সম্পাদকের (আল)পিনের খোঁচা ও আমার ছেলেবেলার ইতিবৃত্ত

প্রকৃতিপ্রেমিক এর ছবি
লিখেছেন প্রকৃতিপ্রেমিক (তারিখ: রবি, ২৩/০৯/২০০৭ - ১১:৪৭অপরাহ্ন)
ক্যাটেগরি:

এই ব্লগের একজন নামকরা ব্লগার হঠাৎ করেই ঠিক করলেন 'আমার ছেলেবেলা' নামে একটা ই-বই বের করবেন। ভাল কথা। কিন্তু সেই ছেলেবেলা হবে 'অন্যদের ছেলেবেলা', সম্পাদকের নয়। কার কার ছেলেবেলা নিয়ে বইটি বের করা হবে তার একটা তালিকাও তিনি ব্লগে প্রকাশ করলেন। সেই তালিকার নিচের দিকে আমার নাম দেখে অতিশয় আনন্দিত হলেও পরমুহূর্তেই সে আনন্দ উবে গেল। কারণ একটাই- সেপ্টেম্বর মাস, শুরু হচ্ছে ক্লাস। সাথে শতাধিক বিষয়ে ব্যস্ততা। ঠিক সেসময়েই আমি পুরানো শহর থেকে নতুন শহরে চলে এসেছি। রাস্তাঘাট কিছুই তেমন চিনিনা। সম্পাদককে লিখলাম

অতিথি হয়েই পড়ছিলাম। ভাবছিলাম, অতিথি হয়েই আগামী ক'টা দিন কাটিয়ে দেব কী না। ৬ তারিখ থেকে নতুন সেমিস্টার শুরু হচ্ছে। এই শহরে আমি নতুন। কোথায় কী পাওয়া যায় তা-ই ঠিকমত বুঝে উঠতে পারিনি। এই চাল কিনি তো এসে দেখি পেঁয়াজ নেই। অনেক খুঁজে ফিরে জিরা আর ধনিয়ার গুঁড়া পাওয়া গেল। ঘরে আসবাব বলতে কিছুই নাই। আপাতত ফ্লোরেই ঘুমাচ্ছি বউ বাচ্চাসহ। পিসি'র হার্ড ড্রাইভ নষ্ট। এখনো জানিনা এই শহরে কোথায় ডিস্ক কিনতে পাওয়া যায়। ভাগ্য ভাল ল্যাপটপটা একটা সমতলের উপর রাখা সম্ভব হয়েছে। এর মধ্যেই ছেলেবেলা লেখার কড়া নোটিশ। লোভও সামলাতে পারছিনা। যিনি দয়া করে আমার নাম নিয়েছেন, তাঁর মত সম্পাদকের ডাক শুনে কিভাবে ঘুমিয়ে থাকি!

ভাবছিলাম হয়তো উনি আমার অবস্থা বিবেচনা করে কিছুটা সহানুভূতি প্রকাশ করবেন। কিন্ত বিধি বাম। উনি জবাব দিলেন-


আপনি এই মূহুর্তে লেখালেখির জন্য সবচেয়ে সুবিধাজনক অবস্থায় আছেন। ঘরে নানা ঝামেলা দেখা গেলে লেখালেখিতে সময় দেয়াই উত্তম।

মনে রাখবেন আমাদের জীবনের ৮৭ শতাংশ ঝামেলা সময়ের সাথে সাথে এমনিতেই শেষ হয়ে যায়।

এজন্য খাটাখাটনি করার কোন দরকার নেই।

আসুন লেখালেখিতে মন দেই।

সবাই বিখ্যাত হতে চায়। সব লেখকই চান তার লেখা অনেক মানুষ পড়ুক। আমিও এর ব্যতিক্রম নই। আমিও চাইলাম এমন জাঁদরেল সম্পাদকের সম্পাদনায় প্রকাশিত বইয়ে আমার ছেলেবেলার গল্পও থাকুক।

মানুষ তার সবচেয়ে ভাল লেখাগুলো লেখে সবচেয়ে সুখের সময়ে অথবা সবচেয়ে দু:খের সময়ে। আমার এখন মাঝামাঝি অবস্থা। আর লেখার মত মনও নেই। লিখতে বসলেই যাদের কলম ফুঁড়ে লেখা বের হয়, আমি তাদের দলের নই। যাহোক লেখার চিন্তা মাথায় আনলাম।

সম্ভবত বিজ্ঞান পড়ার একটা সুবিধা বা অসুবিধা হল সবকিছুকেই ছকে বেঁধে ফেলার প্রবণতা। আমার ছেলেবেলা নিয়ে কী লিখব তারও মনে হচ্ছিল একটা তালিকা করে নেই। কত ছোটবেলা থেকে শুরু করব? স্কুলের প্রথম দিন, বেড়ে ওঠা, ছোটবেলার দৈনন্দিন, বড় স্কুলে যাওয়া, সাফল্য, ব্যর্থতা এসব?

