একটি মানুষ অথবা নীল পৃথিবীর গল্প

মূর্তালা রামাত এর ছবি
লিখেছেন মূর্তালা রামাত (তারিখ: শনি, ১৭/১১/২০১২ - ৭:৩৪পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

অনেক রাতে ঘুম ভেঙ্গে গেল আফসারুল আমিনের। আসলে তিনি ঘুমানইনি। ঘুমের ভান করে পড়েছিলেন। মাঝখানে একটু তন্দ্রামত এসেছিল। তারপর যাকে তাই। না ঘুমিয়ে মড়ার মত ঘুমিয়ে থাকার অভিনয় করাটা খুব কষ্টের, অস্বস্তিকরও বটে। তবুও তিনি সেটা করতে বাধ্য হয়েছিলেন ফিরোজার কারণে। ফিরোজা তার স্ত্রী। তিনি বারবার এপাশ ওপাশ করায় সে কছিুতেই ঘুমাতে পারছিল না। শেষমেষ বিরক্ত হয়ে সে বলেই ফেলেছিল, “দিন শেষে শান্তিমত একটু ঘুমুতেও দেবে না নাকী!”।
অথচ তিনি ভেবেছিলেন রাতে শুয়ে শুয়ে ঠাণ্ডা মাথায় ফিরোজাকে সেই ভয়ানক কথাটি বলবেন।

চেহারা দেখেই ফিরোজা কিছু আঁচ করতে পারবে বলে তার ধারণা ছিল। কীসের কী! তিনি যে কিছু বলতে চান ফিরোজা এটা বুঝতেই পারলো না! অফিস থেকে ফেরার পর চিন্তামগ্ন মুখ, কোনরকম দুটো মুখে দিয়েই শুয়ে পড়া, বিছানায় শুয়ে শুয়ে উসখুস করা- কোন কিছুই ফিরোজার কাছে কোন অর্থ বহন করলো না! মাঝখানে সে অবশ্য একবার টিপ্পনী কেটে বলেছে,“জোর করে কবি সাজবার কোন দরকার নেই, বুঝলে। ওসব ভড়ং অনেক হয়েছে। এখন একটু সংসারের দিকে মনোযোগী হও।” ভাবখানা এমন যেন তিনি সংসারের জন্য কিছুই করেননি!

আফসারুল আমিন ঘাড় ঘুরিয়ে দেখেন। ফিরোজা কেমন পাশ ফিরে নিশ্চিন্তে একটা লতার মত এলিয়ে আছে। তার হিংসা হয়। ইচ্ছে হয় ধাক্কা দিয়ে লতাটাকে সোজা করে তার মুখোমুখি করে জিজ্ঞাসা করেন, ফিরোজা সংসারের জন্য আমি কি কিছুই করিনি? অনেক কষ্টে ইচ্ছেটাকে তেতো বড়ি বানিয়ে গিলে ফেলেন তিনি। সোজা হয়ে সামনে তাকান। মাথার উপর সাদা সিলিংয়ে একটা বৃত্ত এঁকে বন বন করে ফ্যানটা ঘুরছে। বৃত্তের একটি প্রান্ত ধরে তিনি ফেলে আসা পথে রওনা দেন। বলা নেই কওয়া নেই হুট করেই ঘুমের ভেতর একদিন বাবা মারা গেলেন। কবি কবি চেহারার কাধেতে ঝোলানো ব্যাগ আফসারুল আমিনের সংগ্রাম শুরু হলো। মা আর দুই ভাই বোনের সংসার চালাতে দাঁতে দাঁত চেপে তিনি পরিশ্রম করে গেলেন। হাত দিয়ে জোয়াল টানার মত করে তিল তিল করে তিনি একটু একটু এগুতে লাগলেন। বাবার রেখে যাওয়া ঋণ শোধ করলেন, আরিফের লেখাপড়ার খরচ চালালেন, মিতুর বিয়ে দিলেন, মাকে শহরে নিয়ে এলেন। তারপর হঠাৎ একদিন খেয়াল হলো নিজেরইতো থিতু হওয়া হয়নি! অবশেষে পড়ন্ত বেলায় খালাতো বোন ফিরোজার সাথে বিয়ে। ফিরোজা তাকে ছোটবেলা থেকেই পছন্দ করতো, তিনিও। তার কবিতাগুলো যেন জানালা যার ভেতর শালিক পাখির মত অনায়াসে ঢুকে পড়তো ফিরোজা। সেই শালিক নিয়ে তিনি এককালে কতো কবিতা লিখেছেন, গুনে শেষ করা যাবে না। ফিরোজা কি এখন সেখান থেকে দু’একটা লাল হলুদ পালক এনে তাকে দেখাতে পারবে? পারবে না, আফসারুল আমিন নিজের মনেই মাথা নাড়েন। তার বৃত্তাকার পথটি ফ্যানের ধারালো ব্লেডের সাথে ঘষা খেয়ে কোথায় যেন মুখ থুবড়ে পড়ে।

