যুদ্ধদিনের কাহিনী - ১

মুশফিকা মুমু এর ছবি
লিখেছেন মুশফিকা মুমু (তারিখ: শুক্র, ২৭/০৩/২০০৯ - ৬:৪০অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সময়কার কাহিনী আব্বু আম্মুর কাছে অনেক শুনেছি। শুনেছি পরিচিত অনেক আন্কেল আন্টিদের কাছে। কত রকমের কাহিনী শুনেছি কিন্তু যুদ্ধের সময় দেশের সাধারন মানুষ যে কত কষ্ট করেছে তা এমন স্মৃতিচারণ, নাটক, সিনেমা আর বই পড়ে শুধুমাত্র আন্দাজ করতে পারি, কল্পনা করতে পারি, যদিও পাকিস্তানি আর্মির নির্মম অত্যাচার আমার কল্পনারও বাইরে। এসব কাহিনী শুনে কিছু কিছু মানুষের ওপর প্রচন্ড রকম শ্রদ্ধা হয়, মনেহয় মানুষ আসলেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জীব। আবার একই ঘটনার কিছু মানুষের ওপর আর পাকিস্তানি আর্মির কাজ শুনে মনেহয় মানুষের চেয়ে নির্মম,খারাপ জীব হতেই পারেনা।

যখন ঠিক করলাম ২৫শে মার্চ হিসেবে একটা কাহিনী লিখব তখন খাতা কলম নিয়ে বসে বললাম আব্বু ঐ কাহিনীটা আবার বলোতো। আব্বু অবাক হয়ে বলে খাতা কলম কেনো, তখন বললাম এই কাহিনীটা আমি আমার ব্লগে লিখে রাখব, যেখানে অনেকে পড়তে পারবে, জানতে পারবে। আব্বুর কাছে বেশ কয়েকবার শুনলেও, গল্পগুলো প্রতিবারই আব্বু এমন ভাবে বলে যেন আমাকে প্রথমবারের মত শোনাচ্ছে। জানি আব্বুর মত ফিলিংস দিয়ে বলতে/লিখতে পারবোনা, হয়তো অনেক কিছু ডিটেইলস বাদও পরে যাবে তবুও চেষ্টা করবো আমার যতটুকু সম্ভব ভাল করে লেখার।

প্রথম পর্ব
১৯৭১ সালের জুলাই মাস। প্রায় একমাস আগে থেকে সব ঠিক করা ছিল যে আব্বু আর পাশের বাড়ির আব্বুর এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু তোজাম চাচা, এলাকার আরো কিছু ছেলেরা মিলে গোপনে কবে কিভাবে যুদ্ধে যাবে। প্ল্যান হল বগুড়ার শারিয়াকান্দি থানা থেকে ৫কি.মি. উত্তরে যমুনা নদীর একটা চর ছিল, ওখান থেকে দুটো পাটের বড় বড় নৌকা ভোর আযানের পর পর সবাইকে নিয়ে রওনা দেবে। গন্তব্য আসামের মাইনকার চর। ওখানে গনি সাহেব নামের এক লোক সবাইকে রিসিভ করে সবার যুদ্ধের ট্রেনিং এ যাওয়ার ব্যবস্থা করবে।

তো যাওয়ার দিন রাত ২টার দিকে আব্বু আর তোজাম চাচা লুকিয়ে চুপিচুপি বাড়ি থেকে বের হল। ৩টার দিকে হাট করমজা নামের এক জায়গায় আরো ২০-২৫জন ছেলেদের সাথে মিট করে একসাথে পায়ে হেটে রওনা দিল যমুনা নদীর ঐ চরের উদ্দেশে। প্রায় ১০-১৫কি.মি হেটে নদীর তীরে সবাই এসে পৌছাল। এসে দেখে ওখানে আরো অনেক ছেলেরা এসেছে, বয়স ১৫ থেকে শুরু করে ৩০ এর মধ্যে, সবাই মিলে প্রায় ৭৩-৭৪ জন ছেলে হবে। আব্বুর বয়স ছিল ১৮ আর পকেটে ছিল মাত্র ২টাকা। তোজাম চাচার কাছে ছিল ৫০টাকা, উনিই ছিল আব্বুর ভরসা।

