তুঁতনির্ভর গুটিপোকা থেকে প্রাপ্ত ধারণারও বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যবহার সম্ভব

মুজিব মেহদী এর ছবি
লিখেছেন মুজিব মেহদী (তারিখ: বিষ্যুদ, ২১/০২/২০০৮ - ১:১১পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

লিখতে শুরু করবার প্রস্তুতিপর্ব

শুধু তো ছিঁড়বে বল, কী বাল ছিঁড়বে তুমি ছিঁড়েই দেখাও, লিখ রূঢ় অ্যান্টিক অথবা আলোকপুচ্ছ, বীরোচিত জেগেছিল আকাশতল্লাটে যেই সৌর-রহস্য, কিংবা লিখ গানাবেশ, অননুমোদিতেসু মৌসুমী ধারা, বুড্ডিস্ট চান্টস, দুপুরের বটগাছ আর তার ঝুরি, উইন্ডজুড়ে ভেসে আসা চৌরাশিয়াফুল, আমরা দেখেছি কত লালনের সুরমগ্ন ঘাটে-নেমে-জলখাওয়া সাধুসন্ত লোপ, ধানের খেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রোদেদের গলা কেটে নদীজল লাল করে দেয়া, এসব তো লিখতে পার-- কষ্টকল্পনার শিল্পক্ষতি, ভ্রমণের মধু ভ্রমণের বিষ, পুড়িয়ে-পিটিয়ে হত্যা, আমাকে আর ছোঁবে-না নির্দেশ, চাপাতির কোপ, গুলেলায়লা আতরের ঘ্রাণ, তালেবানি বিপ্লব আর গেলাসে গেলাসে উপচে ওঠা ভেট সিক্সটিনাইন, লিখ শনির আখড়া পাড়ায় আরেকটা কানসাটের জেগে ওঠা, লিখ ধর্ষিত রাজনীতি ও রাজার নীতিতে ফলা উফশী মিথ্যার দাহে দেশজুড়ে নেমে আসা মনন-কলূষ, নগরবেশ্যার উৎকট সাজ কিংবা রাজাকারতন্ত্রপুরে বিটের তালে তালে গণধর্ষণ খেলার কথাও চাইলে লিখা যেতে পারে

কী লিখতে চাও কিছুই বল না যদি মোড়ের মস্তান লিখ, লিখ র‌্যাব-কোবরা-চিতা কিংবা পাষণ্ড পুলিশ, ফিকশনের নতুন আঙ্গিক ক্রসফায়ার নিয়ে লিখ, লিখ অকার্যকর সংসদ, মিডিয়া বুজরুকি, সাম্রাজ্যবাদের দালালি করে টাকা করা, লিখ সংলাপ নামের ছিলা কলা, গাড়িহীন রাজপথে হরতালের সাফল্য-আফল্য গোনা, কুটিরশিল্পের ব্যাপক উন্নতি আর যখন যেখানে খুশি সিরিজ বোমার খেল, ঢলাঢলি ঢেলাঢেলি করে সঙ্গীকে ল্যাং মারা, লিখ কামে-প্রেমে দ্বন্দ্ব নিরসনে ট্রাক ট্রাক এ.কে-ফরটিসেভেন, পেটেন্ট কারণে লিখ বীজাভাবে ভুখা সব কৃষকের চোখে নামা জলকথা, চুরমার এথনোবোটানি আর এলিয়েন স্পিসিসের মনোকালচার, গরুদের পেটেচোখে মায়া, জিএমও'র রামচোদন আজ দেশে দেশে, মানুষ মেরে লিখ কী করে রক্ষিতে হয় বায়োডাইভারসিটি, সেবাবাণিজ্য লিখ ওতপাতা বহুজাতিকের নখদন্তহাতে, ইকোলজের দিকে চুলওড়া রভসে তবু বউ নিয়ে ঘণ্টায় আশি কিলো রান, হেলমেটে তাড়া খাওয়া বাতাসের দৌড়ের ধ্বনি, যেন শ্মশানে মাথার খুলি শরৎবাবুর দেখা, হরষে এগিয়ে যাও সন্ধ্যা হয়-হয় সময়ের ঠাণ্ডা-লাল সূর্যকুসুমের পেট থেকে নেমে আসা কবিতার উটকো চরণ তুমি ধরে বস