তার ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। বিয়ের পর তার কবিতা নামের হারানো মোহর খুঁজতে ফিরোজা কোন আগ্রহই দেখালো না। বরঞ্চ সে হয়ে উঠলো একজন চিত্রকর। আফসারুল আমিনের উপর জালের পর জাল এঁকে সে সংসার ফুটিয়ে তুললো। আর তিনিও কেমন যেন মোহে পড়লেন। সংসারে পেরেকের মত গেঁথে গেলেন। ছেলেমেয়ের বাবা হলেন। তাদের নানা ইচ্ছা, এটা ওটার চাহিদা পূরণে চাকা হয়ে গড়িয়ে চললেন অবিরাম। মাঝে মাঝে যে তার কবিতা লিখতে ইচ্ছা হয় না, তা নয়। হঠাৎ হঠাৎই তার কল্পনায় শব্দ, আবেগ, ছন্দের অশরীরীরা নেচে ওঠে। মনে হয়, তার মনের উপর কে যেন ঝুপ করে ডানা গুটিয়ে বসলো। সেই ভারে তিনি থম মেরে যান, জগতের বাইরে কোথায় যেন তার দৃষ্টি মেঘ হয়ে বৃষ্টিতে গুড়ো গুড়ো হয়।

প্রথম প্রথম ফিরোজা এ নিয়ে খুব চিন্তিত ছিল। জোর করে তাকে সে দু’একবার ডাক্তারের কাছেও নিয়ে গেছে। তাকে নিয়ে ফিরোজার এ উৎকণ্ঠা আফসারুল আমিন বেশ উপভোগ করতেন। তাকে নিয়ে ভাবার কেউ একজন অন্তত আছে এই ভাবনা তাকে স্বস্তি দিতো। নিজের মাকে কখনো তিনি তাকে নিয়ে ভাবতে দেখেননি। বরঞ্চ মা সবসময় চাইতেন ছোট দুই ভাইবোনের একটা হিল্লা হবার পর যেন আফসারুল আমিন তার নিজের কথা ভাবে। বড় ভাই হিসেবে আফসারুল তার দায়িত্ব ঠিকমতো পালন করবে কীনা এ নিয়ে মায়ের দুঃশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। তার স্বপ্নবাজ ছেলেটার তুলো তুলো ভাবুক মনটা চিরকাল তার কাছে অবহেলিতই থেকে গেছে। সেই একই অবহেলা আফসারুল আমিন পেয়েছেন তার ভাই আরিফের কাছ থেকে। ভালো একটা চাকরি পেয়ে সে এখন উপরতলার মানুষ। ভাইয়ের ছা পোষা সংসারে পা ফেলতে তার লজ্জা হয়। ছোট বোন মিতুর স্বামী ব্যবসায়ী, ছেলেমেয়েরা ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। তারপরও নিজের বিয়ে নিয়ে মিতু সুখী না। তার ধারণা আফসারুল আমিন নিজের দায়িত্ব এড়াবার জন্যই তাকে তড়িঘড়ি একজনের হাতে গছিয়ে দিয়েছেন; এর চেয়েও ভাল ঘরে তার বিয়ে হতে পারতো।

আফসারুল আমিন এসব নিয়ে আগে খুব ভাবতেন। এখন আর ভাবেন না। ফিরোজা যে তাকে নিয়ে আজকাল আর আগের মতো উৎকণ্ঠিত হয় না, সেটাতেও তিনি অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। এমনকী তার ছেলেমেয়েরা যখন তাকে বলে, “সবার বাসায় টিভি ফ্রিজ আছে, আমাদের বাসায় নেই কেন? আব্বু, তুমি কেমন আব্বু!”, তখনও তিনি বিচলিত হন না। নিজেকে তিনি একটা ডাইনিং টেবিল ভাবেন যেখানে সবাই একত্রিত হবে। খাওয়া দাওয়া করবে। হাসি ঠাট্টা গল্প গুজবের পর তরকারির ঝোলের দাগ টেবিলের নিরেট বুকের এখানে সেখানে লেগে থাকবে। এটাই স্বাভাবিক, আফসোসসের কিছু নেই। কিন্তু আজকের দিনটা অন্যরকম। আজ তিনি ধ্বসে পড়া একটা পাহাড়। গড়িয়ে পড়ছেন তো পড়ছেনই, অন্ধকার খাদ আজগরের হা নিয়ে বসে আছে। তার প্রচ- হাসফাস ঠেকে। তিনি উঠে বসেন। ফিরোজার কোন বিকার নেই। তার গাঢ় নিশ্বাস আফসারুল আমিনের থমকে যাওয়া সময়ে মৃদু টোকা দিয়ে যায়। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ান। পাশের ঘরে উঁকি দেন। সোনার কাঠি রুপোর কাঠির মতো নিতু-প্রিতুর পাশাপাশি শুয়ে আছে। কোন জড়তা নেই, যেন ওরা নিশ্চিত রাত ফুরোলেই রাজপূত্রের দেখা পাওয়া যাবে। ওদের ভাবনাহীন জীবনের স্বর্গকে পাশ কাটিয়ে তিনি আলগোছে বারন্দায় এসে দাঁড়ান। পুরো শহরটাকে অন্ধকার মুঠির ভেতর পুরে রেখেছে। কেবল কিছু মেঘ সেই মুঠি থেকে বেরিয়ে উড়ে যাচ্ছে এদিক সেদিক। তিনি হাত বাড়ান । শীতল বাতাসের আলতো স্পর্শে তার শরীরে শিরশিরে একটা অনুভূতি হাঁটাচলা করে। আপন মনেই ভয়ানক কথাটা তার ঠোটে ফস করে দেশলাইয়ের কাঠি হয়ে জ্বলে ওঠে, জানো কোম্পানি থেকে আমাকে আমাকে আজ ছাঁটাই করা হয়েছে?
কেন!
বয়স হয়ে গেছে তো। ওরা ইয়ং ছেলেপেলে চায়।
কিন্তু তুমি যে এতো বছর সার্ভিস দিলে?
সেটা মূল্যহীন।
এটাতো অমানবিক!
এটাই পৃথিবী!