মানুষের জীবনে সম্ভবত সাফল্যের চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি। আরো হালকা ভাষায়, ব্যর্থতা নয় অপ্রাপ্তি। অপ্রাপ্তির পরিমানই বেশি। এর মূলে রয়েছে মানুষের সীমাহীন চাহিদা। কেউ একজন বলেছিলেন "যতই পড়িবে ততই ভুলিবে"। চাহিদার ব্যাপারটাও ঠিক সেরকমই। যত বেশী চাহিদা, তত বেশি অপ্রাপ্তি। আর ছেলেবেলা নিয়ে লিখতে গিয়ে বারবার অপ্রাপ্তিগুলোই মনে পড়েছে। এই অপ্রাপ্তিগুলো কেবল অপূর্ণ চাহিদা নয়, আছে নানা বঞ্চনা আর সীমাবদ্ধতার গল্প।

লেখকের সবচেয়ে বড় সুবিধা সে ইচ্ছে মত লিখতে পারে। সে লেখা কেউ পড়লেই কি আর না পড়লেই কি; লেখকের কিছু যায় আসে না। ব্যাপারটা সত্যি, শুরুর দিকে। কিন্তু একজন লেখক যখন প্রথিতযশা হন, তখন তার জীবনী মানুষ পড়ে। লেখকও তাঁর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে জীবনের অপ্রাপ্তিগুলো তুলে ধরে। কিন্তু আমি তো খ্যাতনামা নই, আমার ছেলেবেলা লেখার তো কোন দরকার নেই। কে পড়বে আমার ছেলেবেলা? তাই লিখতেও কিছুটা সংকোচ বোধ হচ্ছিল।

এরই মধ্যে সম্পাদক সাহেব আরো একটি কড়া নোটিশ দিলেন। তার মানে, লেখা জমা দিতেই হবে আর তা-ও নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই।

একদিন স্বপ্নের মধ্যে 'আমার ছেলেবেলা'কে দেখলাম। যাক, কোত্থেকে শুরু করব তার একটা ধারণা তো হল। কিন্তু মাঝরাতের স্বপ্ন ভোর হতেই ভুলে গেলাম। তবে স্বপ্ন দেখায় একটা লাভ হল। পরিবর্তন হল আমার সিগনেচার-লাইন। সেখানে লিখলাম-

আমার লেখাগুলো আসে স্বপ্নের মাঝে; স্বপ্ন শেষে সেগুলো হারিয়ে যায়।

এভাবেই চলছিল। একে তো সময় তেমন পাচ্ছিনা, তারমধ্যে রমজান শুরু হয়ে গেল। রোজা রেখে আর সারাদিন নানা ঝামেলা শেষে ইফতারির পরে লেখার চিন্তা ভাবনা করতেই মেয়ে এসে প্রায়শই ল্যাপটপটা দখল করে নিত। লেখা আর শুরু হয়না।

এর মধ্যেই আলপিন নিয়ে দেশে তুলকালাম কান্ড। তার রেশ কাটতে না কাটতেই সাপ্তাহিক ২০০০ নিয়ে শোরগোল। তার রেশ ছড়িয়ে পড়ল সচলায়তনে। একাউন্ট একটিভ রাখতে সেখানে একটা দুটা কমেন্ট তো নিদেনপক্ষে পোস্ট করতে হয়!

শেষমেষ আমার অলক্ষেই ২২ তারিখ পার হয়ে গেল। ধারনা ছিল বাইশ সেপ্টেম্বরই লেখা দেওয়ার শেষ দিন। আমার এখানে ২২ তারিখ মানে তো বাংলাদেশে ২৩ তারিখ শুরু হয়ে গিয়েছে। তাই শেষ মুহূর্তে ট্রেন ধরার নিয়তে রাত দেড়টায় লেখা শুরু করলাম। একটানা লিখে রিভিউ না করেই পাঠিয়ে দিলাম সম্পাদক বরাবর।

এখন ভাবছি, ছেলেবেলা লেখার তাড়া খেয়ে ছেলেবেলা লেখার আউটলাইন তো তৈরি হল। এটাই বা কম কি।


মন্তব্য

মুহম্মদ জুবায়ের এর ছবি

এই হৃদয়হীন সম্পাদক নিজে লিখবেন না, কারণ তাঁর ছেলেবেলা বলে কিছু নেই! তিনি বয়োবৃদ্ধ সম্পাদক হয়েই জন্মেছেন বলে আমরা সিদ্ধান্তে আসতে পারি। চোখ টিপি

-----------------------------------------------
ছি ছি এত্তা জঞ্জাল!

এস্কিমো এর ছবি

এই হৃদয়হীন সম্পাদক

ঘটনা সত্য...জুবায়ের ভাই।

লেখতে চাই ..কিন্তু কি লিখবো?

বিপ্লব রহমান এর ছবি

ছেলেবেলা লেখার তাড়া খেয়ে ছেলেবেলা লেখার আউটলাইন তো তৈরি হল। এটাই বা কম কি। চোখ টিপি


একটা ঘাড় ভাঙা ঘোড়া, উঠে দাঁড়ালো
একটা পাখ ভাঙা পাখি, উড়াল দিলো...

হাসান মোরশেদ এর ছবি

হাসি
-----------------------------------
মানুষ এখনো বালক,এখনো কেবলি সম্ভাবনা
ফুরোয়নি তার আয়ু

-------------------------------------
জীবনযাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু ।।

ইশতিয়াক রউফ এর ছবি

এক কাজ করা যায়... সম্মিলিত প্রতিশোধ-স্বরূপ সবাই মিলে 'সম্পাদকের ছেলেবেলা' নামে একটা বই লিখি! 'আমার ছোটবেলা' নামে 'অন্যদের ছেলেবেলা' বের করার সাথে কাটাকাটি হয়ে যাবে! চোখ টিপি জনগণের কল্পণাশক্তির দৌঁড় এবং সম্পাদকপ্রীতির গভীরতা জানা হয়ে যাবে এক ধাক্কায়।

আরিফ জেবতিক এর ছবি

সম্পাদকের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।
আগামী শুক্রবার বাদ জুমা এই বিষয়ে কিছু একটা করা হবে।

অফ দ্য রেকর্ড :ছেলেবেলার লেখাটা কিন্তু এই লেখার চেয়ে ছোট হইলো মন খারাপ

নতুন মন্তব্য করুন

এই ঘরটির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হবে এবং জনসমক্ষে প্রকাশ করা হবে না।