লিখবে কি গাঁজার ঠেক নাকি কমে আসা পানি-বিদ্যুৎ-গ্যাস, আধপোড়া মোমের দানিতে সিংহচিহ্নিত কোনো আসন বানাতে সিংহীর দু'চারিটি কেশের স্খলন, যুক্তির লাশে চড়ে ঠোঁটেমুখে চোপা লিখ, হেলমেট হোল্ডারে ঝোলা দিনকার কাঁচাহাট ছোটমাছ, আগুন লাগানো দামে আলুপটলটমেটোসজনেলাউ, জোটের চোটে পকেটের তলাঅব্দি টান, 'ভাইসব, আমরা এনেছি দেশে লাখো লাখো কুমিরের ছানা, কেটে শুকনো শত খাল', প্রতিদিন দেহের ছাল বাকল ছিঁড়ে একনম্বর গিয়ারে তবু ঘরে ফেরা, পরাজিতের, ঘরের বাইরে কোনো ফুটপাতে সদা মুখ ভার করা নিত্যব্যর্থ ত্যাগী মন, নমিত-দমিত

কী লিখতে চাও, লিখতে কী সাহসই বা কর, কিছুই তো লিখা হয় নি তোমার, যা খুশি লিখতে পার, যেকোনো কিছুতে আজ যেকোনো কিছুটিই লিখা যেতে পারে, পালাতেই চাও যদি পাঁচদিন আগে দেখা লিখ তবে স্বপ্নের স্কেলেটনখানি

পাঁচদিন আগে দেখা স্বপ্ন

যেকোনো পোর্টে থামে ও চালককে বলে হিসি-দিতে-যাওয়া-যায় জাতীয় বিমানে করে উঁচু এক টিলাতে সেদিন ডজনতিরেক বালবাচ্চা নিয়ে মহাবিপদেই পড়া, বাচ্চালোগ পাইলটকে না-বলে খোদ আমাকে বলে-কয়ে গুলতি মারতে গেছিল কোন ফাঁকে, উঠতি বয়েসি এক প্রজাপতির হেটলাইটের আলোয় ঝলসে গিয়ে আমি তথ্যটা চালককে দিতে ভুলে যাই, শেষে খটরমটর করে বিমানটি শুরু করলে ওড়া, স্রেফ মানরক্ষার তাগিদে চালকব্যাটার হাতে-পায়ে ধরে আরেকটু ল্যান্ড করাতে রাজি করানো ও বালবাচ্চাদের যাহোক একটা হিল্লা করা, বিমানের আর সব যাত্রীরা ওই ভুলের দণ্ডস্বরূপ টলারেটই করল না আমাকে, ডজনের সবাইকে উঠিয়ে শুধু টিলার ওপরে একা আমাকেই রেখে গেল ফেলে

শেষে মনমরা হয়ে নিশিন্দা গাছের ছায়া ধরে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরার পথে কামারবাড়ির কালীকৃষ্ণ বালিকার সাথে দেখা, দু'হাতে বুক চেপে অপমানকর এক কথা বলে পাশবাড়ির দেওড়িপথে সে অন্তর্হিত হলে চোখ গিয়ে থেমে যায় পুকুরের ধারে, দেখি লাল মোরগরঙা ধার দেয়া বাইকখানা আমার ভেঙেচুরে পড়ে আছে দালানও'লা বাড়িটির পিছে, কাঁদো কাঁদো মনের বেদনে আমি ঘাসে বসে পড়ি, চুল ছিঁড়ি টেনে টেনে মাথার, ভাবি, আমার জনম গেল হারাতে হারাতে-- এসব ঘটনা নিয়ে একদিন দু'চার কথা লিখতে হবে জানলে, পকেটের নোটবইয়ে স্বপ্নবৃত্তান্তের সব অনুঘটনাও জেনো টুকে রাখতাম ঠিক গল্পকারের মতো

গল্পকার যেভাবে টুকরো ইনফরমেশনগুলো টুকে রাখেন তাঁর খাতায়

সাহায্য সংস্থার ডায়েরিতে কালো কালিতে চিকন হরফে, কখনো বাংলায় কখনো ইংরেজিতে, কখনোবা রেখায়-আঁচড়ে, সুগন্ধা নদীর বাঁক কোনমুখী, হুলারহাটগামী লঞ্চের দৈর্ঘ্য, সন্ধ্যা ও দোয়ারিকা ফেরিঘাটে পাটাতন কত-- পাতায় পাতায় এতসব বিচিত্র ফুল ফল এঁকে খানিক থেমে তিনি জানালায় তাকান, হেলান দেন চেয়ার কোচের গদিতে, হাঁটুর উপরে ভাঁজ হয়ে ঝিমুতে থাকে নীলাশীষ মাখা তথ্যভারী খাতা, বাতাসের চাবুক খেয়ে চমকে উঠে সহসা লেখেন ভাঙাব্রিজ, দৌলতদিয়া ফেরিঘাট, তুরপুন মার্কা খাঁটি সরিষার তৈল, লেখেন ইয়েলো ড্রাগনফাই, উর্বরা আলুর আড়ৎ, এমএল অনন্ত, যেটা আটকে গেছে বালুচরে, আর জল আর সমুদ্দুর, সব, গল্পকার যেভাবে এঁকে রাখেন তার নকশাবিদ্যা দিয়ে, আমি সেভাবে জেনো কোনোদিন ধরে রাখব সবটুকু আমার চোখের জল

