ছেড়ে দিলাম

রোমেল চৌধুরী এর ছবি
লিখেছেন রোমেল চৌধুরী [অতিথি] (তারিখ: সোম, ০২/০৫/২০১১ - ৭:১০পূর্বাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এইখানে। শেষাবধি পেলাম ওটাকে। দৃষ্টি এড়ানোর ফন্দি আঁটতে আঁটতে হয়তো ওটার কেটে গেছে কয়েকটি দীর্ঘ সপ্তাহ। কত ছল-চাতুরী করতে হয়েছে, কতই না খেলতে হয়েছে লুকোচুরি। দুই ট্রাঙ্কের মাঝ দিয়ে চলে যাওয়া ইস্পাতের দেয়াল ঘেরা সরু গলি, পলিথিন দিয়ে মুড়িয়ে রাখা অব্যবহৃত লেপ-তোষকের আঁধার ঘুঁজি, পরিত্যক্ত আসবাবের দাঁতে শিরশির তোলা অমসৃণ ফোঁকর, পাট পাট করে বিছানো দৈনিক পত্রিকার স্তূপ, ষ্টোর রুমে রাখা সুগন্ধি চালের বস্তার দুএকটা সুতো বেরিয়ে থাকা লোভনীয় ফুটো, আটার টিন থেকে ভেসে আসা বিবশগন্ধী রেণু মাখা বাতাস। এগুলোর ভেতর দিয়েই নিপুণ পরিকল্পনা-মাফিক তৈরি করেছিল পালিয়ে বেড়াবার অলি-গলি। ফাঁকে ফাঁকে নরম রোমের গায়ে খুদ মাখবার দুএকটা স্বাদু মুহূর্তও হয়ত তার আস্তিনে হেসে উঠেছিল। যাহোক, সেগুলোর কিছুই টিকেনি আখেরে।

সবটুকু শক্তি সঞ্চয় করে ফাঁদের ভেতর আটকে পড়া ক্ষুদ্র দেহটায় একটা ঝাঁকি দিল ওটা, শেষ চেষ্টা। কিন্তু অল্পই নাড়াতে পারলো নিজেকে। কালো চোখ দুটোতে কোন আকুতি ফুটে উঠলো না। এই ক্ষুদ্র প্রাণীটির বোধহয় আর বুঝতে বাকী ছিল না যে মৃত্যু একেবারে কাছে এসে দাঁড়িয়েছে। ঐ যে অমোঘ শত্রু, ক্ষমাহীন প্রস্তর-মূর্তির মতো সামনে দাঁড়িয়ে। এতটুকু আশা নেই ক্ষমা পাবার, দণ্ড-মুক্তির কিম্বা দণ্ডাদেশ স্থগিত হবার। শুধু একটু মর্যাদার মৃত্যু, বুঝি এই সামান্য অভিপ্রায়টুকু নিয়ে অপেক্ষা করছিল। ওটা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল আমার দিকে।

সেই দৃষ্টিতে কি যে ছিল, হঠাৎ আমাকে তা আনমনা করে দেয়। কোথা থেকে এক চিলতে তরল ভাবনার স্রোত এসে আমাকে অধিকার করে নেয়। মৃত্যুর জিম্মায় অসহায় প্রাণ সঁপে দিয়ে এই মুহূর্তে আর কি ভাবছে ওটা? সম্ভবত: ওর লুকানো কুঠুরিতে পর্যাপ্ত সঞ্চয় নেই। হয়তো মিকি, ওর কচি শিশুটি, পুরোটা দিন যার কেটে যায় মায়ের অপেক্ষায়, মুখ শুকনো করে বসে আছে। ভাবছে, কখন ফিরবে মা। চালের বস্তার ফুটো বেয়ে গড়িয়ে পড়া সামান্য দানাগুলো অসামান্য সুখের দোলায় দুলতে দুলতে বয়ে নিয়ে আসবে। কচি মুখে তুলে দেবে মমতা মেখে। হয়ত আজ ওদের পরিবারের উৎসবের দিন। সেজে-গুজে বসে আছে পুরো পরিবার। মা ফিরলেই কেক কাটা হবে। আনন্দে সবাই গেয়ে উঠবে একসাথে। হয়ত তার তরুণ ছেলেটির শিক্ষার পাট চুকেছে, স্বাবলম্বী হলও বলে। হয়ত মনে এসে ভিড় করা একরাশ প্রিয় নৈরাশ্যকে নেড়ে চেড়ে দেখছে সে, একান্তই নিজস্ব আবর্তে। আহা আর কোনোদিন রান্নাঘরের রহস্যময় ছায়া ছায়া চত্বরে ঘুরে বেড়ানো হবে না, আর কোনোদিন মনের আনন্দে আচম্বিতে মুচড়ে উঠা হবে না, আর কোনোদিন হবে না মধুর দৌড়ঝাঁপ, আর কোনোদিন সে পাবে না শিকারি বিড়ালের থাবাকে ব্যর্থ করে দেয়ার মোহন সুখ। এই দৃষ্টি সহ্য হয় না আমার!