সিনিয়র ছেলেরা সবার নাম লিখে নিল আর কে কোন নৌকায় উঠবে ঠিক করে দিল। অর্ধেক এক নৌকায় বাকি অর্ধেক আরেক নৌকায়। ঐ চরে নৌকা দুটোর পাশেই কিছু কুরে ঘর ছিল, ঘর গুলোর সামনে শশা আর ঝিংগার বাগান ছিল। অনেক ছেলেরা ক্ষুধার জন্য শশা আর কাচা ঝিাংয়াই খেয়ে নিচ্ছিল। কুরে ঘরের লোকজন শব্দ পেয়েও এসে দেখেও কিছু বলেনি।

যাইহোক মাঝিরা এর আগেও এভাবে অনেক ছেলেদের আসামে নিয়ে গিয়েছিল। তাই সবাইকে বলল রংপুরের ফুলছরির ঘাট সন্ধার আগে পার না হতে পারলে বিপদ হতে পারে। ওখানে আর্মির ক্যাম্প আছে। যদি বিপদ হয় তবে প্ল্যান ছিল মাঝিরা গ্রানেড দিয়ে নৌকা উড়িয়ে দেবে, কারণ আর্মির হাতে ধরা পরে টর্চার্ড হয়ে মৃত্যুর চেয়ে এভাবে অনেক ভাল। আর এভাবে সাতার দিয়ে অনেকে বেঁচেও যেতে পারে। বিপদের জন্য মাঝিরা একটা চুলা, কিছু চাল, ডাল আর কয়েকটা পাতিলও সাথে নিল। না খাওয়ার জন্য নয়।

তারপর ফজরের আযানের পরপরই পাট ভর্তি নৌকাদুটো রওনা দিল। নৌকার ওপরে ছিল অনেক অনেক পাট আর নৌকার ভিতর দুই তাকে গাদাগাদি করে ৩৫-৩৬ জন ছেলেদের লুকিয়ে রাখা হল। প্রথম নৌকাটি ছাড়ার ১০ মিনিট পর দ্বিতীয় নৌকাটি ছারল। আব্বু যে নৌকায় ছিল সেটা ছিল দ্বিতীয় নৌকা।

রংপুরের ফুলছরি ঘাটের দুপাশেই ছিল আর্মির ক্যাম্প। মাইনকার চরে যাওয়ার একমাত্র পথ এর মাঝ দিয়ে। মাঝিরা বলল সন্ধায় এ জায়গা পার হওয়া খুব বিপদজনক কারণ আর্মিরা তখন স্পিডবোট নিয়ে সার্চ করে। প্রথম নৌকাটি সন্ধ্যার আগেই পার হয়ে গেল কিন্তু দ্বিতীয় নৌকাটি ওখানে পৌছালো মাগরেবের আযানের আগে আগে। তাই বেলা ডুবে যাওয়ায় ঐ জায়গার কিছু দুরে মাঝি নৌকা থামালো আর বলল এখানে আপনারা সবাই নামায আর যার যা করার করে নিন। কিন্তু ঘাটে এত ছেলে দেখে কিছু মানুষ ছুটে আসল। ওরা এসে বুঝতে পারল আর বলল এখন ওদিক দিয়ে যেয়েননা। এখন গেলে ওরা অবশ্যই আটকাবে। এর চেয়ে বরং আপনারা সবাই আমাদের বাসায় রাতটা থেকে যান। আবার কাল সকালে রওনা দিয়েন। অনেক ছেলেরা ওদের কথা শুনে ভয় পেয়ে থাকতে চাইল, কিন্তু মাঝিরা বলল, এসব কাজে কাউকে বিশ্বাস করবেন না, এখানে থাকলে কি হবে বলা যায় না। তখন যারা ভয় পেয়েছিল তাদের বুঝিয়ে আবার সবাই নৌকা বোঝাই হয়ে রওনা দিল।

[চলবে]

****************************************
লেখা বেশি বড় হয়ে যাচ্ছে আর লিখতেও দেরী হচ্ছে। এখন অর্ধেক টুকু করে পোস্ট করলাম


মন্তব্য

বাউলিআনা [অতিথি] এর ছবি

চলুক..
পরের পর্ব দয়া করে কটু তাড়াতাড়ি।

রায়হান আবীর এর ছবি

আংকেল কে স্যালুট। স্যালুট লক্ষ মুক্তিযোদ্ধাকে ...