আমার চোখের জল

কাঁদি না বলে কাঁচা দুঃখগুলো ভিতরের অদৃশ্য আধারে ধরা থাকে, এই 'কাঁদি না বলে সব ধরা থাকে' জাতীয় অহংকারটা মিথ্যা রাজহাঁসের মতো, যেটা হঠাৎ ঋ লিখতে গিয়ে ফুটে ওঠে কাগজে, কখনো না-কাঁদা খুব ক্ষতিকর, বাবা মরে গেলে আমরা কাঁদি, মা মরে গেলে, ভাইবোন-আত্মীয়স্বজন, স্ত্রী মরে গেলে কিংবা স্বামী, এসব মরামরি কাণ্ড দিনান্তে ঘটে না কারো, এগুলো ছাড়াও গোপনে একা একা কাঁদা ভালো, প্রায় নিয়মিত প্রত্যেকেরই কাঁদবার মতো কিছু ঘনঘটা থেকে যায়, থাকে, গোপনে ভাবলে ঠিক পাওয়া যাবে, অবশ্য বেহায়া-নিলাজের বেলা নাও থেকে পারে, দেখো, গোপনে আমি কাল কাঁদব একাকী, অশ্রু ঝরবে যেসব পবিত্রতর, শক্তিবলে জমিয়ে সেসব শক্ত করে রেখে দেব যত্নে আদরে, আমার নিজের তো কাঁদবার মেলা ইস্যু আছে, যেসব নিয়ে এমনকি একাধটা কবিতাও লিখা যেতে পারে, ভিতরের কবিজনে দেখব বলে কয়ে, এসব ভাঙন নিয়ে যখন যেমন পারে সে যেন দু'দশ কথা লিখে-টিখে রাখে

শক্ত হয়ে ওঠা চোখের একটি জল নিয়ে কবিতা

পা ফেলতেই সাপের বাহার তিড়িং বিড়িং ফণা, পা ফেলতেই নিরানন্দ চেনা জীবনযাপন, পা ফেলতেই ঘোর দংশন, নষ্ট গাজন, পা ফেলতেই ব্যাহত হয় নিজের মতো চলা, পা ফেলতেই পকেটকাটা স্বাস্থ্যহানি, পা ফেলতেই বেজার বন্ধুর লম্বাটে পা, দৌড়ানো বা, হাজার একটা পায়ের সাথে ঠোকাঠুকি, পা ফেলতেই পায়ের গায়ে দগদগে ক্ষত একটি জেগে ওঠা

জেগে ওঠা

ফের যখন জাগব তখন রোদ এসে বিছিয়ে রেখেছে দেখব চাদর, আমি তার ওপর দি' হেঁটে হাত মুখ ধুতে যাব, বাথরুম সারব, ধূলাবালি ঝাড়ব ও বাইরে বেরুব, যখন ফিরে আসব তখন জেগে ওঠাটা কীরকম ফলপ্রসূ হলো, তার হিসেব মেলাতে কাগজে এক আঁকব জ্যামিতি আর তার ওপর ফাঁদব একা দুনিয়া কাঁপানো সেই উপপাদ্যখানি, যা কখনো পারেন নি ইউক্লিড কিংবা শিমজাতীয় শস্যবিদ্বেষী পিথাগোরিয়ান কোনো বুড়ো

পিথাগোরিয়ান শিমবিদ্বেষ

কেন এ নিষেধ পিথু, অযথা ভজনশালার গায়ে ঝুলিয়ে রেখেছ কেন লাল কৌপীনখানি, যদি রেশমের মতো ঠিক টান দিলে নাই-ই খোলে সূতা, তবে এ বন্দিদশা চল ভেঙে ফেলি, চল ঘরের বাইরে যাই, গিয়ে দেখি তুঁতপাতা গুটিপোকার খাদ্য হওয়া ছাড়া লাগে কি না দরকারি আরো কোনো কাজে

বৃষ্টিগাছের তলায়


মন্তব্য

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।