“যা, ছেড়ে দিলাম তোকে। বাড়ীতে ফিরে যা, জলদি ফিরে যা তোর বাচ্চাগুলোর কাছে। স্বামীর বুকে ফিরে যা তুই, শান্তিতে মাথা পেতে দিয়ে ভুলে যা দুঃস্বপ্নের রাত। ফিরে যা জীবনের কাছে, আনন্দের কাছে যা তুই।” ফাঁদের মুখটা খুলে দিলাম, নিমেষে ওটা উধাও হয়ে গেল।

(একটি বিদেশী গল্প অবলম্বনে)


মন্তব্য

কৌস্তুভ এর ছবি

ভালো।

এরকম সাধুভাষা ভরা অনুবাদের মধ্যে মিকি শব্দটা কেমন লাগে জানি।

আর এই গল্পের 'আমি'র ইমোশনে ভ্যাদভ্যাদে হয়ে পড়া দেখে খুব বিরক্ত হলাম। দেঁতো হাসি

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

গল্প লেখা আমার স্বভাবগত নয়। গল্পের টেকনিকগুলো শিখতে চেষ্টা করছি মাত্র। টেকনিক শেখার ক্ষেত্রে আমার কাছে অনুবাদ প্রচেষ্টাই সবচেয়ে লাগসই ঠেকে। এই গল্পটি আদৌ কোন বিখ্যাত লেখকের বিখ্যাত সৃষ্টির মধ্যে পড়ে না। তাই মূল গল্পের শেষাংশে লেখককে আরো বেশী 'ইমোশনে ভ্যাদভ্যাদে' ও প্রচারধর্মী হতে দেখি। সেটুকু ছেঁটে দেবার পরেও যে সুশীল পাঠকের চোখের কোণ থেকে বিরক্তির পিঁচুটি সম্পূর্ণ মুছে ফেলা গেল না, সেজন্য দায়ী গল্প লেখায় আমার অর্বাচীনতা। ভাইটি, কুস্তীর প্যাঁচ শিখে নেই আগে, তারপর হবেখন।

আরো বেশ ক'টি গল্প-কবিতার সাথে এই গল্পটি যে টেকনিক বোঝাতে ব্যবহৃত হয়েছে তার নাম 'প্লট'। কতগুলো 'ব্রিফ এনকাউন্টার' দিয়ে অতি সংক্ষিপ্ত পরিসরে কি করে এক একটা চমৎকার প্লট তৈরি করা যায় সেটি বোঝাতে ব্যবহার করা হয়েছে এই গল্পসহ আরো কিছু গল্প-কবিতা। গল্পটি কতটুকু সার্থক তা বিবেচনায় না এনে দেখুন, প্লটটি কি কুশলী ও অভাবনীয়।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

কৌস্তুভ এর ছবি

আপনি কি একটু বিরক্ত হলেন?

ব্রিফ এনকাউন্টার' দিয়ে সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্লটটা তৈরী হয়েছে, সহমত। সেই গুণটা ভালো। তবে প্লটটি পূর্বপরিচিত (ঠিক ইঁদুরের গল্পই দেখেছি বলছি না, সাধারণভাবে), তাই হয়ত ততটা মুগ্ধতা আসে নি।

সত্যি বলতে, আমার রুমমেটই কদিন আগে একটি ধরা পড়া ইঁদুরের প্রতি ইমোশনে ভ্যাদভ্যাদে হয়ে পড়েছিল... (ঠিক সেটার পরিবারের কথা ভেবে নয় হয়ত)

আপনার অনুবাদ আমার ভালই লেগেছে। যেটুকু আপত্তি সেটা মূল গল্পটার প্রতিই।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

না ভাই, বিরক্ত হই নি। তবে মনে হয় বিরক্ত করেছি। ওসব বাদ দিন তো!
আমার মেয়ে নতুন কিছু একটা শিখলেই কানের কাছে এসে সবিস্তারে বর্ণনা করে, আমিও নিখুঁত অভিনয়ে একেবারেই কিছু না জানার ভান করে শুনে যাই। প্রথম পাঠে কি শিখলাম সেটি শুনুন না,
প্লটের মৌলিক উপাদান তিনটি, এক্সপোজিসন, কনফ্লিক্ট আর ক্লাইম্যাক্স।
কনফ্লিক্ট আবার দু'রকমের, বাহ্যিক ও অন্তর্গত। দ্বন্দ্ব ডালপালা মেলতে পারে গল্পের চরিত্রগুলোর মধ্যে, কোন একটি বা একাধিক চরিত্রের সাথে পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির, মানুষের অন্তর্গত প্রবৃত্তিগুলোর মধ্যে। এই অনুবাদে গল্পের ছেঁটে ফেলা অংশটিতে তেমনি আরেকটি অন্তর্গত দ্বন্দ্বকে বেড়ে উঠতে দেখি।

গল্পের শেষটা দেখুন,
"Go home to your children," she urged. "To your wife or husband," She opened the trap. The mouse vanished.