ধন্যবাদ শেয়ার করার জন্য।

ভূঁতের বাচ্চা এর ছবি

মুক্তিযুদ্ধের গল্পগুলোর মধ্যে যেন একটা অদৃশ্য শক্তি কাজ করে। অনেক অনেকবার পড়লেও এসব গল্পগুলো কখনোই পুরানো হয়ে যায়না। আবারো পড়তে ইচ্ছে করে। মুক্তিযুদ্ধের কাহিনী নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোও তাই। দুঃখের কথা হল এমন অনেক মুক্তিযুদ্ধের গল্প হারিয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। যেগুলোর সংরক্ষণ দরকার। মুমুর এই উদ্যোগকে তাই সাধুবাদ জানাই। মুমুর মতন অন্য কারো আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের গল্প জানা থাকলে আমাদের শোনাবেন আশা রাখি। পড়তে ভাল লাগছে মুমু। সামনের পর্বের অপেক্ষায় থাকলাম।
----------------------------------------

--------------------------------------------------------

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

মুমু... বেশি চা খায়েন না... কালো হয়ে যাবেন... তাড়াতাড়ি চা শেষ করে পরের কিস্তি ছাইড়েন...
______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

মুশফিকা মুমু এর ছবি

হাহাহাহা অসুবিধা নাই আমি চা খুব কম খাই খাইছে , কালকে বাকিটুকু পোস্ট করে দিব

------------------------------
পুষ্পবনে পুষ্প নাহি আছে অন্তরে ‍‍

হোসেন [অতিথি] এর ছবি

স্যালুট সেই সাহসী মুক্তিযোদ্ধাকে যার সাহসের ফলাফলেই পেয়েছি আমাদের পরিচয়।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

যত বড় হোক, যত সময় লাগুক, বিস্তারিত লিখুন। এগুলোই সত্য ইতিহাস। এগুলো লিপিবদ্ধ থাকা জরুরী। আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তান, বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক। এটি আপনার দ্বায়িত্বও বটে।

এই প্রয়াসের জন্য আপনাকে স্যালুট। প্রতিদিন স্যালুট আপনার বাবা আর তার সহযোদ্ধাদের।



তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

নীল ভ্রমর [অতিথি] এর ছবি

খুউব ভাল লাগছিল পড়তে। তাড়াতাড়ি বাকিটুকু লিখুন। অপেক্ষায় আছি।

অনিন্দিতা এর ছবি

চমৎকার হচ্ছে মুমু।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

অধীর আগ্রহে বসে আছি পরের পর্বের জন্য।

রেনেট এর ছবি

আজকের পাঁচ তারা মুমুর বাবা আর তার সঙ্গীদের জন্য চলুক
---------------------------------------------------------------------------
If your father is a poor man, it's not your fault ; but If your father-in-Law is a poor man, it's definitely your fault.

---------------------------------------------------------------------------
একা একা লাগে

সংসারে এক সন্ন্যাসী এর ছবি

দুর্দান্ত উদ্যোগ, মুমু। নামকরণটিও খুব সুন্দর হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধাদের একেবারে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গল্পগুলো লিপিবদ্ধ হয়ে থাক। প্রয়োজনে আপনার পিতার কথন অডিওতে ধারণ করে রাখুন এবং সম্ভব হলে শেয়ার করুন সকলের সঙ্গে।

আপনার পিতা ও তাঁর সহযোদ্ধাদের প্রতি আমার সার্বক্ষণিক মুগ্ধতা আর শ্রদ্ধা।

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
যৌনদুর্বলতায় ভুগছি দীর্ঘকাল। দুর্বল হয়ে পড়ি রূপময়ী নারী দেখলেই...

~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~
টাকা দিয়ে যা কেনা যায় না, তার পেছনেই সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করতে হয় কেনু, কেনু, কেনু? চিন্তিত

সুলতানা পারভীন শিমুল এর ছবি

ভালো লাগছে, মুমু।
যাই, ২য় পর্বটা পড়ে ফেলি।

...........................

সংশোধনহীন স্বপ্ন দেখার স্বপ্ন দেখি একদিন

...........................

একটি নিমেষ ধরতে চেয়ে আমার এমন কাঙালপনা

রানা মেহের এর ছবি

সিরিজটা চালু থাক
-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

-----------------------------------
আমার মাঝে এক মানবীর ধবল বসবাস
আমার সাথেই সেই মানবীর তুমুল সহবাস

তানবীরা এর ছবি

দেরীতে পড়লাম মুমু

তানবীরা
---------------------------------------------------------
চাই না কিছুই কিন্তু পেলে ভালো লাগে

*******************************************
পদে পদে ভুলভ্রান্তি অথচ জীবন তারচেয়ে বড় ঢের ঢের বড়

অতন্দ্র প্রহরী এর ছবি

দুর্দান্ত লেখা, মুমু।
২য় পর্বের মন্তব্যেই বলসি, তাই আর নতুন করে বললাম না। সংক্ষেপে বলি, সিরিজ চলুক...

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।