-বেদনা-লোভলালসা আর অনুরাগবিরাগ? তাদেরও কি ছিল ছবির ঐ মীথ-দেবদেবীময় একমাত্রিক অদ্ভূত জীবন ছেড়ে সচল তাসনীমের মত নিজস্ব দারুচিনি-দ্বীপময় একান্ত আপন "স্মৃতির শহর" ? আমারই মত তারাও বা তাদের মত আমিও কি সমকালীন ও পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা আর সভ্যতার সীমাবদ্ধতার নিগড়ে নিজেদের অজান্তেই সীমাবদ্ধ নই? আবার সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করেও কোনভাবে সম্পর্কিত? মিল ও তফাৎ কতটুকু?

কোন নিঃসংশয় উত্তর পাইনি। তবে প্রাচীণ পাথরের বুকে ইতিহাসের ছবি থেকে চোখ ফিরিয়ে আশেপাশের জীবন্ত বাস্তবের দিকে তাকাতেও সেই একই প্রশ্ন জাগে মনে। এটাও কম অচেনা আর এগ্‌জটিক নয়। তারপরও, শুধু ঢাকা নয়, এখানেও দেখি অন্য মানুষের অন্যরকম "স্মৃতির শহর" - একটি নয়, অনেকগুলি - কালের পরতে পরতে, সময়ের গলিতে গলিতে, অনুভূতির রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিরন্তর স্রোতশীল।

শীষার নল হাতে কফিশপে বসে অনন্ত ব্যাকগ্যামনে মত্ত পাগড়ি আর জোব্বায় ঢাকা প্রবীণের বলিরেখাবহুল মুখে, টুরিস্ট স্পটে টাউট মধ্যমানবের ধূর্ত চোখে, নীলের ফেলুক্কায় বালক মাঝির উদাস চেহারায় বা হিজাব-সানগ্লাস-কামিজ-জিন্স-ভ্যানিটি ব্যাগ পরিহিতা তরুণী গাইডের বিদেশী ট্যুরিস্টের দূর্ব্যবহারে কান্নাচাপা ছলছল চোখের জীবনসংগ্রামের মধ্যে কি দেখতে পাইনা কালভিনোর পোলোর দেখা সেই বিদেশী চত্বরের মানুষটিকে ? কিম্বা সময়ের এস্ক্যালেটরে কোন সমান্তরাল বিশ্বে আমারই কোন অতীতের প্রশাখা বা অনর্জিত ভবিষ্যৎ ?

যাজ্ঞে।

------

এরপর ঐতিহাসিক নগরী লুক্সোর থেকে প্রাচীণ মিশরের দক্ষিণ প্রান্তের সীমান্ত শহর আসওয়ানে পৌঁছে গেলাম। তবে সে গল্প আরেক দিনের জন্য তোলা রইল। হাসি



ছবিসূত্রঃ ইন্টারনেট।



মন্তব্য

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি
মন মাঝি এর ছবি

আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

তারেক অণু এর ছবি
প্রৌঢ় ভাবনা এর ছবি

কিম্বা সময়ের এস্ক্যালেটরে কোন সমান্তরাল বিশ্বে আমারই কোন অতীতের প্রশাখা বা অনর্জিত ভবিষ্যৎ ?

এবারের লেখাটি, সত্যিই বুঝেছি।

মন মাঝি এর ছবি

হাসি আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

সত্যপীর এর ছবি

আপনার আপনমনে গল্প করে যাবার ভঙ্গীটি অসম্ভব চমৎকার। পাঁচতারা।

..................................................................
#Banshibir.

মন মাঝি এর ছবি

আপনমনের স্বগতোক্তি পরমনে কতটুকু বোধগম্য হল, এক্ষেত্রে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ বটে। পাব্লিক ফোরামে প্রকাশিত উক্তির সেরকম একটা দায় আছে বলেই জানি। সেনিয়েই একটু সংকুচিত/চিন্তিত আছি। আপনাকে আপনারে অসংখ্য -ধইন্যাপাতা-

****************************************

প্রখর-রোদ্দুর এর ছবি

উত্তম জাঝা!

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।