পাঠশালার ঘন্টা শুনে বৃষ্টির ফোঁটারা ঝাঁক বেধে নামে। আফসারুল আমিনের নির্ঘূম চোখে তারা নীল পৃথিবীর পাঠ বুঝে নিতে থাকে।

১৬/১১/২০১২
সিডনি, অস্ট্রেলিয়া।


মন্তব্য

অতিথি লেখক এর ছবি

আফসারুল আমিনের এই জীবন আসলে বেশ পরিচিত। সবার জন্য অনেক কিছু করেও কারো জন্যই কিছু করেনি এমন অভিযোগ অনেকের কাছে শুনেছি। আফসারুলের এই জীবন চিত্র আসলেই বেদনার। সবচেয়ে ট্র্যাজিক হল যখন নিজ ঘরেও সে ক্রমশ পর হতে শুরু করে।

লেখা ভালো লেগেছে।

পাঠশালার ঘন্টা শুনে বৃষ্টির ফোঁটারা ঝাঁক বেধে নামে। আফসারুল আমিনের নির্ঘূম চোখে তারা নীল পৃথিবীর পাঠ বুঝে নিতে থাকে। চলুক

অমি_বন্যা

মূর্তালা রামাত এর ছবি

ধন্যবাদ।

মূর্তালা রামাত

পদব্রজী এর ছবি

হয়তো খুব সাধারন একটি ঘটনা, কিন্তু গল্প বলার কয়দাটা অসাধারন-----

মূর্তালা রামাত এর ছবি

উৎসাহ দেয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।

মূর্তালা রামাত

সাত্যকি এর ছবি

অনেক সুন্দর। কেন জানি চাকরি হারানোর ব্যাপারটা আগে থেকে বুঝে গেলেও ভালো লাগাটা রইল শেষ পর্যন্ত।

মূর্তালা রামাত এর ছবি

ভাল লেগেছে জেনে কৃতার্থ হলাম।

মূর্তালা রামাত

অতিথি লেখক এর ছবি

চেনা মানুষের চেনা গল্প চমৎকার গাঁথুনিতে। সত্যি ভালেঅ লেগেছে। শুভেচ্ছা রইল।

স্বয়ম

মূর্তালা রামাত এর ছবি

ধন্যবাদ।

মূর্তালা রামাত

অতিথি লেখক এর ছবি

জীবনের স্বপ্ন - স্বপ্নের জীবন - ভালো লাগলো।

-অয়ন

অগ্নির এর ছবি

ভালো লাগল গল্পটা । কষ্টও লাগল । নিঃসঙ্গতার গল্প ।

সাফিনাজ আরজু  এর ছবি

চলুক
ভালো লাগলো, কিছুটা মন খারাপও। কখনও কখনও খুব কাছের মানুষগুলোও কেন জানি খুব স্বার্থপর হয়ে যায়। মন খারাপ

নীড় সন্ধানী এর ছবি

বিয়ের আগের রোমান্টিকতা বিয়ের পরে উধাও হয়ে যাবার ব্যাপারটা নিয়ে আরো একটু বিস্তারিত পড়তে ইচ্ছে করছিল। একই মানুষ একেকটা পর্বে এসে রং বদলায় কেন? আফসারুল আমিনের অসহায়ত্ব কড়া নেড়ে দিল ভেতরে।

‍‌-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.--.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.-.
সকল লোকের মাঝে বসে, আমার নিজের মুদ্রাদোষে
আমি একা হতেছি আলাদা? আমার চোখেই শুধু ধাঁধা?

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।