Suddenly, she was conscious of a new cleanness in her. A wide air walked in her. A life has blundered its way into her power and it had been hers to preserve or destroy. She had not destroyed. In the center of that simple restraint was--creation. She had created a piece of life. It was wonderful.

"Why", she thought, as her height doubled, "why, I'm good! I'm good."

She ironed her aprons. Her back was straight. Her eyes were mild, and soft with a godlike loving-kindness.

আর হ্যাঁ, মিথ্যে বলেছি একটা, অনুচিত হয়েছে। আলোচ্য গল্পটি পুলিৎজার বিজয়ী একজন নামকরা আমেরিকান লেখকের একটি বিখ্যাত ও বহুল আলোচিত গল্প।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

আয়নামতি1 এর ছবি

নিজেকে খুঁজে পাওয়ার এই অনুভূতিটা সত্যিই মন ছুঁয়ে গেল! অনেক ধন্যবাদ ভাইয়া।

রাতঃস্মরণীয় এর ছবি

ভালো লাগলো। চলুক

------------------------------------------------
প্রেমিক তুমি হবা?
(আগে) চিনতে শেখো কোনটা গাঁদা, কোনটা রক্তজবা।
(আর) ঠিক করে নাও চুম্বন না দ্রোহের কথা কবা।
তুমি প্রেমিক তবেই হবা।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ ছোটো।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

ষষ্ঠ পাণ্ডব এর ছবি

শেষ অনুচ্ছেদটা বাদ দিলে - অসাধারণ, কোন কিছুর ছায়া-কায়া বলে মনে হয়নি।


তোমার সঞ্চয়
দিনান্তে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

পাণ্ডব দা,
বয়স্কদের পাঠশালায় গল্প লেখার দীক্ষা নিচ্ছি। ধনুক ভাঙা পণ করেছি আপনার ভাত মেরে দেবই দেব ! চোখ টিপি খাইছে

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

সবুজ পাহাড়ের রাজা এর ছবি

চলুক

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, রাজা সাহেব। আপনার পোষ্ট বহুদিন পরি না ভাই। জলদি নামান।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

রু (অতিথি)  এর ছবি

ভালো লেগেছে।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, রু ভাই।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

সৈয়দ নজরুল ইসলাম দেলগীর এর ছবি

ভালো লাগলো

______________________________________
পথই আমার পথের আড়াল

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

ধন্যবাদ, নজরুল ভাই।

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

পাগল মন এর ছবি

গল্পের পরিণতিটা বুঝতে পারছিলাম কিন্তু বর্ণনাটা ভালো লাগল।

------------------------------------------
হায়রে মানুষ, রঙিন ফানুস, দম ফুরাইলে ঠুস
তবুও তো ভাই কারোরই নাই, একটুখানি হুঁশ।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

গল্পের পরিণতি-টাই তো ছেঁটে দিয়েছি। এবার কৌস্তুভ ভাইয়ের প্রতিমন্তব্যে সেটি তুলে দিলাম। দেখুন তো, মেলে কি না ! হাসি

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

বইখাতা এর ছবি

চলুক ইঁদুর ভয় পাই।

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

"চমৎকার !
ধরা যাক দু একটা ইঁদুর এবার"

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

আয়নামতি1 এর ছবি

শেষ অনুচ্ছেদটাতেই সবটুকু আবেগ পেলাম যে আমি! সবার মত আমি এত বুঝিনা। আবেগটা ছাড়া মন খারাপ এটা বুঝি ভালো কথা নয়, না ভাইয়া? অদ্ভূত ভালো লাগলো লেখাটা!

রোমেল চৌধুরী এর ছবি

বোন,
মূল গল্পের শেষ অনুচ্ছেদটি কৌস্তুভ ভাইয়ের প্রতিমন্তব্যে তুলে দিয়েছি, ইংরেজীতে। সেটি পড়ুন, আশাকরি আপনার ভালো লাগবে। সেখানে আপনার প্রশ্নের উত্তরটুকুও খুঁজে পাবেন। শুভপ্রীতি!

------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমি এক গভীরভাবে অচল মানুষ
হয়তো এই নবীন শতাব্দীতে
নক্ষত্রের নিচে।

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।